Sunday, November 15, 2020

'জানি তুমি অনন্য'

 


সৌমিত্র কেন অনন্য?

উত্তরটা এক দিক দিয়ে সহজ। চারমিনার ঠোঁটে প্রদোষ চন্দ্র মিত্র থেকে কেতাদুরস্ত, চোস্ত অসীম;  ধূর্ত চতুর ময়ুরবাহন থেকে বিভূতিভূষণের মানসপুত্র অপু; এদিকে আদর্শবাদী শিক্ষক উদয়ন পন্ডিত থেকে ওদিকে প্রেমাতুর অমল; এমন ভার্সেটাইল কজন বাঙালি অভিনেতাই বা ছিলেন? উত্তম কুমার সব সময় বাঙালির স্মার্টনেসের ধ্রুবক, সেদিক থেকে চিন্তা করলেও সৌমিত্র অনন্ত চরিত্রের বৈচিত্র্যে পাল্লা দিতে পারবেন উত্তমের সঙ্গে। কিন্তু সৌমিত্র ঠিক এই কারণেই কি অনন্য? ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে।

সৌমিত্রের ক্যারিয়ারের শুরুটাই এমন একজনের হাত ধরে, যার জন্য বাকিদের অনেকটা আলাদা হয়ে গেছেন ওখানেই। সত্যজিৎ রায়ের চোখ ছিল আর দশজন বাঙালির চেয়ে আলাদা, মননে আর মেধায় ছিলেন ক্ষণজন্মাদের একজন। জহুরির চোখে হীরে কদর করতে জানতেন, সৌমিত্রকে দেখে বুঝেছিলেন এই ছেলেকে দিয়ে হবে। সৌমিত্র নিজেও অনেক কাঠখড় পুড়িয়েই অভিনয়ে এসেছিলেন। নিজের শীর্ণকায় চেহারা নিয়ে ছেলেবেলা থেকে একসময় হীনমন্যতায় ভুগতেন। মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে সেই বাধা পার করেছেন, যদিও অনায়াসেই পরে তাকে সুদর্শন বলা যেত। তবে বাঙালির মেয়েদের স্বপ্নের পুরুষ উত্তমকুমার হতে না পারলেও সৌমিত্র নিজের জায়গাটা দাঁড় করিয়েছেন সহজাত অভিনয়-মেধার জন্য। যে মেধার জন্য অপু হয়ে যখন তিনি ইন্টারভিউ দিতে যান, তখন প্রশ্নকর্তার উত্তর শুনে জবুথবু হয়ে উত্তর দিতে গিয়ে স্ক্রিপ্টের বাইরে বাড়তি একটা ঢোকও দেন। আর সেই ইম্প্রোভাইজেশন দেখে দূর থেকে মুচকি হাসিতে সত্যজিত তারিফ করে ওঠেন। চরিত্রের ভেতর ঢুকে যাওয়ার এই ব্যাপারটা ছিল মজ্জাগত। অনেক অভিনেতারই সেটা থাকে অবশ্য। তবে সৌমিত্রের মধ্যে একটু বেশিই ছিল।

সাধারণত বিখ্যাত গল্প থেকে ছবি করলে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয় না সবসময়। পথের পাঁচালি বা অপরাজিতের বই হিসেবে যে আসন, রূপালী পর্দায় সেটা দেখানো ছিল আরো বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ নেওয়া সত্যজিতের মতো জিনিয়াসের পক্ষেই ছিল সম্ভব। তবে অপুর চরিত্রটার জন্য সত্যজিতের এমন একজনের দরকার ছিল, যেন বাঙালির কল্পনার পটে আঁকা ছবিটাই যেন চলে আসে সিনেমার ফ্রেমে। সেখানে সৌমিত্র একেবারে লেটার মার্ক পেয়ে পাশ। অপুর যৌবন থেকে মধ্যবয়স অবদি সংগ্রামটা সৌমিত্রের ক্যারিয়ারের বড় একটা পরীক্ষা ছিল, সেটার জন্য কম ঘাম ঝরাতে হয়নি তাকে।

তবে চ্যালেঞ্জের মুখে সত্যজিত তাকে দাঁড় করিয়েছেন বার বারই। অটোমেটিক কাস্ট হয়ে ওঠার পরেও গুপি গাইন বাঘা বায়েনে প্রিয় চরিত্র তাকে দেননি, আবার ঠিক কল্পনার ফেলুদা না হওয়ার পরও সত্যজিৎ আস্থা রেখেছিলেন সৌমিত্রের ওপর। অরণ্যের দিনরাত্রির অসীম বা চারুলতার অমলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে দৃশ্যত সৌমিত্রকে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি, শহুরে মধ্যবিত্তের সেই চরিত্রের সঙ্গে মিশে গেছেন সহজেই। কিন্তু অশনী সংকেতের গঙ্গাচরণের গ্রাম্য চরিত্রের জন্য তাকে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছিল। আবার অভিযানের নরসিং চরিত্রটাও বেশ আন্ডাররেটেড, খ্যাপাটে ড্রাইভারের ভূমিকায় সৌমিত্র যেন অনেকটাই পালটে ফেলেছিলেন নিজের খোলনলচে। ঝিন্দের বন্দির ধুরন্ধর ময়ুরবাহনের ভূমিকায়ও যে নিজেকে এভাবে বদলে ফেলবেন, সেটা কে ভেবেছিল?

সৌমিত্র আসলে এ কারণেই অনন্য। নিজের একটা অন্তর্ভেদী আর অনুসন্ধিৎসু মন তো ছিলই, সেটা আরও বেশি ধারালো হয়েছে সত্যজিতের সঙ্গে এসে। প্রিয় মানিকদাকে নিয়ে আস্ত একটা বই-ই লিখে ফেলেছেন, সত্যজিতও এই বুদ্ধিমান মেধাবী যুবককে দারুণ পছন্দ করতেন। তবে তার বাইরে তপন সিংহ থেকে বাণিজ্যিক পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন অক্লেশে। কিন্তু সবখানেই নিজের মেধার একটা ছাপ রেখে যেতেন। মধ্যবিত্ত বাঙালির যে গর্ব করার জায়গা, সেই শিক্ষা আর প্রজ্ঞার দ্যুতি ছিল তার চোখেমুখে আর চলনেবলনে। বাঙালির স্বপ্নের পুরুষ না হোন, তাই হতে পেরেছেন পাশের বাড়ির মেধাবী ছেলেটি। আর এখানেই ছিলেন আর দশজন অভিনেতার চেয়ে ব্যতিক্রম। সেজন্যই প্রিয় সহঅভিনেত্রীর নাম জানতে চাওয়ার সময় ভেবে বলেছিলেন, ‘আমি জানি সবাই সুচিত্রা বা অপর্ণার নামই হয়তো আশা করবেন, তবে আমি বলব অভিযানে ওয়াহিদা রেহমানের কথা। ওরকম একটা চরিত্র কজন করতে পারে?’ এমন উত্তরই বা কজন অভিনেতা দিতে পারেন?

সৌমিত্র তাই এক ও অদ্বিতীয়, চে গুয়েভারার উত্তমের পাশে বাঙালির ফিদেল কাস্ত্রো।

 

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...