Sunday, February 27, 2022

ঢাকার প্রেম


 ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি, অসিত আর হিতাংশু; ঢাকায় পুরানা পল্টনে, উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা, সেই পুরানা পল্টন, সেই মেঘে-ঢাকা সকাল!’
 
কয়েকটা লাইনেই মনটা কেমন নস্টালজিক হয়ে ওঠে, তাই না? যেন একসঙ্গে ভীড় করে আসতে থাকে ধোঁয়া ধোঁয়া সেই পুরনো প্রেমের ছবি। বুদ্ধদেব বসুর ‘আমরা তিনজন’ গল্পের এই শুরুটা শুধু বাংলা সাহিত্যের-ই নয়, ঢাকার ইতিহাসেরও অংশ হয়ে গেছে। ঢাকার প্রেম বললেই তাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরনো পল্টনের সেই তিন প্রেমিকের ছবি। সবাই একসঙ্গে প্রেমে পড়েছিল অন্তরা নামের সেই মেয়ের, শেষ পর্যন্ত তিন জনই হয়ে গিয়েছিলেন ট্র্যাজেডির নায়ক। পুরনো পলটনের বাতাসে তাই আজও ভেসে বেড়ায় তিন প্রেমিকের দীর্ঘশ্বাস।
ঢাকা শহরটা যত পুরনো, প্রেমও ঠিক ততটাই। বুদ্ধদেব বসুর গল্পের তিন প্রেমিক পলটনের মাঠে শুয়ে হারিয়ে যেত ঘোরে। তবে ঢাকার বাতাসে প্রেম কিন্তু নীরবে না, সরবেই এসেছিল অনেক আগে থেকে। মোঘল আমলে ঢাকার নারীরা ছিল কঠোর অন্তঃপুরবাসিনী, পর্দাপ্রথার ভেদ করে পরপুরুষের সাথে চোখাচোখির বেশি কিছুর সুযোগ তখন কমই ছিল। বিশেষ করে অভিজাত মুসলিম পরিবারের হলে তো কথাই নেই। কিন্তু প্রেম কি অতশত বাধা মানে? ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজও তাই প্রেমিক-প্রেমিকাদের ফিসফিসানি ঠিক ঢাকতে পারত না। এর মধ্যেই এক দুইটি প্রেমের গল্প হয়ে থাকে অমর। সেটাও অবশ্য সফল প্রেম নয়, ইউসুফ-জুলেখা বা লায়লী-মজনুর মতো ব্যর্থ প্রেম। আপনি জেনে একটু অবাক হতে পারেন, ঢাকার সবচেয়ে ট্রেডমার্ক খাবার যেটা, সেই বাখরখানির নামই এসেছে একটা কিংবদন্তি ট্র্যাজেডি থেকে।  
 
