অনেক দিন পর একটা জম্পেশ ফেব্রুয়ারি মাস কাটালাম ।সিংহ রাশির জাতকের এবার অর্থভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল কিনা জানিনা ,তবে আমার মাসের শুরুতে বেশ কিছু অপ্রত্যাশিত অর্থসমাগমে পকেটটা কিঞ্চিত হৃষ্টপুষ্ট দেখাচ্ছিল ।কিন্তু ,ঐ যে , সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় ,তাই একবার বইমেলায় যাওয়া শুরু করতেই পকেট মোটামুটি গড়ের মাঠ ।তবে বলতেই হচ্ছে ,শেষ পর্যন্ত কিছু পছন্দসই বই কেনা হয়েছে ,তাই মাস শেষের দৈন্যকে এখন আর খুব একটা গায়ে মাখছি না ।
স্বীকার করতে কুন্ঠা নেই ,বইমেলায় পারতপক্ষে আমি এক্সপেরিমেন্ট করার ধারেকাছ দিয়ে যাইনা ,আরো পষ্টাপষ্টি করে বললে ,নতুন লেখকের বই খুব একটা কেনা হয়না ।কিন্তু এবার অনেক দিন বাদে কয়েকজন আনকোরা লেখকের বই কেনা হল ।আনকোরা কথাটি আসলে পুরোপুরি ঠিক হলোনা , প্রিন্ট দুনিয়ায় তারা নতুন লেখক হলেও ,অন্তর্জালের কল্যাণে ব্লগখোরদের কাছে তারা মোটেই নতুন নন ।তাই মাহবুব আজাদকে ব্লগারদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা খুব একটা আবশ্যক নয় ,হিমু নামেই যিনি সমধিক পরিচিত।বাংলা ব্লগিংয়ে একদম শুরু থেকেই তিনি সমানে দুহাতে লিখে আসছেন ,আর আমার মত চুনোপুঁটি ব্লগারদের কীবোর্ড গুতানো মূলত তার ব্লগ পড়েই শুরু ।বলতে তাই কসুর নেই,পাঠসূত্র থেকে প্রকাশিত লেখকের প্রথম গল্পগ্রন্থ "ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প " কিনতে আমি দুবার ভাবিনি।
এবার গল্পগুলো নিয়ে খানিকটা বলি ।
পুরনো বাড়ি গল্পটি দিয়ে বইয়ের শুরু ।লেখককে আমি ধন্যবাদ দেব এমন একটা গল্প প্রথমেই পাঠকের সামনে হাজির করার জন্যে। গল্পটি আবর্তিত হয়েছে বালক টুলুকে ঘিরে ,টুলুর চোখে আমরা দেখতে পাই স্মৃতিকাতর হাসানকে ।তের বছর কাটানো বাড়িটির প্রতি এক অদ্ভুত ফ্যাসিনেশন হাসানকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফেরে ।গল্পটি শেষতক এক তীব্র বিষাদে আচ্ছন্ন করে আমাকে ,সম্ভবত টুলুকেও।গল্পের শেষদিকে থেকে কিছু লাইন পড়লেই গল্পটির শক্তিমত্তা আরেকটু স্পষ্ট হবে।
“সেই কান্নাও টুলুদের এই নিঃস্ব বাড়ির মত ,তাতে শব্দ নেই ,আছে শুধু স্মৃতিঘাতের শোক,ঐ কান্নাটুকুতে একটা নীলরঙের আকাশে ফুটে ওঠা লাল শিমুলের জন্য বিষাদ আছে ,একটা বুড়ো কৃষ্ণচূড়া গাছের জন্য লালিত ভালবাসা আছে ।একবুক কান্না নিয়ে হাসান নামের লোকটা ওলটপালট হতে থাকে টুলুদের ঘরের মেঝেতে”।
