Sunday, August 29, 2010

মৃত কবিদের জন্য এলিজি

মাঝে মাঝে একটা কথা খুব মনে হয় ,কোথায় যেন পড়েছিলাম ,অর্থনাশ ,জরা -ব্যাধি ,প্রিয়জন হারানোর মর্মন্তুদ শোক সবকিছুই একসময় ফিকে হয়ে আসে ,কিন্তু স্বপ্নের টুঁটি চেপে ধরলে সেই দগদগে ক্ষত আজন্ম বয়ে বেড়াতে হয় ,স্বপ্নহননের স্মৃতি আমাদের ফেরারি হয়ে তাড়া করে বেড়ায় অবিরত ।আর বরাত যাদের একেবারেই মন্দ ,সেই অপূর্ণ স্বপ্ন তখন নিতান্তই দুঃস্বপ্ন হয়ে তাদের ওপর সিন্দাবাদের ভূতের মত আছর করে বসে ।হয়তো বলবেন ,এতো একেবারেই ছেঁদো কথা ,সবারই তো এরকম কিছু স্বপ্ন থাকেই ,আর সবগুলো যে পূরণ হবে সে দিব্যিও কেউ হলফ করে দিতে পারবেনা ।তবে যে স্বপ্নের সাথে আবেগ গলাগলি করে বেড়ে ওঠে ,যে স্বপ্ন নেশার মত আচ্ছন্ন করে ফেলে ,সেটার অপূর্ণতায় কোথাও না কোথাও সুর কেটে যায় বৈকি ।

পিটার ওয়েইরের "ডেড পয়েটস সোসাইটি" দেখতে গিয়ে এসব কথাই মাথায় বৃত্তাকারভাবে পাক খেতে লাগল ।নামজাদা এক স্কুলের একদল তরুণের নিস্তরঙ্গ জীবনে আচমকাই একটা পরিবর্তন আসে ।প্রথাগত স্রোতে গা না ভাসিয়ে নতুন সাহিত্যের শিক্ষক তাদের স্বপ্নের গতি-প্রকৃতি আমূল পালটে দেন ,তাদের কোমল মনে বুনে দেন নান্দনিকতার বীজ ,কবিতার প্রতি তাদের ভালবাসাকে দেন উস্কে ।স্বপ্নবাজ তরুণের দল যেন সৃষ্টিসুখের নেশায় পাগলপারা হয়ে ওঠে ,অন্তঃপুরবন্দী হয়েও শিক্ষকের প্রেরণায় মায় নিষিদ্ধ কবিসঙ্ঘ অব্দি গড়ে তোলে ।কিন্তু বড়ই পাষাণভাবে তাদের এই নিখাদ রোমান্টিকতায় জল ঢেলে দেওয়া হয় ,তাদের কাব্যচর্চা মুখ থুবড়ে পড়ে বড় অসময়ে ।আর স্বপ্ন আর বাস্তবের নির্মম সংঘর্ষের বলি হয়ে উঠতি কবিদের পরিণাম হয় মর্মান্তিক।

সিনেমাটি এমন কোন কালজয়ী কিছু নয় ,তবে স্রেফ একটি বাঁধাগতের হলিউডি ছবিও অবশ্যই নয় ,খানিকটা হলেও আপনার মনে তা রেখাপাত করতে বাধ্য ।সবচেয়ে বড় কথা ,কবিতার সনাতনী ধারণাকে আস্কাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে রবিন উইলিয়ামস যখন গমগম করে বলে ওঠেন ,"আমরা স্রেফ শখের খাতিরে কবিতা পড়িনা ,আমরা কবিতা পড়ি কারণ আমরা মানুষ ,আর কবিতা মানুষের বেঁচে থাকার খোরাক", তখন টের পাই ,আমার শিরদাঁড়া দিয়ে আবেগের এক ঠান্ডা চোরাস্রোত বয়ে চলছে ,এই যান্ত্রিক আমিও তখন ভীষণভাবে রোমান্টিক হয়ে ওঠি ,চিত্ত হয়ে ওঠে উতরোল।কারণ এই ভাবনাগুলোই আমি ভাবতাম ঠিক ঐ স্বপ্নদর্শী বয়সে ,আমার মধ্যেও হয়ত তখন সবকিছু দুমড়ে মুচড়ে দেওয়ার দুর্মর ইচ্ছে খেলা করত ,এবং বলাই বাহুল্য ,একসময় এই ক্লিশে নৈমিত্তিকতার চাপে সেই ভাবনাগুলোও আস্তে আস্তে মিইয়ে যায় ,একেবারে ঘুঁচে যায়না বটে, কিন্তু ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে ।

তাই ছাত্রদের কানে যখন রবিন উইলিয়ামসের এই কথা অনুরণিত হতে থাকে ,"সিজ দ্য ডে ,মেক ইওর লাইভস এক্সট্রা-অর্ডিনারি"(অনুবাদ করলাম না ,পাছে রসভংগ হয় ),কেন জানি আমার কানেও কথাটি বারবার ঘুরপাক খেতে থাকে ,স্বপ্নধংসের শোকে আমি ফের আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।

Friday, August 27, 2010

কালো বরফ ও আমার শৈশবচরিত

আমার জগতে তখন সাদাকালোর কোন ঠাঁই ছিলনা, পুরোটাই ছিল ভীষণ রকম রংদার। স্কুলের ঘন্টা বাজত ঢংঢং, একছুটে চলে যেতাম লালচে ইটের স্কুলমাঠে, বিকেলের ফিকে আলোয় দেখতে পেতাম যেন রংধনুর সাত রঙ। বাড়ি ফেরার সময় চারপাশটা আগাপাশতলা চেখে ফেলত আমার নবিশ চোখ; টুংটুং করে বেল বাজানো রিকশাওয়ালা, স্টেশনারি দোকানের ক্লিশে সাইনবোর্ড, অদূরের প্যারেড ময়দান কাঁপিয়ে বেড়ানো ছোকরার দল, সবকিছুই দেদারসে আনন্দ বিলিয়ে যেত, আমার মনে তখন অবারিত আনন্দের ফল্গুধারা। বিকেলটা যেন টুপ করে কেটে যেত, আমার কেবলই মনে হত হতচ্ছাড়াকে যদি আচ্ছাসে পাকড়াও করে ধরে রাখা যেত ,তবে বেশ হত। আমাদের কলোনির সামনে ছিল পুরনো ইটের স্তুপ, সেই ইটের স্তুপে চলত লুকোচুরি খেলা। একসময় হলুদরঙ আলোটা মিইয়ে আসত, মুয়াজ্জিনের জলদগম্ভীর আযান শোনা যেত একটু পরেই, আমরা দমে যেতাম ভীষণভাবে, খেলা এই সাঙ্গ হয়ে এল বলে। সেই থুত্থুড়ে পুরনো কলোনির বাতাসটাকে আমার বেকায়দা রকম গুমোট মনে হত, আঁধার জেঁকে বসার সাথে সাথে সেই ভাবটাও আরো প্রকট হত।


কালো বরফ পড়তে পড়তে এইসব কথাই ঘুরেফিরে আমার করোটিতে পাক খেতে লাগল। আমার বয়সও তখন পোকার মতই, তবে পোকার মত আঙ্গুল চোষার বাতিক বোধহয় ছিলনা। তবে পোকাকে আমি হিংসে করি, একটু বেশি রকমই। পোকার মত আমার কল্পনার পালের হাওয়া কি এত ফুলেফেঁপে উঠত। কী জানি? তবে যে অদ্ভূত ইন্দ্রজাল মাহমুদুল হক সৃষ্টি করেছেন উপন্যাসের শুরুতেই, সে ঘোর থেকে চট করে বের হওয়া খুবই মুশকিল।শুরুতেই তার নিরাসক্ত কথন-

তখন আমার অভ্যেস ছিল বুড়ো আঙ্গুল চোষার। কখনো পুকুর-ঘাটে, কখনো বারান্দার সিঁড়িতে, কখনো- বা জানালায় একা একা বসে কেবল আঙ্গুল চুষতাম। আঙ্গুলের নোনতা স্বাদ যে খুব ভাল লাগতো, ঠিক সে রকম কোন ব্যাপার নয়। তখন ভাললাগা বা মন্দলাগা এসবের কোন ঝক্কি ছিল না, যতোটুকু মনে পড়ে; পৃথিবী যে গোল, একথা শুনে কানমাথা রীতিমতো ঝাঁ ঝাঁ করতো। সে একটা গোলমেলে বিষম ব্যাপার। ভাবতাম আমরা তাহলে কোথায় আছি, কমলালেবুর তলার দিকে না ওপরের দিকে; তলার দিকের মানুষজনের তো টুপটাপ ঝরে পড়ার কথা।

এইভাবে মাহমুদুল হক ভোজবাজির যে রমরমা পসরা সাজিয়ে বসেন, আমার সাধ্য কী এই কুহকের জাল ভেদ করা? আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ে যেতে থাকি। মাঝে মাঝে আবছা আবছা মনে পড়ে, এরকম বিটকেলে ভাবনায় আমিও সময় সময় বুঁদ হয়ে থাকতাম। মা বলতেন, আমি নাকি প্রায়ই নানা প্রশ্নবাণে সবাইকে জেরবার করে ফেলতাম, জবাব না দেওয়া অবধি এসব উটকো সওয়াল থেকে রেহাই পাওয়ার সাধ্য নাকি কারও ছিলনা। কালো বরফ মন্থনকালে কত কথাই যে মনে আসে!এমন ভয়ঙ্কর সুন্দরভাবে কেউ কি লিখতে পারে-

হু হু বাতাসের গায়ে নকশা-তোলা ফুলের মতো অবিরল আকুলতা,পোকার বুকের ভেতরের ফাঁকা দালানকোঠা গুম গুম করে বাজে, পোকা তুই মর, পোকা তুই মর!

