শাহাদুজ্জামানের সাথে পয়লা মোলাকাত হয়েছিল কয়েকটি বিহবল গল্প বইটিতে। আক্ষরিক অর্থেই গল্পগুলো পড়ে বিহবল হয়েছিলাম, বাঁধাগতের বাইরে একেবারেই আলাদা ঢঙ্গে লেখা, তারিয়ে তারিয়েই পড়েছিলাম। এরপর প্রথম মওকাতেই পড়ে ফেললাম তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ। এই বইটিতেও নিরীক্ষা নিয়ে লেখকের প্রয়াস লক্ষণীয়, প্রথাগত ধারার বাইরে গিয়ে এই বইতে আমি আবিষ্কার করি নতুন একজন শাহাদুজ্জামানকে।
১৮৯৯ সংখ্যাটা শুনলে কবিতাপ্রেমীদের মাথায় ঝট করে একটা নামই আসার কথা। কাব্যপ্রিয় আমাকে বলা যাবেনা কোন অর্থেই, তাই শিরোনামের মাহাত্ম্য টের পেতে আমাকে কিছুদূর অবধি পড়ে যেতেই হল। ছোটগল্পের মানদন্ডেও গল্পের কলেবর একেবারেই পৃথুল নয়, শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এর মাঝেই জীবনানন্দের প্রতি উৎসারিত প্রগাঢ় অনুরাগ ঠাহর করতে বেগ পেতে হয়না বৈকি।
শুরুর গল্পটা পড়ে বইটা ছেড়ে ওঠা মুশকিল হয়ে পড়ে, এরপর তরতর করে বাকিগুলো পড়ে ফেলতে কসুর করিনা। তবে এর মাঝে একটি গল্পের কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়, আন্না কারেনিনার জনৈক পাঠিকা। এই গল্পের শুরু পুরনো বইয়ের দোকানে লেখকের আন্না কারেনিনা বইটি কেনার পরের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। গল্পটাকে বলা যায় গল্পের মধ্যেই যেন আরেকটা গল্প, অনেকটা আমার দারুণ পছন্দের একটা ছবি দ্য ফল এর মত। আন্না কারেনিনা বইয়ের মার্জিনে একজন পাঠিকার কিছু মতামত, মতামত না বলে অবশ্য দর্শন বলাটাই যুৎসই। হাসান ভাই নামের একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে মমতার ছুঁড়ে দেওয়া কিছু আপাতসরল জিজ্ঞাসা লেখককে তাড়িত করে, বইটা পড়ার সময় লেখকের সামনে উন্মোচিত হয় একজন আনকোরা কিন্তু মনোযোগী পাঠিকার নতুন অলিন্দ। এইসব প্রশ্ন থেকে উপজাত হিসেবে বেরিয়ে আসে কিছু অমোঘ প্রশ্ন, মমতা-হাসানের সম্পর্কের একটা হালকা আঁচও পাওয়া যায় এতে। তাই গল্পে লেখকের পাঠক সত্ত্বার চেয়ে অনুসন্ধিৎসু সত্ত্বা প্রবল হয়ে ওঠে অনেকটা এভাবে-
এ ছাড়াও আরও কয়েকটি টুকরো মন্তব্যে লক্ষ করি নানা সামাজিক প্রসঙ্গে আমাদের এই পাঠিকার মনোযোগী পর্যবেক্ষণ।আন্না কারেনিনায় দেখা যাচ্ছে, সে সময় ধনাঢ্য রুশদের মধ্যে নিজের ভাষা ছেড়ে মাঝে মধ্যে ফরাসী বলার একটা ফ্যাশন ছিল। লেভিনের বন্ধুর স্ত্রী ডল্লি যখন তেমনি তার মেয়ের সঙ্গে ফাঁকে ফাঁকে ফরাসী বলছিল লেভিন তখন ভাবছিলেন- ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ফরাসী ভাষায় কেন কথা বলছেন উনি? কি অস্বাভাবিক আর কৃত্রিম। ছেলেমেয়েরাও টের পায় সেটা, এই ফরাসী শেখা আর স্বাভাবিকতা ভোলা। মমতা পাশে লিখেছেন- ঠিক যেমন আজকাল এদেশের বড়লোক পরিবারগুলোতে ইংরেজি বলা। ওদেরগুলোও মনে হয় কি অস্বাভাবিক আর কৃত্রিম।
