Tuesday, August 23, 2011

অস্তিত্বের সংকট ও কয়েকটি আত্মজিজ্ঞাসা

ফ্রান্স আর ইতালির সীমানার খুব কাছে, আল্পস পর্বতের কোল ঘেঁষে ইউরিয়াজ নামের ছিমছাম একটি গ্রাম। পাইন, ফার ,এলমের ছায়াঘেরা এই প্রত্যন্ত জনপদে মধ্যরাতের সুনসান নীরবতা। ভালমত কান পাতলে পাণ্ডববর্জিত সেই প্রত্যন্ত জনপদের এক নিভৃত গৃহকোণে কলমের খসখস শব্দই শোনা যাবে কেবল। গৌরবর্ণের সেই মানুষটা লিখে চলেছে অবিরত, খানিক পর চশমাটা আলগোছে পাশে রেখে কী যেন ভেবে চলেছেন চুপচাপ। আবার তিনি মৌনীর মত সেই পিনপতন নীরবতার মাঝে কলম তুলে নেন, লিখে ফেলেন লাইনের পর লাইন। কী ভাবছেন এই সুদর্শন আগন্তুক, যার নিবাস ফ্রান্স থেকে যোজন যোজন দূরের এক দেশে?

ফ্রান্স থেকে সটান চলে যাব বাংলার এক অজ পাড়াগাঁয়েতখনো সেখানে শীতের কুয়াশা জেঁকে বসেনি, পাতলা সরের মত তার একটা পরত পড়েছে মাত্র। জ্যোৎস্নাশোভিত সেই রাতে একজন যুবক শিক্ষক দেখতে পায় একজন অর্ধ উলঙ্গ যুবতি নারীর নিস্পন্দ দেহ। সেই দেহ থেকে প্রাণপাখি অনেক আগেই উড়ে গেছে, একথা ঠাহর করতেও কষ্ট হয়না যুবকের। সেই আশ্চর্যউজ্জ্বল রাতে এই উটকো আবিষ্কার যুবকের ভেতরটা তোলপাড় করে দেয়, সে জড়িয়ে পড়ে এক অযাচিত দৈব দুর্বিপাকে।

এদিকে ফ্রান্সের সেই গাঁয়ে লেখকের কলম তখন তুফান গতিতে ছুটছে। তার মাথার ভেতরে তখন এক অতীন্দ্রিয় জগত, যেখানে একজন যুবক শিক্ষক অস্তিত্বের দ্বন্দ্বে খাবি খাচ্ছে, পড়ে গিয়েছে ভয়-দ্বিধা-সংশয়ের এক অতল গহবরে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নামের ওই ভিনদেশী লেখক বুঁদ হয়ে আছেন এক জাদুবাস্তবতার জগতে, লিখে চলেছেন তার এক কালজয়ী কীর্তি, চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসখানি।

চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসের প্রেক্ষাপট আদপে একেবারেই অনুল্লেখযোগ্য, দুলাইনেই এর সারগর্ভকে এক খোঁচায় লিখে ফেলা যায়। কিন্তু এই আপাত নিস্তরঙ্গ, নিথর উপন্যাস হাতে না নিলে বোঝা দায়, কি এক অদ্ভুত প্রহেলিকা প্রোথিত আছে এই উপন্যাসের ভেতর। উপন্যাসের শুরুটা আগেই জানান দেওয়া হয়েছে। যুবক গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের আশ্রিত শিক্ষক, এক শীতের রাতে কোন এক বিচিত্র খেয়ালে সেই পরিবারের একজন সদস্য কাদেরের পিছু নেয়। কাদের একজন স্বল্পবাক ব্যক্তি, নিজেকে রহস্যের মোড়কে আবৃত করে রাখতেই পছন্দ করেন। অন্তুর্মুখী কাদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন, এমন কথা অনেকে বলতে কসুর করেননা। কিন্তু তার অলৌকিক ক্ষমতা থাক আর নাই থাক, নিজেকে ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন করে রাখার কারণে আকে নিয়ে অনেকের মাঝেই শ্রদ্ধামিশ্রিত সমীহভাব কাজ করে। এই অতিসাধারণ অর্বাচীন যুবক শিক্ষক আরেফ আলীও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই এই সমীহজাগানিয়া কৌতূহল নিবৃত্ত করতে না পেরেই সেই রাতে কাদেরের পিছু নেয় শিক্ষক। কিন্তু ঘটনাচক্রে সে বাঁশঝাড়ে আবিষ্কার করে বসে এক গ্রাম্য রমণীর মৃতদেহ। এবং এই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার শেষে সে কাদেরের সাথে মুখোমুখি হয়ে পড়ে। ঐ নির্জন স্থানে একটি শবদেহের আবিষ্কার, এবং এরপর হঠাৎ রহস্যময় কাদেরের আকস্মিক উদয় যুবককে ফেলে দেয় এক দুর্বোধ্য জটাজালে।

