Thursday, November 4, 2010

নোলানের খোয়াবনামা

১.

স্বপ্ন নিয়ে কাঁটাছেড়া এ পর্যন্ত নেহায়েত কম হয়নি, কিন্তু সত্যি করে বললে তার কতটুকুই বা আমরা জানি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বলা যায় স্বপ্নের কথা প্রায়ই আমার মনে থাকেনা, আর যেটুকুও মনে থাকে সেটুকুও বোধহয় অনেকটাই আটপৌরে। কোন উঁচু স্থান থেকে নিচে পড়ে যাওয়া, পরীক্ষার হলে সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে অথচ একটি প্রশ্নের উত্তরও ঠিকঠাক দিতে পারছিনা বা কোন কিছু আমাকে তাড়া করছে, আমি ক্রমাগত ছুটছি- এসব স্বপ্নই ঘুরেফিরে আমার ঘুমে হানা দেয়। মজার ব্যাপার হল, আচমকা যখন ঘুম ভেঙ্গে যায় তখনই স্বপ্নটা মাথায় গেঁথে থাকে। একটু তলিয়ে দেখতে গিয়ে জানলাম, আমাদের ঘুমের একটা সুনির্দিষ্ট স্তরেই এই স্বপ্ন দেখার কাজটা ঘটে। এই স্তর আবার ঘুমের মাঝেই বেশ কবার ঘটে থাকে। তো এই পর্যায়ে এসে যখন ঘুমটা কেঁচে যায় তখনই ওই স্বপ্নটা ছাপ রেখে যায়। এজন্যই বোধহয় আমাদের সুখস্বপ্নগুলোর স্মৃতি খুব একটা মনে থাকেনা, অথচ দুঃস্বপ্নের স্মৃতি সবারই কমবেশি থেকে থাকে।

২.

স্বপ্নের নিখুঁত ঠিকুজির সুলুকসন্ধান বিজ্ঞানীরা এখনো ঠিক পাননি, এক্ষেত্রে আবার নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ এমনকিও একথাও ঠাউরে থাকেন, স্বপ্ন আদপে এক ধরনের ঐশীবাণীই বটে। তাদের মতে, স্বপ্নই এক অজানা জগতের সাথে আমাদের যোগাযোগের চাবিকাঠি। এমন দাবি হয়তো অনেকের কাছেই কষ্টকল্পনা ঠেকবে, কিন্তু ওবিই বা আউট অফ বডি এক্সপেরিয়েন্সের কথা মাথায় রাখলে এক লহমায় এ দাবি উড়িয়ে দেওয়া যায়না। অনেকেই হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কাজগুলোর অনুভূতি অনেকসময় স্বপ্নে বেশ প্রকট হয়ে ওঠে। ধরা যাক, আপনি স্বপ্নেই কোন জায়গা থেকে পড়ে যাচ্ছেন, ওই মুহুর্তে কিন্তু আপনার অনুভূতি পুরোটাই ভয়াবহ রকমের জান্তব, অথচ পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু আপনার ঘুমের মাঝেই ঘটছে। দেহ থেকে আত্মার এই সাময়িক বিচ্ছেদের সময় এই ধরনের অভিজ্ঞতার গোমরটা আসলে তাহলে কোথাও? এই প্রশ্নের উত্তরও ব্যাপকই ঘোলাটে, এ বিষয়ে গবেষণা এখনও জোরেসোরে চলছে, তাই বিভিন্ন তত্ত্বের কথা বলা হলেও একেবারে চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা এখনো কোনটি পায়নি। কেউ কেউ বলে থাকেন, আমাদের চেতনা দেহ থেকে ভিন্ন একটি সত্ত্বা বা বলা ভাল দেহবিহীন চেতনা এবং চেতনাবিহীন দেহ দুই-ই সম্ভব। এই জন্যই দেহবিচ্ছিন্ন হয়েও স্রেফ আমাদের চেতনার কারণে আমরা স্বপ্নের মাঝেও স্বাদ, গন্ধ, স্পর্শের মত অনুভূতিও পেতে পারি। তবে এটা একটা থিওরি মাত্র, এরকম এন্তার থিওরি আছে এবং সেগুলো নিয়ে আগাপাশতলা ব্যবচ্ছেদ আজ অবধি জারি রয়েছে। আরেকটা কথা বলে রাখা ভাল, স্বপ্ন পারলৌকিক বা অন্য জগতের সাথে মেলবন্ধনের যোগসূত্র এমনটা যারা ভেবে থাকেন, তাদের মতে স্বপ্ন আসলে জাগরণেরই বিকল্প একটি রুপ। কিন্তু এই যুক্তি খোঁড়া মনে হয় একারণে যে , স্বপ্ন আসলে অবচেতন মনেরই একটা দশা মাত্র, আর স্বপ্নের সময় আমাদের ব্রেইনের সংকেতগুলো এ ধারণাই দেয়।

৩.

