আসলে জীবন মানেই শৈশব; জীবনভর
মানুষ এই একটা ঐশ্বর্যই ভাঙ্গিয়ে খায়, আর কোনো
পুঁজিপাট্টা নেই তার।
মাহমুদুল হকের এই কথাটা আজ যেন বার বার ফিরে
এসেছিল শাহাদুজ্জামানের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডায়। শাহাদুজ্জামান এই সময়ের অন্যতম প্রধান
সাহিত্যিক, তার সাহিত্যকর্ম নিয়েই কথা বলার রসদ রয়েছে বিস্তর। তবে বইপড়ুয়ার সঙ্গে
শনিবারের আড্ডায় শাহাদুজ্জামান হয়ে পড়লেন স্মৃতিমেদুর, ফিরে গেলেন শাহজিবাজার থেকে
শুরু করে খাকি চত্বরের খোয়ারির সেই দিনগুলোতে, বিদ্যুচ্চমকের মতো ফিরে এলো
চলচ্চিত্র সংসদের সেইসব দিন। সঙ্গে নিজের সাহিত্য দর্শনের কথাও উঠে এসেছে
প্রাসঙ্গিকভাবে, পাঠক তাতে পেয়েছেন ভাবনার অনেক খোরাক।
শাহাদুজ্জামান তাঁর বেড়ে ওঠার দিনগুলো নিয়ে
আগেও কথা বলেছেন কিছু আড্ডায়। ক্যাডেট কলেজের দিনগুলো নিয়ে আস্ত একটা বই-ই আছে
তার। তবে আজ অনেক দিন পর নিজের শৈশবের সেই নদীতে অবগাহন করলেন পরমানন্দে। প্রকৌশলী
বাবার কর্মসূত্রে শৈশব কেটেছে নানা জায়গায়। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায়, খুলনায়, বরিশালে
ছিলেন একসময়। তবে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটে আছে হবিগঞ্জের শাহজিবাজারের স্মৃতি।
পাহাড়ঘেরা এই জনপদে কাটিয়েছেন শৈশবের সোনালী কিছু সময়। শাহজিবাজার একটা সময়
একেবারেই নিস্তরঙ্গ পাহাড়ি জনপদ ছিল, তবে পাওয়ারপ্ল্যান্ট হওয়ার পর থেকে বদলে যায়
দৃশ্যপট। শাহাদুজ্জামানরা তখন সেখানে বসবাস শুরু করেন। তবে যান্ত্রিকতার দাপটের
পরও প্রকৃতির সান্নিধ্য বেশ ভালোমতোই পেয়েছেন। শেয়াল, বাগঢাশ দেখেছেন কাছ থেকে,
পাহাড়ে পাহাড়ে ঘরে বেরিয়েছেন। পাগলা মেলায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা মানুষ
দেখেছেন। তার একটা মুরগির খামারও ছিল
সেখানে। এই শাহজিবাজার থেকেই দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, শকুনের নখর এখনো মনে
দাগ কেটে আছে তার। যুদ্ধের সময় একটা কক্ষে অন্তরীণ হয়ে ছিলেন অনেক দিন। জগতের
বীভৎসতার সঙ্গে পরিচয়ও তখন থেকে।
এই স্মৃতিচারণের মধ্যেই অবশ্য লেখক হিসেবে তার
বেড়ে ওঠার গল্পও এলো। বাবা প্রকৌশলী হলেও সুকুমারবৃত্তি চর্চা করতেন ভালোমতোই।
শাহাদুজ্জামানের ভাষায়, ‘আমার বাবা ছিলেন আসমানদারি মানুষ, খুব মিনিয়েচার
লেভেলে টোটাল মানুষ হওয়ার চেষ্টা ছিল। মূল চেষ্টা ছিল লেখার, সাহিত্যের পাঠক
ছিলেন। গান করতেন। ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। জীবন হচ্ছে একটা আনন্দের ব্যাপার। এই
ব্যাপারটা দেখতাম তার ভেতর আনন্দের কমতি ছিল না। পড়তে পড়তে বিরক্ত হলে গান শুরু
