যাত্রীরা হুঁশিয়ারঃ
আগে থেকেই জানতাম, থানচি আদতে একটা থানা। তবে এখানেও আমাদের জন্য বেশ বড়সড় একটা চমকই অপেক্ষা করছিল। চাঁদের গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে দেখি, সামনে কোন রিকশা বা ভ্যানের টিকিটিরও দেখা নেই। আচ্ছা মুসিবতে পড়া গেল তো! সামনে এগিয়ে তো বিলকুল কপালে হাত, আমাদের আস্ত একটা নদীই পার হতে হবে, তাও একেবারে দেশি হাতনৌকায়। অবস্থা বেগতিক দেখে আমরা খানিক দোনোমনা করছিলাম কিন্তু খানিক বাদে দেখলাম মানুষজন পিলপিল করে নির্বিবাদে ওই নৌকায়ই পার হচ্ছে। এবার আর গড়িমসির বালাই না করে নৌকায় চড়ে বসলাম। নদীটা অবশ্য ও জায়গায় খুব বেশি চওড়া ছিলনা, তার পার হতে খুব একটা সময় লাগেনি।
যাহা ছিল নিয়ে গেল কাঠের তরী...
দুষ্টু ছেলের দল
বাসস্থান বিড়ম্বনাঃ
থানচি বাজারে গিয়ে এর চেয়েও বড় গ্যাড়াকলে পড়া গেল, গতর রাখার জন্য একটুকরো আশ্রয় এখন কই মেলে? বাজারে খোঁজখবর করে জানলাম এখানে একটা সরকারী বিশ্রামাগার আছে, বরাত ভাল হলে ওটাতেই ঠাঁই মিলতে পারে। বরাতটা আসলে আমাদের একটু বেশি রকমেরই ভাল ছিল, কারণ দৈবক্রমে রেস্টহাউসের কেয়ারটেকারের সাথে আমাদের বাজারেই দেখা হয়ে গেল। তিনি জানালেন, আপাতত রেস্টহাউস ফাঁকাই আছে, আমাদের জন্য তিনটে রুমেরও আশ্বাস দিয়ে দিলেন। আমরা তখন রাতটা যেনতেনপ্রকারে কাটানোর জন্য তৈরি ছিলাম, আর এ যে মেঘ না চাইতেই জল! জলদি মালপত্র রেস্টহাউসে রেখে একটু হাঁফ ছাড়া গেল। ওদিকে পেটের ভেতর ছুঁচোরা তখন ডনবৈঠক করছে। বাজারেই শুনলাম, এই সময়টাতে নাফাখুম প্রত্যাবর্তনকারীদের হারটা খুব বেশি, গত দুদিন নাকি দেদার মানুষ থানচি ছেড়ে গেছে। আর কি অদ্ভুত কাকতাল, সেখানে আবার আমাদেরই জনাকয়েক ভার্সিটিফ্রেন্ডদের সাথে দেখা, ওরা অবশ্য রাতটা থানচিতে কাটাবেনা, দুপুরের খাওয়া সেরেই তিন্দু নামের আরেকটা জায়গায় রওনা দেবে, রাতটা তাদের ওখানেই(তিন্দুতে) কাটানোর খায়েশ।
ঠাঁই মিলেছিল যেথায়ঃ
একরত্তি বাজার
জীবনজোব্বাই জীয়নকাঠি!:
থানচি একদমই একটেরে একটা জায়গা, একটা সরু পাকা রাস্তা বাজারের বুক চিরে চলে গেছে, তারই দুপাশে সব দোকানপাট। বিদ্যুতের জন্য সূর্যদেবই ভরসা, সেটা দিয়েই নৈমিত্তিক প্রয়োজন মেটাতে হয় থানচিবাসীকে। রাজ্যের খিদে নিয়ে আমরা যখন একটা হোটেলে ঢুকে পড়লাম বেলা তখন তিনটা ছুঁই ছুঁই। আমাদের হকিকত ছিল এমনই, ওরকম উটকো সময়ে এসব বিটকেলে জায়গায় যা পাওয়া যায় তাই সই। তাই আন্ডার ঝোলের সাথে কচুর তরকারি দিয়ে গলা পর্যন্ত গিললাম, তবে দামটাও কিন্তু ছিল গলাকাটাই। এরকম আনকোরা স্থানে ট্যুরিস্টদের কিছু মালকড়ি গচ্চা দিতেই হয়, তা ও নিয়ে আর খুব একটা গা করিনি। সে যাকগে, খেয়েদেয়ে এসে এবার আমাদের রোখ চাপল, এই মওকায় আমাদের সাধের লাইফজ্যাকেটগুলো নিয়ে একটু হাত-পা মকশো