Friday, October 15, 2010

প্রলাপসমগ্র

কেন লিখি? এ সওয়াল পুছতে কোন ঝঞ্ঝাট নেই বটে, কিন্তু উত্তর দেওয়ার হ্যাপা বিস্তর। লেখালেখি কালেভদ্রে যা করি সেগুলো ধর্তব্যের মাঝে পড়ে বলে মনে হয়না, কিন্তু একথা কুন্ঠাহীন চিত্তে স্বীকার করি, লেখার একটা তাড়না প্রায়ই প্রবলভাবে অনুভব করি। হয়তো ঠিক করলাম, কোন একটা বিষয় নিয়ে লিখব, মনে মনে একটা রাফ আউটলাইনও খাড়া করলাম, কিন্তু কোন এক বিচিত্র কারণে কিবোর্ডে আঙ্গুল স্পর্শ করা মাত্রই গতি অস্বাভাবিক রকমের শ্লথ হয়ে পড়ে, একসময় রণে ভঙ্গে দিয়ে উঠে পড়ি। এভাবে কত কিছুইতো অকালেই ঝরে পড়েছে, ড্রাফট হিসেবে খোলসবন্দি হয়ে পড়ছে, বরাত খুব বেশি ভাল না হলে তাদের কারও সহসা আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনাও নেই। লিখতে আমার রাজ্যের যত আলিস্যি, তারপরও উড়ুক্কু লেখাজোখার ভূত মাথা থেকে চট করে নামতেই চায়না। এদিকে সারাদিন খুচরো খাচরা পড়া ঠিকই হয়ে যায়। এক সচলেই আজকাল বেশ খানিকটা সময় বুঁদ হয়ে থাকতে হয়, তায় পত্রপত্রিকা ইত্যাদি মিলিয়ে বেশ খানিকটা সময় পড়ার পেছনেও ব্যয় হয়ে যায়। তারপরও দেখা গেল , কিছুটা সময় স্রেফ লেখার জন্যই বরাদ্দ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু শেষমেশ সেটা আর হয়ে ওঠেনা। আর তাই হপ্তায় হপ্তায় বিশালবপু রিপোর্টের কথা বাদ দিলে ইদানিং লেখার হার একেবারেই শুন্যের কোটায়।

তারপরও কিছুমিছু যে একেবারেই লেখা হয়না তা নয়। মাঝে মাঝে বেমক্কা একটা জোয়ার আসে, সেই জোয়ারের ঠেলায় তখন আপনিই লেখা হয়। তখন লেখার জন্য খোরাকের অভাব হয়না, আর লেখাও এগোয় তরতরিয়ে, একেবারে দাপুটে বেগে উজিয়ে চলে। কিন্তু এই ধাক্কাটা আসে উটকো, কোন জানান না দিয়েই, আর সেটার জন্য হাপিত্যেশই করে যেতে হয়। তারপর আবার যেইকে সেই। আবার ঝিমিয়ে পড়া এবং মাথা খুঁড়ে মরা ছাড়া কিছু করার থাকেনা।

এখন কেউ যদি আচমকা বলে বসেন, উপসর্গ তো রাইটার্স ব্লকের সাথে বিলক্ষণ মিলে যাচ্ছে, তবে আমাকে হারেরে করে তেড়ে আসতেই অবে। এইবেলা বলে রাখা ভাল, ব্যাধি যতই সংক্রামক হোক, এসব সম্ভ্রান্ত ব্যাধি আমাদের মত উন্মার্গিকদের কস্মিনকালে হবে বলে মালুম হয়না। হবেই বা কেন বলুন, আমি আজকে থেকে একবারের তরে কিবোর্ড না চাপলেও এমন কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হবেনা, যে দুচারজন বন্ধুবান্ধব অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে না পেরে পড়ে ফেলে, আর পড়ার পর বাধ্য হয়েই পিঠ চাপড়ে দেওয়ার ভান করে, তারা হয়তো একদুবার তাগাদা দেবে, কিন্তু স্রেফ এ পর্যন্তই। কদিন বাদে কিবোর্ডে ধুলোর স্তর পুরুও হতে থাকবে, এছাড়া আর কোন ইতরবিশেষ হবে বলে মনে হয়না। হাজার হোক, আজতক লেখালেখি নির্ভেজাল আনন্দের রসদ ছাড়া বৈ আর কিছু তো নয়। পারিবারিক হ্যাপা, শারীরিক-মানসিক অবসাদ ইত্যাদিকে যদি লেখালেখির অন্তরায় ধরে নিই, তবে তা হবে নিছক ছেনালিপনা মাত্র।