করতেন। খুলনায় সরকারি কোয়ার্টারে একবার প্ল্যান করলেন ওয়াল পেইন্টিং করবেন। সেই
ছবিটা এখনো আছে।’
ক্যাডেট কলেজে যখন পড়তেন, তখনও যে লিখবেন এমন কিছু ভাবেননি
শাহাদুজ্জামান। পড়তেন প্রচুর, একই সঙ্গে আগ্রহ ছিল বিতর্ক আর বক্তৃতায়। তবে লেখার
ঠিক ঝোঁক ছিল না। ক্যাডেট কলেজের দেয়ালপত্রিকা বা ম্যাগাজিনেও সেভাবে লেখেননি
কখনো। ওই সময় বাংলা রচনা লিখতে হতো স্কুলের পরীক্ষায়। সেখানে একটা রচনার বিষয়
ছিল-তোমার জানালা থেকে। ক্লাসের কেউ তা চেষ্টা করেননি। তবে শাহাদুজ্জামান প্রেরণা
নিয়েছিলেন বাবার একটা গল্প থেকে। তাঁর বাবা লেখালেখি করলেও সেগুলো প্রকাশে খানিকটা
কুন্ঠা ছিল তাঁর। শাহাদুজ্জামান যেমন বলছেন,
তাঁর গল্পটা ছিল লেখক হতে চাওয়া একজন মানুষের চন্দ্রযাত্রার। সেখানে তার
সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বিভূতি, শরৎ, মানিকসহ অনেকের দেখা হয়। বাবার সেই
গল্প থেকে পাওয়া আইডিয়া রচনায় ব্যবহার করে শিক্ষকদের চমৎকৃত করেছিলেন
শাহাদুজ্জামান।
এই প্রসঙ্গেই এলো রফিক কায়সারের কথা। এই শিক্ষকের কথা আগেও অনেক
জায়গায় বলেছেন শাহাদুজ্জামান। ডেড পোয়েটস সোসাইটির জন কিটিংয়ের মতো ইনিও কিশোর
শাহাদুজ্জামানের মনে বুনে দিয়েছিলেন সাহিত্যের জন্য সত্যিকারের ভালোবাসার বীজ,
সামনে খুলে দিয়েছিলেন বিশাল একটা জানালা। কিশোর ফটিকের মনস্তত্ব থেকে
শাহাদুজ্জামান রফিক কায়সারের হাত ধরে ঘুরে এসেছিলেন বিশ্বসাহিত্যে। ইনিই বলেছিলেন,
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্পকার হিসেবে কমলকুমার মজুমদারের কথা। সেই বয়সে
কমলকুমার শাহাদুজ্জামান কেন, তার আশেপাশের মানুষের কাছেও প্রায় অজ্ঞাত ছিলেন। ধীরে
ধীরে কমলকুমারের হাত ধরে অন্য একটা জগতে ঢুকে পড়লেন লেখক।
এই প্রসঙ্গেই ধীরে ধীরে এলো সুবিমল মিশ্রের নামও। এই নিরীক্ষাধর্মী
লেখকের পাঠককুল সীমিত হলেও তার মধ্যে ছক ভেঙে নতুন কিছু করার চেষ্টা ছিল।
শাহাদুজ্জামান বলছেন, আরও অনেক বাংলাদেশি লেখকের মতো কলকাতার লেখকদের নিয়ে গদগদ
ভাব তার ছিল না। অনেকবার কলকাতায় গিয়েও তারকা কোনো লেখকের সঙ্গে আলাদা করে দেখা
করার তাগিদ অনুভব করেননি। শুধু সুবিমল মিশ্রর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য একবার কলকাতা
ছেড়ে গিয়েছিলেন দূরে আরেক জায়গায়, যেখানে একটা গ্রাম্য স্কুলে সুবিমল মিশ্র
পড়াতেন। সেই সাক্ষাৎকারের স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল শাহাদুজ্জামানের মাথায়।
এলো চলচ্চিত্র সংসদের গুরু মোহাম্মদ খসরুর কথাও। বাংলাদশের বিকল্প ধারার
চলচ্চিত্রের এই পথিকৃতের সঙ্গে একসময় অনেকটা সময় কাটিয়েছেন শাহাদুজ্জামান।