গল্পটা একটু খোলাসা করে বলা যাক। ঢাকার প্রথম স্বাধীন নবাব ছিলেন মুর্শিদ কুলি খাঁ। তাঁরই দত্তক ছেলে আগা বাকের। বলা যায় বাবার একেবারে যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন বাকের। যেমন মেধায়, তেমনি অস্ত্রবিদ্যায়ও তুখোড়। কিন্তু সেই বাকের প্রেমে পড়ে গেল রাজধানী মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগমের। এই খনি বেগমের সৌন্দর্যের খ্যাতি সেই সময় ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো ঢাকায়। নবাবপুত্র বাকেরও তাই মজে গেল সেই রূপসীর প্রেমে। কিন্তু এই গল্পে এবার হাজির হলো একজন ভিলেন। বউজিরপুত্র নগর কোতোয়াল জয়নাল খানও ছিল খনি বেগমের প্রেমপ্রার্থী।  খনি বেগমকে প্রেমও নিবেদন করে সে-ওকিন্তু খনি বেগম তো আগেই মন দিয়ে বসেছে আরেকজনকে। জয়নাল খানকে তাই বিফল হতে হলো। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে জয়নাল ভাবে, খনি বেগমকে একটা কঠিন শাস্তি দিতে হবে। ঘটনাচক্রে সেটা জানাজানি হয়ে যায়,  আগা বাকের জয়নালকে হুমকি দেয় দেখে নেওয়ার। সেই সময়ে যা হতো, এরপর ঠিক হলো দুজনের তলোয়ারযুদ্ধ হবে। ওদিকে ঘটতে থাকে আরেক কাহিনি। জয়নালের দুই বন্ধু উজিরকে মিথ্যা খবর দেয় যে, বাকের জয়নালকে হত্যা করে লাশ গুম করেছে। উজির নবাবের কাছে গিয়ে বলে, ‘হুজুর আমার ছেলে হত্যার বিচারের বিচারের ভার আপনার কাছেই দিলাম’। নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ ছিলেন কঠিন নীতিপরায়ণ মানুষ। ছেলেকে অপরাধের শাস্তি দেন তিনি, বাকেরকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বাঘের খাঁচায়। কিন্তু বাঘের আর সাধ্য কি তার সঙ্গে এঁটে ওঠার?  বাকেরের হাতে মারা যায় বাঘ। এর মধ্যে ফাঁস হয়ে যায় জয়নালের মারা যাওয়ার মিথ্যা খবর। চতুর জয়নাল ওদিকে খনিকে অপহরণ করে নিয়ে যায় দক্ষিণ বঙ্গে। বাকেরও খবর পেয়ে যান, সত্যিকারের প্রেমিকের মতোই খনিকে উদ্ধার করতে পিছু নেয় জয়নালের। এরপর আবার টক্কর লাগে দুজনের। কুচক্রী জয়নাল খান বাকেরকে হত্যার চেষ্টা করতে গেলকিন্তু উজির এবার নিজে এসে পড়েন। বাকেরকে বাঁচিয়ে নিজের ছেলেকে হত্যা করেন তলোয়ারের আঘাতে। তবে তার আগে জয়নাল তলোয়ার ঢুকিয়ে দেয় খনি বেগমের বুকে, বাকেরের কোলেই ঢলে পড়ে খনি। বাকেরগঞ্জে সমাধিস্থ করা হয় খনি বেগমকে। আর বাকের সবকিছু ছেড়ে রয়ে গেল প্রিয়তমার সমাধির কাছে দক্ষিণ বঙ্গে। বাকেরের নামেই বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ বা এখন যেটা পটুয়াখালি-বরিশাল, সেই অঞ্চলের নাম হয় বাকেরগঞ্জ। আর বাকের আর খনির নাম থেকেই এসেছে বিখ্যাত বাকরখনি, যেটা দিয়ে নাস্তা না হলে পুরনো ঢাকার লোক দের চলেই না।
এই প্রেম নিয়ে অবশ্য কোনো সিনেমা হয়নি। তবে গল্পটা কিন্তু সিনেমা হওয়ার মতোই। ঢাকার প্রেম নিয়ে অবশ্য লেখা হয়েছে অনেক গল্প-উপন্যাস-কবিতা। বুদ্ধদেব বসুর কথা তো বলা হয়েছে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের বিখ্যাত হয়তো গল্পেও এসেছে ঢাকার রহস্যময় প্রেম। এই প্রেমের শুরু ধোলাইখালের ওপর নির্মিত লোহারপুলে। কোনো এক দুর্যোগের রাতে লোহারপুল পাড়ি দিচ্ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। সেই অন্ধকার রাতে দেখলেন শুনশান ব্রিজের ওপর এক পুরুষ ও এক নারী দুই দিক থেকে অতিক্রম করলো পরস্পরকে। প্রেমেন্দ্র মিত্র তাদের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন অন্যরকম একট প্রেম। সেই থেকেই লেখা হলো তার বিখ্যাত গল্প ‘হয়তো’।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের সেই ত্রিশের দশকের ঢাকার প্রেমের সঙ্গে আজকের ঢাকাকে অবশ্য মেলানো যাবে না একদমই। ত্রিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকেও ঢাকা ছিল অনেকটাই শান্ত, নিথর। তখনও ঢাকার অত তাড়াতাড়ি কোথাও যাওয়ার তাড়া ছিল না। হ্যাঁ, সেই সময়ে প্রেম করার মতো নিরিবিলি জায়গার অভাব ছিল না, তবে কাজটা সহজ ছিল না মোটেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীদের সংখ্যা তখন বাড়তে শুরু করেছে। স্বাভাবিকভাবেই যৌবনধর্মের অমোঘ টানে শুরু হয়েছে মন দেওয়া নেওয়ার পালা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক লুকোচুরি করে সেই সুযোগ কিছুটা মিলত বটে, তবে যোগাযোগ করতেও কত হ্যাপা। মোবাইল তো দূরে থাক, তখনকার দিনে ল্যান্ড ফোনও ছিল না ঠিকঠাক। চিঠি লেখা ছাড়া তো গতি নেই প্রেমিক-প্রেমিকাদের, তবে সেই চিঠি দেওয়াটাই হতো মুশকিল। প্রক্টরের মাধ্যমে দিতে হতো চিঠি। একবার তো প্রক্টর যাতে বুঝতে না পারেন, সেজন্য আরবী বিভাগের এক ছাত্রী প্রেমিককে চিঠিই লিখল আরবীতে। সেই চিঠির মর্ম প্রেমিক কীভাবে উদঘাটন করেছিল, সেটা অবশ্য একটা প্রশ্ন।
