Sunday, February 27, 2022

ঢাকার প্রেম


 ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি, অসিত আর হিতাংশু; ঢাকায় পুরানা পল্টনে, উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা, সেই পুরানা পল্টন, সেই মেঘে-ঢাকা সকাল!’
 
কয়েকটা লাইনেই মনটা কেমন নস্টালজিক হয়ে ওঠে, তাই না? যেন একসঙ্গে ভীড় করে আসতে থাকে ধোঁয়া ধোঁয়া সেই পুরনো প্রেমের ছবি। বুদ্ধদেব বসুর ‘আমরা তিনজন’ গল্পের এই শুরুটা শুধু বাংলা সাহিত্যের-ই নয়, ঢাকার ইতিহাসেরও অংশ হয়ে গেছে। ঢাকার প্রেম বললেই তাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরনো পল্টনের সেই তিন প্রেমিকের ছবি। সবাই একসঙ্গে প্রেমে পড়েছিল অন্তরা নামের সেই মেয়ের, শেষ পর্যন্ত তিন জনই হয়ে গিয়েছিলেন ট্র্যাজেডির নায়ক। পুরনো পলটনের বাতাসে তাই আজও ভেসে বেড়ায় তিন প্রেমিকের দীর্ঘশ্বাস।
ঢাকা শহরটা যত পুরনো, প্রেমও ঠিক ততটাই। বুদ্ধদেব বসুর গল্পের তিন প্রেমিক পলটনের মাঠে শুয়ে হারিয়ে যেত ঘোরে। তবে ঢাকার বাতাসে প্রেম কিন্তু নীরবে না, সরবেই এসেছিল অনেক আগে থেকে। মোঘল আমলে ঢাকার নারীরা ছিল কঠোর অন্তঃপুরবাসিনী, পর্দাপ্রথার ভেদ করে পরপুরুষের সাথে চোখাচোখির বেশি কিছুর সুযোগ তখন কমই ছিল। বিশেষ করে অভিজাত মুসলিম পরিবারের হলে তো কথাই নেই। কিন্তু প্রেম কি অতশত বাধা মানে? ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজও তাই প্রেমিক-প্রেমিকাদের ফিসফিসানি ঠিক ঢাকতে পারত না। এর মধ্যেই এক দুইটি প্রেমের গল্প হয়ে থাকে অমর। সেটাও অবশ্য সফল প্রেম নয়, ইউসুফ-জুলেখা বা লায়লী-মজনুর মতো ব্যর্থ প্রেম। আপনি জেনে একটু অবাক হতে পারেন, ঢাকার সবচেয়ে ট্রেডমার্ক খাবার যেটা, সেই বাখরখানির নামই এসেছে একটা কিংবদন্তি ট্র্যাজেডি থেকে।  
 