একটা মজার ঘটনার কথা বলি। আমাদের এক বন্ধু বলছিল তার স্বপ্নের কথা। মাসতিনেক আগে সে স্বপ্ন দেখে সে কয়েকজন অচেনা ছেলের সাথে একটা হোটেলের কামরায় আড্ডায় মশগুল। ঐ সময় আচমকা তার ঘুম ভঙ্গে যায়। পরে তার রুমমেটকে সে ওই স্বপ্নের বয়ান দেয়। মজার ব্যাপার হল, ঠিক কদিন আগে আমাদের বান্দরবান ট্যুরে ঐ বন্ধুই আরো কজনের সাথে এক কামরায় রাত কাটায়। বলাই বাহুল্য, তাদের পরিচয়টা ওই ট্যুরেই পয়লা ঘটেছিল। স্বপ্নের অলোকদর্শন ক্ষমতার এমন নজির খুব বেশি বিরল নয়। আর এ ধরনের প্রোফেটিক স্বপ্নের জন্যও স্বপ্ন নিয়ে বিভিন্ন উদ্ভট থিওরি হালে পানি পেয়ে যায়। অলোকদর্শন (যদি ব্যাপারটা আসলেই থেকে থাকে) স্বপ্নের একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষংগ, সমস্যা হল নিতান্তই কাকতাল বলে এ ধরনের স্বপ্নকে হয়তো কনফার্মেশন বায়াস বা অন্যকোন পরিসংখ্যানের গেরোয় ফেলে দিয়ে দিব্যি নাকচ করা যায়, তাই বলে ব্যাপারটা কি আদতেই এক লহমায় উড়িয়ে দেওয়া যায় কি?

৪.

বলতে দ্বিধা নেই, স্বপ্ন নিয়ে এসব ভাবনার খোরাক পয়লা পাই গুনী ফিল্মমেকার ক্রিস্টোফার নোলানের সাম্প্রতিকতম ছবি "ইনসেপশন" দেখার পর। প্রেস্টিজ, মেমেন্টো, ডার্ক নাইটের মত বহুল পরিচিত বা ফলোয়িং এর মত স্বল্প পরিচিত সিনেমাগুলো দেখার পর এমনিতেই নোলানের ভক্ত বনে গিয়েছিলাম, তাই ইনসেপশন নিয়ে কৌতূহলের পারদটা খুব চড়াই ছিল। হাতের কাছে পাওয়া মাত্র দেখে ফেলতে তাই কসুর করিনি মোটেই। সিনেমাটি তুঙ্গে ওঠা সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছে কিনা এমন সওয়ালের জওয়াব দেওয়ার আগে স্বপ্ন নিয়ে নোলানের চিন্তাভাবনাটা একটু বলা দরকার। ইনসেপশনের ধারণা নোলান অনেকদিন ধরেই পেলেপুষে বড় করেছিলেন, তবে ঠিক কীভাবে এটাকে ফুটিয়ে তুলবেন সেটা নিয়ে শুরুতে তার মনে একটু দ্বিধাই ছিল। ভাবনাটা দানা বাঁধতে শুরু করে যখন নোলান এমন একটা জগতের কথা কল্পনা করেন যেখানে সবার স্বপ্নগুলো একটি অবিচ্ছিন্ন স্বপ্নরাজ্যে মিশে একাকার হয়ে আছে। সম্পূরক চিন্তা হিসেবে তার মাথায় তখনই আসে, আরে তাই যদি হতো, তবে স্বপ্ন নিয়ে নয়-ছয়ও হতে পারে বৈকি। মোদ্দা কথা হল, ইনসেপশনের মূল যে বুনিয়াদ, অর্থাৎ স্বপ্নচুরির আইডিয়া তখনই তার মাথায় আসে। নোলানের এই স্বপ্নবাজি শুরু হয় ষোল বছর বয়েসে, যখন এক ল্যুসিড ড্রিমের পর তার মাথায় এই চিন্তা আসে। নোলান অবশ্য বলতে কসুর করেননি, বোর্হেসের লেখা পড়ে তিনি এই দুরুহ কাজে হাত দিতে বেশ ভাল রকমের প্রণোদিত হন।