করা যাক, সুযোগ যখন পেয়েছিই। আমাদের রেস্টহাউস থেকে সামনে এগুলে একটা পুকুর ,জলটাও মনে হল বেশ টলটলে। পারলে তো তখনই লাফ দেই এ অবস্থা। যাই হোক, জীবনজোব্বাগুলো গায়ে চড়িয়ে আমরা নেমে পড়লাম জলকেলিতে। ওইদিন সূর্যের তেজ ছিল দারুণ কড়া, আমরা ঘেমে নেয়ে তখন মোটামুটি সারা। পানিতে নামার সাথে সাথে একটা দুর্দান্তরকম প্রশান্তিতে মনটা ভরে উঠল, আর প্রথমবারের মত পানিতে ভাসার মজা তো ছিলই, হোক সেটা লাইফজ্যাকেটের আনুকূল্যে। কিছুক্ষণ হাস্যকরভাবে বেধড়ক হাত পা ছোঁড়ার পর খেয়াল হল, পুকুরের ওপাশে একটা স্কুল, আর সেই স্কুল থেকে কচি কাঁচার দল আমাদের দিকে পলক না ফেলে তাকিয়ে আছে। বুঝলাম ওদের জন্য কতক মাথাবিগড়ানো তরুণের বালসুলভ জলকেলির এমন দুর্লভ বিনোদন হাতছাড়া করা আসলেই শক্ত। ব্যাপার বুঝে আর বেশি সময়ক্ষেপণ করিনি, ওবেলার মত জলক্রীড়ায় ইস্তফা দিতে হল।
নেটওয়ার্কের বাইরে!
এসবকায়কারবার শেষ করতে করতে বেলা ততক্ষণ অনেকদূর গড়িয়ে পড়েছে। আমাদের শরীরে তখন রাজ্যের ক্লান্তি, তাই বিছানায় শুতে না শুতেই সটান ঘুম। ঘুম ভাঙ্গার পর দেখি বাইরের আলো ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে, সন্ধ্যা হয়ে এল বলে। এখন এক কাপ চা না হলেই নয়। আর আশপাশটা একটু ঘুরে বেড়ালেও মন্দ লাগবেনা। তাই পরের আধাঘন্টায় সবাইকে ঘুম থেকে টেনেহিঁচড়ে তুলে বাজারমুখী হলাম। থানচি বাজার যে নেহায়েতই গরিবী হালের সেটা আগেই আভাস দিয়েছিলাম। তবে ভালমত ঘুরে টের পেলাম, ছোট হলেও মোটামুটি সব ধরনের জিনিসই এখানে সহজলভ্য। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, থানচির মানুষ বেশ ভাল রকম দেশপ্রেমিকও বটে। এখানে এসে একটা জরুরী ফোন করতে গিয়ে দেখি, গ্রামীণের নেটওয়ার্ক বেমালুম গায়েব। রবি, বাংলালিংক বা ওয়ারিদের (হালের এয়ারটেল) অবস্থাও তথৈবচ। তখন আমাদের মধ্যে একমাত্র টেলিটকধারীর মুখে ষাট ওয়াটের ঝকঝকে হাসি। জানা গেল, এখানে টেলিটকের একচেটিয়া ব্যবসা। দেশের টাকা বাইরে লোপাট হতে না দেওয়ার জন্য থানচিবাসীকে একটা ধন্যবাদ তাই দেওয়াই যায়।
ভোরের থানচি
সূয্যিমামা ওঠার আগে উঠব আমি জেগেঃ
এবার তবে উপায়?:
মুশকিলটা শুরু হল আসলে ঠিক এরপর। আমামদের পরদিন ভোরেই থানচি থেকে রেমাক্রিবাজার যাওয়ার প্ল্যান, তাই নৌকা ঠিক করে ফেলা তখন আশু দরকার। হাতে বিকল্প ছিল দুটি, বৈঠা নৌকা আর ইঞ্জিনচালিত নৌকা। বৈঠা নৌকার অসুবিধে হল সময়টা লাগবে অনেক বেশি, অয়ার উল্টোপিঠে সুবিধা এই, ইঞ্জিনের কর্ণবিদারী ঘ্যাড়ঘেড়ে আওয়াজ থেকে নিস্তার মিলবে। খরচের দিক দিয়েও বৈঠা নৌকাই সাশ্রয়ী ছিল। তো সাতপাঁচ ভেবে আমরা বৈঠা নৌকার পক্ষেই রায় দিলাম। প্ল্যান তো ঠিক হল, এবার কার্যোদ্ধারের পালা। বাজার চষে বেড়িয়ে একজন মাঝি ঠিক করে ফেলা হল, তিনি আশ্বাস দিলেন দুটো