যা কিছু নিঃশব্দ, যা কিছু শব্দময়, যা কিছু দৃশ্যগোচর, দৃশ্যাতীত, সবকিছুই একজোট হয়ে হাত ধরাধরি করে ঘিরে ধরে; অদ্ভুত এক আব্জনার তালে তালে আস্ত একটি রাত মোমের মত গলে পড়ে, জিনজার-হিনজার জিঞ্জার-গিনজার, জিনজার-হিনজার পোকা শুনে, শুনতে পায়। পোকা পোকা হয়ে যায়।

তবে অচিরেই ভাবালুতায় চুর হয়ে আমাকে এক লহমায় মাটিতে নামিয়ে আনেন লেখক, আবদুল খালেককে সাক্ষী রেখে দাঁড় করিয়ে দেন বাস্তবতার কর্কশ জমিনে। বৈষয়িকতার সাথে ক্রমাগত যুঝতে থাকা খালেককে আশেপাশের মানুষগুলোর সাথে মেলাতে যায়, শৈশবে ফিরে যেতে খাবি খেতে হয়না আমাকে। এদিকে উপন্যাস এগোতে থাকে তরতর করে, আর আবদুল খালেক ওরফে পোকার দ্বৈত বয়ান আমাকে ধন্দে ফেলে দেয়। দুজনকে মেলাতে পারি তখন, যখন শৈশবের গিরিবালার ঝুপ করে নেমে আসে আবদুল খালেকের ভাষ্যে-

"বাইরে আকাশ বলে একটা কিছু আছে, তা জান তো ! সেখানে একটা চাঁদ আছে, গোল চাঁদ। ঐ চাঁদের ভেতর হাঁটুমুড়ে কতোকাল বসে আছে। চরকায় সুতো কাটছে বসে বসে। "

পোকা ও আবদুল খালেকের এই আজব যুগলবন্দি চলতে থাকে মেলাক্ষণ। বাবা ,মা ,মনি ভাইজান, টিপু ভাইজান, রানিবুবু,পুঁটি, কেনারাম কাকা, ছবিদিরা পোকাকে অহর্নিশ সুখস্বপ্ন দেখিয়ে যায়, তার ছোট্ট জগতে তারা একেকজন অধীশ্বর হয়ে ওঠে, নিজেদের অজান্তেই। ওদিকে আবদুল খালেকও কী প[আরে নিজের ভাবালুতাকে বেনোজলে ভাসিয়ে দিতে? স্ত্রী, শিশুসন্তান নিয়ে তার ছোট্ট সংসার, তারপরও নগ্ন বৈষয়িকতার রক্তচক্ষুর সামনে সন্ত্রস্ত থাকতে হয়। এতকিছুর পরেও তার ভেতরের পোকা মাঝেসাঝেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। স্ত্রীকে সে ভালোবাসে, কিন্তু সেই ভালবাসায় আটপৌরে সমস্যা সূঁচ হয়ে ঢোকে, আর ফাল হয়ে বেরুবার প্রাণপাত চেষ্টা করে। এই টানাপোড়েনে সে বিচলিত হয়, তার ভেতরটা পুড়ে খাক হতে থাকে, কিন্তু আর দশটা মানুষের মত সবদিক সামলে সুমলে চলার ব্যাপারে সে আনাড়িই থেকে যায়। রেখা ও আবদুল খালেকের এইসব ছোটখাট মান- অভিমানের ভেতর দিয়ে আবদুল খালেকের কল্পনাবিলাসী মন পাঠকের কাছে আরও গভীরভাবে ধরা দিতে থাকে এইভাবে-

রেখা আর টুকু, এই দুজনের জন্যে তার ভাবনা। নিজেকে সে বাদ দেয়; নিজেকে নিয়ে তার কোন সমস্যা নেই, কোনো না কোনোভাবে তার চলে যাবে।

এটাও একটা বাতুল চিন্তা, ফালতু ধারণা। আবদুল খালেক শুধরে নেয় নিজেকে, তার ভাবনা -চিন্তায় ওদের ভূমিকা যেন নিছক বোঝার। এর ভেতরে আচ্ছন্নভাবে তার একটা অহমিকা আছে, সে চালাচ্ছে ওদের। কে কাদের চালায়, আসলে তো যে যার নিজের জীবনকে নিজেই চালায়। চালানো মানে জিবনটাকে কোনমতে টেনে বেড়ানো। চেয়ে-চিন্তে, মেরে-কেটে, যেভাবেই হোক।


উপন্যাসের দ্বিতীয়াংশ শুরু হয় অনেকটা আচমকা, "আলো ছায়ায় যুগলবন্দি" শিরোনামে। রেখা ও খালেকের টানাপোড়েন এখানে অনেকটা থিতিয়ে পড়ে, তারা সহসা আবিষ্কার করে, তাদের সম্পর্কের গাঁথুনি পলকা নয় মোটেই। কিন্তু চমকে উঠতে হয়, যখন হঠাৎ পাঠক আবিষ্কার করে, দেশভাগের সময় পোকার ঘরছাড়ার সেই স্মৃতি আবদুল খালেককে আজতক ফেরারি হয়ে তাড়া করে, আর কোন এক আলটপকা মুহুর্তে ছাইচাপা আগুনের মত বেমক্কা জ্বলে ওঠে। পাঠক ধাক্কা খায়, যখন মনিভাইজান ছবিদির কাছ থেকে বিদায় নেয়। আর সেই যে সুর কেটে যায়, আর আবদুল খালেকের সারাটা জীবন বেসুরো হয়ে যায়; পোকা হয়ে সেই হারানো সুরের হদিস ঝুঁজে ফেরে সে,জনমভর।

Thursday, August 19, 2010

অপেক্ষা

আয়তাকার ঘরটি আকৃতিতে নেহাত ছোটখাট নয়,কিন্তু দিনমান একধরনের থম মেরে থাকা সুনসান নীরবতা সেখানে বিরাজ করে। বয়সের সাথে যুঝতে থাকা একজন লোক,শীর্ণপ্রায়, জীর্ণ হয়ে যাওয়া ফুটোঅলা সফেদ পাঞ্জাবি পড়ে ঘরটাকে পাহারা দেন ,বা বলা ভাল আগলে রাখেন। সময় সময় তিনি ক্লায়কেশে পুরনো হয়ে যাওয়া তালা খোলেন;তাকে জেরবার হতে হয়, এই বুড়ো বয়সে রদ্দিকালের তালা খোলার ক্লিশে কাজ করতে হয় তাকে নিয়মিতভাবে-একটা নির্দিষ্ট সময়ে। সেই ঘরে তিনি বসে থাকেন মিটমিট করতে থাকা ফ্লুরোসেন্ট বাতিতে, তার মাথার ওপর খাপছাড়াভাবে ঘুরতে থাকে তার চেয়েও বুড়িয়ে যাওয়া কালচে পাখা।


তিনি একা ঘরে বসে থাকেন অতিপ্রাকৃত নৈঃশব্দের মাঝে, মাঝে মাঝে ছারপোকারা তাকে জানান দিয়ে যায় এই ঘরে তিনি আসলে একা নন, দেয়ালে ওত পেঁতে থাকা হলুদ গৃহগোধিকাও পৌনঃপুনিক টিকটিক শব্দ করে-বলে,"বাছা, রোসো, তোমার প্রতীক্ষার পালা খুব শীঘ্রই সাঙ্গ হবে"। কিন্তু আদপে তা ঘটেনা, বা ঘটার কোন নিকট সম্ভাবনাকেও সুদূরপরাহত মনে হয়। তারপরও তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন, কখনো সখনো ঝিমুতে থাকেন ,তারপর জের কেটে গেলে দেয়ালঘড়ির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন, তারপর আবার ঝিমান, কিন্তু প্রতীক্ষার পালা আর ফুরোয়না।মাঝে মাঝে বিমল মিত্রের তোবড়ানো সাহেব বিবি গোলামের ওপর লেপটে থাকা ধুলোর বহর সরানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালান, আবার আলগোছে পড়ে থাকা ক্যাবকো প্রকাশনীর গুটি গুটি হরফের সঞ্চয়িতা ঠিকঠাক সাজিয়ে রাখেন। এভাবে তিনি বসে থাকেন ক্লান্তিকর সব মূহুর্তের পসরা সাজিয়ে; বেমক্কা তিনি শরতবাবুত ঢাউস সাইজের উপন্যাসসমগ্রের ওপর অপত্য স্নেহে হাত বুলিয়ে দেন, অনুমান করা যায়- তখন তার তার পোড় খাওয়া ফুসফুস থেকে নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। পাশের দোকানে তখন জম্পেশ আড্ডা জমে, ছাই হয়ে যাওয়া অগুণিত বেনসন অ্যান্ড হেজেসের কোন কোনটির ধোঁয়ার কটু গন্ধ ব্যাপন প্রক্রিয়ায় তার নাকে এসে লাগে, হল্লামাস্তি করতে থাকা তরুণদের ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বিষয়ক বচসা তিনি প্রায়ই শুনতে পান, শুনতে পান মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের কোন এক ডানাকাটা পরীর রসালো ফিরিস্তি। এমনকি পড়ুয়াদের অ্যাসাইনমেন্ট- ল্যাবরিপোর্ট বিষয়ক দীর্ঘ আলাপচারিতাও তার কানে আসে, তিনি শুনতে চান বা না চান সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। অনেককিছুরই মর্ম তিনি ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারেননা ,তার লেখাজোখা না থাকা অভিজ্ঞতা ফেল মেরে যায় নির্বিবাদে এসব হালজমানার তরুণদের কাছে। তারপরও তিনি বসে থাকেন, আশা করেন, কোন এক ভুল সময়ে কেউ সেই ক্যাচকেচে দরজা ঠেলে প্রবেশ করবে, বলবে- রহমান ভাই, একটা বই নেওয়া যাবে?

আহসানউল্লাহ হলের তিনতলার বর্ষীয়ান লাইব্রেরিয়ান এভাবে কোন এক শুভ মুহুর্তের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন,অনন্ত কাল ধরে...