বলা যায়, এই ভাবনা অঙ্কুরিত হতে বেশ সময় নিয়েছে। গোড়ায় তো নোলান ভেবেই রেখেছিলেন ম্যুভিটা হবে ভৌতিক আবহের। কিন্তু হরর ম্যুভিগুলোর সেই চিরকালীন সমস্যা- আবেগ বা অনুভূতিগুলো শেষমেশ খেলো হয়ে যাওয়ার কারণে এই ধারণা থেকে তিনি সরে আসেন। এইখানে অবশ্য আমি নিজে নোলানকে বাহবা দেব, কারণ স্বপ্নের মত একটা দুর্বোধ্য ভাবনা লালনা করার জন্য হরর ব্যাকগ্রাউন্ড আদপেই ঠিক যুতসই হয়না। এভাবে বছর দশেক ব্যয় হয় স্ক্রিপ্টটাকে ঠিকঠাক করে মূল ব্যাপারগুলোকে একসুতোয় গাঁথার জন্যে। এটাও মেলা আগের কথা, ঠিকঠাক বললে ২০০১ সালের দিকে। তবে তখনই ঠিক করেন সিনেমাটা তিনি রয়েসয়ে বড়সড় বাজেট নিয়ে বানাবেন। স্বপ্নে কিন্তু মানুষ এক নিমেষে অসাধ্য সাধন করতে পারে, আর মানুষের মনের ক্ষমতার দৌড় কদ্দুর, তা নিয়ে আজ অবধি কোন সঠিক মাপজোখ পাওয়া যায়না। শেষমেশ নোলান ঠিক করেন, স্বপ্ন নিয়ে কারবার করতে হলে বিশাল একটা স্কেলেই কাজ করা সমীচীন। আজ তাই দীর্ঘদিনের স্বপ্নবাজির ফসল আজকের ২০১০ সালের ইনসেপশন।

৫.

যাই হোক, একজন দর্শক হিসেবে যদি বলি, সিনেমাটা দেখতে গিয়ে কোথাও টাল খেতে হয়নি, পুরো সময়টা জুড়েই রোলারকোস্টারে চড়ার মত একটা টানটান উত্তেজনার স্বাদ পেয়েছি, একথা বলতেই হবে। তবে স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন ব্যাপারটা আমাকে আসলেই তাজ্জব করে দিয়েছে। স্বপ্নের ভেতর আরেকটা স্বপ্নের কথা না হয় মানা গেল, কিন্তু তার ভেতরেই আরেকটা স্বপ্ন? ব্যাপারটা কিঞ্চিত ঠাহর করতে পারতেই আমার মাথায় যে প্রশ্নের উদয় হল, এই দ্বিতীয় স্তরের মাঝেই আরেকটা স্তরও কি অসম্ভব? আদতে নোলান কিন্তু তাই দেখালেন, আর এটাই দর্শকের একটা পেলব অনুভূতির রেশ কাটিয়ে মাথার ভেতর ভাবনার ঝড়ে বইয়ে দেওয়ার নোলানের নিজস্ব কারিকুরি। আর কিছু কিছু ব্যাপার, যেমন স্বপ্নের স্তরগুলোর গভীরতা যতই বাড়তে থাকবে ততই তাদের সময়ের ব্যপ্তিও বাড়তে থাকবে। সোজা কথায় বললে বাস্তবে যখন আমরা ঘুমের যে সময়টুকু নিয়ে স্বপ্ন দেখি, তার স্থায়িত্বকাল কিন্তু খুবই কম। কিন্তু ওই সময়েই স্বপ্নের ব্যপ্তিকাল অনেক বেশি। এ ব্যাপারগুলো মোটামুটিভাবে অনেকের কাছে বোধগম্য, ম্যুভি দেখার সময় কোন জগতটা বাস্তব আর কোন জগতটা স্বপ্নের, আর স্বপ্নের হলেই এর কোন স্তরের এ নিয়ে কোন খটকায় অন্তত আমাকে পড়তে হয়নি। তবে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, স্তরগুলো নিয়ে ঘোরতর কুহক নোলান বুঝেশুনেই এড়িয়ে গেছেন, অন্তত এই ক্ষেত্রে তিনি দর্শককে ঘোল খাওয়াতে চাননি চিনি।