নৌকাতেই আমাদের কাজ চলে যাবে, আর ভাড়াটাও আমাদের নাগালের মধ্যেই। এসব যোগাড়যন্তর করতে করতে নৈশভজের সময় হয়ে এল। লইট্টা মাছ আর শুটকির তরকারি দিয়ে আহার শেষে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, তখন নয়টাও বাজেনি। ওদিকে থানচি তখনই বেশ শুনশান হয়ে পড়েছে, আমাদের রেস্টহাউজেও কেমন এক ধরনের ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা। একজন প্রস্তাব দিল, চল, ছাদ থেকে খানিক ঘুরে আসি। ছাদটাও দিব্যি খোলামেলা, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, অগুণিত তারাদের মেলা বসেছে। ইটকাঠের জঞ্জালে তারা দেখার আসল মজা কখনোই ঠিকমত পাইনি, একসাথে এত তারা দেখে আমাদের নবিশ চোখ তাই আদপেই টেঁসে গিয়েছিল।
সাঙ্গু নদীর তীরেঃ
সহস্র সারসঃ
সার বাঁধা নৌকাঃ
ও মাঝি নাও ছাইড়া দে...:
আড্ডা মারতে মারতে তখন ঘন্টাদুয়েক পেরিয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটা বারটা ছুঁই ছুঁই। পরেরদিন খুব ভোরে উঠতে না পারলে সারাদিনের প্ল্যান মাটি, তাই আড্ডার পাট ওখানেই চুকিয়ে দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে টের পেলাম, শেষরাতের দিকে ভালই একপশলা বাদলা হয়েছে, সবকিছু আর ঝকঝক করছে। কিন্তু এই উটকো বৃষ্টির জন্য খানিক বাদেই যে আমাদের হাপিত্যেশ করতে হবে সেটা আমরা কস্মিনকালেও ভাবিনি। চটজলদি মালপত্র গুছিয়ে যখন নাস্তা করতে বের হব, তখন আমাদের মাঝি দিল আচমকা দুঃসংবাদ। আগের রাতের উটকো বৃষ্টিতে নদীর পানি নাকি বেশ বেড়ে গেছে, তাই দুজন মাঝির একজন নিমরাজি থাকলেও আরেকজন ধনুকভাঙ্গা পণ করেছে, সে যাবেইনা। ব্যাপার শুনে আমাদের মাথায় হাত। খোঁজ নিয়ে জানলাম, নদীর বেশ ক জায়গায় আমাদের খাড়া চড়াই এর মত পার হতে হবে, তাই হাত নৌকা নিয়ে গেলে সাড়ে সর্বনাশ হতে পারে। এখন মুশকিল আসান করতে আমাদের মাথার চুল ছেঁড়ার উপক্রম। বেমক্কা এখন নতুন নৌকা পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, যাত্রা্টাও এভাবে অকালে মাঠে( পড়ুন থানচিতে) মারা যায় কিনা সেটা ভেবে আমরা তখন জেরবার। এমন সময় খবর পেলাম একটা ইঞ্জিননৌকা ফাঁকা আছে, কিন্তু মওকা পেয়ে তারা দামটাও হাঁকালো ভালই। আমাদের ধড়ে অবশ্য ততক্ষণে প্রাণ ফিরে এসেছে, তাই মুলোমুলির ভাবনা ঝেড়ে ফেলে ওটাতেই চেপে বসলাম। এদিকে লাগল আরেকটা কেলো, আমাদের থানচির বিডিআর চেকপোস্ট থেকে অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি নেওয়ার হ্যাপাও অনেক, সবার নামধাম ঠিকানা দিতে দিতে অনেক সময়ক্ষেপণ হয়ে গেল।কাকভোরে রওনা দেওয়ার কথা থাকলেও দেখতে দেখতে বেলাও গড়িয়ে গেল অনেক। অবশেষে সকাল আটটা নাগাদ আমরা এগার জন ইঞ্জিননৌকায় সওয়ার হয়ে থানচি ছেড়ে গেলাম। এবারের গন্তব্য রেমাক্রিবাজার।
No comments:
Post a Comment