এইভাবে একটি বইয়ের "মার্জিনে মন্তব্যে"র সূত্র ধরে লেখকের সামনে এক অনালোকিত জগতের দুয়ার খুলে যায়। এই ঠাস বুনোটের শহরে একজন অচিন পাঠিকার হারানো ঠিকুজির তিনি সন্ধান করে চলেন, আমরাও পড়ে ফেলি গল্পের মধ্যে আরেকটি গল্প।
তবে বইটির যে গল্পটা আমার চোখে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আদল নিয়েছে সেটা হল, ইব্রাহীম বক্সের সার্কাস। অন্যান্য গল্পের মত এটি স্বল্পবপু নয়, তবে গল্পের কিছুদূর এগিয়ে এটাও লেখকের ভুয়োদর্শনমূলক বলে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। গল্পের কাহিনি এক প্রত্যন্ত গ্রামে একজন তরুণ চিকিৎসকের কিছু অভিনব অভিজ্ঞতা নিয়ে। সদ্যপাশকৃত এই ডাক্তার বদলি হয়ে চলে আসেন এই দুর্গম জনপদে। এই পরিস্থিতিতে যেটা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক; গ্রামের কুসংস্কারপীড়িত মানুষের ভ্রান্ত ধারণা, রোগ বালাই নিয়ে তাদের উদ্ভট খেয়াল, আধুনিক চিকিৎসা সম্পর্কে অজ্ঞানতা এসবই ডাক্তারকে মোকাবেলা করতে হয়। এই পর্যন্ত গল্পটিকে আটপৌরে মনে করলে আসলে খুব বেশি দোষ ধরাও যায়না। কিন্তু এরপর প্রাত্যহিকতার আবডালে আরেকটি অতীন্দ্রিয় জগতের হদিস পান ডাক্তার, যেখানে বাস করে ইব্রাহিম বক্সের মত খামখেয়ালি, রহস্যময় একজন লোক, বকরি বুড়ির মত একজন আপাতপমূর্খ কিন্তু দুর্বোধ্য গ্রাম্য প্রবীণার। গ্রাম্য সংস্কারের আড়ালে ইব্রাহিম বক্সের কৌতূহলী মন আর বৈজ্ঞানিক সত্ত্বার ঠিকুজি ডাক্তারকে দ্বিধায় ফেলে দেয়, এতদিনের আধুনিক কলাকৌশলের সাথে এসব উন্মার্গিক অথচ সৃষ্টিশীল প্রজ্ঞার সন্ধান তাকে ফেলে দেয় ভয়ানক টানাপোড়েনে। এক লহমায় ইব্রাহিম বক্সের চিকিৎসা বিষয়ক মতবাদকে উড়িয়ে দিতে যেমন পারেননা, ঠিক তেমনি পারেননা নিজের যুক্তিবাদী সত্ত্বার সাথে টক্কর দিয়ে সবকিছু মেনে নিতে। অবশ্য নিয়তি অচিরেই তাকে এই সংকট থেকে মুক্তি দেয়, সেই গণ্ডগ্রামে ডাক্তারগিরির পাট চুকিয়ে অচিরেই তিনি ফিরে যান নিজের শেকড়ে। গল্পটা একদিক দিয়ে খানিকটা প্রথাগতই বটে, এখানেই তিনি নিরীক্ষার আশ্রয় নিয়েছেন সবচেয়ে কম। চরিত্রগুলোকে স্বাভাবিক বিকাশের পথ দেখিয়েছেন, ঘটনাগুলোকে একসূত্রে গেঁথেছেন দক্ষ হাতে।
তবে অন্যগল্পগুলো নিয়ে কিছু না বললে অন্যায়ই হবে। শিং মাছ, লাল জেল এইসব গল্পে লেখক আসলে একটি থিমের ওপর কিছু ছোট ছোট চুটকি ফেঁদেছেন। গল্পটা ভীষণ রকম সুখপাঠ্য, এ ধরনের গল্প পড়ার আনন্দ অসামান্য, তবে এসব গল্প ভুলে যাওয়াটাও অনেকটা সহজ। অন্যদিকে পন্ডিত গল্পে লেখকের বিদ্রুপের তীর্যক সুর অনেকটাই স্পষ্ট, সখেদে তিনি অর্থগৃধু বুদ্ধিব্যবসায়ীদের অন্তসারশূন্যতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, বাস্তবের কর্কশ জমিনের সাথে সংশ্রবহীন তত্ত্বকথার ঝান্ডাধারীদের একহাত দেখে নেন। এসব গল্পে লেখক অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত, পাঠক হিসেবে এ ধরনের গল্পের প্রতিও আমার একটা বাড়তি পক্ষপাত আছে অবশ্য।