Monday, August 16, 2010

অপোগণ্ডের হাস্যপরিহাস

কেন হাসি, এককথায় এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া মুশকিল। হাসি জিনিসটা মানুষের মজ্জাগত, এ নিয়ে যেমন সংশয় নেই ,ঠিক তেমনি এটা ভয়ানক রকম সংক্রামকও বটে। বেমক্কা কারো হাসি চলে আসলে সেই হাসি চেপে রাখতে যে হ্যাপাটা পোহাতে হয় সেটা আশা করি অনেকেরই জানা আছে। উচ মাধ্যমিক পরীক্ষার একদিন আমাদের হলে টহল দিচ্ছিলেন একজন বুড়োমত শিক্ষক। যে কোন কারণেই হোক, তিনি আমাদের রেজিস্ট্রেশন কার্ডটি বারবার খতিয়ে দেখছিলেন। তাই স্বাক্ষর করতেও বেশ বিলম্ব হচ্ছিল তার। একসময় আমাদের এক ফচকে বন্ধুর কার্ডটি চেক করার সময় তিনি একবার ছবির দিকে, ফের বন্ধুটির দিকে চাইছিলেন। বোধকরি, ছবির সাথে বাস্তবের খোমার গরমিল দেখে তিনি বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ বলা নেই,কওয়া নেই ,বন্ধুপ্রবর বিকট স্বরে হল কাঁপিয়ে হেসে উঠল। আমরা তখন লেখাটেখা ছেড়ে কান্ড দেখছি। এদিকে, শিক্ষক মশাই পুরোপুরি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। পরে বন্ধুটি বলেছিল,হঠাৎ করেই নাকি তার এমন বেমক্কা হাসি পেয়ে যায়।


মজার ব্যাপারটা হল, এই হাসিটা কিন্তু বলে কয়ে আসেনা।এটা একটা খুবই প্রচলিত ধারণা, খুব মজার কিছু হলেই মানুষ হাসে। কিন্তু আদপে আমরা [ ঘটনাগুলো থেকেই হাসির রসদ খুঁজে নিই। খুব সাধারণ কথাবার্তাতেই মানুষ হেসে থাকে সবচেয়ে বেশি। মানুষ কথা বলার আগে থেকেই তার মুখে হাসি ফুটেছিল, সেটা গবেষণাতেই বের হয়ে এসেছে। তাই হাসি একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত একটা ব্যাপার, একারণে এর রসায়ন নিয়ে খানাতল্লাশি করতেও জেরবার হতে হয়(বাংলা ছিনেমার মুহাহা মার্কা হাসি বাদ দিলে, একমাত্র ডিপজল এ হাসি স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিতে পারে)। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, ব্যাপারটা আমাদের মেজাজের ওপর হাসির রকমসকম বেশ কিছুটা নির্ভর করে। একারণে দম ফাটানো কোন কৌতুকও বরাত মন্দ থাকলে অবস্থাভেদে মাঠে মারা যায়। আপনি হয়তো একটি জোকস বলে আসর মাত করে ফেলেন, অথচ অন্যদিকে অন্য জায়গায় আপনার জোকসটি হয়ে গেল বিলকুল ফ্লপ। আমাদের এক বন্ধু ছিল, প্রায়ই আমাদের বিভিন্ন কৌতুক বলে হাসানোর কোশেশ করত। আদি রসাত্মক থেকে শুরু করে সবধরনের কৌতুকই তার স্টকে দেদার ছিল। কিন্তু কদিন পরেই ব্যাপারটা বিষম রুপ নিল। একই বাঁধাগতের কৌতুক বলে আর কত লোক হাসানো যায় ? শেষমেষ যেই সে এসে বলত, দোস্ত ,আজকে একটা ব্যাপক জোক্স আছে। কথাটা নিষ্ঠুর শুনাবে, তবে আমরা তখন তাকে বেরসিকের মত থামিয়ে দিয়ে বললাম, আগে বল,কোন জায়গায় হাসতে হবে। কদিন পরেই বন্ধুটি লোক হাসানোর প্রজেক্টে ইস্তফা দিল।

তবে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, উইটি ব্যক্তিরা তাদের উইট নিয়ে খুবই সজাগ থাকেন। যেখানে সেখানে তো নয়ই, বরং বেশ বাছবিচার করে তারা এই উইটের ভাঁড়ার থেকে রয়েসয়েই খরচ করেন। এক্ষেত্রে পরিমিতিবোধের ব্যাপারটাও খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে। কখন থামতে হবে সেটা না জানলে ,শেষমেষ হিউমারের বারোটা বেজে যেতে বাধ্য। সরল বাংলায় আমরা এটাকে বলে থাকি ছ্যাবলামি। তবে সোনায় সোহাগা হয়ে উইটের সাথে যদি আরেক ডব্লিউ,উইসডম যোগ হয়। পাণ্ডিত্যরস তখন সেই রসবোধকে দান করে স্নিগ্ধ আমেজ। সৈয়দ মুজতবা আলী,তপন রায় চৌধুরী নাম এক্ষণে না নিলে তাই গোস্তাকি হবে। তবে কথাটা একটু মোটা দাগের হয়ে যাবে, তারপরও বলি, সব বড় লেখকই কমবেশি রসবোধ নিয়ে জন্মান। কারো লেখায় সেটা প্রকটভাবে ফুটে ওঠে,কারো লেখায় সেটার প্রচ্ছন্ন আভাস পাওয়া যায়, আর কেউ হয়তো সচেতনভাবেই সেটাকে আড়াল করে রাখেন।

তবে কেলোটা বাধে ভীষণভাবে যখন কেউ জোকার খেতাব পেয়ে বসে। সে বেচারা তখন যাই বলে, বা যাই করে,মানুষ অবলীলায় হেসে গড়িয়ে পড়ে। কোন বিশেষ কসরত ব্যতিরেকেই সে হাসিয়ে আসর মাত করে দিতে পারে। এই ক্ষমতাটা যে স্রষ্টাপ্রদত্ত,সে কথাও অস্বীকার করার জো নেই। তার দু;খেও মানুষ তখন হাসে,সুখে তো বটেই। মুশকিল হল, এই তকমা একবার গায়ে এঁটে গেলে সেটাকে খসানোতেও কম বেগ পেতে হয়না। একেবারে আনকোরা লোকজনও যদি নির্বিবাদে তার সাথে ঠাট্টা তামাশা করে, তবে কারই বা ভাল লাগে বলুন?

শুনেছি,রবিবাবু বলে গিয়েছেন, হাস্যরসের পূর্বশর্ত কাউকে না কাউকে একটু ছোট হওয়া। হাসি ঠাট্টার ক্ষেত্রে তাই ভিকটিম থাকতেই হবে।আমাদের বন্ধুমহলে প্রায়ই টিটকারী,ব্যাঙ্গ,বিদ্রুপ আকছার চলে,কিন্তু বেশির ক্ষেত্রে এর শিকার হয় আমাদের সবচেয়ে গোবেচারা বন্ধুটি। সমস্যাটা হল ,মাঝে মাঝেই সম্মিলিত তোপের মুখে পড়ে তাকে একটু বেশি রকম নাকাল হতে হয়। আদতে, কারো আছাড় খাওয়ার ঘ্টনা কিন্তু খুব একটা সুখপ্রদ ব্যাপার নয়। কিন্তু এরকম উটকো আছাড় খেতে দেখলে আমরা প্রায়শই হেসে ফেলি, সেটাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চস্বরে। আবার আছাড়ের থেকে ব্যাপারটা যদি গুরুতর পর্যায়ে চলে যায়, তবে সেখানে ঠাট্টা তামাশা আর চলেনা, তখন কেউ হাসলে তাকে আমরা বিকারগ্রস্তই গণ্য করি। তাই হাসানোর ব্যাপারে যেমন সংযম আবশ্যক, ঠিক তেমনি কখন হাসি থামাতে হবে সেটা বুঝার মত মুরোদও থাকতে হবে বৈকি।

Saturday, August 14, 2010

৩৫ বছর আগের একদিন

১.

এই শুক্রবারটা গড়পড়তা অন্য দিনের মত ছিলনা,সেদিন ঢাকার এক নিভৃত কানাগলিতে কোন অনাহুত আগন্তুককে দেখে নেড়িকুত্তারা সশব্দে ঘেউ ঘেউ করে ওঠেনি, হকারের উচ্চকিত কোরাসে ঐ গলি প্রকম্পিত হয়ে ওঠেনি, সামনের রাজপথের রিকশাগুলো বেপথু হয়ে একটা দুটো কানাগলির সামনে এসে গোত্তা খায়নি, তবে মির্জা আসলাম ঠিকই গোসল সেরে ফুরফুরে মেজাজে বেরিয়েছিলেন। সুপুরুষ এই তরুণের প্রিয় পোশাক পাঞ্জাবি,বনেদী কাঠের আলমারি খুলে তার সদ্য খলিফাপাড়া থেকে সেলাই করা সফেদ পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে দেন। স্বভাববিপরীত ব্রীড়া ঝেড়ে ফেলে আয়নায় নিজেকে দেখার লোভটাও সামলাতে পারলেননা, গর্বোদ্ধত ভঙ্গিমায় নিজেকে দেখলেন,নাহ! পাঞ্জাবিতে আসলেই তাকে দারুণ মানায়। মাথাটা আঁচড়িয়ে যেই টুপিটা হাতে নিলেন, আচমকা একটি অযাচিত খবর তাকে বাকরুদ্ধ করে দিল। শোকস্তব্ধ আসলাম ধীরে ধীরে পাঞ্জাবিটা খুলে ফেলেন, তারপর যন্ত্রচালিতের মত আলগোছে রেখে দেন বিছানার পাশে। সেই নতুন বানানো পাঞ্জাবি তিনি আর ভুলেও ধরে দেখেননি।

২.