গল্পটা একটু খোলাসা করে বলা যাক। ঢাকার প্রথম স্বাধীন নবাব ছিলেন মুর্শিদ কুলি খাঁ। তাঁরই দত্তক ছেলে আগা বাকের। বলা যায় বাবার একেবারে যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন বাকের। যেমন মেধায়, তেমনি অস্ত্রবিদ্যায়ও তুখোড়। কিন্তু সেই বাকের প্রেমে পড়ে গেল রাজধানী মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগমের। এই খনি বেগমের সৌন্দর্যের খ্যাতি সেই সময় ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো ঢাকায়। নবাবপুত্র বাকেরও তাই মজে গেল সেই রূপসীর প্রেমে। কিন্তু এই গল্পে এবার হাজির হলো একজন ভিলেন। বউজিরপুত্র নগর কোতোয়াল জয়নাল খানও ছিল খনি বেগমের প্রেমপ্রার্থী।  খনি বেগমকে প্রেমও নিবেদন করে সে-ওকিন্তু খনি বেগম তো আগেই মন দিয়ে বসেছে আরেকজনকে। জয়নাল খানকে তাই বিফল হতে হলো। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে জয়নাল ভাবে, খনি বেগমকে একটা কঠিন শাস্তি দিতে হবে। ঘটনাচক্রে সেটা জানাজানি হয়ে যায়,  আগা বাকের জয়নালকে হুমকি দেয় দেখে নেওয়ার। সেই সময়ে যা হতো, এরপর ঠিক হলো দুজনের তলোয়ারযুদ্ধ হবে। ওদিকে ঘটতে থাকে আরেক কাহিনি। জয়নালের দুই বন্ধু উজিরকে মিথ্যা খবর দেয় যে, বাকের জয়নালকে হত্যা করে লাশ গুম করেছে। উজির নবাবের কাছে গিয়ে বলে, ‘হুজুর আমার ছেলে হত্যার বিচারের বিচারের ভার আপনার কাছেই দিলাম’। নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ ছিলেন কঠিন নীতিপরায়ণ মানুষ। ছেলেকে অপরাধের শাস্তি দেন তিনি, বাকেরকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বাঘের খাঁচায়। কিন্তু বাঘের আর সাধ্য কি তার সঙ্গে এঁটে ওঠার?  বাকেরের হাতে মারা যায় বাঘ। এর মধ্যে ফাঁস হয়ে যায় জয়নালের মারা যাওয়ার মিথ্যা খবর। চতুর জয়নাল ওদিকে খনিকে অপহরণ করে নিয়ে যায় দক্ষিণ বঙ্গে। বাকেরও খবর পেয়ে যান, সত্যিকারের প্রেমিকের মতোই খনিকে উদ্ধার করতে পিছু নেয় জয়নালের। এরপর আবার টক্কর লাগে দুজনের। কুচক্রী জয়নাল খান বাকেরকে হত্যার চেষ্টা করতে গেলকিন্তু উজির এবার নিজে এসে পড়েন। বাকেরকে বাঁচিয়ে নিজের ছেলেকে হত্যা করেন তলোয়ারের আঘাতে। তবে তার আগে জয়নাল তলোয়ার ঢুকিয়ে দেয় খনি বেগমের বুকে, বাকেরের কোলেই ঢলে পড়ে খনি। বাকেরগঞ্জে সমাধিস্থ করা হয় খনি বেগমকে। আর বাকের সবকিছু ছেড়ে রয়ে গেল প্রিয়তমার সমাধির কাছে দক্ষিণ বঙ্গে। বাকেরের নামেই বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ বা এখন যেটা পটুয়াখালি-বরিশাল, সেই অঞ্চলের নাম হয় বাকেরগঞ্জ। আর বাকের আর খনির নাম থেকেই এসেছে বিখ্যাত বাকরখনি, যেটা দিয়ে নাস্তা না হলে পুরনো ঢাকার লোক দের চলেই না।
এই প্রেম নিয়ে অবশ্য কোনো সিনেমা হয়নি। তবে গল্পটা কিন্তু সিনেমা হওয়ার মতোই। ঢাকার প্রেম নিয়ে অবশ্য লেখা হয়েছে অনেক গল্প-উপন্যাস-কবিতা। বুদ্ধদেব বসুর কথা তো বলা হয়েছে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের বিখ্যাত হয়তো গল্পেও এসেছে ঢাকার রহস্যময় প্রেম। এই প্রেমের শুরু ধোলাইখালের ওপর নির্মিত লোহারপুলে। কোনো এক দুর্যোগের রাতে লোহারপুল পাড়ি দিচ্ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। সেই অন্ধকার রাতে দেখলেন শুনশান ব্রিজের ওপর এক পুরুষ ও এক নারী দুই দিক থেকে অতিক্রম করলো পরস্পরকে। প্রেমেন্দ্র মিত্র তাদের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন অন্যরকম একট প্রেম। সেই থেকেই লেখা হলো তার বিখ্যাত গল্প ‘হয়তো’।