হলে না থাকার সুবাদে আমাদের বন্ধু সোহাগকে প্রায়ই আজিমপুর থেকে মিরপুরগামী বাসে চড়তে হত ।প্রতিদিনই সে আশা করত কোন ত্বন্বী রমণী ভুবনমোহিনী হাসি হেসে তার পাশের আসনটিতে বসবে ,কিন্তু তার বদনের বেহাল হকিকতের কারণেই হোক ,বা অন্য কোন কারণেই হোক ,তার সে আশা প্রায়ই হত গুড়ে বালি । যাক ,বলছিলাম সোহাগের কথা ।একদিন তার সাথে মিরপুর লিংকে সহযাত্রী হল একজন বুড়োমত লোক ।সোহাগ বেশ মিশুক ,একেবারে আনকোরা মানুষজনের সাথে নির্বিবাদে আলাপ জুড়ে দিতেও সে বেশ পটু ছিল ।তো সেইদিন ,একথা সেকথার পর সে সহযাত্রী ভদ্রলোকের সাথে রীতিমত আলাপ ফেঁদে বসল।মজাটা হল ,বাস থেকে নামার পর ভদ্রলোক সোহাগকে বললেন ,তোমার বাড়ি তো চট্টগ্রাম ,তাইনা ?
পরে যখন সোহাগ আমাদের কাছে তার অননুকরণীয় টিপিক্যাল চাঁটগাইয়া অ্যাকসেন্টে বলল ,”দোস্ত ,লোকটা আমার কথা শুনে কেমনে বুঝল আমি চাঁটগাইয়া ”।আমরা আর কিছু বললামনা ,মুচকি মুচকি হাসতে লাগলাম ।
সোহাগ একটু সরল টাইপের ,তাই বাতচিত করার সময় কথার টান অতটা আমলে নিতনা ।কিন্তু আমাদের অনেককেই এই প্রচন্ড রকম সজাগ থাকা সত্তেও এই অ্যাকসেন্ট লুকোতে কাঠখড় পোড়াতে হয় ,অনেকে আবার একেবারেই পারেনা ।তা না হয় নাই পারল ,কিন্তু মাঝে মাঝে এসব হ্যাপাটা একটু বেশি রকমের হয়ে যায় ।আমাদের আরেক বন্ধুর কথায় ভয়াবহ আঞ্চলিক টান চলে আসে ।সে আবার খুবই সুদর্শন ,পোশাক আশাকেও বেশ ফিটফাট ,কিন্তু যেই মুখ খুললেই বাঝে যত বিপত্তি ।আমরা বলি ,সোহান কথা না বলার আগ পর্যন্ত আমাদের ক্লাসের সবচে স্মার্ট ছেলে ।আর আমাদের প্রথম প্রেসেন্টেশনের পর কথাটা একটু বদলে গিয়ে হল ,সোহান বাংলার চেয়ে ইংরেজি ঢের ভাল বলে ,আর সবচেয়ে ভাল বলে যখন সে কিছুই না বলে ।
তবে বোধকরি ,একঝাক মানুষের মধ্য থেকেও আমাদের চাঁটগাইয়াদের সনাক্ত করতে সনাক্ত করতে বেগ পেতে হয় সবচেয়ে কম ।একেবারে অথেনটিক টান তো আছেই ,তায় আবার প্রতি বাক্যের শেষে বাইডিফল্ট “যে” অনুসর্গ যুক্ত করায় আমরা বুঝে যেতাম ,এ ব্যাটা চাঁটগাইয়া নওজোয়ান ।তাই যতই তুমি ইংরেজিতে তুবড়ি ছোটাও না কেন ,কুট্টিদের মত “আবে চিপায় পড়লাম ” ডায়ালগ দিয়ে বর্ণচোরা সাজার চেষ্টা করনা কেন ,হুঁ হুঁ ,চাঁটগাইয়া হয়েছ তো মরেছ ,একেবারে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় তোমার সব কসরতই মাঠে মারাই যাবে ।
তবে একটু চোখকান খোলা রাখলেই কিন্তু অল্পবিস্তর টান অনেকের কথার মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায়।ব্যাপারটা এমন কোন গুরুতর বা দূষণীয় তো নয়ই –আমি অন্তত মনে করিনা ।আসলে এইসব মানুষের কথা থেকেই চিনে ফেলার ব্যাপারগুলো আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে ।তবে মাঝে মাঝে এজন্য বড়সড় কেলোও হয়ে যেতে পারে ।একবার নতুন টিউশনিতে গেলাম ,আর গিয়েই গৃহকর্তার সাথে একথা সেকথার পর চট করে ধরে ফেললাম ওনারা চট্টগ্রামের ।(উনি আবার অতটা চৌকস ছিলেননা বোধহয় ,তাই আমার কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারেননি Wink)। কিন্তু কোন কুক্ষণে যে হাসিমুখে বলেছিলাম আংকেল ,আপনার বাড়ি তো চট্টগ্রাম ,না ? অমনি শুনতে পেলাম ,”ওমা ,ছ ছাই খারবার ,তোয়ার ঘর খন্নান্দি” (দ্যাখ দেখি কান্ড ,তোমার বাড়ি কোথায়)? অথচ তখন পর্যন্ত আমি একবারও আমার বেত্তান্ত বলিনি ।তারপর পরিচয় দিতে ওসব বইঙ্গাদের(বৈদেশিদের ) ভাষা লাটে উঠে গেল ,এরপর থেকে আমাকে আমার আনাড়ি চাঁটগেয়ে এলেম নিয়েই পুরো সময়টা কাজ চালাতে হয়েছিল ।
তবে সত্যি কথাটাই বলি ,ক্লাস টেস্ট ,সেশনাল, অ্যাসানমেন্টের গ্যাড়াকলে যখন পেরেশান হয়ে পড়ি ,ইটপাথরের ঢাকার ঠাস বুনোটে মনটা যখন ভীষন রকম হাঁসফাঁস করতে থাকে ,নীলক্ষেতের জনাকীর্ণ রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমি যখন বাটালি হিলের ছায়াঘেরা রাস্তার ভাবালুতায় বিভোর থাকি ,তখন আচমকা শুনতে পাওয়া “ওয়া ,কেন আছ ,গম আছনি??” ,কথাগুলো শুনতে নেহায়েত মন্দ লাগেনা ।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
ঢাকার প্রেম
‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...
-
‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...
-
খুব সম্ভবত বাঙালি দর্শকের ফেলুদা নিয়ে সারাজীবনের একটা অতৃপ্তি ছিল, পারফেক্ট ফেলুদা সেভাবে পাওয়া হয়নি কখনো। সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে স...
-
সব কবিদের গদ্য সুন্দর হয় না। কেউ কেউ আছেন যাদের দুই হাতে একসঙ্গে বাজে কবিতা আর গদ্যের যুগলবন্দি। শঙ্খ ঘোষের গদ্যই সত্যিকার অর্থে পড়েছিলাম আ...
No comments:
Post a Comment