গড়পড়তা মানুষের তুলনায় আসলাম সাহেবের উচ্চতা কিছুটা বেশিই । এই প্রৌঢ বয়সেও এই গৌরবর্ণের মানুষটিকে ব্যক্তিত্ত্বের ছটার জন্যে আলাদাভাবে ঠিকই নজর কেড়ে নেন তিনি। সরকারি চাকুরির প্রলম্বিত জীবন শেষে এই কিছুদিন হল তিনি অবসরে গিয়েছেন। চাকুরীর পাট চুকানো হয়ে গিয়েছে, ছেলেমেয়েরাও এখন বেশ লায়েক, পড়াশওনা শেষে তারা টাকাও কামাচ্ছে মন্দ না। ছোট ছেলেটাতো মাত্র কিছুদিন আগেই নতুন চাকুরীতে যোগ দিল। এর মধ্যে পয়লা মাইনের অর্থে সে সবার জন্য উপহারও কিনে ফেলেছে এন্তার। এমনিতে আসলাম সাহেব মানুষটা একটু সৌখিন গোছের। কর্মজীবনেও তিনি ধোপদুরস্ত থাকতে পছন্দ করতেন। চেহারার জৌলুসের কারণে তাকে সব পোশাকেই কমবেশি মানিয়ে যেত। এখন তার বয়স গড়িয়েছে, তবে এটুকু শখ আহ্লাদ এখনো পুরোপুরি বিসর্জন দেননি তিনি। ছেলেদের কাছ থেকে মর্জিমত উপহার পেলে এখনো তিনি বেজায় খুশি হন। এদিকে তার গিন্নি আবার বুড়ো বয়সে সাজপোশাকের এই খোকাটে বাইয়ের জন্য ঠাট্টা করতে ছাড়েননা। তিনি অবশ্য এসবের থোড়াই কেয়ার করেন,কাপর চোপড়ে টিপটপ থাকার চেষ্টা করেন, মায় তাঁর আটপৌরে লুঙ্গি দেখলেও সদ্য পাটভাঙ্গা বলে ভ্রম হতে পারে। আশেপাশের মানুষজনও তাঁর এই বাতিকগ্রস্ততা সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানে।

শুক্রবার। আসলাম সাহেব সময় থাকতে গোসলটা সেরে নিলেন, খানিক বাদেই জুমার নামাজের জন্য মসজিদে যেতে হবে। এসব কাজে তিনি তাড়াহুড়ো একদমই পছন্দ করেননা। তাছাড়া এই বয়সে আগের মত চটপটে হয়ে থাকাটাও হ্যাপার ব্যাপার। তাই সবকিছুর জন্য একটু আলাদা সময় এখন বরাদ্দ রাখতেই হয়। ড্র্রয়ার থেকে সদ্য ধোয়া লুঙ্গি আর ইস্ত্রি করা সাদা হাফশার্টটা গায়ে জড়িয়ে নিলেন।

এমন সময় তাঁর ছোট মেয়ে অনুযোগের সুরে জানতে চাইল,"বাবা, আবার এই সাদা শার্ট কেন? ভাইয়া কালকে যে পাঞ্জাবিটা এনেছে সেটা একদিন পড়লে কীইবা এমন হয় ? "

আসলাম সাহেব মৃদু হাসলেন,"মা,তুই কী জানিস না, আমি শুক্রবার দিন কখনো পাঞ্জাবি পরিনা।"

সত্যিই তো, একে একে পয়ত্রিশটি বছর কেটে গেল,এর মধ্যে তিনি একবারের জন্যও কোন শুক্রবারেই পাঞ্জাবি গায়ে চড়াননি। ৩৫ বছর আগের মধ্যআগস্টের সেই শুক্রবারের ফেরারী স্মৃতি তাঁকে এখনো তাড়া করে ফেরে, চোখ মুদলেই সেদিনকার সেই সফেদ পাঞ্জাবিতে তিনি লাল লাল ছোপ দেখতে পান...তার আর পাঞ্জাবি পরা হয়না....।

Tuesday, August 10, 2010

সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি

সেদিন ক্যাফেতে বসে বেশ ভাবের সাথে রাজা উজির পেটাচ্ছি,বাইরে তখন বৃষ্টিটাও বেশ জেঁকে ধরেছে,তার সাথে অবধারিতভাবে উড়ে যাচ্ছে কাপের পর কাপ চা,আর সিগ্রেট তো দেখতে না দেখতে ভস্ম হয়ে যাচ্ছিলই।মন মেজাজ বড়ই শরিফ ছিল আমাদের।এমন সময় বলা নেই কওয়া নেই কোত্থেকে দুম করে মফিজ এসে পড়ল।মুহুর্তেই আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় আমাদের মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেল।

জানতে চাইলাম,"কিরে,এমন ঝড়ো কাক হয়ে এলি যে?"

বেচারা তখন ভিজে জবজবে হয়ে পড়েছে।ভেজা কাপড় নিংড়াতে নিংড়াতে সে জবাব দিল," আর,বলিসনা,দৌড়োতে দৌড়োতে পেরেশান হয়ে গেলাম।"

মনে মনে ভাবলাম,এই সেরেছে,এখন শুরু হয়ে যাবে এফএম রেডিওর আরজেদের মত ননস্টপ বকবকানি। সবাই দেখলাম একেবারে ম্যাদা মেরে আছে,মফিজের কাহিনী শোনার ইচ্ছে কারো বিন্দুমাত্রও নেই।

কিন্তু মফিজ এসব ভ্রুক্ষেপ করার মত আদমীই নয়,সে ওদিকে বিশাল এক কাহিনী ফেঁদে বসার জন্য রীতিমত প্রস্তুতি নিচ্ছে।আমরা তখন ফাঁকেতালে
তাস পেটানো মুলতবি রেখেই সটকে পড়ার ফিকির
করছিলাম।কিন্তু,বিধিবাম,মফিজ অমনি আমাদের ক্যাঁক করে চেপে ধরল।
"আরে,কোথায় যাস,দাঁড়া ,একটু শুনে যা?" হতচ্ছাড়াটা এমন চিনেজোঁকের মত সেঁটে রয়েছে যে,শেষে পলায়ন পর্বে ইস্তফা দিতেই হল।
"আরে শোন,একটা ভালো খবর আছে।"উৎসাহে তার চোখ চিকচিক করছিল।

সবার মাথায় তখন একই চিন্তা,তোর আর ভাল খবর,গত তিনমাস এই "ভাল খবর " শুনতে শুনতেই তো কেটে গেল।তিন মাস আগে কিন্তু এই হ্যাপা আমাদের পোহাতে হয়নি।কিন্তু কোন কুক্ষণে যে মফিজের মাথায় কোবতে লেখার ভূত চেপে বসেছিল কে জানে।একদিন নাকি শীতের সকালে ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশিরবিন্দু দেখে হঠাৎ তার মনে হল,সে একজন কবি।এসব কেচ্ছা সে যখন আমাদের সবিস্তারে শোনাচ্ছিল তখন আমরা দস্তুরমত ঘাবড়ে গেলাম।এমনিতেই সে একটু ক্ষ্যাপাটে কিসিমের বান্দা,এত বড় নাম সবার ডাকতে অসুবিধে,এই অজুহাতে সে নিজের পিতৃপ্রদত্ত নাম মোস্তাফিজকে অবলীলায় ছেঁটে মফিজ বানাতেও কিচুমাত্র কসুর করেনি।আমাকে তখন বাধ্য হয়েই বলতে হল,"দেখ,তুই কারো কাছ থেকে ছ্যাঁকাও খাসনি,পরীক্ষায়ও গোল্লা মারিসনি,বা অন্য কিছুও হয়নি যে তোকে কবিতা লিখতে হবে।সবচেয়ে বড় কথা হল সবাইকে দিয়ে তো আর সবকিছু হয়না,আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নিয়ে লাভ কি?।"

এবার মফিজের উৎসাহে খানিকটা ভাটা পড়ল বোধহয়।ক্ষুণ্ণচিত্তে সে বলল,"তোরা আমার কবিতা না শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি ?প্রতিভা তো কেবল বের হওয়ার জন্য আকুলি বিকুলি করে,কেবল সুযোগের অভাবে পারেনা।বলতে পারিস,ঐ মুহুর্তে সেই দৃশ্য না দেখলে হয়ত আমি বুঝতেই পারতাম না আমার মাঝে এই প্রতিভা আছে।"

এহেন আবেগমথিত দার্শনিক কথন শুনে আমাদের মন খানিকটা দ্রবীভূত হল বৈকি।বললাম,"আচ্ছা,শোনা দেখি তোর কবিতা?"মানুষ না জেনে খাল কেটে কুমীর আনে,আর আমরা একেবারে হাঙ্গর নিয়ে আসলাম।


ওদিকে মফিজ তখন গলা খাকারি দিয়ে কবিতা শুরু করে দিয়েছে,

সেদিন দুজনে
গিয়েছিলাম বনের ধারে ,
কিন্তু সেখানে কোন বন ছিলনা,
সেখানে ছিল কেবল একখন্ড মরুভুমি,
সেই মরুভূমির শেষ প্রান্তে,
আমরা দিগন্ত দেখতে গিয়েছিলাম ,
কিন্তু আমরা দেখতে পাইনি কোন দিগন্ত,
কারণ আমরা দুজনেই ছিলাম অন্ধ।

এটুকু বলে মফিজ একটু দম ফেলল।আর আমরা ! কি আর বলব,আমরা যাকে বলে একেবারে বাকরুদ্ধ !।বলাই বাহুল্য,আনন্দে অবশ্যই নয়।খুব একটা উপাদেয় কিছু আমরা তার কাছ থেকে আশা করিনি অবশ্যই,তাই বলে এতটা ! ওদিকে মফিজ তখন রীতিমত আশা নিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে আছে।আমরা তখন একজন আরেকজনের দিকে বোবা চাউনি মেলে তাকিয়ে আছি।ভাবখানা এমন,কিরে কি বুঝলি ? ওদিকে মফিজ বল,"এবার বল,কবিতা কেমন হয়েছে?"।আমি সাবধানে বললাম,"দোস্ত,কিছুই তো বুঝলাম না।"ও দেখি ততোধিক উৎসাহে বলে চলেছে,"আসলে ব্যাপার হল,আমি ব্যাপারটার মধ্যে খানিকটা পরাবাস্তব গন্ধ আনতে চেয়েছি।আর শেষের অসাধারণ চমকটা বলতে পারিস,অনেকটা নাটকীয়ভাবে আমার মাথায় চলে এসেছে।ব্যাপারটা তাহলে একটু খুলেই বলি............"

আমি তাড়াতাড়ি বললাম," ও আচ্ছা,আচ্ছা।এবার বুঝলাম।তা তুই এবার কি করবি?"।মফিজ তখন আনন্দে সপ্তম স্বর্গে,"ভাল কথা মনে করেছিস,এই কবিতাটা যে কোন সাহিত্য পত্রিকা লুফে নেবে,কি বলিস?"
আমরা আর কিছু বললামনা।কে আর পাগলকে সাঁকো নাড়তে নিষেধ করবে?

