Thursday, April 7, 2011

স্মৃতির শহরে রাশেদের সাথে

১.
দিনটা ছিল বোশেখের এক রৌদ্রতপ্ত দুপুর, এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। খাওয়ার সময় দুদন্ড জিরিয়ে নেওয়ার আগে আলগোছে হাতে তুলে নিয়েছিলাম বইটি। এরপরের ঘন্টাখানেক আমি আক্ষরিক অর্থেই বুঁদ হয়ে ছিলাম, মুহুর্তের জন্যও চোখ সরাইনি(বা বলা ভাল সরাতে পারিনি) বইয়ের পাতা থেকে । চোখের কোনায় পানি চকচক করেছিল কিনা মনে নেই, তবে পড়া শেষে ভেতরটা ভীষণরকম কুঁকড়ে গিয়েছিল, সেটা দিব্যি দিয়েই বলা যায়। রাশেদের সাথে আমার পয়লা মোলাকাত হল এভাবেই, আর প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের আমার বন্ধু রাশেদ চলে গেল প্রিয় বইগুলোর ছোট্ট তালিকার কাতারে।

২. ব্যাপারটা কাকতাল কিনা জানিনা, মোরশেদুল ইসলামের কাজের সাথে প্রথম পরিচয়ও কিন্তু মুহম্মদ জাফর ইকবালেরই আরেকটা দুর্দান্ত কিশোর উপন্যাস, দীপু নাম্বার টু এর মধ্য দিয়ে। মনে পড়ে, ছবিটা দেখে মনে হচ্ছিল, দীপু যেন আমার উড়ুক্কু কল্পনার দীপুর সাথে ঠিকঠাক মিলে গেল। তখনই ছবিটার প্রতি একটা দারুণ রকম মোহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর এটুকু হলফ করে বলতে পারি, বড়বেলায় ফের ছবিটা দেখার পর সেই মোহভঙ্গ হয়নি, সেই বালকবয়েসের মুগ্ধতার রেশ তখনও অনেকটা থেকে গিয়েছিল। এরপর মোরশেদুল ইসলামের খেলাঘর, দূরত্ব ছবি দুটো দেখেছি, তবে কোনটিই জাফর ইকবালে সাথে যুগলবন্দির ফিরিস্তি নয়। তবে কেন জানিনা প্রায়ই মনে হত, দুষ্টু ছেলের দল, হাতকাটা রবিন বা আমার বন্ধু রাশেদের মত কিশোর বয়সের দুমলাটের ভালবাসাকে সেলুলয়েডিত করতে মোরশেদুল ইসলামই হতেন সবচেয়ে যোগ্য লোক ।

৩. বেশ কিছুদিন আগেই শুনেছিলাম সরকারী অনুদানে মোরশেদুল ইসলামের পরিচালনাতেই রুপালী পর্দায় রাশেদকে দেখা যাবে। তখন থেকেই শুরু অপেক্ষার প্রহর গোনার। অবশেষে এই এপ্রিলে এসে মুক্তি পেল ছবিটি। আর দুদন্ড ফুরসত পেয়েই ছবি দেখার মওকা ছাড়লামনা, সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে একেবারে সোজা সিনেমা হলে। এখানে বলে রাখছি, আমার কাছে বইটার একটা নিজস্ব আবেদন আছে। সেই প্রীতির জায়গাটুকু থেকে ছবিটার কাছ থেকে প্রত্যাশা আকাশ না ছুঁলেও পারদটা অনেকটা চড়া ছিল। একেবারে যাকে বলে "স্ট্রাইকিং অ্যাপিয়ারেন্স" না হলেও প্রথমেই রাশেদকে দেখে সেই কল্পনার রাজ্য টলে যায়নি, সেজন্য পরিচালকের একটা বাহবা পাওনা থাকবে। বেশ নিপাট চেহারার চালাক চতুর গোছের রাশেদের প্রথম দর্শনে খুঁত যদি ধরতেই হয়, তবে বলব বয়সটা সামান্য বেশিই হয়েছে হয়তোবা। তবে সেটাকে খুব বেশি আমলে না নিলেও চলে। ইবুর চরিত্রটাও টাল খায়নি, তবে এই জায়গায় আমার একটু খেদ আছে, সে কথায় পরে আসছি। গল্পের কাহিনি অনেকেই জানেন, তাই সেটা নিয়ে লম্বা ফিরিস্তি দেওয়াটা জলঘোলা করাই হবে। সিনেমাটার প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধের ওপরে, তাই সেই সময়কার আবহটা পুরো ছবি জুড়েই ছিল। রাশেদ-ইবু সহ বাকিদের গেটআপ বা অন্যান্য দৃশ্যগুলো সেভাবেই সাজানো হয়েছে। সিনেমার শুটিং হয় ছিমছাম দিনাজপুর শহরে, নদীতীরের দৃশ্যগুলো ছিল এককথায় চমৎকার। সিনেমাটোগ্রাফি তাই বেশ ভালমত উতরে গেছে বলা যায়। তবে যে ব্যাপারটা আলাদা করে বলতেই হয় সেটা মূল উপন্যাসের সাথে দারুণ সামঞ্জস্য। বইয়ের পাতায় যেমনটি পড়েছিলাম, পর্দায় ঠিক সেই কাহিনিই দেখলাম। খুব বেশি নিরীক্ষার ব্যাপারে পরিচালক বেশ সংযত থেকেছেন, কোন উটকো মোচড় দিয়ে কাহিনির বারটা না বাজানোয় তাকে আরেকটা ধন্যবাদ দিতেই হয়। রাশেদের অভিনয়ে খানিকটা আড়ষ্টতা থাকলেও ওই বয়েসী ছেলেদের মধ্যে সেটা কিছুটা থাকাটাই স্বাভাবিক। এদিক দিয়ে ইবুকে কিছু জায়গায় বরং বেশি সাবলীল মনে হয়েছে। বাকি কিশোর অভিনেতারাও পাশ মার্ক পাবে। অন্যান্য কলাকুশলীদের কথা বলতে গেলে আলাদাভাবে বলবব রাইসুল ইসলাম আসাদ আর পীযুষ বন্দোপাধ্যায়ের কথা। অভিনয়ের এন্তার সুযোগ তাদের ছিলনা, তবে যেটুকু করেছেন সেটুকুতেই নিজেদের জাত চিনিয়েছেন। তবে আলাদাভাবে অরু আপা আর শফিক ভাইয়ের চরিত্রদুটোর কথা বলতেই হয়। হোমায়রা হিমুর অভিনয় কিছুটা মাত্রায় মেলোড্রামাটিক, কিছু জায়গায় একটু চপলমতীও মনে হয়েছে। এদিকে আরমান পারভেজ মুরাদ শফিক ভাইয়ের চরিত্রে আমার ভাবনার সাথে অবিকলই মিলে গেছেন।