খুব স্থির একটি স্থির চিত্র গল্পটি আদপে স্রেফ একটা স্ন্যাপশট, যেখানে একটা খুব সংক্ষিপ্ত ঘটনার মাধ্যমে লেখক অনেকগুলো উপসংহার টেনেছেন। এখানে কাহিনি খোঁজাটা হবে অরণ্যে রোদন, তবে নিরীক্ষার ছাপ এই গল্পেও সুস্পষ্ট। উড্ডীন গল্পের ক্ষেত্রেও এই কথা অনেকটা খাটে, এই গল্পটা আমি ঠিক ধরতে পারিনি, মাঝেমাঝেই রাশটা ছুটে গিয়েছে বলে মনে হয়েছে। আয়নার ওপিঠ লাল একজন পঙ্গু মানুষের গল্প, অনেকটা ডাইভিং বেল অ্যান্ড দা বাটারফ্লাই ছবিটার কথা মনে করিয়ে দেয়। এই ঘরানার গল্পের একটা বিষাদমাখা সুর থাকে, সেটা আমাকে ছুঁয়ে যায় বৈকি। কিন্তু কতটা দাগ কেটেছে এ সওয়াল পুঁছলে সেটার উত্তর দিতে আমি খানিকটা ভাববই। চীনা অক্ষর অথবা লংমার্চের গল্পটিকে আমার কিছুটা কমজোরি মনে হয়েছে, ঠিক দানা বেঁধে উঠতে পারেনি ,কেন জানি মনে হয়েছে এটা হয়েছে "একটি হতে গিয়েও না হতে পারা " গল্প।
আরেকটি গল্পের কথা আলাদাভাবে বলব, নিজকলমোহনায় ক্লারা লিন্ডেন। একজন ভিনদেশী রমণী দোভাষীর সাহায্য নিয়ে গন্ডগ্রামে সন্তান প্রসবের ওপর গবেষণা করতে আসেন। অনেক চটকদার পিলে চমকানো তথ্যই তিনি জানতে পারেন, নিজের গবেষণার সাফল্যের কথা ভেবে তিনি উচ্ছ্বসিতও হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে এদেশীয় দোভাষীর কাছেও ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় দুর্বোধ্য এক প্রহেলিকার নাম, গ্রাম্য মিথের অভিনবত্ব তাকে চমকিত করে। প্রবীণ ধাত্রীর কাছে এর আবেদন আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন। গল্পের শেষলাইনটি আসলে অনেক কথাই বলে দেয়-
নিজকলমোহনায় তখন দুপুর। ঢেঁকিঘরে হাওয়া, সেখানে শ্বেতাঙ্গ, বাদামি, শ্যামবর্ণ তিনজন নারীর মিথস্ক্রিয়া।
বইটিতে আমরা একজন শক্তিমান লেখকের দেখা পাই, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যার নিবিড় পর্যবেক্ষণ রয়েছে, সমাজ- সংস্কার নিয়ে যার অভ্রভেদী দৃষ্টিভঙ্গি আছে। লেখক নিরীক্ষার প্রশ্নে কোন আপস করেননি, হয়ত গল্প হিসেবে সবগুলো ঠিক উতরে যেতে পারেনি, কিন্তু প্রত্যেকটি গল্প আলাদাভাবে ভাবতে বাধ্য করবে, চিন্তার খোরাক জোগাবে এটুকু হলফ করে বলা যায়। তাই, একজন পাঠক হিসেবে পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ পড়ে লেখকের কাছ থেকে প্রত্যাশার পারদও অনেকখানি চড়ে যায়।
Thursday, April 28, 2011
Thursday, April 7, 2011
স্মৃতির শহরে রাশেদের সাথে
১.