পরের তিন মাস এমনি অসংখ্য কবিতার অত্যাচারে আমরা একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়লাম।তার সর্বশেষ "ভাল"খবর হল,সে নাকি এখন লিটল ম্যাগাজিন বের করবে।আমরাও রীতিমত ভয়ে ভয়ে আছি,কবিতার
ভূত ব্যাটার মাথা থেকে কবে নামবে কে জানে। ততদিন পর্যন্ত গা ঢাকা দিয়ে থাকাই সই।

একটি সচিত্র ফুটবল কাহিনী

সেশনাল,ক্লাস টেস্ট,অ্যাসাইনমেন্টের খপ্পরে প্রাণটা একেবারে ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছিল।নানান ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি পেতে যখন আমরা ফিকির করছিলাম তখনই একদিন ঘোষণা এল,মেকানিক্যাল ডে উপলক্ষে ইন্টার ব্যাচ ডিপার্টমেন্টাল ফুটবলের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের মত পাঁড় ফুটবলভক্ত ও ফুটবলারদের জন্য এ যে ছিল মেঘ না চাইতেই জল ।তারপর কয়েকদিন মাঠে গিয়ে হাড়ভাংগা প্র্যাকটিস এবং ম্যাদামারা শরীরগুলোকে সচল করার দুরুহ অপপ্রয়াস।অবশেষে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শুরু হল টুর্নামেন্ট।প্রথম ম্যাচই ০৫ ব্যাচের সাথে।একেবারে যাকে বলে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই হওয়ার পর আমরা (০৬ ব্যাচ) ২-১ গোলে জিতে ফাইনালে উঠে গেলাম।

অবশেষে এল ধীরে ধীরে ফাইনালের মাহেন্দ্রক্ষণ এগিয়ে এল।খেলা শুরুর আগ থেকেই উত্তেজনায় আমাদের বুক ঢিপঢিপ করছিল।শিরোপা জিততে পারবতো?প্রতিপক্ষ (০৭ ব্যাচ)কে হেলাফেলা করার কোনো সুযোগ ছিলনা।কিন্তু কাগজে কলমে আমরাই ছিলাম এগিয়ে।যাই হোক,রেফারির হুইসেলে খেলা শুরু হল।



ওরা ১৫ জন :)



আমরা দ্রুত যে যার পজিশন নিয়ে ফেললাম।প্রথম দিকে অবশ্য খানিকটা এলোমেলো খেলাই হচ্ছিল।সময় গড়ানোর সাথে ধীরে ধীরে দুই দলই আক্রমন পালটা আক্রমণ চালাতে থাকে ।তবে আমাদের উইঙ্গার সৌরভ আর প্লেমেকার শাহীনের দুর্দান্ত বোঝাপড়ায় ওরা জেরবার হয়ে পড়ছিল ।এরই ফাঁকে আমিও বারকয়েক রাইট ব্যাক থেকে ওভারল্যাপ করে এগিয়ে যাই।কিন্তু মুহুর্মুহু আক্রমণ সত্ত্বেও প্রথমার্ধ গোলশুন্যভাবে শেষ হয়।



বিরতিতে আমাদের দুর্ধর্ষ টিম মিটিং :P



আমাদের আদি ও অকৃত্রিম সাপোর্টারেরা
B-)


দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ওদের আমরা একেবারে জেঁকে ধরি।এমন সময় সৌরভ হঠাৎ বল নিয়ে দু জনকে কাটিয়ে ঢুকে পড়ে ডিবক্সে।কিন্তু তৃতীয়জনকে কাটানোর সময় হঠাৎই সে পপাৎধরণীতল।





তারপর রেফারিকে ঘিরে আমাদের আবেদন




এবং পেনাল্টি স্পটের দিকে রেফারিরি অঙ্গুলিহেলন ,অতঃপর গোওওওওওওওওওওওওওল :):)




এরপর বাকি ম্যাচ রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার মাঝে কোনোমতে পার করে দেওয়া।অবশেষে সেই কাংখিত জয় :D:D




ইতো-অঁরির স্টাইলে আমাদের বিজয়োল্লাস B-)




পাদটিকাঃ দুর্দান্ত স্ন্যাপশটের জন্য বন্ধু নিলয় ও আশিককে ধন্যবাদ।

ফর্মালিটিজ নিয়ে কিছু ইনফর্মাল বাতচিত

বেশ ক'বছর আগের কথা।তখন চট্টগ্রামের ফয়েজলেকে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক নামের নতুন এক কিসিমের বিনোদন এল।শুনলাম,সেখানে নাকি "রোলার কোস্টার নামের এক অতীব ভয়াবহ " আজাব আছে।তো শুভক্ষণ দেখে এক বিকেলে আমরা কজন সেই অত্যাশ্চর্য নিরীক্ষণে বেরিয়ে পড়লাম।এতক্ষণ বেশ বড় বড় বুলি হাকালেও রোলার কোস্টারের সামনে গিয়ে আমাদের রীতিমত চক্ষু চড়কগাছ।মানুষ দেখি টারজানের মত গলা ফাটিয়ে সর্বশক্তিতে চিৎকার করছে।আমার আবার উচ্চতাভীতি ছিল একটু বাড়াবাড়ি রকমের,অবস্থা বেগতিক দেখে আমি সটকে পড়ার ্মওকা খুঁজছিলাম।ভীত কন্ঠে বন্ধুকে শুধালাম,"আচ্ছা ,সবাই ওখানে উঠেই এত জোরে চিৎকার করছে ক্যান"?বন্ধু বিজ্ঞোচিত জবাব দিল,"আরে বোকচন্দর এটাও বুঝলিনা,এটা হোল এখানকার ফর্মালিটিজ B-)।"



ফর্মালিটিজের(কেতাবী বাংলায় যাকে আনুষ্ঠানিকতা বলাটাই বোধহয় সমীচীন হবে) ব্যবচ্ছেদ করা আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও বাস্তবিকভাবে খুব একটা সহজ কম্মো নয়।সাধারণভাবে সামাজিক মানুষকে যেসব নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয় সেগুলোকেই ফর্মালিটিজ বলা হয়ে থাকে।তবে এই সরল সত্যের আড়ালের গোমরটা ধরতে না পারলেই বাঝে যত বিপত্তি।ফর্মালিটিজ মেনটেইনের সময় নিজের বুদ্ধি -বিবেচনার ওপর সর্বদা ভরসা না করে খানিকটা অনুকরণ (বা অনুসরণ ) করাটা খুব একটা দূষণীয় নয় তো বটেই,বরং আখেরে বেশ কাজেও দিতে পারে বটে। তাই নিজ বুদ্ধিতে সায় না দিলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্যের বুদ্ধিতে চলা উচিত,তাহলে পস্তাবার শঙ্কা খানিকটা কম থাকে।


তবে অনেকেই আছেন যারা এসব আনুষ্ঠানিকতার বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে নিজের মর্জিমাফিক বেশভুষা ধারণ করেন,বিনিময়ে এর খেসারতও তাদের দিতে হয় বৈকি।আমাদেরই এক বন্ধুরই পোশাক আশাকের ব্যাপারে ছিল চরম বৈরাগ্য ,এক্ষেত্রে নূন্যতম ভদ্রতা -সভ্যতার ধারও সে ধারত না ।বলাই বাহুল্য,তাকে নিয়ে কোথাও গেলেই একটা কেলো বাঁধার সম্ভাবনা থাকত।কিন্তু একদিন তার কীর্তি আমাদের সব শঙ্কাকেও ছাপিয়ে গেল।আমরা গিয়েছিলাম আইডিবিতে ,কিছু টুকটাক কেনাকাটা সারতে।কিন্তু হঠাৎই বলা নেই কওয়া নেই,আমাদের মাথায় একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত, সেই বন্ধুবর দেখি দেঁতো হাসি হেসে তার কুখ্যাত সবুজ লুঙ্গি নাচাতে নাচাতে আসছে!!মজার ব্যাপার হল,আমাদের এই হাড়িপানা মুখ দেখেও তার কোনোই ভাবান্তর হলোনা,অম্লান বদনে সে যথারীতি আমাদের সাথে ঘুরতে লাগল !আরেকটু বলে রাখা ভাল,এই "আত্মঘাতী" কম্মোর ফল তাকেও দিতে হয়েছিল,এর পর থেকে তার নাম হোল "লুঙ্গি রাশেদ।"


হুজুগে বাঙ্গালীর একটা বড় সমস্যা হল,তারা সবসময় মুদ্রার এক দিকেই দেখে,মুদ্রার উলটো পিঠে কি আছে সেদিকে ভুলেও তাকায়না । কবি শেখ সাদির পোশাক নিয়ে সেই ঘটনার কথা আমরা সকলেই অল্পবিস্তর জানি,।সবাই উচ্চকিত স্বরে শেখ সাদির রসবোধের তারিফ করলেও বিসমিল্লায় যে তাকে ভালোমতোই হেনস্তা হতে হয়েছিল,তা বিস্মৃতি পরায়ন মানুষ বিলকুল ভুলে গেছে।অথচ তিনি যদি কিঞ্চিৎ আনুষ্ঠানিকতা পালন করতেন তাহলে এই হ্যাপার মধ্যদিয়ে তাকে হয়তো যেতে হতোনা !! আসলে মোদ্দা কথা হল এই,সাবেকী আমলে বিখ্যাত ব্যক্তিরা তো বটেই,মায় আমজনতা পর্যন্ত তাদের বসন নিয়ে হয়ত খুব একটা গা করতনা(টিভি সিরিয়ালগুলোতে হরদম দেখানো মোঘল আমলের পাবলিকদের মনি-মুক্তা ইত্যাকার মুল্যবান বস্তু খচিত খুবসুরৎ শাহী পোশাক এই ক্যাটাগরির বাইরে থাকবে )।তবে নির্বোধও মাত্রই জানে,এই ফ্যাশন সচেতন যুগে এটা একেবারেই আকাশ কুসুম ব্যাপার ।হালে পোশাক নিয়ে পুরোদস্তুর গবেষণা হচ্ছে,এবং তথাকথিত ফ্যাশানবিদদের এইসব জ্ঞানগর্ভ পরামর্শও মানুষ গোগ্রাসে গিলছে।কিন্তু সীমা ছাড়ালেই এসব গবেষণা হয় মারাত্মক হাস্যাস্পদ।এই তো সেদিন প্রচেষ্টার দশ বছরে পা দেওয়া একটি বহু প্রচারিত দৈনিকের রুপসজ্জা পাতা দেখেও আক্কেল গুডুম হলাম।রাতের দাওয়াত হলে স্ট্রাইপ শার্টের সাথে ম্যাচিং করে ধূসর প্যান্ট এবং তার সাথে অতি অবশ্যই কালো জুতো বা কোন ইনফর্মাল দাওয়াতে পাঞ্জাবির সাথে ম্যাচ করে কোলাপুরি বা নাগরা পরতে হবে ,ইত্যাদি উপদেশের বহর শুনে এখন আসলেই ভিরমি খেতে হয়।আনুষ্ঠানিকতার নামে অতি আনুষ্ঠানিকতা বা ফ্যাশানের নামে ছ্যাবলামি,যাই বলিনা কেন,নির্মল বিনোদন দেওয়া ছাড়া এসব পরামর্শ আর কোন কাজে আসেনা বলেই মনে হয়।