৪. অভিনয়ের কাসুন্দি বাদ দিলে স্রেফ ডিরেকশনের বিচারে ছবিটাকে দুর্দান্ত না বলতে পারলেও ভাল বলতেই হবে। নদীতীরের বা রেলব্রিজের ওপরে লংশটের দৃশ্যগুলোর কথা আলাদাভাবে বলব। আবহ সঙ্গীত অনেকটাই প্রথাগত, যুদ্ধের দৃশ্যগুলোতে প্রথাগত দামামা বা পরিচিত দেশের গানের নেপথ্য সুরের কথা এই মুহুর্তে মনে পড়ছে। এখানেও বাঁধাগতের বাইরে গিয়ে অন্য কিছু করার যথেষ্টই অবকাশ ছিল। তবে একটা কথা বলতেই হবে, রাশেদের ওপর থেকে ফোকাসটা মাঝে মাঝেই সরে গিয়েছে বলে মনে হয়েছে। মূল বইটা না পড়া থাকলে এই ব্যবধান আসলে ঠিক গোচরে আসবেনা, তবে স্পটলাইট আরেকটু কম ইবুকেন্দ্রিক হলেও পারত। এটা অবশ্য আমার একান্তই নিজস্ব পর্যবেক্ষণ, এর সাথে একমত হবেননা এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া যেতেই পারে।

৫.

ছবির শেষ দিকের অংশটকুর জন্য আসলে অনেকটাই মুখিয়ে ছিলাম। যুদ্ধের ডামাডোলে একদল অকুতোভয় কিশোরের রোমাঞ্চকর কাহিনি যেমনি আচমকা শুরু হয়েছিল , অমনি সেটা আচমকাই শেষ হয়ে গেল। ইবু তার অনেক দিনের গোপন ক্ষত শত চেষ্টা করেও মুছে ফেলতে পারেনা, তাই সে টের পায়, রাশেদের সাথে তার অদৃশ্য এক ধরনের যোগসূত্র রয়েই যায়। সেই রাশেদ, যার বাবা খানিকটা "পাগলা কিসিমের", যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির হালহকিকত রাখে, সেই রাশেদ, যে কিনা ভয়ের তোয়াক্কা না করে গুলি বয়ে নিয়ে যায়, যে কিনা আহত মুক্তিযোদ্ধা শফিক ভাইকে দুঃসাহসিকভাবে ছিনিয়ে আনে, যে কিনা মৃত্যুকে আয়নায় দেখেও জয় বাংলা বলতে কুন্ঠাবোধ করেনা। এসবই বহবার পড়া, চোখ মুদলেই আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাই। সবকিছুর পরেও রাশেদের জন্য আমার ভেতরের স্পর্শকাতর অনুভূতিতে নাড়া দেওয়ার জন্য মোরশেদুল ইসলাম একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। তাই এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাদের প্রজন্মের যাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবেগের বিশেষ স্থান রয়েছে, যারা কৈশোরের মাতাল করা সময়ে "আমার বন্ধু রাশেদ" পড়ে এক অব্যক্ত বেদনায় কাতর হয়েছে, তাদের কিশোরবেলার সেই সুপ্ত স্মৃতির শহরে আরেকটা দুর্দান্ত সফরের জন্য এই ছবির চেয়ে মোক্ষম দাওয়াই আর কিছু হতে পারেনা।

No comments:

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...