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের সেই ত্রিশের দশকের ঢাকার প্রেমের সঙ্গে আজকের ঢাকাকে অবশ্য মেলানো যাবে না একদমই। ত্রিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকেও ঢাকা ছিল অনেকটাই শান্ত, নিথর। তখনও ঢাকার অত তাড়াতাড়ি কোথাও যাওয়ার তাড়া ছিল না। হ্যাঁ, সেই সময়ে প্রেম করার মতো নিরিবিলি জায়গার অভাব ছিল না, তবে কাজটা সহজ ছিল না মোটেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীদের সংখ্যা তখন বাড়তে শুরু করেছে। স্বাভাবিকভাবেই যৌবনধর্মের অমোঘ টানে শুরু হয়েছে মন দেওয়া নেওয়ার পালা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক লুকোচুরি করে সেই সুযোগ কিছুটা মিলত বটে, তবে যোগাযোগ করতেও কত হ্যাপা। মোবাইল তো দূরে থাক, তখনকার দিনে ল্যান্ড ফোনও ছিল না ঠিকঠাক। চিঠি লেখা ছাড়া তো গতি নেই প্রেমিক-প্রেমিকাদের, তবে সেই চিঠি দেওয়াটাই হতো মুশকিল। প্রক্টরের মাধ্যমে দিতে হতো চিঠি। একবার তো প্রক্টর যাতে বুঝতে না পারেন, সেজন্য আরবী বিভাগের এক ছাত্রী প্রেমিককে চিঠিই লিখল আরবীতে। সেই চিঠির মর্ম প্রেমিক কীভাবে উদঘাটন করেছিল, সেটা অবশ্য একটা প্রশ্ন।
তবে ঢাকায় তখন আজকের মতো প্রকাশ্যে প্রেমিক-প্রেমিকারা এতোটা ঘুরে বেড়াত না। লোকলজ্জার ভয়টাই ছিল বড়, সেজন্য একসঙ্গে রিকশা ঘরে ঘোরার ক্ষেত্রেও কত সতর্কতা! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাসের ভেতরেই প্রেম করত, কখনো যেত রমনা পার্কে। একটা সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভাবন ছিল এখনকার ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সি গেটে, তার পাশেই ছিল খেলার মাঠ। একটু নিরিবিলিতে প্রেম করার জন্য সেটা ছিল মোক্ষম একটা জায়গা। ষাট বা সত্তরের দশকে এসে আরেকটু শিথিল হয় সামাজিক বিধিনিষেধ, রাস্তাঘাটে প্রেমিক-প্রেমিকাদের আনাগোনাও একটু একটু করে বাড়তে থাকে। তখন অবশ্য হবু প্রেমিকদের অন্যতম গন্তব্যস্থল ছিল নিউ মার্কেট, তন্বী যুবতীরা সেখানেই ভীড় করত বেশি। এখনকার মতো তখন কথা বলার এত সাহস তো যুবকদের ছিল না। কাউকে দেখে পছন্দ হয়ে গেলে কোনোভাবে তার পিছু নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত দেখে আসা- এটাই ছিল অনেক বড় সাহসের কাজ। কাজটা অবশ্য এখনকার যুগের মতো এতোটা কঠিন ছিল না। তখন গাড়িঘোড়া ছিল রাস্তায় কম, ট্রাফিক জ্যামেরও এতো বালাই ছিল না।
এরপর আশি বা নব্বই দশকে এসেও প্রেমের গল্প খুব একটা বদলায়নি। তখন ল্যান্ডফোন মোটামুটি সুলভ হতে শুরু করেছে, সেটা ছিল যোগাযোগের ভালো একটা উপায়। বাসার কড়া নজরদাড়ি এড়িয়ে সেই ল্যান্ডফোনে চলত প্রেমিক-প্রেমিকাদের ফোনালাপ, তবে ধরা হয়ে গেলে একেবারে ফোনে তালা। আর কার্ডফোনের চলও শুরু হয়েছে, সেখানে ঢুকে পয়সা ফেলেও কথা বলা যেত। ওদিকে প্রেমপত্রের মাধ্যমে ভাব বিনিময় তো চলতই। সিনেমার গানের সীমা পেরিয়ে তখন ব্যান্ড সংগীত জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে, প্রেমিক-প্রেমিকারাও হতে শুরু করেছেন আরেকটু সাহসী।
ঢাকার সেই প্রেম হুট করে বদলে যেতে শুরু করে মোবাইল-যুগে এসে। সেই প্রথম ল্যান্ডফোনের বাধা পেরিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকারা হতে শুরু করেছে আরও কাছের। এর মধ্যে ঢাকা আরও বেশি ঠাসবুনোটের হয়েছে, অন্তরঙ্গ আলাপের জন্য জায়গা খুঁজে পাওয়া হয়েছে আরও কঠিন। মুঠোফোন আরও বেশি মানুষের নাগালে এসেছে, কিন্তু কমেছে অভিসারের জায়গা। ভদ্রস্থ প্রেমের জন্য গজাতে শুরু করেছে রেস্টুরেন্ট, প্রেমিক-প্রেমিকারা সেখানেই করতে শুরু করেছে ভীড়। এর মধ্যে মোবাইল যুগ হয়ে গেছে স্মার্ট-ফোন আর ফেসবুকের যুগ। চেকইন আর সেলফি প্রেমকে করেছে আরও বেশি ভার্চুয়াল। কিন্তু এক চিলতে জায়গা খুঁজতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের হতে হয়েছে জেরবারপয়লা ফাল্গুন থেকে ভালোবাসা দিবসে সেই টিএসসিই হয়ে পড়ে লোকে লোকারণ্য। ফেব্রুয়ারিতে অবশ্য আরেকটু সময় কাটানোর সুযোগ মেলে প্রেমিক-প্রেমিকাদের, এটা যে বইমেলার মাস! বইপ্রেমী যুগলরা একসঙ্গে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নেন প্রাণভরে, পরস্পরকে তারা দেন কবিতার বই।
শত ব্যস্ততা, শত নাগরিক ক্লেশে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া এই মনোরম মেট্রোপলিসের বাতাসেও ভেসে বেড়ায় প্রেম। হোক সেটা ফুচকার দোকানে, রিকশার হুডের নিচে বা রেস্টুরেস্টের চেকিনে। প্রতিদিন ঢাকার আয়ু একটু করে বাড়ে, আর বাড়ে তার প্রেমের বয়সও। ঢাকার প্রেম তাই হয়তো বুড়িয়ে যায়, ফুরিয়ে যায় না।
 