অবাক হতে পারেন, উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ বলতে গেলে এটুকুই। কিন্তু এই অঘটনের পর যুবক শিক্ষকের টানাপোড়েন আর দ্বন্দ্বই মূলত উপন্যাসের উপজীব্য। দরবেশসুলভ ভাবমূর্তির জন্য কাদেরকে ওই মৃত্যুর জন্য দায়ী করতে না পারা যুবক শিক্ষকের মানসিক অসহায়ত্বকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আবার মুদ্রার উলটো পিঠে কাদেরের সাথে সেই নারীর কোন সংযোগ স্থাপনে অক্ষমতা তাকে নিদারুণ পীড়া দিতে থাকে। লৌকিক, প্রচলিত ধারণার বাইরে কোন অসংস্কৃত, অগ্রহণযোগ্য সমাধানের দিকে পৌঁছানোর দীনতা তাকে কুরে কুরে খায়। বরং নিজের দুর্বলতার জন্য তার মাঝে এমন ভাব্নাও আসে, কাদের কি তাকেই হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেছিল? এ ধরনের পরস্পরবিরোধী এক ইন্দ্রজালে ধীরে ধীরে লেখক পাঠককে জড়িয়ে ফেলেন, ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের চিরন্তন সংজ্ঞার ব্যবচ্ছেদে প্রলুব্ধ করেন।

বলতে দ্বিধা নেই, এক লহমায় গোগ্রাসে গেলার মত বই এটি নয়। যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি লেখক পাঠককে করতে চেয়েছেন, সেসব সওয়ালের জবাব দিতে হলেও ভাবনার ঘূর্ণাবর্তে পড়ে যেতে হবে নিশ্চিত। অস্তিত্বের এই নানামুখী সংঘাতে যুবক শিক্ষক নাচার হয়ে পড়েন, কিন্তু শেষমেশ প্রকৃত ঘটনার নগ্ন রুপ উন্মোচিত হয়, এবং সেই দুরুহ সত্য তাকে তিলে তিলে গ্রাস করে। এবং অবধারিতভাবে এই সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখতে না পারার মাশুল তাকে দিতে হয়, পাকেচক্রে তার ঘাড়ে বর্তায় হত্যাকাণ্ডের দায়ভার। এসবই মোটামুটি অনুমেয় পরিণতি, কিন্তু যেটা অননুমেয়,তা হল এই সত্য আবিষ্কারের পথের নানান ঘাত প্রতিঘাত। কীভাবে একজন আপাতভীরু শিক্ষক অবস্থার ফেরে দুর্দান্ত সাহসী হয়ে ওঠে, সেটারই এক উত্থানপতনবহুল দ্বন্দ্বমুখর বয়ান এই বইটি।

ওয়ালীউল্লাহর এই উপন্যাস বিভিন্ন দিক দিয়েই অভিনব, উল্লেখ করার মত হাতেগোনা কটি চরিত্র, কিন্তু সেগুলোকেই তিনি ছাঁচে ঢেলেছেন নিপুণ হাতে। পাঠকের মর্মমূলে গিয়ে তিনি আঘাত করেছেন বারংবার, তাকে দাঁড় করিয়েছেন সাক্ষীর কাঠগড়ায়। অস্তিত্ববাদী উপন্যাসের সংজ্ঞা না জেনেও তাই সচেতন পাঠকের কাছে চরিত্রগুলোর অস্তিত্বের সংকট ধামাচাপা থাকেনা, পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত ধীরে ধীরে বিমূর্ত হয়ে উঠতে থাকে।

No comments:

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...