এই যেমন ধরুন, এই মুহুর্তে করোটিতে একটা গল্পের প্লট ঘুরপাক খাচ্ছে। কাহিনির একটা সরলরৈখিক রুপও খাড়া করে ফেলেছি এর মাঝে, শুরুটাও বোধ হয় মন্দ হয়নি, কিন্তু এরপরই গিয়ে ঠোক্কর খেতে হল, হঠাৎই খেই হারিয়ে ফেললাম। একবার মনে হল, এভাবে লিখি। খানিক লিখেই আবার সেটা মুছে ফেলি। এভাবে কিবোর্ডের ওপর দিয়ে রীতিমত ঝড় বয়ে গেছে, কিন্তু আদপে লাভের খাতায় লবডঙ্কা, যে তিমিরে ছিলাম এখনো সে তিমিরেই আছি। শেষমেশ যেটা হল, এখন গল্পটার ওপরই বেশ একটা অনীহা জন্মে গেছে, যে কাঠামো খাড়া করেছিলাম সেটাকেও জোলো ঠেকছে। কাহিনির চরিত্রগুলোও বেখাপ্পা হয়ে উঠছে, তাদের বাগ মানানো হয়ে পড়ছে নিতান্তই কঠিন। ফলে এই গল্পটাও বোধহয় আঁতুরঘরেই মারা যেতে বসেছে, যদিনা বিলকুল অবাক করা কিছু ঘটে না থাকে।

তবে এর মাঝে সৈয়দ হকের মার্জিনে মন্তব্য পড়ে হালে কিছুটা হলেও পানি পেলাম। সৈয়দ হক যেখানে কুন্ঠাহীন রায় দিয়ে গেছেন- কোটি কোটি গল্প লেখা হয়ে গেছে, সম্পূর্ণ নতুন গল্প নির্মাণ করা আর সম্ভব নয়, সব সম্ভাবনাই শোষিত নির্মমভাবে, তখন মনে হয়, এভাবে গল্পটিকে অকালেই গলা টিপে না মারলেই পারতাম। হাজার হোক, সব নতুন গল্পই যদি হয় নতুন বোতলে পুরাতন মদিরা, তখন সেখানে কোন গল্পের অকালপ্রয়াণ আমায় ব্যথাতুর করে বৈকি।


মাঝে মাঝেই ভাবি ,গল্পের সুলুক সন্ধান লেখকেরা করেন কীভাবে? কী উপায়ে এমন জম্পেশ সব কাহিনির প্রসব হয়? উত্তরটা অনেক সময় আমিই আপনমনে দিতাম , লেখকদের দেখার চোশ আর ভূয়োদর্শনই হয়তো মোক্ষম তফাত গড়ে দেয়। কিন্তু গল্পের শেষের অমন পিলে চমকানো মোচড়, সেটাই বা আসে কী করে? এইখানে বলতেই হবে, স্রেফ টুইস্ট খুঁজতে গিয়ে একসময় বিভ্রান্ত হতাম, মনে করতাম ,এই টুইস্টের ভেতরেই বুঝি গল্পকারের যাবতীয় কেরদানি, তবে সৈয়দ হকের বয়ানে সেই ভ্রান্তির অপনোদন খানিকটা হলেও হয়েছে। শুনুন তবে-

[i]গল্প খোঁজায় যাঁরা বিশ্বাস করেন তারা আসলে দৈবের ওপর নির্ভর করেন, এ কালে যখন অন্নবস্ত্রের জন্যেও দৈবের ওপর মানুষের বিশ্বাস নেই, তখন গল্পের জন্য তার ওপর নির্ভর করাটা নিতান্তই হাস্যকর। [/i]

একথার পর বোধহয় আর কিছু বলা চলেনা। তারপরও নাটকীয়তার প্রতি একটা পলকা মোহ হয়তো অজান্তেই গল্পকারের ভেতর কাজ করে, আর সেই ফাঁদে লেখক বেভুলে পা দিয়ে বসলেই হয় সাড়ে সর্বনাশ।সে যাকগে, এসব কথা ফেঁদে নিজের অক্ষমতা আর আড়াল করতে চাইনা। এখন কেবল অপেক্ষার পালা, আবার হয়তো একটা জোয়ার আসবে, তখনই এই রাহু থেকে ঘটবে আমার নির্বাণলাভ।

No comments:

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...