 

Wednesday, April 21, 2021

অন্ধের স্পর্শের মতো চলে গেলেন শঙ্খ ঘোষ

 সব কবিদের গদ্য সুন্দর হয় না। কেউ কেউ আছেন যাদের দুই হাতে একসঙ্গে বাজে কবিতা আর গদ্যের যুগলবন্দি। শঙ্খ ঘোষের গদ্যই সত্যিকার অর্থে পড়েছিলাম আগে। বইয়ের ঘর বইতে পড়েছিলাম একটা বইয়ের দুই মলাটে ভিড় করে থাকা গল্প। কী মোলায়েম সেই ভাষা! এরপর পড়লাম অন্ধের স্পর্শের মতো। এরপর আরও নানা কিছু। বইয়ের ঘর থেকে কয়েকটা ছত্র এখানে তুলে দিচ্ছি। 


"আবারও কি তবে হারিয়ে ফেললাম বইখানা?

আগেও হারিয়েছিলাম একবার। সেটা টের পাবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছিল অল্প বয়সের একটা অংশই যেন হারাল আমার জীবন থেকে। সেটা যে বইয়ের ভিতরকার কোন মহিমার জন্য, তা কিন্তু নয়। সেটা তার চারপাশে ঘিরে থাকা অনুষঙ্গের জন্য। ভিতরের কথাগুলি ছাড়াও আরো কত সম্পদ থাকে বইয়ের, থাকে কত ব্যক্তিগত মুহূর্তের স্তবকে স্তবকে খুলে যাওয়া স্মৃতি, কোনো একখানা বই হাতে নিলে যেন কোনো নিজস্ব জীবনাংশই জেগে ওঠে তাই। কোনো বইয়েরই কোনো বিকল্প-বই হতে পারে না, একই সংস্করণের একই মুদ্রণের হলেও তা হয় না। প্রত্যেকটা বই-ই জেগে থাকে তার একলা গরিমায়, একক ইতিহাসে।"

শঙ্খ ঘোষ একটা সময় ডুব দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে তার বই ‘এ আমির আবরণ” যারা পড়েছেন, তারা কিছুটা অনুভব করতে পারবেন কতটা মগ্ন ছিলেন তিনি রবীন্দ্রচৈতন্যে। সেটা ব্যাখ্যা করে বোঝানো মুশকিল, এবারও কয়েকটা লাইন তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।

‘যে মুখে তিনি আমার দিকে আসিতেছেন আমি যদি সেই মুখেই চলিতে থাকি তবে তাঁর কাছ থেকে কেবল সরিতে থাকিব, আমি ঠিক উলটা মুখে চলিলে তবেই তো মিলন হইবে।