শেষের কবিতায় পড়া একটি কথা এখনো মনে গেথে আছে,ফ্যাশানটা হল মুখোশ আর স্টাইলটা হল মুখশ্রী ।ফর্মালিটিজের ব্যবচ্ছেদ করতে গেলে এই কথাটিই আসলে সবার শেষ কথা।আপনি আচরি ধর্ম বলে একটা কথা আছে,তাই স্টাইল কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিবিশেষে ভিন্নই হয়ে দাঁড়ায়। পোশাকি আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজাল সত্ত্বেও স্টাইলই ব্যক্তিকে আলাদা করে রাখে।একথা অস্বীকার করার জো নেই,কর্পোরেট জগতে কেতাদুরস্ত হয়ে থাকাটা বিশেষভাবে জরুরি ।তবে এই কর্তব্য পালের সময় জবরজং হয়ে থাকাটা আর যাই হোক,স্মার্টনেসের পরিচায়ক নয়।সোজা কথায় বললে,রুচিবোধ ও ঔচিত্যবোধ,এই দুয়ের মেলবন্ধন না ঘটলে পোশাকি আনুষ্ঠানিকতা হবে কেবলই অন্তসারশূন্য,ফর্মালিটিজ হয়ে পড়বে মূল্যহীন।

বইয়ের কথা -ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প

অনেক দিন পর একটা জম্পেশ ফেব্রুয়ারি মাস কাটালাম ।সিংহ রাশির জাতকের এবার অর্থভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল কিনা জানিনা ,তবে আমার মাসের শুরুতে বেশ কিছু অপ্রত্যাশিত অর্থসমাগমে পকেটটা কিঞ্চিত হৃষ্টপুষ্ট দেখাচ্ছিল ।কিন্তু ,ঐ যে , সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় ,তাই একবার বইমেলায় যাওয়া শুরু করতেই পকেট মোটামুটি গড়ের মাঠ ।তবে বলতেই হচ্ছে ,শেষ পর্যন্ত কিছু পছন্দসই বই কেনা হয়েছে ,তাই মাস শেষের দৈন্যকে এখন আর খুব একটা গায়ে মাখছি না ।

স্বীকার করতে কুন্ঠা নেই ,বইমেলায় পারতপক্ষে আমি এক্সপেরিমেন্ট করার ধারেকাছ দিয়ে যাইনা ,আরো পষ্টাপষ্টি করে বললে ,নতুন লেখকের বই খুব একটা কেনা হয়না ।কিন্তু এবার অনেক দিন বাদে কয়েকজন আনকোরা লেখকের বই কেনা হল ।আনকোরা কথাটি আসলে পুরোপুরি ঠিক হলোনা , প্রিন্ট দুনিয়ায় তারা নতুন লেখক হলেও ,অন্তর্জালের কল্যাণে ব্লগখোরদের কাছে তারা মোটেই নতুন নন ।তাই মাহবুব আজাদকে ব্লগারদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা খুব একটা আবশ্যক নয় ,হিমু নামেই যিনি সমধিক পরিচিত।বাংলা ব্লগিংয়ে একদম শুরু থেকেই তিনি সমানে দুহাতে লিখে আসছেন ,আর আমার মত চুনোপুঁটি ব্লগারদের কীবোর্ড গুতানো মূলত তার ব্লগ পড়েই শুরু ।বলতে তাই কসুর নেই,পাঠসূত্র থেকে প্রকাশিত লেখকের প্রথম গল্পগ্রন্থ "ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প " কিনতে আমি দুবার ভাবিনি।

এবার গল্পগুলো নিয়ে খানিকটা বলি ।

পুরনো বাড়ি গল্পটি দিয়ে বইয়ের শুরু ।লেখককে আমি ধন্যবাদ দেব এমন একটা গল্প প্রথমেই পাঠকের সামনে হাজির করার জন্যে। গল্পটি আবর্তিত হয়েছে বালক টুলুকে ঘিরে ,টুলুর চোখে আমরা দেখতে পাই স্মৃতিকাতর হাসানকে ।তের বছর কাটানো বাড়িটির প্রতি এক অদ্ভুত ফ্যাসিনেশন হাসানকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফেরে ।গল্পটি শেষতক এক তীব্র বিষাদে আচ্ছন্ন করে আমাকে ,সম্ভবত টুলুকেও।গল্পের শেষদিকে থেকে কিছু লাইন পড়লেই গল্পটির শক্তিমত্তা আরেকটু স্পষ্ট হবে।

“সেই কান্নাও টুলুদের এই নিঃস্ব বাড়ির মত ,তাতে শব্দ নেই ,আছে শুধু স্মৃতিঘাতের শোক,ঐ কান্নাটুকুতে একটা নীলরঙের আকাশে ফুটে ওঠা লাল শিমুলের জন্য বিষাদ আছে ,একটা বুড়ো কৃষ্ণচূড়া গাছের জন্য লালিত ভালবাসা আছে ।একবুক কান্না নিয়ে হাসান নামের লোকটা ওলটপালট হতে থাকে টুলুদের ঘরের মেঝেতে”।

সেতু সঙ্কট ও তোমার ঘরে বাস করে কারা লেখকের অবিশেষণসম্ভব উইটে ভাস্বর ,কতকটা ডার্ক হিউমারেও ।সেতু সংকটে লেখক আমাদের পা-চাটা অর্থলোলুপ পলিটিশিয়ানদের সমানে চপেটাঘাত করেছেন ,অবশ্যই তার স্বকীয় ফর্মুলায় ,তবে ছোটগল্পের আমেজটা যেন ঠিকঠাক আসেনি । তোমার ঘরে বাস করে কারা – সেই অর্থে অনেকটা চটুল গল্প ,লেখক এখানে গল্প নির্মাণের আগাপাশতলা দিয়েও যাননি ,আমাদের গল্পটি বলে গেছেন কেবল ,অনেকটাই পাঠকদের পাতে তুলে খাইয়ে দিয়েছেন বলা চলে ।তবে লেখকের সক্ষমতার বিচারে গল্পটিকে খানিকটা ক্লিশেই বলা চলে ,মাঝে মাঝে ভেল্কির ঝলক দেখালেও তার ছটা খুব প্রখর ছিল ,তা বলা যায়না ।

নিদপিশাচ আক্ষরিক অর্থেই একটি অদ্ভুত গল্প । লাস্যময়ী স্বাগতাকে ঘিরে নাসিমের উদ্ভট কল্পনাকে ঘিরে গল্পের শুরু ,কিন্তু অনেকটা আলটপকা স্যাডিস্ট পরিতোষবাবু তার সর্বগ্রাসী ছায়ায় গল্পটিকে কব্জা করে ফেলেন ,নাসিমকেও ।গল্পটি বোধ হয় যতটা না ফ্যান্টাসিনির্ভর ,তার চেয়েও বেশি মনোদৈহিক ।গল্পটির কলেবরে খানিকটা পৃথুল ,কিন্তু মাঝেমাঝেই মনে হয় কাহিনী একটু টাল খেয়েছে ।তবে একেবারে শেষের লাইনের চমকটা ঠাহর আমি আসলেই করতে পারিনি ,এখানে লেখকের ইশারা আমার এলেমেও কুলোয়নি ।

ব্লগসূত্রে বিলুপ্তি আগেই পড়া ছিল ,না হলে অবধারিতভাবে এটিই আমাকে নাড়া দিয়েছে সবচে বেশি ।কি নির্লিপ্তভাবেই না আমাদের জাতিগত অন্তসারশুন্যতাকে লেখক চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ।হতে পারে এ এক অলীক সময়ের কাহিনী ,হতে পারে তা লেখকের কল্পনাপ্রসূত ,কিন্তু একদিন যে এরকম হবেনা ,তা কি কেউ হলফ করে বলতে পারে ?শেষের লাইন কটি আমি নিশ্চিত পাঠককে একটা সশব্দ নাড়া দেবে –

আকাশে গুলির শব্দ মিলিয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ,যেভাবে এর আগে অনেকগুলি বছরে মিলিয়ে গেছে অনেক প্রতিশ্রুতির ধ্বনি ,প্রতিধ্বনি ।

ম্যাগনাম ওপাস বইয়ের শেষ গল্প ,রকিব ,রমা ও লেখক আনিস চৌধুরীর ত্রিভুজ কেমিস্ট্রি এই গল্পের উপজীব্য ।রমা ও রকিব নিজেদের মধ্যে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ,কিন্তু মজার ব্যাপার হল নাটাইটা লেখক আনিস চৌধুরীর হাতে ,আর তার অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে রকিব আর রমা দুজনেই জড়িয়ে পড়ে এক প্রহেলিকাময় সম্পর্কে ।তবে সবচে মজার ব্যাপার হল ,শেষ পর্যন্ত দুজনমানব মানবীর সনাতনী সম্পর্কের চাইতে নির্বাসিত লেখকের মহাকীর্তির রহস্যই শেষে প্রকট হয়ে ওঠে ।গল্পটি আদপেই অন্য গল্পগুলোর চেয়ে খানিকটা ব্যতিক্রম ।প্লটের অভিনবত্বের কারণে , বা লেখকের কারিশমার কারণেই হোক ,নাম ভূমিকায় গল্পটির স্থান তাই যথার্থই হয়েছে ।

(পাদটীকা : দিনকতক আগে জানলাম ,এবারের বইমেলায় সেরা নবীন গল্পকার হিসেবে মাহবুব আজাদ তার “ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প” বইটির জন্য সিটিব্যাংক আনন্দ আলো পুরস্কার পেয়েছেন ।গল্পগ্রন্থ পড়ার পর আমাকে তাই বলতেই হচ্ছে ,এই পুরস্কার বোধ হয় যোগ্যতমের কাছেই গিয়েছে । )