জানাচ্ছেন, ‘খসরু ভাই-ই প্রথম আর্লি সিক্সটিজে বাংলাদেশ ফিল্মস সোসাইটি করেন।
ওয়াহিদুল হক ছিলেন তার সঙ্গে। তিনি গানবাজনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর খসরু ভাই পরে
সেটি চালিয়েছেন। এককভাবে এই চলচ্চিত্র সংসদ তৈরি করার কাজ করেছেন। ফিল্ম যে ক্রিটিক্যাল চর্চার ব্যাপার, উনি সেটা বিশ্বাস
করতেন। প্রথম উনি ফিল্ম ট্রেনিং শুরু করলেন। সতীশ বাহাদুরকে আনলেন ভারত থেকে। ছবি
যোগাড় থেকে শুরু করে লেখা করেছেন অনেক কিছু। যেমন
সূর্যদীঘল বাড়ি যখন হলো, শাকের ভাই (মসিহউদ্দিন শাকের, পরিচালক) একেবারে খসরু ভাইয়ের হাতে
তৈরি।’
আবার মোহাম্মদ খসরুর কাছে ভালো কাজ নিয়ে আপসহীনতার দীক্ষাও পেয়েছেন।
মিথ্যে স্তোক নয়, সব সময় সরাসরি কথা বলেছেন খসরু। কাউকে কাজ নিয়ে খোসামোদ
করেননি, সেজন্য কটুভাষী হিসেবেও দুর্নাম ছিল তার। শাহাদুজ্জামান এখন বলছেন, এই
নির্মোহ থাকার অভ্যাসটা লেখক হিসেবেও জরুরি। পাঠকের মন যোগানোর জন্য নয়, তাদের মন
জাগানোর জন্যই লেখককে হতে হবে আপসহীন। পাঠকের রুচিকে অনুসরণ করার চেয়ে তৈরি করাটাই
তার কাছে আগে। সেজন্য নিজের লেখায় গতানুগতিক পাঠকপ্রিয়তার কথা না ভেবে নিজের
কথাগুলো বলতে চেয়েছেন আগে। সেজন্য তিনি কমলকুমার বা সুবিমলের সাহসের তারিফ করেন।
তবে সবিনয়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন, তিনি তাদের কারও মতোই হতে চাননি। তাদের ভাবনাটা
ধারণ করেছেন, অনুসরণ করেননি। সেজন্য লেখা্লেখি সবসময় তার কাছে ম্যারাথন রেসের মতো,
একশ মিটার স্প্রিন্ট নয়। তিনি যেটা বলতে চেয়েছেন, সেটাই সময় নিয়ে লেখার মাধ্যমে
জানাতে চেয়েছেন। জীবানন্দের মতো অত তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাননি।
এভাবেই চলতে থাকে আড্ডা। বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের তুলনা,
বাংলা সাহিত্যের নিরীক্ষা, মহামারী নিয়ে সাহিত্য এসব প্রসঙ্গ এসেছে। কেন সিনেমা
লেখালেহির চেয়ে সহজে মানুষের দুয়ারে পৌঁছে যেতে পারে, সেই আলোচনা এসেছে।
বাংলাদেশের সিনেমা যে বাজেট নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতার অভাবেই বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে
নিতে পারছে না- নিজের এই বিশ্বাসের কথাও বলেছেন শাহাদুজ্জামান। করোনার এই সময়ে সাহিত্যের ভূমিকা নিয়েও কথা
হয়েছে। এই ক্রান্তিকালে পেশাগতভাবে নিজের ব্যস্ত ভূমিকার কথাও বলেছেন সন্তর্পণে।
তবে সবকিছুর পর আরও অনেক বিষয় নিয়ে কথাই হয়নি। বইপড়ুয়ার নজরুল সৈয়দ, হিল্লোল দত্ত
ও সুহান রিজওয়ানের সঙ্গে পরের আড্ডায় হয়তো শাহাদুজ্জামানের সঙ্গে এমন আরও কয়েকটি
বিহবল ঘন্টা কাটবে- আপাতত সেই আশা করতে দোষ নেই।