তিনি রূপ ভালোবাসেন, তাই কেবলই রূপের দিকে নামিয়া আসিতেছেন। আমরা তো শুধু রূপ লইয়া বাঁচি না, আমাদের তাই অরূপের দিকে ছুটিতে হয়। তিনি মুক্ত, তাই তাঁর লীলা বন্ধনে, আমরা বদ্ধ, সেইজন্য আমাদের আনন্দ মুক্তিতে। এ কথাটা বুঝি না বলিয়াই আমাদের যত দুঃখ।’

শঙ্খ ঘোষের কবিতা নিয়ে খুব বেশি বলবার কিছু নেই। মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনের মতো মুখে মুখে ছড়িয়ে যাওয়া কবিতা ছাড়াও তার অনেক কবিতাই পরানের গহীনে নিয়ে কড়া নাড়ে। শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতার প্রায় সবগুলোই তাই হৃদয়ের অনেক কাছাকাছি। এর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিতাটা দিয়েই কবির প্রয়াণদিবসে এই বিদায়ী তর্পণ ... 

যে দূর দূরের নয়, যে দূর কাছের থেকে দূর

যে আকাশ ভরে আছে আকাশের ভিতর বিধুর

যে স্বর স্বরের চেয়ে চেয়ে শরীরের আরও কাছাকাছি

আমার ভিতরে আমি ক্ষীণ তার প্রান্ত ছুঁয়ে আছি।

যে তুমি তোমারও চেয়ে ছড়িয়ে রয়েছ অবিনাশ

যে তুমি পাথরে ফুল সে তুমি সজলে ভাসো শিলা

কালের আহত কাল তুলে নিয়ে যায় তাঁর শাঁস

এতদিন সয়ে থেকে তার পরে ছিঁড়ে যায় শিলা

ঘুমের ভেতর ঘুমে পড়ে থাকে ডানাভাঙা হাঁস

পাটল প্রবাহে তবু অবিকল জাগে এক টিলা।

আমি সেই স্তবে ভরা নীরব পলের পাশাপাশি

কিছুই না এর প্রেমে  অবলীন হয়ে আছি। 




Tuesday, December 29, 2020

টোটা রায় চৌধুরী: পটে আঁকা ফেলুদা

 খুব সম্ভবত বাঙালি দর্শকের ফেলুদা নিয়ে সারাজীবনের একটা অতৃপ্তি ছিল, পারফেক্ট ফেলুদা সেভাবে পাওয়া হয়নি কখনো। সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে সব্যসাচী চক্রবর্তী থেকে কখনো সখনো করা আবীর চট্টোপাধ্যায় থেকে সবাইকে নিয়ে হয়তো খুঁতখুঁতানি থেকে গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যজিৎ যেমন ছবি এঁকেছিলেন, ঠিক তেমন একটা ফেলুদা বোধ হয় পাওয়া গেল। সৃজিতের ফেলুদা ফেরতের প্রথম পর্ব ছিন্নমস্তার অভিশাপ দেখতে গিয়ে এরকমই মনে হচ্ছিল। 


টোটা রায় চৌধুরী লোকটার মুখের আদল ঠিক যেন সত্যজিতের আঁকা সেই ফেলুদার ছাপ। প্রথম দেখাতেই টোটাকে অনেকখানি মনে ধরে যাবে আপনার। সেই চৌকোনো মুখ, দোহারা গঠনের সঙ্গে অন্তর্ভেদী চোখ। সঙ্গে উচ্চতাটাও মোটামুটি ঠিকঠাক। এ তো গেল বাইরের দেখায়, অভিনয়ে টোটা কত পাবেন? এখানে হয়তো দুই রকম মত থাকতে পারেন। কেউ বলতে পারেন, টোটা বড্ড বেশি আড়ষ্ট, একটু যেন বেশিই গম্ভীর। এখানে টোটার হয়তো উন্নতির সুযোগ থাকলেও থাকতে পারে। তবে আমার মতো কারও মনে হতে পারে, টোটার এই মাপা অভিনয়টা ফেলুদার সাথে ভালোমতোই মানিয়েছে। ফেলুদাকে এরকমই খানিকটা স্বল্পবাক, চুপচাপ হিসেবে কল্পনা করেছিলাম। অবশ্যই রসবোধ ছিল, সেই ড্রাই হিউমার এখনো ঠিক টোটা হয়তো পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারেননি (যেটার মূল পরিচয় পাওয়া যেত জটায়ুকে টিপ্পনী কাটার মাধ্যমে)। তবে সব মিলে টোটা আপাতত উতরে গেছেন। 