দিনটা ছিল বোশেখের এক রৌদ্রতপ্ত দুপুর, এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। খাওয়ার সময় দুদন্ড জিরিয়ে নেওয়ার আগে আলগোছে হাতে তুলে নিয়েছিলাম বইটি। এরপরের ঘন্টাখানেক আমি আক্ষরিক অর্থেই বুঁদ হয়ে ছিলাম, মুহুর্তের জন্যও চোখ সরাইনি(বা বলা ভাল সরাতে পারিনি) বইয়ের পাতা থেকে । চোখের কোনায় পানি চকচক করেছিল কিনা মনে নেই, তবে পড়া শেষে ভেতরটা ভীষণরকম কুঁকড়ে গিয়েছিল, সেটা দিব্যি দিয়েই বলা যায়। রাশেদের সাথে আমার পয়লা মোলাকাত হল এভাবেই, আর প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের আমার বন্ধু রাশেদ চলে গেল প্রিয় বইগুলোর ছোট্ট তালিকার কাতারে।
২. ব্যাপারটা কাকতাল কিনা জানিনা, মোরশেদুল ইসলামের কাজের সাথে প্রথম পরিচয়ও কিন্তু মুহম্মদ জাফর ইকবালেরই আরেকটা দুর্দান্ত কিশোর উপন্যাস, দীপু নাম্বার টু এর মধ্য দিয়ে। মনে পড়ে, ছবিটা দেখে মনে হচ্ছিল, দীপু যেন আমার উড়ুক্কু কল্পনার দীপুর সাথে ঠিকঠাক মিলে গেল। তখনই ছবিটার প্রতি একটা দারুণ রকম মোহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর এটুকু হলফ করে বলতে পারি, বড়বেলায় ফের ছবিটা দেখার পর সেই মোহভঙ্গ হয়নি, সেই বালকবয়েসের মুগ্ধতার রেশ তখনও অনেকটা থেকে গিয়েছিল। এরপর মোরশেদুল ইসলামের খেলাঘর, দূরত্ব ছবি দুটো দেখেছি, তবে কোনটিই জাফর ইকবালে সাথে যুগলবন্দির ফিরিস্তি নয়। তবে কেন জানিনা প্রায়ই মনে হত, দুষ্টু ছেলের দল, হাতকাটা রবিন বা আমার বন্ধু রাশেদের মত কিশোর বয়সের দুমলাটের ভালবাসাকে সেলুলয়েডিত করতে মোরশেদুল ইসলামই হতেন সবচেয়ে যোগ্য লোক ।
৩. বেশ কিছুদিন আগেই শুনেছিলাম সরকারী অনুদানে মোরশেদুল ইসলামের পরিচালনাতেই রুপালী পর্দায় রাশেদকে দেখা যাবে। তখন থেকেই শুরু অপেক্ষার প্রহর গোনার। অবশেষে এই এপ্রিলে এসে মুক্তি পেল ছবিটি। আর দুদন্ড ফুরসত পেয়েই ছবি দেখার মওকা ছাড়লামনা, সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে একেবারে সোজা সিনেমা হলে। এখানে বলে রাখছি, আমার কাছে বইটার একটা নিজস্ব আবেদন আছে। সেই প্রীতির জায়গাটুকু থেকে ছবিটার কাছ থেকে প্রত্যাশা আকাশ না ছুঁলেও পারদটা অনেকটা চড়া ছিল। একেবারে যাকে বলে "স্ট্রাইকিং অ্যাপিয়ারেন্স" না হলেও প্রথমেই রাশেদকে দেখে সেই কল্পনার রাজ্য টলে যায়নি, সেজন্য পরিচালকের একটা বাহবা পাওনা থাকবে। বেশ নিপাট চেহারার চালাক চতুর গোছের রাশেদের প্রথম দর্শনে খুঁত যদি ধরতেই হয়, তবে বলব বয়সটা সামান্য বেশিই হয়েছে হয়তোবা। তবে সেটাকে