বইমেলা কড়চা ১

বইমেলা প্রাণের মেলা ,তাই প্রাণের তাগিদেই সেখানে ছুটে যেতে হয় ।ফেব্রুয়ারি মাস এলে বই মেলায় তাই না গেলেই নয় ।নতুন বইয়ের তীব্র মৌতাতে জায়গাটা ম ম করে , সেই গন্ধ শোঁকার জন্য প্রাণটাও তাই হামেশাই আইঁঢাই করে বৈকি ।তাই মাঝেসাঝে একেবারে প্লান প্রোগ্রাম কষে ,আবার কখনো সখনো একেবারেই ঝটিকা সফরে বইমেলায় ঢুঁ মেরে আসা হয় ।হতচ্ছাড়া পকেটের হতশ্রী অবস্থাকে পাশ কাটিয়ে গেলে বইমেলা সফরে আমি তাই নিখাদ অ্যাডভেঞ্চারের আমেজই পাই ।কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায় ,কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়ে যেগুলোকে এক তুড়িতেই উড়িয়ে দেওয়া হয়ে পড়ে নিতান্তই দুষ্কর ।

বইমেলার বাইরে বাহারি পণ্যের বিকিকিনি দেখে আমার প্রায়ই মনে হয় ,মানুষ রথ দেখতে এসে শুধু কলারই সওদা করছে ,রথ আর দেখছেনা ।এমনও হয় ,ভিতরে স্টলগুলো খাঁ খাঁ করছে ,বিক্রয়কর্মীরা বসে বসে ভেরেণ্ডা ভাজছে ,এদিকে বাইরে রকমারি জিনিসের সামনে উটকো মানুষের ভিড়ভাট্টায় চলাই দায় হয়ে পড়েছে ।সাদা চোখে অনেকে হয়তো এসব দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবেন ,বাহ ! বইমেলা তো আমাদের সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে ।কিন্তু বাইরের চটক দেখে যারা মেলার মূল সার্থকতা নিয়ে বেজায় আত্মপ্রসাদ লাভ করেন ,আমি অন্তত তাদের দলে নেই ।আমি লেখক নয় ,প্রকাশক নই ,এমনকি জাঁদরেল সমালোচক-সমঝদারও নই ,কিন্তু তারপরও একটা ব্যাপার নিয়ে মাঝে মধ্যেই মনটা খচখচ করে ,এই যে হাজারো মানুষের ভিড়ে মেলাঙ্গনে দুদন্ড দাঁড়াবার ফুরসত মেলেনা ,কিন্তু এদের মাঝে বইয়ের প্রকৃত ক্রেতা কয়জন ? সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ছাড়াও বিশেষ দিনগুলোতে যেভাবে জনতার ভিড় উপচে পড়ে ,তাতে করে এই সওয়ালটি আরও বেশি করে আমাকে জেঁকে ধরতে থাকে ।মননশীল –ভাবুক পাঠকদের হিসেব তো দিল্লি দূর অস্ত ,মূলস্রোতের লেখকদের পাঠকগোষ্ঠী ক্রমবর্ধনশীল ,এমন দাবি কি আমরা হলফ করে করতে পারি ?“প্রচারেই প্রসার” আপ্তবাক্যে বিশ্বাসী লেখকদের বই হয়তো ভালোই বিকোচ্ছে ,দেদারসেও বিক্রি হচ্ছে ,কিন্তু একথাও আমাদের ভুলে যাওয়া চলবেনা ,তারা পাঠকদের লেখক নন ,বরং অনেকাংশেই মিডিয়ার লেখক ।তাই কর্পোরেট মিডিয়ার আশীর্বাদপুষ্ট লেখকের সামনে অটোগ্রাফ বা ফোটোগ্রাফশিকারীদের অসীমতক লাইন দেখে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক ,এদের মাঝে পাঠকদের সংখ্যা বাছতে লাইন উজাড় হয়ে যাবে ,বরং সিংহভাগই হুজুগে ভক্ত –অনুরক্ত –শুভানুধ্যায়ী । এর ফলে যে লোকসানটা আড়ালে আবডালে কাজ করে চলেছে ,সেটা হল ,এসব অযাচিত লোকের গাড্ডায় আসল পাঠকেরা তাদের মনপসন্দ বই বিচারে নাচার হয়ে পড়ছে ;একটু ঘুরেফিরে ,একটু চেখেচুখে বই বাছাই করাটা হয়ে পড়েছে ভীষণ দুরুহ ।তাই ছুটির দিনগুলোতে অন্তত বই কিনতে বইমেলায় যাওয়ার কথা এখন আর কস্মিনকালেও ভাবা যায়না ,ভাবতে ভয় হয় ,পাছে কয়েক বছর পর আটপৌরে দিনগুলোতেও কিনা বইমেলায় পা দেওয়া দায় হয়ে পড়ে ।

আঞ্চলিকতা বা অঞ্চল বিষয়ক কথকতা

হলে না থাকার সুবাদে আমাদের বন্ধু সোহাগকে প্রায়ই আজিমপুর থেকে মিরপুরগামী বাসে চড়তে হত ।প্রতিদিনই সে আশা করত কোন ত্বন্বী রমণী ভুবনমোহিনী হাসি হেসে তার পাশের আসনটিতে বসবে ,কিন্তু তার বদনের বেহাল হকিকতের কারণেই হোক ,বা অন্য কোন কারণেই হোক ,তার সে আশা প্রায়ই হত গুড়ে বালি । যাক ,বলছিলাম সোহাগের কথা ।একদিন তার সাথে মিরপুর লিংকে সহযাত্রী হল একজন বুড়োমত লোক ।সোহাগ বেশ মিশুক ,একেবারে আনকোরা মানুষজনের সাথে নির্বিবাদে আলাপ জুড়ে দিতেও সে বেশ পটু ছিল ।তো সেইদিন ,একথা সেকথার পর সে সহযাত্রী ভদ্রলোকের সাথে রীতিমত আলাপ ফেঁদে বসল।মজাটা হল ,বাস থেকে নামার পর ভদ্রলোক সোহাগকে বললেন ,তোমার বাড়ি তো চট্টগ্রাম ,তাইনা ?

পরে যখন সোহাগ আমাদের কাছে তার অননুকরণীয় টিপিক্যাল চাঁটগাইয়া অ্যাকসেন্টে বলল ,”দোস্ত ,লোকটা আমার কথা শুনে কেমনে বুঝল আমি চাঁটগাইয়া ”।আমরা আর কিছু বললামনা ,মুচকি মুচকি হাসতে লাগলাম ।

সোহাগ একটু সরল টাইপের ,তাই বাতচিত করার সময় কথার টান অতটা আমলে নিতনা ।কিন্তু আমাদের অনেককেই এই প্রচন্ড রকম সজাগ থাকা সত্তেও এই অ্যাকসেন্ট লুকোতে কাঠখড় পোড়াতে হয় ,অনেকে আবার একেবারেই পারেনা ।তা না হয় নাই পারল ,কিন্তু মাঝে মাঝে এসব হ্যাপাটা একটু বেশি রকমের হয়ে যায় ।আমাদের আরেক বন্ধুর কথায় ভয়াবহ আঞ্চলিক টান চলে আসে ।সে আবার খুবই সুদর্শন ,পোশাক আশাকেও বেশ ফিটফাট ,কিন্তু যেই মুখ খুললেই বাঝে যত বিপত্তি ।আমরা বলি ,সোহান কথা না বলার আগ পর্যন্ত আমাদের ক্লাসের সবচে স্মার্ট ছেলে ।আর আমাদের প্রথম প্রেসেন্টেশনের পর কথাটা একটু বদলে গিয়ে হল ,সোহান বাংলার চেয়ে ইংরেজি ঢের ভাল বলে ,আর সবচেয়ে ভাল বলে যখন সে কিছুই না বলে ।

তবে বোধকরি ,একঝাক মানুষের মধ্য থেকেও আমাদের চাঁটগাইয়াদের সনাক্ত করতে সনাক্ত করতে বেগ পেতে হয় সবচেয়ে কম ।একেবারে অথেনটিক টান তো আছেই ,তায় আবার প্রতি বাক্যের শেষে বাইডিফল্ট “যে” অনুসর্গ যুক্ত করায় আমরা বুঝে যেতাম ,এ ব্যাটা চাঁটগাইয়া নওজোয়ান ।তাই যতই তুমি ইংরেজিতে তুবড়ি ছোটাও না কেন ,কুট্টিদের মত “আবে চিপায় পড়লাম ” ডায়ালগ দিয়ে বর্ণচোরা সাজার চেষ্টা করনা কেন ,হুঁ হুঁ ,চাঁটগাইয়া হয়েছ তো মরেছ ,একেবারে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় তোমার সব কসরতই মাঠে মারাই যাবে ।

তবে একটু চোখকান খোলা রাখলেই কিন্তু অল্পবিস্তর টান অনেকের কথার মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায়।ব্যাপারটা এমন কোন গুরুতর বা দূষণীয় তো নয়ই –আমি অন্তত মনে করিনা ।আসলে এইসব মানুষের কথা থেকেই চিনে ফেলার ব্যাপারগুলো আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে ।তবে মাঝে মাঝে এজন্য বড়সড় কেলোও হয়ে যেতে পারে ।একবার নতুন টিউশনিতে গেলাম ,আর গিয়েই গৃহকর্তার সাথে একথা সেকথার পর চট করে ধরে ফেললাম ওনারা চট্টগ্রামের ।(উনি আবার অতটা চৌকস ছিলেননা বোধহয় ,তাই আমার কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারেননি Wink)। কিন্তু কোন কুক্ষণে যে হাসিমুখে বলেছিলাম আংকেল ,আপনার বাড়ি তো চট্টগ্রাম ,না ? অমনি শুনতে পেলাম ,”ওমা ,ছ ছাই খারবার ,তোয়ার ঘর খন্নান্দি” (দ্যাখ দেখি কান্ড ,তোমার বাড়ি কোথায়)? অথচ তখন পর্যন্ত আমি একবারও আমার বেত্তান্ত বলিনি ।তারপর পরিচয় দিতে ওসব বইঙ্গাদের(বৈদেশিদের ) ভাষা লাটে উঠে গেল ,এরপর থেকে আমাকে আমার আনাড়ি চাঁটগেয়ে এলেম নিয়েই পুরো সময়টা কাজ চালাতে হয়েছিল ।

