তখন পড়তাম ক্লাস ওয়ানে ,বয়স আর কতই বা হবে ,বড়জোর ছয়।সালটা ১৯৯৪।এমনিতে আলাদাভাবে বছরটিকে মনে রাখার মত খুব একটা কারণ নেই । কিন্তু এতদিন বাদে আজ হঠাৎ সেই নাবালক বয়সের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানোরও কারণ আছে বৈকি ।তখনই যে ঠিকঠাক চিনতে শিখেছিলাম সাদা কালো চর্মগোলকটিকে! আর মোটামুটি হলফ করে বলা যায় ,ফুটবলের সাথে আমার গাঁটছড়া বাঁধার শুরুটাও ওই বছরেই। বছরটা বিশ্বকাপের।তবে বিশ্বকাপ কী বস্তু সেটা ভালমত ঠাউরে উঠতে পারিনি তখনো। শুধু ভাসাভাসা মনে পড়ে,মাঝরাতে বাবা-চাচার আচমকা গোল বলে চিৎকার করে ওঠা,পরিণামে ঘুম ঘুম চোখে আমার পিটপিট করে খানিক টিভির দিকে তাকিয়ে থাকা ,এবং চোখ খোলা রাখার প্রাণপণ প্রয়াস সত্ত্বেও খানিক বাদেই ফের ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যাওয়া। বলা যায় ,গোল শব্দটার সাথে আমার পরিচয়ও তখনই। বলতে কসুর নেই ,এতসব কেচ্ছার কিছু কিছু মায়ের মুখেই শোনা।
ওই বছর প্রথমবারের মার্কিন মুলুকে বিশ্বকাপের আসর বসে। আমাদের সাথে তাদের সময়ের ব্যবধান দুস্তর ,তাই খেলার সময়সূচী ছিল খানিকটা বেকায়দা গোছের ,বেশিরভাগ খেলাই হত মাঝরাত্তিরে ।এহেন বেমক্কা সময়ের খপ্পরে পড়েও নাকি আমার ফুটবল পাগল বাবা-চাচারা নিরস্ত হতেননা,পরের দিনের অফিসের চোখরাঙ্গানিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সেই মাঝরাতেই আমাদের আটপূরে বৈঠকখানায় একেবারে ধুন্দুমার লেগে যেত। বাবা ছিলেন ব্রাজিলের সাপোর্টার ,মামা -চাচারা আর্জেন্টিনা।তবে যুদ্ধংদেহী ভাব যেটাকে বলে ,তেমনটা খুব একটা দানা বেঁধে উঠতে পারেনি ড্রাগ কেলেংকারীতে ম্যারাডোনার জড়ানো ,এবং পরিণামে আর্জেন্টিনার চটজলদি পাততাড়ি গোটানোই হয়ত ছিল এর কারণ।
তবে সত্যিকারের ফুটবল ফ্যানাটিক(আজকের দিনে যাদের হুলিগান নামের গালভরা নামে ডাকা হয় !) ছিলেন আমার ছোট চাচা। তাকেই আমি প্রথম দেখেছি ব্রাজিল আর্জেন্টিনার বাইরে অন্য দলকে সমর্থন দিতে,তাও আবার যেনতেন নয় ,একেবারে পাঁড় সমর্থক।নেদারল্যান্ডের আগাপাশতলা ভক্ত ছিলেন তিনি,ওই সময় থেকেই ইউরোপিয়ান ফুটবলের নিয়মিত খবরাখবর রাখতেন। কোয়ার্টার ফাইনালে নাকি নেদারল্যান্ড ব্রাজিলের কাছে হেরে যাওয়ায় ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলেন।টোটাল ফুটবল টার্মটাও তার মুখ থেকেই প্রথম শোনা,পরে বেশ বড় হয়েও এর অর্থ জেনেছিলাম।আমার ফুটবলাসক্তির হাতেখড়িটা মূলত তার হাত ধরেই ,মাঠে গিয়ে টুকটাক বলে লাথি মারতে শেখাটাও।
স্বাভাবিকভাবেই , ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার তুমুল দ্বন্দ্ব ঠাহর করার তাকত ওই বয়সে তখনো হয়নি ,তখন আমি যে দলের পোশাক মনে ধরত ,তাকেই নির্বিবাদে সমর্থন দিয়ে যেতাম।তবে ওই বিশ্বকাপের একটা ঘটনার কথা আমার এখনো পষ্ট মনে পড়ে। তখন বিটিভির রাত আটটার খবর বাসায় দেখা হত ,একদিন খেলার সংবাদে দেখি সাদা-সবুজ জার্সি পড়া মিশমিশে কালো এক লোক বল নিয়ে ছুটছে তো ছুটছেই,মাঠের মাঝ বরাবর থেকে বল নিয়ে কীভাবে কীভাবে যেন বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের পাশ কাটিয়ে বলটি জালেও জড়িয়ে দেয়। অমন খ্যাপাটে দৌড় তখন পর্যন্ত আমি আর দেখিনি (এখনও এমন দৌড় খুব একটা দেখা যায়না) ,আর বলাই বাহুল্য সৌদি আরবের সাইদ আল ওয়াহরাইনের দেওয়া সেই অতিমানবীয় গোল আমার মনে রাখা প্রথম কোন গোলের স্মৃতি।
পরে বড় হয়ে যখন ৯৪ বিশ্বকাপের গোলগুলোর ক্লিপিংস দেখি ,তখন আলটপকা চোখের সামনে কিছু কিছু মুহুর্তের ঝাপসা কায়া ভাসতে থাকে, আর আমিও প্রথম প্রেমের মতই প্রথম বিশ্বকাপের ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি ,নিজের অজান্তেই স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠি।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
ঢাকার প্রেম
‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...
-
‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...
-
খুব সম্ভবত বাঙালি দর্শকের ফেলুদা নিয়ে সারাজীবনের একটা অতৃপ্তি ছিল, পারফেক্ট ফেলুদা সেভাবে পাওয়া হয়নি কখনো। সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে স...
-
সব কবিদের গদ্য সুন্দর হয় না। কেউ কেউ আছেন যাদের দুই হাতে একসঙ্গে বাজে কবিতা আর গদ্যের যুগলবন্দি। শঙ্খ ঘোষের গদ্যই সত্যিকার অর্থে পড়েছিলাম আ...
No comments:
Post a Comment