সেতু সঙ্কট ও তোমার ঘরে বাস করে কারা লেখকের অবিশেষণসম্ভব উইটে ভাস্বর ,কতকটা ডার্ক হিউমারেও ।সেতু সংকটে লেখক আমাদের পা-চাটা অর্থলোলুপ পলিটিশিয়ানদের সমানে চপেটাঘাত করেছেন ,অবশ্যই তার স্বকীয় ফর্মুলায় ,তবে ছোটগল্পের আমেজটা যেন ঠিকঠাক আসেনি । তোমার ঘরে বাস করে কারা – সেই অর্থে অনেকটা চটুল গল্প ,লেখক এখানে গল্প নির্মাণের আগাপাশতলা দিয়েও যাননি ,আমাদের গল্পটি বলে গেছেন কেবল ,অনেকটাই পাঠকদের পাতে তুলে খাইয়ে দিয়েছেন বলা চলে ।তবে লেখকের সক্ষমতার বিচারে গল্পটিকে খানিকটা ক্লিশেই বলা চলে ,মাঝে মাঝে ভেল্কির ঝলক দেখালেও তার ছটা খুব প্রখর ছিল ,তা বলা যায়না ।
নিদপিশাচ আক্ষরিক অর্থেই একটি অদ্ভুত গল্প । লাস্যময়ী স্বাগতাকে ঘিরে নাসিমের উদ্ভট কল্পনাকে ঘিরে গল্পের শুরু ,কিন্তু অনেকটা আলটপকা স্যাডিস্ট পরিতোষবাবু তার সর্বগ্রাসী ছায়ায় গল্পটিকে কব্জা করে ফেলেন ,নাসিমকেও ।গল্পটি বোধ হয় যতটা না ফ্যান্টাসিনির্ভর ,তার চেয়েও বেশি মনোদৈহিক ।গল্পটির কলেবরে খানিকটা পৃথুল ,কিন্তু মাঝেমাঝেই মনে হয় কাহিনী একটু টাল খেয়েছে ।তবে একেবারে শেষের লাইনের চমকটা ঠাহর আমি আসলেই করতে পারিনি ,এখানে লেখকের ইশারা আমার এলেমেও কুলোয়নি ।
ব্লগসূত্রে বিলুপ্তি আগেই পড়া ছিল ,না হলে অবধারিতভাবে এটিই আমাকে নাড়া দিয়েছে সবচে বেশি ।কি নির্লিপ্তভাবেই না আমাদের জাতিগত অন্তসারশুন্যতাকে লেখক চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ।হতে পারে এ এক অলীক সময়ের কাহিনী ,হতে পারে তা লেখকের কল্পনাপ্রসূত ,কিন্তু একদিন যে এরকম হবেনা ,তা কি কেউ হলফ করে বলতে পারে ?শেষের লাইন কটি আমি নিশ্চিত পাঠককে একটা সশব্দ নাড়া দেবে –
আকাশে গুলির শব্দ মিলিয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ,যেভাবে এর আগে অনেকগুলি বছরে মিলিয়ে গেছে অনেক প্রতিশ্রুতির ধ্বনি ,প্রতিধ্বনি ।
ম্যাগনাম ওপাস বইয়ের শেষ গল্প ,রকিব ,রমা ও লেখক আনিস চৌধুরীর ত্রিভুজ কেমিস্ট্রি এই গল্পের উপজীব্য ।রমা ও রকিব নিজেদের মধ্যে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ,কিন্তু মজার ব্যাপার হল নাটাইটা লেখক আনিস চৌধুরীর হাতে ,আর তার অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে রকিব আর রমা দুজনেই জড়িয়ে পড়ে এক প্রহেলিকাময় সম্পর্কে ।তবে সবচে মজার ব্যাপার হল ,শেষ পর্যন্ত দুজনমানব মানবীর সনাতনী সম্পর্কের চাইতে নির্বাসিত লেখকের মহাকীর্তির রহস্যই শেষে প্রকট হয়ে ওঠে ।গল্পটি আদপেই অন্য গল্পগুলোর চেয়ে খানিকটা ব্যতিক্রম ।প্লটের অভিনবত্বের কারণে , বা লেখকের কারিশমার কারণেই হোক ,নাম ভূমিকায় গল্পটির স্থান তাই যথার্থই হয়েছে ।
(পাদটীকা : দিনকতক আগে জানলাম ,এবারের বইমেলায় সেরা নবীন গল্পকার হিসেবে মাহবুব আজাদ তার “ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প” বইটির জন্য সিটিব্যাংক আনন্দ আলো পুরস্কার পেয়েছেন ।গল্পগ্রন্থ পড়ার পর আমাকে তাই বলতেই হচ্ছে ,এই পুরস্কার বোধ হয় যোগ্যতমের কাছেই গিয়েছে । )
No comments:
Post a Comment