খুব বেশি আমলে না নিলেও চলে। ইবুর চরিত্রটাও টাল খায়নি, তবে এই জায়গায় আমার একটু খেদ আছে, সে কথায় পরে আসছি। গল্পের কাহিনি অনেকেই জানেন, তাই সেটা নিয়ে লম্বা ফিরিস্তি দেওয়াটা জলঘোলা করাই হবে। সিনেমাটার প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধের ওপরে, তাই সেই সময়কার আবহটা পুরো ছবি জুড়েই ছিল। রাশেদ-ইবু সহ বাকিদের গেটআপ বা অন্যান্য দৃশ্যগুলো সেভাবেই সাজানো হয়েছে। সিনেমার শুটিং হয় ছিমছাম দিনাজপুর শহরে, নদীতীরের দৃশ্যগুলো ছিল এককথায় চমৎকার। সিনেমাটোগ্রাফি তাই বেশ ভালমত উতরে গেছে বলা যায়। তবে যে ব্যাপারটা আলাদা করে বলতেই হয় সেটা মূল উপন্যাসের সাথে দারুণ সামঞ্জস্য। বইয়ের পাতায় যেমনটি পড়েছিলাম, পর্দায় ঠিক সেই কাহিনিই দেখলাম। খুব বেশি নিরীক্ষার ব্যাপারে পরিচালক বেশ সংযত থেকেছেন, কোন উটকো মোচড় দিয়ে কাহিনির বারটা না বাজানোয় তাকে আরেকটা ধন্যবাদ দিতেই হয়। রাশেদের অভিনয়ে খানিকটা আড়ষ্টতা থাকলেও ওই বয়েসী ছেলেদের মধ্যে সেটা কিছুটা থাকাটাই স্বাভাবিক। এদিক দিয়ে ইবুকে কিছু জায়গায় বরং বেশি সাবলীল মনে হয়েছে। বাকি কিশোর অভিনেতারাও পাশ মার্ক পাবে। অন্যান্য কলাকুশলীদের কথা বলতে গেলে আলাদাভাবে বলবব রাইসুল ইসলাম আসাদ আর পীযুষ বন্দোপাধ্যায়ের কথা। অভিনয়ের এন্তার সুযোগ তাদের ছিলনা, তবে যেটুকু করেছেন সেটুকুতেই নিজেদের জাত চিনিয়েছেন। তবে আলাদাভাবে অরু আপা আর শফিক ভাইয়ের চরিত্রদুটোর কথা বলতেই হয়। হোমায়রা হিমুর অভিনয় কিছুটা মাত্রায় মেলোড্রামাটিক, কিছু জায়গায় একটু চপলমতীও মনে হয়েছে। এদিকে আরমান পারভেজ মুরাদ শফিক ভাইয়ের চরিত্রে আমার ভাবনার সাথে অবিকলই মিলে গেছেন।
৪. অভিনয়ের কাসুন্দি বাদ দিলে স্রেফ ডিরেকশনের বিচারে ছবিটাকে দুর্দান্ত না বলতে পারলেও ভাল বলতেই হবে। নদীতীরের বা রেলব্রিজের ওপরে লংশটের দৃশ্যগুলোর কথা আলাদাভাবে বলব। আবহ সঙ্গীত অনেকটাই প্রথাগত, যুদ্ধের দৃশ্যগুলোতে প্রথাগত দামামা বা পরিচিত দেশের গানের নেপথ্য সুরের কথা এই মুহুর্তে মনে পড়ছে। এখানেও বাঁধাগতের বাইরে গিয়ে অন্য কিছু করার যথেষ্টই অবকাশ ছিল। তবে একটা কথা বলতেই হবে, রাশেদের ওপর থেকে ফোকাসটা মাঝে মাঝেই সরে গিয়েছে বলে মনে হয়েছে। মূল বইটা না পড়া থাকলে এই ব্যবধান আসলে ঠিক গোচরে আসবেনা, তবে স্পটলাইট আরেকটু কম ইবুকেন্দ্রিক হলেও পারত। এটা অবশ্য আমার একান্তই নিজস্ব পর্যবেক্ষণ, এর সাথে একমত হবেননা এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া যেতেই পারে।
৫.