এখানেই সারাজীবনের একটা আপসোস ছিল। সৌমিত্রের অভিনয় নিয়ে বলার কিছু নেই, সোনার কেল্লা বা জয়বাবা ফেলুনাথের সেই সৌমিত্রই আমাদের চিরচেনা ফেলুদা। কিন্তু ঠিক ফেলুদাসুলভ মুখের আদল বা ব্যক্তিত্বটা তার সেভাবে ছিল কি না সেটা তর্কসাপেক্ষ। সত্যজিত নিজেও যতটা না ফেলুদা, তার চেয়ে অনেক বেশি খুঁতখুঁতে ছিলেন জটায়ুকে নিয়ে। সেজন্য সন্তোষ দত্ত মারা যাওয়ার পর আর ফেলুদাই করলেন না। সৌমিত্রর ফেলুদা যাত্রা তাই দুইটি ছবিতেই শেষ (যদিও ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা আর গোলকধাম রহস্য নামে দুইটি টিভি চলচ্চিত্র করেছিলেন, কিন্তু সেগুলোর লিংক খুঁজে পেলাম না)।


সত্যিকার অর্থে ছেলেবেলায় আমরা সব্যসাচীকে দেখেই বড় হয়েছি। টিভিতে আমার প্রথম দেখা ফেলুদা গোঁসাইপুর সরগরমের সেই সব্যসাচী আর সেই জটায়ুতে রবি ঘোষ। সব্যসাচীর উচ্চতা, গড়ন সবকিছুই ঠিকঠাক। ড্রাই হিউমারটাও দারুণ, কিন্তু বড্ড দেরিতে ফেলুদা করা শুরু করেছিলেন। আর মুখাবয়বটাও ঠিক ফেলুদার সাথে মানানসই মনে হয়নি। একটা সময় আর কাউকে না পেয়ে বুড়ো বয়সেই তাকে ধরেবেঁধে ফেলুদা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবির আর পরমব্রতরা যে ফেলুদা করেছেন, সেগুলো আসলে কমবেশি ছেলেমানুষিই হয়েছে। শার্লক নিয়ে যেমন বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ আইকন হয়ে উঠেছে, বাঙালি সেভাবে আর ফেলুদাকে পায়নি। 




টোটা সেই আইকন হতে পারবেন কি না, সেটা এখনো অনেক দূরের পথ। সেজন্য সৃজিতেরও প্রচুর খাটাখাটনি করতে হবে। প্রথম চেষ্টায় তার নির্দেশনা উতরে যাওয়ার মতো, কিন্তু আবহসংগীত আর চরিত্র নির্বাচনে আরও উন্নতির সুযোগ আছে। অনেক জায়গায় আবহ সংগীত খাপছাড়া মনে হয়েছে। ফেলুদার মজা এই, ছোটখাট চরিত্রগুলোর অভিনয়গুণে প্লট আরও জমে উঠে। সেদিক দিয়ে নীলিমা দেবির মত কারও অভিনয় আরও ভালো হতে পারত। তবে জটায়ুতে অনির্বাণ আর নতুন তোপসে অ্যাভারেজ ছিলেন, তাদেরও সুযোগ আছে উন্নতি করার। 


তবে শুধু টোটার জন্যই ফেলুদা ফেরতের পরের অধ্যায়ের জন্য এখন তৃষিত অপেক্ষা থাকবে।



Sunday, November 15, 2020

'জানি তুমি অনন্য'

 


সৌমিত্র কেন অনন্য?