তবে ঢাকায় তখন আজকের মতো প্রকাশ্যে প্রেমিক-প্রেমিকারা এতোটা ঘুরে বেড়াত না। লোকলজ্জার ভয়টাই ছিল বড়, সেজন্য একসঙ্গে রিকশা ঘরে ঘোরার ক্ষেত্রেও কত সতর্কতা! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাসের ভেতরেই প্রেম করত, কখনো যেত রমনা পার্কে। একটা সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভাবন ছিল এখনকার ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সি গেটে, তার পাশেই ছিল খেলার মাঠ। একটু নিরিবিলিতে প্রেম করার জন্য সেটা ছিল মোক্ষম একটা জায়গা। ষাট বা সত্তরের দশকে এসে আরেকটু শিথিল হয় সামাজিক বিধিনিষেধ, রাস্তাঘাটে প্রেমিক-প্রেমিকাদের আনাগোনাও একটু একটু করে বাড়তে থাকে। তখন অবশ্য হবু প্রেমিকদের অন্যতম গন্তব্যস্থল ছিল নিউ মার্কেট, তন্বী যুবতীরা সেখানেই ভীড় করত বেশি। এখনকার মতো তখন কথা বলার এত সাহস তো যুবকদের ছিল না। কাউকে দেখে পছন্দ হয়ে গেলে কোনোভাবে তার পিছু নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত দেখে আসা- এটাই ছিল অনেক বড় সাহসের কাজ। কাজটা অবশ্য এখনকার যুগের মতো এতোটা কঠিন ছিল না। তখন গাড়িঘোড়া ছিল রাস্তায় কম, ট্রাফিক জ্যামেরও এতো বালাই ছিল না।
এরপর আশি বা নব্বই দশকে এসেও প্রেমের গল্প খুব একটা বদলায়নি। তখন ল্যান্ডফোন মোটামুটি সুলভ হতে শুরু করেছে, সেটা ছিল যোগাযোগের ভালো একটা উপায়। বাসার কড়া নজরদাড়ি এড়িয়ে সেই ল্যান্ডফোনে চলত প্রেমিক-প্রেমিকাদের ফোনালাপ, তবে ধরা হয়ে গেলে একেবারে ফোনে তালা। আর কার্ডফোনের চলও শুরু হয়েছে, সেখানে ঢুকে পয়সা ফেলেও কথা বলা যেত। ওদিকে প্রেমপত্রের মাধ্যমে ভাব বিনিময় তো চলতই। সিনেমার গানের সীমা পেরিয়ে তখন ব্যান্ড সংগীত জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে, প্রেমিক-প্রেমিকারাও হতে শুরু করেছেন আরেকটু সাহসী।
ঢাকার সেই প্রেম হুট করে বদলে যেতে শুরু করে মোবাইল-যুগে এসে। সেই প্রথম ল্যান্ডফোনের বাধা পেরিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকারা হতে শুরু করেছে আরও কাছের। এর মধ্যে ঢাকা আরও বেশি ঠাসবুনোটের হয়েছে, অন্তরঙ্গ আলাপের জন্য জায়গা খুঁজে পাওয়া হয়েছে আরও কঠিন। মুঠোফোন আরও বেশি মানুষের নাগালে এসেছে, কিন্তু কমেছে অভিসারের জায়গা। ভদ্রস্থ প্রেমের জন্য গজাতে শুরু করেছে রেস্টুরেন্ট, প্রেমিক-প্রেমিকারা সেখানেই করতে শুরু করেছে ভীড়। এর মধ্যে মোবাইল যুগ হয়ে গেছে স্মার্ট-ফোন আর ফেসবুকের যুগ। চেকইন আর সেলফি প্রেমকে করেছে আরও বেশি ভার্চুয়াল। কিন্তু এক চিলতে জায়গা খুঁজতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের হতে হয়েছে জেরবারপয়লা ফাল্গুন থেকে ভালোবাসা দিবসে সেই টিএসসিই হয়ে পড়ে লোকে লোকারণ্য। ফেব্রুয়ারিতে অবশ্য আরেকটু সময় কাটানোর সুযোগ মেলে প্রেমিক-প্রেমিকাদের, এটা যে বইমেলার মাস! বইপ্রেমী যুগলরা একসঙ্গে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নেন প্রাণভরে, পরস্পরকে তারা দেন কবিতার বই।
শত ব্যস্ততা, শত নাগরিক ক্লেশে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া এই মনোরম মেট্রোপলিসের বাতাসেও ভেসে বেড়ায় প্রেম। হোক সেটা ফুচকার দোকানে, রিকশার হুডের নিচে বা রেস্টুরেস্টের চেকিনে। প্রতিদিন ঢাকার আয়ু একটু করে বাড়ে, আর বাড়ে তার প্রেমের বয়সও। ঢাকার প্রেম তাই হয়তো বুড়িয়ে যায়, ফুরিয়ে যায় না।
 

 

2 comments:

callhounikerd said...

The Lucky Eagle Casino & Hotel - Mapyro
Find your 울산광역 출장마사지 perfect getaway or getaway at The Lucky Eagle Casino & Hotel in Eagle 당진 출장마사지 Pass, WA. Find out more about 여수 출장안마 The Lucky 대전광역 출장안마 Eagle Casino & Hotel in 양산 출장마사지 Eagle Pass,

bahramkairis said...

Benjamin Moore Titanium: The perfect application for your project
Benjamin camillus titanium Moore Titanium is a ion chrome vs titanium fully functional, titanium iv chloride versatile, high-quality Titanium project titanium trim as seen on tv with an easy-to-use titanium mug device.

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...