ছবির শেষ দিকের অংশটকুর জন্য আসলে অনেকটাই মুখিয়ে ছিলাম। যুদ্ধের ডামাডোলে একদল অকুতোভয় কিশোরের রোমাঞ্চকর কাহিনি যেমনি আচমকা শুরু হয়েছিল , অমনি সেটা আচমকাই শেষ হয়ে গেল। ইবু তার অনেক দিনের গোপন ক্ষত শত চেষ্টা করেও মুছে ফেলতে পারেনা, তাই সে টের পায়, রাশেদের সাথে তার অদৃশ্য এক ধরনের যোগসূত্র রয়েই যায়। সেই রাশেদ, যার বাবা খানিকটা "পাগলা কিসিমের", যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির হালহকিকত রাখে, সেই রাশেদ, যে কিনা ভয়ের তোয়াক্কা না করে গুলি বয়ে নিয়ে যায়, যে কিনা আহত মুক্তিযোদ্ধা শফিক ভাইকে দুঃসাহসিকভাবে ছিনিয়ে আনে, যে কিনা মৃত্যুকে আয়নায় দেখেও জয় বাংলা বলতে কুন্ঠাবোধ করেনা। এসবই বহবার পড়া, চোখ মুদলেই আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাই। সবকিছুর পরেও রাশেদের জন্য আমার ভেতরের স্পর্শকাতর অনুভূতিতে নাড়া দেওয়ার জন্য মোরশেদুল ইসলাম একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। তাই এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাদের প্রজন্মের যাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবেগের বিশেষ স্থান রয়েছে, যারা কৈশোরের মাতাল করা সময়ে "আমার বন্ধু রাশেদ" পড়ে এক অব্যক্ত বেদনায় কাতর হয়েছে, তাদের কিশোরবেলার সেই সুপ্ত স্মৃতির শহরে আরেকটা দুর্দান্ত সফরের জন্য এই ছবির চেয়ে মোক্ষম দাওয়াই আর কিছু হতে পারেনা।
দিনটা ছিল বোশেখের এক রৌদ্রতপ্ত দুপুর, এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। খাওয়ার সময় দুদন্ড জিরিয়ে নেওয়ার আগে আলগোছে হাতে তুলে নিয়েছিলাম বইটি। এরপরের ঘন্টাখানেক আমি আক্ষরিক অর্থেই বুঁদ হয়ে ছিলাম, মুহুর্তের জন্যও চোখ সরাইনি(বা বলা ভাল সরাতে পারিনি) বইয়ের পাতা থেকে । চোখের কোনায় পানি চকচক করেছিল কিনা মনে নেই, তবে পড়া শেষে ভেতরটা ভীষণরকম কুঁকড়ে গিয়েছিল, সেটা দিব্যি দিয়েই বলা যায়। রাশেদের সাথে আমার পয়লা মোলাকাত হল এভাবেই, আর প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের আমার বন্ধু রাশেদ চলে গেল প্রিয় বইগুলোর ছোট্ট তালিকার কাতারে।
২. ব্যাপারটা কাকতাল কিনা জানিনা, মোরশেদুল ইসলামের কাজের সাথে প্রথম পরিচয়ও কিন্তু মুহম্মদ জাফর ইকবালেরই আরেকটা দুর্দান্ত কিশোর উপন্যাস, দীপু নাম্বার টু এর মধ্য দিয়ে। মনে পড়ে, ছবিটা দেখে মনে হচ্ছিল, দীপু যেন আমার উড়ুক্কু কল্পনার দীপুর সাথে ঠিকঠাক মিলে গেল। তখনই ছবিটার প্রতি একটা দারুণ রকম মোহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর এটুকু হলফ করে বলতে পারি, বড়বেলায় ফের ছবিটা দেখার পর সেই মোহভঙ্গ হয়নি, সেই বালকবয়েসের মুগ্ধতার রেশ তখনও অনেকটা থেকে গিয়েছিল। এরপর মোরশেদুল ইসলামের খেলাঘর, দূরত্ব ছবি দুটো দেখেছি, তবে কোনটিই জাফর ইকবালে সাথে যুগলবন্দির ফিরিস্তি নয়। তবে কেন জানিনা প্রায়ই মনে হত, দুষ্টু ছেলের দল, হাতকাটা রবিন বা আমার বন্ধু রাশেদের মত কিশোর বয়সের দুমলাটের ভালবাসাকে সেলুলয়েডিত করতে মোরশেদুল ইসলামই হতেন সবচেয়ে যোগ্য লোক ।
