আগেই বলে রাখছি এটা ঠিক কোনো প্রথাগত রিভিউ নয়, বরং তাৎক্ষণিক পাঠপ্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে।
প্রচলিত ধারণা সম্ভবত এটা, একজন লেখকের জন্য প্রথম বই লেখাটা সবচেয়ে কঠিন। তবে আমার কাছে মনে হয়, দ্বিতীয় বইটাই তার জন্য সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। বই অনেকেই লেখেন, হৃদয়ের কথা বলতেও কমবেশি সবাই ব্যাকুল থাকেন। প্রথম বইয়ে সেসবই বলে ফেলা যায় নিঃসংকোচে। তবে দ্বিতীয় বইয়ে সেই বলাতে ভর করতে পারে একটু দ্বিধা, লেখক হয়ে ওঠার পাথুরে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের কথা বলাটাই তখন ভীষণ দুরুহ একটা কাজ।
তাহলে এই উপন্যাসের ভেতর কী আছে? প্রথম লাইন থেকেই আছে প্রবলরকম একটা অস্বস্তি। ‘কমফোর্ট জোনের’ বাইরে গিয়ে রঙিন চশমাটা খুলে ফেলে অন্য একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। সেজন্য এই বইটা ঠিক চট করে তারিয়ে তারিয়ে পড়ার মতো নয়। সমর কুমার চাকমা, আরিফ, হিমেল , বিজন দেওয়ান বা শামীম আজাদরা প্রতিটা মুহূর্তেই পাঠকের উরুসন্ধি বরাবর কেমন যেন একটা খোঁচা দিয়ে যান। তবে চিন্তাশীল পাঠক সেই অস্বস্তির কাঁটা নিয়েই পড়ে যাবেন, সেটি নিশ্চিত।
খানিকটা পড়তে পড়তেই উন্মার্গিক ঢাকা শহর থেকে সেই যাত্রায় চলে যেতে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে। পর্যটকদের কাছে এই জায়গার এখন অনেক কদর, সাইড়ু, সাজেকের সুবাদে সেখানে এখন চেকিনগুনিয়ার দাপটও কম নয়। এসব বাদ দিয়ে পাহাড়ের ভেতর ট্রেকিং করতে গিয়ে একদম গহীনেও গেছেন অনেকে। নিজেরও কয়েকবার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেটির সুবাদে পাহাড়ের মানুষদের সঙ্গে অল্প বিস্তর সুখ দুঃখের কথা বলেছি। এই উপন্যাসের বেশ কিছু অংশের সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে তাই সমস্যা হয় না। শান্ত সমাহিত জনপদের বাইরেও মরমে মরে যাওয়া যে অন্যতর পাহাড়, সবুজের আড়ালে রক্তে লাল হয়ে যাওয়া পাহাড়ের খবর আসলে আমরা কয়জন জানি? বা জানলেও সেটা আমরা গা করি কজন? ওই তো একুশে ফেব্রুয়ারি এলে হয়তো ওদের মাতৃভাষা নিয়ে এক দুইটা ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করি, এক দুইটা রেপ হলে হয়তো এক দুইটা হ্যাশট্যাগ দিই, লংগদুতে ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হলে হয়তো কিছু স্যাড রিঅ্যাকশন দিয়ে আসি- এই তো। তাও তো ফেসবুক-ইউটিউব এসে কিছু জানতে পারছে অনেকে, আগে তো এসব চাপা পড়ে যেত জলপাই বর্মের আড়ালে।
দুই মলাটে সমর, বিজয় দেওয়ানদের গল্প পড়তে গিয়ে তাই প্রবল একটা ঝাঁকি খাই। এর মধ্যে ফুটবল এসে দুদন্ড শান্তি দেবে বলে মনে হয়, লেখকের বর্ণনায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের প্রতিটি ঘাসও হয়ে ওঠে বাঙময়। তবে দলাদলি, নোংরামি এখানেও আছে, তার ভেতরেই লড়ে যেতে হয় সমর আর শামীমদের। এখানে যেন কিছুটা মতি নন্দীর সেই ফ্লেবারটা পাওয়া যায়। তবে সন্তর্পণে বুঝে যেতে হয়, ফুটবলটা এখানে নিছকই একটা ক্যামোফ্লাজ।
খানিক পড়েই তাই শান্তিপ্রিয়ার জন্য মনটা উতলা হতে থাকে, জানতে ইচ্ছে করে বিজয় দেওয়ানদের জামিনে ছেড়ে দেওয়া হলেও জানে বাঁচতে দেওয়া হবে তো? আনসার আলীদের মতো পাহাড়ে পাকিপনা করনেওয়ালা অনেকে আছেন, তারা কি জুমঘরে আগুন লাগিয়েই যাবেন? এমন অস্বস্তি, চাপা আতঙ্ক আর উদ্বেগের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে পদতলে চমকায় মাটি।
এর মধ্যেই উঁকি দিয়ে যান হারিয়ে যাওয়া সেই কল্পনা চাকমা, বন্দুকযুদ্ধে নিহত রক্তাক্ত মানবেন্দ্র লারমার লাশ। ও হ্যাঁ, এক ফাঁকে দেখা দিয়ে যান পাইপ টানা মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নামের লোকটাও। পাহাড়ের জন্য যাঁর মমতা ছিল অসীম, লোগাং গণহত্যার ঠিক পরে যিনি নিজেই ছিলেন পাহাড়ে। লেখকের করোটিতে ইলিয়াস বেঁচে থাকেন আশ্চর্য সজীব হয়ে। মনোরম মনোটোনাস ঢাকা শহরের বর্ণনায় ইলিয়াসের সেই ছায়া আরও ভালোভাবে টের পাওয়া যায়, চিলেকোঠার সেপাই বা খোয়াবনামার মতোই যেন চাবুক মারতে থাকে পদতলে চমকায় মাটি; আমাদের ভীষণ অস্বস্তিকে সঙ্গী করে, আমাদের চেনা জগতের আরও সব ভণ্ডামির মুখোশ খুলতে খুলতে। এই মানদণ্ডে অন্তত, পদতলে চমকায় মাটিকে তাই উপেক্ষা করা যায় না। কমফোর্ট জোনের বাইরে বেরিয়ে আসার এই চেষ্টা এই সেলফিসর্বস্ব যুগেই বা কম কী?