উত্তরটা এক দিক দিয়ে সহজ। চারমিনার ঠোঁটে প্রদোষ চন্দ্র মিত্র থেকে কেতাদুরস্ত, চোস্ত অসীম;  ধূর্ত চতুর ময়ুরবাহন থেকে বিভূতিভূষণের মানসপুত্র অপু; এদিকে আদর্শবাদী শিক্ষক উদয়ন পন্ডিত থেকে ওদিকে প্রেমাতুর অমল; এমন ভার্সেটাইল কজন বাঙালি অভিনেতাই বা ছিলেন? উত্তম কুমার সব সময় বাঙালির স্মার্টনেসের ধ্রুবক, সেদিক থেকে চিন্তা করলেও সৌমিত্র অনন্ত চরিত্রের বৈচিত্র্যে পাল্লা দিতে পারবেন উত্তমের সঙ্গে। কিন্তু সৌমিত্র ঠিক এই কারণেই কি অনন্য? ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে।

সৌমিত্রের ক্যারিয়ারের শুরুটাই এমন একজনের হাত ধরে, যার জন্য বাকিদের অনেকটা আলাদা হয়ে গেছেন ওখানেই। সত্যজিৎ রায়ের চোখ ছিল আর দশজন বাঙালির চেয়ে আলাদা, মননে আর মেধায় ছিলেন ক্ষণজন্মাদের একজন। জহুরির চোখে হীরে কদর করতে জানতেন, সৌমিত্রকে দেখে বুঝেছিলেন এই ছেলেকে দিয়ে হবে। সৌমিত্র নিজেও অনেক কাঠখড় পুড়িয়েই অভিনয়ে এসেছিলেন। নিজের শীর্ণকায় চেহারা নিয়ে ছেলেবেলা থেকে একসময় হীনমন্যতায় ভুগতেন। মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে সেই বাধা পার করেছেন, যদিও অনায়াসেই পরে তাকে সুদর্শন বলা যেত। তবে বাঙালির মেয়েদের স্বপ্নের পুরুষ উত্তমকুমার হতে না পারলেও সৌমিত্র নিজের জায়গাটা দাঁড় করিয়েছেন সহজাত অভিনয়-মেধার জন্য। যে মেধার জন্য অপু হয়ে যখন তিনি ইন্টারভিউ দিতে যান, তখন প্রশ্নকর্তার উত্তর শুনে জবুথবু হয়ে উত্তর দিতে গিয়ে স্ক্রিপ্টের বাইরে বাড়তি একটা ঢোকও দেন। আর সেই ইম্প্রোভাইজেশন দেখে দূর থেকে মুচকি হাসিতে সত্যজিত তারিফ করে ওঠেন। চরিত্রের ভেতর ঢুকে যাওয়ার এই ব্যাপারটা ছিল মজ্জাগত। অনেক অভিনেতারই সেটা থাকে অবশ্য। তবে সৌমিত্রের মধ্যে একটু বেশিই ছিল।

সাধারণত বিখ্যাত গল্প থেকে ছবি করলে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয় না সবসময়। পথের পাঁচালি বা অপরাজিতের বই হিসেবে যে আসন, রূপালী পর্দায় সেটা দেখানো ছিল আরো বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ নেওয়া সত্যজিতের মতো জিনিয়াসের পক্ষেই ছিল সম্ভব। তবে অপুর চরিত্রটার জন্য সত্যজিতের এমন একজনের দরকার ছিল, যেন বাঙালির কল্পনার পটে আঁকা ছবিটাই যেন চলে আসে সিনেমার ফ্রেমে। সেখানে সৌমিত্র একেবারে লেটার মার্ক পেয়ে পাশ। অপুর যৌবন থেকে মধ্যবয়স অবদি সংগ্রামটা সৌমিত্রের ক্যারিয়ারের বড় একটা পরীক্ষা ছিল, সেটার জন্য কম ঘাম ঝরাতে হয়নি তাকে।

তবে চ্যালেঞ্জের মুখে সত্যজিত তাকে দাঁড় করিয়েছেন বার বারই। অটোমেটিক কাস্ট হয়ে ওঠার পরেও গুপি গাইন বাঘা বায়েনে প্রিয় চরিত্র তাকে দেননি, আবার ঠিক কল্পনার ফেলুদা না হওয়ার পরও সত্যজিৎ আস্থা রেখেছিলেন সৌমিত্রের ওপর। অরণ্যের দিনরাত্রির অসীম বা চারুলতার অমলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে দৃশ্যত সৌমিত্রকে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি, শহুরে মধ্যবিত্তের সেই চরিত্রের সঙ্গে মিশে গেছেন সহজেই। কিন্তু অশনী সংকেতের গঙ্গাচরণের গ্রাম্য চরিত্রের জন্য তাকে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছিল। আবার অভিযানের নরসিং চরিত্রটাও বেশ আন্ডাররেটেড, খ্যাপাটে ড্রাইভারের ভূমিকায় সৌমিত্র যেন অনেকটাই পালটে ফেলেছিলেন নিজের খোলনলচে। ঝিন্দের বন্দির ধুরন্ধর ময়ুরবাহনের ভূমিকায়ও যে নিজেকে এভাবে বদলে ফেলবেন, সেটা কে ভেবেছিল?