৩. বেশ কিছুদিন আগেই শুনেছিলাম সরকারী অনুদানে মোরশেদুল ইসলামের পরিচালনাতেই রুপালী পর্দায় রাশেদকে দেখা যাবে। তখন থেকেই শুরু অপেক্ষার প্রহর গোনার। অবশেষে এই এপ্রিলে এসে মুক্তি পেল ছবিটি। আর দুদন্ড ফুরসত পেয়েই ছবি দেখার মওকা ছাড়লামনা, সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে একেবারে সোজা সিনেমা হলে। এখানে বলে রাখছি, আমার কাছে বইটার একটা নিজস্ব আবেদন আছে। সেই প্রীতির জায়গাটুকু থেকে ছবিটার কাছ থেকে প্রত্যাশা আকাশ না ছুঁলেও পারদটা অনেকটা চড়া ছিল। একেবারে যাকে বলে "স্ট্রাইকিং অ্যাপিয়ারেন্স" না হলেও প্রথমেই রাশেদকে দেখে সেই কল্পনার রাজ্য টলে যায়নি, সেজন্য পরিচালকের একটা বাহবা পাওনা থাকবে। বেশ নিপাট চেহারার চালাক চতুর গোছের রাশেদের প্রথম দর্শনে খুঁত যদি ধরতেই হয়, তবে বলব বয়সটা সামান্য বেশিই হয়েছে হয়তোবা। তবে সেটাকে খুব বেশি আমলে না নিলেও চলে। ইবুর চরিত্রটাও টাল খায়নি, তবে এই জায়গায় আমার একটু খেদ আছে, সে কথায় পরে আসছি। গল্পের কাহিনি অনেকেই জানেন, তাই সেটা নিয়ে লম্বা ফিরিস্তি দেওয়াটা জলঘোলা করাই হবে। সিনেমাটার প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধের ওপরে, তাই সেই সময়কার আবহটা পুরো ছবি জুড়েই ছিল। রাশেদ-ইবু সহ বাকিদের গেটআপ বা অন্যান্য দৃশ্যগুলো সেভাবেই সাজানো হয়েছে। সিনেমার শুটিং হয় ছিমছাম দিনাজপুর শহরে, নদীতীরের দৃশ্যগুলো ছিল এককথায় চমৎকার। সিনেমাটোগ্রাফি তাই বেশ ভালমত উতরে গেছে বলা যায়। তবে যে ব্যাপারটা আলাদা করে বলতেই হয় সেটা মূল উপন্যাসের সাথে দারুণ সামঞ্জস্য। বইয়ের পাতায় যেমনটি পড়েছিলাম, পর্দায় ঠিক সেই কাহিনিই দেখলাম। খুব বেশি নিরীক্ষার ব্যাপারে পরিচালক বেশ সংযত থেকেছেন, কোন উটকো মোচড় দিয়ে কাহিনির বারটা না বাজানোয় তাকে আরেকটা ধন্যবাদ দিতেই হয়। রাশেদের অভিনয়ে খানিকটা আড়ষ্টতা থাকলেও ওই বয়েসী ছেলেদের মধ্যে সেটা কিছুটা থাকাটাই স্বাভাবিক। এদিক দিয়ে ইবুকে কিছু জায়গায় বরং বেশি সাবলীল মনে হয়েছে। বাকি কিশোর অভিনেতারাও পাশ মার্ক পাবে। অন্যান্য কলাকুশলীদের কথা বলতে গেলে আলাদাভাবে বলবব রাইসুল ইসলাম আসাদ আর পীযুষ বন্দোপাধ্যায়ের কথা। অভিনয়ের এন্তার সুযোগ তাদের ছিলনা, তবে যেটুকু করেছেন সেটুকুতেই নিজেদের জাত চিনিয়েছেন। তবে আলাদাভাবে অরু আপা আর শফিক ভাইয়ের চরিত্রদুটোর কথা বলতেই হয়। হোমায়রা হিমুর অভিনয় কিছুটা মাত্রায় মেলোড্রামাটিক, কিছু জায়গায় একটু চপলমতীও মনে হয়েছে। এদিকে আরমান পারভেজ মুরাদ শফিক ভাইয়ের চরিত্রে আমার ভাবনার সাথে অবিকলই মিলে গেছেন।