তবে সত্যি কথাটাই বলি ,ক্লাস টেস্ট ,সেশনাল, অ্যাসানমেন্টের গ্যাড়াকলে যখন পেরেশান হয়ে পড়ি ,ইটপাথরের ঢাকার ঠাস বুনোটে মনটা যখন ভীষন রকম হাঁসফাঁস করতে থাকে ,নীলক্ষেতের জনাকীর্ণ রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমি যখন বাটালি হিলের ছায়াঘেরা রাস্তার ভাবালুতায় বিভোর থাকি ,তখন আচমকা শুনতে পাওয়া “ওয়া ,কেন আছ ,গম আছনি??” ,কথাগুলো শুনতে নেহায়েত মন্দ লাগেনা ।

Sunday, August 8, 2010

খাগড়াছড়ির পথে-১





রাঙ্গামাটির মাটি লাল রঙের কিনা জানিনা,বান্দরবানে বাঁদরদের বান ডাকে সেটাও হলফ করে বলা যাবেনা,কিন্তু খাগড়াছড়িতে যে নল-খাগড়া এন্তার দেখা যায়,সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মেলা আগে নাকি খাগড়াছড়ির বুক চিরে বয়ে যাওয়া চেঙ্গি নদির দুপাশে ঘন নল-খাগড়ার বন ছিল, আর সেই থেকেই নাকি খাগড়াছড়ি নামটা কল্কে পেয়েছে। পাহাড়ি ঝর্নার জল জমা হলে পরে তাকে বলা যায় ছড়ি,এমন ছড়ি খাগড়াছড়িতে মিললেও মিলতে পারে বৈকি। যাকগে, ওসব জ্ঞানগর্ভ আলাপ থাক, বলছিলাম খাগড়াছড়ি ভ্রমণের কথা। সফরটা আদপেই একেবারে ঝটিকাগোছের ছিল, বলা যায় অনেকটা দুম করেই আমরা এক ঘনঘোর বর্ষার দিনে বেরিয়ে পড়েছিলাম খাগড়াছরির পানে।

তখন বেমক্কা মিলে যাওয়া একটি ছুটিতে বন্ধুরা সব চাঁটগায়। হাতে অফুরন্ত অবসর,বেলা করে ঘুম থেকে উঠে, বিকেলে ফুটবলে কষে লাথি হাঁকিয়ে আর রাত্তিতে রাজা-উজির মেরেই দিন গুজরান করছিলাম। হঠাত মাথায় ভূত চাপল কোথাও ঢুঁ মেরে আসার। গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত হল খাগড়াছড়িই যাওয়াই সই, ওদিকটায় একদমই ঢুঁ মারা হয়নি। পরদিন ভোরবেলা রওনা দেওয়ার কথা , কিন্তু আমরা একেকজন কুড়ের বাদশা, বিছানায় ওপাশ এপাশ করে, বিকট স্বরে বাজতে থাকা অ্যালার্মঘড়িকে কড়কে দিয়ে যখন আমরা চোখ ডলতে ডলতে বাস-স্টেশনে এসে পড়লাম , তখন ঘড়ির কাঁটা নটা ছুঁই ছুঁই। তবে আকাশের গোমড়ামুখো সুরত দেখে মনটা দমে গেল, তার ওপর বাঁধল নতুন বিপত্তি। শুনলাম খাগড়াছড়িগামী একমাত্র বিরতিহীন বাসটাকে আমরা অল্পের জন্য মিস করেছি। ওদিকে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, আর লোকাল বাসের হেলপাররা অক্লান্তভাবে কর্ণপ্রদেশে "আঁইয়ুন, আঁইউন, বাস ছাড়ি যারগই" বলে হাঁকডাক শুরু করে দিয়েছে। কী আর করা, কা তব কান্তা বলে শেষমেশ ওই লোকাল বাসই ভরসা। আর সিটটাও পড়েছে একেবারে বেকায়দা জায়গায়, সামনের রাস্তায় ঝাঁকুনির কথা ভেবে তখন থেকেই আমাদের মধ্যে দুর্বলচিত্তদের মুখ পাংশুটে হয়ে গেল। ওদিকে তখন বৃষ্টি বেশ ভালভাবে জেঁকে বসেছে, তবে ফটিকছড়ি পেরুনোর পর চারপাশের প্রকৃতি বদলে যেতে লাগল। বর্ষার সবুজে ছাওয়া সদ্যস্নাত বন দেখে মনে হল বাস থামিয়ে নেমে পড়ি। এভাবে একে একে বিভিন্ন এলাকা ছাড়িয়ে মানিকছড়ি এসে পৌঁছুলাম। এরপর পথ রীতিমত শ্বাসরোধকরা, বারবার পাক খেয়ে উপরে উঠে গেছে, কখনোবা এঁকেবেঁকে নিচে নেমে গেছে ।এরমক খাড়া নিচের দিকে নেমে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝেই কানের দুপাশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আগেই বিভিন্ন "শুভানুধ্যায়ীরা" বাঁকা হাসি হেসে বলেছিল, রাস্তা তো খুব একটা সুবিধের নয় হে, অসব রাস্তায় হামেশাই দুর্ঘটনা ঘটে। আমরাও তখন তুড়ি মেরে বলেছিলাম আরে ছোহ! এসবের থোড়াই কেয়ার করি, এ আর এমন কি ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে পরে মনে হয়েছিল, আমরা না হয় পেছনের সিটে উটপাখির মত মাথা গুঁজে চোখটোখ বন্ধ করে দিব্যি থাকতে পারি, তবে এসব হতচ্ছাড়া পথে গাড়ি হাঁকানোর জন্য ড্রাইভার ব্যাটাদের এলেমদার হতে হয় বৈকি, একটু অসাবধান হলেই একেবারে খাদে পড়ে স্বর্গপ্রাপ্তি নিশ্চিত। এসব করতে করতে হঠাত চোখ কচলে দেখলাম ,আরে ওই তো বড় বড় করে লেখা "আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র"। তবে লটবহর নিয়ে আমরা সে যাত্রায় আর নামলামনা, সামনের পর্যটন মোটেলেই আস্তানা গাঁড়বো বলে মনস্থ করা হল। তবে সেখানে গিয়ে দেখি পুরো মোটেল খা খা করছে, আর একজন লোক কাউন্টারে বসে তেরা মেরা ইয়ার না কি জানি একটা হিন্দি গানে মশগুল। বারকয়েক গলা খাঁকারি দেওয়ার পর তার মর্জি হল, আমরা যথাসম্ভব বিনীত স্বরে বললাম, আমাদের থাকার বন্দোবস্ত দরকার, তবে তার আগে পেটপূজো না করলেই নয়। ওদিকে রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখি সেখানেও গুটিকয়েক মাছি ছাড়া পুরোটাই ফাঁকা, অনেক হাঁকডাকের পর কে জানি এসে জানাল, খাবারের কিঞ্চিত দিরং আছে। এহেন পৈশাচিক ভ্রমণের পর এই স্তোকে আমাদের কেউ কেউ হল অগ্নি, আর বাকিরা শর্মা। সাথে সাথে প্ল্যান চেঞ্জড, এখন শরে যাওয়াই সই। বাইরে এসে অবশ্য খিঁচড়ে থাকা মেজাজটা কিছুটা শান্ত হল, পাশ দিয়ে দেখলাম বেশ সুন্দর একটা নদী, নামটা অবশ্য বিতিকিচ্ছিরি কিসিমের-চেঙ্গি। ওখান থেকে ব্যাটারিচালিত শম্বুকগতির টমটমে করে শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা।


খাগড়াছড়ি শহরটা একেবারেই ছোট, আর তাই খুঁজেপেতে একটা চলনসই গোছের হোটেলে উঠে আমরা একটা জবরদস্ত উদরপূর্তি করলাম। তারপর খানিক গড়িয়ে যখন শহরটা ঢুঁ মারতে বের হলাম, তখন দুপুর গরিয়ে গেল বলে। বর্ষার দিন,মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সূর্য মাঝেমাঝেই ঘাই মেরে যাচ্ছে। তবে ভাগ্যদেবী এযাত্রায় সহায় হলেন , উটকো বৃষ্টি বাগড়া দিলে সেদিনকার প্লেন কেঁচে গন্ডুষ হয়ে যেত। ততক্ষণে বেলা বয়ে সেছে, তাই আলুটিলা প্রজেক্টে সেদিনকার মত ইস্তফা দিয়ে সাব্যস্ত হল এরপরের গন্তব্য শহরের ঠিক বাইরের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র। জায়গাটা ছিমছাম, পরিপাটি করে সাজানো। বেশ কজায়গায় দেখলাম লোভনীয় পেয়ারা-কামরাঙ্গা-আমড়ার গাছ। বড় বড় করে লেখা, "ফল ছিড়তে বারণ করা হল- আদেশক্রমে কতৃপক্ষ"। কিন্তু আমাদের মত বিটকেলেদের কাছে ব্যাপারটা হয়ে গেল পাগলকে সাঁকো নাড়াতে নিষেধ করার মত।


ঐ কেন্দের ভেতরেই আবার ছবির মত সুন্দর কিছু জলাধার। সকালের বৃষ্টিতে পুরো পথ ভিজে কাদাটে হয়ে আছে- এর মাঝে আলগোছে পথ চলতে হচ্ছিল। কিছুক্ষণ থেকেই কী একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে আসছিল- ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে গিয়ে বুঝলাম পুকুরপাড়ের কাঁঠাল গাছের নিচে কাঁঠাল পচে অমন বিদঘুটে গন্ধ ছড়িয়েছে, ভাত ছড়ালে যে কখনো সখনো কাকের অভাব হয় সেটাও বুঝলাম। পানি দেখে আমাদের কারো কারো গা কুটকুট করতে লাগল, ওদিকে পড়ন্ত বেলার রোদও বেখাপ্পাভাবে চরে বসেছে, জলকেলি করার জন্য নিঃসন্দেহে প্রশস্ত সময়। তবে পরিপাটি বস্ত্রাচ্ছাদিত হওয়ায় সেদিনকার মত এ প্রস্তাব মুলতবি রাখতে হল।

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...