একইভাবে স্বপ্ন ছিনতাই বা স্বপ্নের মাঝে আরেকটা ভাবনার বীজ বুনে দেওয়ার ব্যাপারটাও নোলানীয় কারদানিই বটে। স্বপনের ভেতরকার জগতটাকে গড়ে তোলা ও নিয়ন্ত্রণ করার মত বিটকেলে ব্যাপারগুলোও নোলান আশ্চর্য দক্ষতায় দেখিয়েছেন। সিনেমার কাহিনি মূলত এ নিয়েই, ডমিনিক কবের(লিওনার্দো দি ক্যাপ্রিও) নেতৃত্বে একদল কর্পোরেট স্পাইয়ের স্বপ্ন চুরির মিশনের ওপর ভর করেই কাহিনি এগি্যেছে। বলাই বাহুল্য, ব্যাপারটা এত সরল আর থাকেনা, ধীরে ধীরে এক জটিল আবর্তে তারা সবাই বাঁধা পড়ে যায়। তারপর...থাক, কাহিনির বয়ানে আর না যাই, সে গপ্পো পরেও ফেঁদে বসা যাবে। তবে একটা কথা না বললেই নয়, কাহিনিতে কবের স্ত্রী মলের(ম্যারিওন কোটিয়ার্ড) ভূমিকা শুরুতে খুব একটা প্রকট না থাকলেও শেষমেশ কিন্তু এই চরিত্রটির উপস্থিতি আলাদাভাবে ঠাহর করা গেছে। আর যে বারদুয়েক আমি সামান্য সময়ের জন্য ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম, সেটাও ওই মলকে নিয়ে তৈরি করা ধোঁয়াশার কারণেই।

সত্যি করে বললে , সিনেমাটির অসাধারণ কন্সেপ্ট বাদ দিলে আলাদাভাবে উচ্চকিত হওয়ার খুব বেশি কিছু বোধহয় নেই। সিনেমার একেবারে শেষের দৃশ্যের হালকা রহস্য ছাড়া তব্দা খেয়ে যাওয়া নোলানীয় মোচড়ও দেখা পাওয়া ভার, তবে আমার নিজস্ব খেদ থেকে থাকবে এই কারণে এই দুর্দান্ত আইডিয়াটার শেষটা একটু জোলোই হল। স্বপ্নবাজির ব্যাপারগুলো স্তব্ধ করে দেওয়ার মতই ছিল, থ্রিলটাও ছিল পুরোদমে, কিন্তু ওই যে নোলানীয় সিগনেচারটা ঠিক যেন দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। তবে নোলানের আত্মপক্ষ সমর্থনে কিন্তু এই জিনিসটাই চলে আসে, তিনি অকপটে স্বীকার করেন এই সিনেমা দেখতে গিয়ে দর্শকদের কোন জট না ছাড়ানো জটিল ধাঁধার সন্ধান দেওয়া তার অভিপ্রায় ছিলনা মোটেই। তাই নোলান নিজেই যখন বলেন, সিনেমাটা আসলে একটা রোলার কোস্টার রাইড, আর ব্যাপার আসলে একটাই, রাইডটাকে স্রেফ উপভোগ করা- তখন আমাদের আশায় তিনি আক্ষরিক অর্থেই জল ঢেলে দেন। তবে স্বপ্ন নিয়ে আমার ভাবনাগুলোকে উস্কে দেওয়া জন্য নোলান একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন বৈকি।

ফুটনোটঃ শুরুতে স্থির করেছিলাম, ইনসেপশন নিয়ে একটা গোছানো রিভিউই লিখব, পরে রিভিউ লিখতে গিয়ে পাছে বেরসিক স্পয়লার অ্যালার্টের উটকো খপ্পরে পড়ে যাই, সে চিন্তায় ওই প্রজেক্টে ইস্তফা দেই। শেষমেশ পোস্টটা দাঁড়ালো স্বপ্ন নিয়ে কিছু উড়ুক্কু বাতচিতের গপ্পো।

No comments:

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...