৪. অভিনয়ের কাসুন্দি বাদ দিলে স্রেফ ডিরেকশনের বিচারে ছবিটাকে দুর্দান্ত না বলতে পারলেও ভাল বলতেই হবে। নদীতীরের বা রেলব্রিজের ওপরে লংশটের দৃশ্যগুলোর কথা আলাদাভাবে বলব। আবহ সঙ্গীত অনেকটাই প্রথাগত, যুদ্ধের দৃশ্যগুলোতে প্রথাগত দামামা বা পরিচিত দেশের গানের নেপথ্য সুরের কথা এই মুহুর্তে মনে পড়ছে। এখানেও বাঁধাগতের বাইরে গিয়ে অন্য কিছু করার যথেষ্টই অবকাশ ছিল। তবে একটা কথা বলতেই হবে, রাশেদের ওপর থেকে ফোকাসটা মাঝে মাঝেই সরে গিয়েছে বলে মনে হয়েছে। মূল বইটা না পড়া থাকলে এই ব্যবধান আসলে ঠিক গোচরে আসবেনা, তবে স্পটলাইট আরেকটু কম ইবুকেন্দ্রিক হলেও পারত। এটা অবশ্য আমার একান্তই নিজস্ব পর্যবেক্ষণ, এর সাথে একমত হবেননা এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া যেতেই পারে।
৫.
ছবির শেষ দিকের অংশটকুর জন্য আসলে অনেকটাই মুখিয়ে ছিলাম। যুদ্ধের ডামাডোলে একদল অকুতোভয় কিশোরের রোমাঞ্চকর কাহিনি যেমনি আচমকা শুরু হয়েছিল , অমনি সেটা আচমকাই শেষ হয়ে গেল। ইবু তার অনেক দিনের গোপন ক্ষত শত চেষ্টা করেও মুছে ফেলতে পারেনা, তাই সে টের পায়, রাশেদের সাথে তার অদৃশ্য এক ধরনের যোগসূত্র রয়েই যায়। সেই রাশেদ, যার বাবা খানিকটা "পাগলা কিসিমের", যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির হালহকিকত রাখে, সেই রাশেদ, যে কিনা ভয়ের তোয়াক্কা না করে গুলি বয়ে নিয়ে যায়, যে কিনা আহত মুক্তিযোদ্ধা শফিক ভাইকে দুঃসাহসিকভাবে ছিনিয়ে আনে, যে কিনা মৃত্যুকে আয়নায় দেখেও জয় বাংলা বলতে কুন্ঠাবোধ করেনা। এসবই বহবার পড়া, চোখ মুদলেই আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাই। সবকিছুর পরেও রাশেদের জন্য আমার ভেতরের স্পর্শকাতর অনুভূতিতে নাড়া দেওয়ার জন্য মোরশেদুল ইসলাম একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। তাই এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাদের প্রজন্মের যাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবেগের বিশেষ স্থান রয়েছে, যারা কৈশোরের মাতাল করা সময়ে "আমার বন্ধু রাশেদ" পড়ে এক অব্যক্ত বেদনায় কাতর হয়েছে, তাদের কিশোরবেলার সেই সুপ্ত স্মৃতির শহরে আরেকটা দুর্দান্ত সফরের জন্য এই ছবির চেয়ে মোক্ষম দাওয়াই আর কিছু হতে পারেনা।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ঢাকার প্রেম
‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...
-
‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...
-
খুব সম্ভবত বাঙালি দর্শকের ফেলুদা নিয়ে সারাজীবনের একটা অতৃপ্তি ছিল, পারফেক্ট ফেলুদা সেভাবে পাওয়া হয়নি কখনো। সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে স...
-
আগেই বলে রাখছি এটা ঠিক কোনো প্রথাগত রিভিউ নয়, বরং তাৎক্ষণিক পাঠপ্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে। প্রচলিত ধারণা সম্ভবত এটা, একজন লেখকের জন্য প্র...