সৌমিত্র আসলে এ কারণেই অনন্য। নিজের একটা অন্তর্ভেদী আর অনুসন্ধিৎসু মন তো ছিলই, সেটা আরও বেশি ধারালো হয়েছে সত্যজিতের সঙ্গে এসে। প্রিয় মানিকদাকে নিয়ে আস্ত একটা বই-ই লিখে ফেলেছেন, সত্যজিতও এই বুদ্ধিমান মেধাবী যুবককে দারুণ পছন্দ করতেন। তবে তার বাইরে তপন সিংহ থেকে বাণিজ্যিক পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন অক্লেশে। কিন্তু সবখানেই নিজের মেধার একটা ছাপ রেখে যেতেন। মধ্যবিত্ত বাঙালির যে গর্ব করার জায়গা, সেই শিক্ষা আর প্রজ্ঞার দ্যুতি ছিল তার চোখেমুখে আর চলনেবলনে। বাঙালির স্বপ্নের পুরুষ না হোন, তাই হতে পেরেছেন পাশের বাড়ির মেধাবী ছেলেটি। আর এখানেই ছিলেন আর দশজন অভিনেতার চেয়ে ব্যতিক্রম। সেজন্যই প্রিয় সহঅভিনেত্রীর নাম জানতে চাওয়ার সময় ভেবে বলেছিলেন, ‘আমি জানি সবাই সুচিত্রা বা অপর্ণার নামই হয়তো আশা করবেন, তবে আমি বলব অভিযানে ওয়াহিদা রেহমানের কথা। ওরকম একটা চরিত্র কজন করতে পারে?’ এমন উত্তরই বা কজন অভিনেতা দিতে পারেন?

সৌমিত্র তাই এক ও অদ্বিতীয়, চে গুয়েভারার উত্তমের পাশে বাঙালির ফিদেল কাস্ত্রো।

 

Monday, July 6, 2020

এনিও মরিকনি: বুনো পশ্চিমে ভেসে বেড়াত যার সুর




খটখট শব্দ করে এগুচ্ছে ঘোড়া, রেখে যাচ্ছে ধূলিধূসর রাস্তা। পেছনে পড়ে আছে বিস্তীর্ণ রুক্ষ উষর প্রান্ত। মাথায় কাউবয় হ্যাট পরে ঘোড়া থেকে নামলেন একজন। হোলস্টারে পিস্তল, প্রথম দর্শন বলে দিচ্ছে লোকটাকে মচকানো যাবে না সহজে। স্যালুনে ঢুকল লোকটা, অর্ডার করল বিয়ারের। এরপর কথা কাটাকাটি থেকে শুরু হলো গানফাইট, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক ড্রতেই শেষ কয়েকজন।

ওয়েস্টার্ন যারা পড়েছেন, তাদের কাছে এই বর্ণনা চেনা তো বটেই, ক্লিশেও লাগতে পারে। বাংলাদেশের পাঠকদের ‘বুনো পশ্চিমের’ সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিল সেবা প্রকাশনী। র‍্যাঞ্চ, কাউবয়, আউটল, বাউন্টি হান্টার, স্যালুন, ডুয়েল... এই শব্দগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের অনেকের মতো আমারও চেনা সেই ছেলেবেলা থেকেই। একটু বড় হয়ে জেনেছিলাম, পশ্চিমের সেই গল্প আধা বাস্তব, আধা কল্পনা। টেক্সাস আর ক্যালিফোর্নিয়ার মাঝের বিস্তীর্ণ অঞ্চলটাই পরিচিত বুনো পশ্চিম নামে।

 একটা সময় সোনার সন্ধানে সেখানে পঙ্গপালের মতো ছুটে এসেছিল অনেকে, এরপর থেকেই সেই উষর অঞ্চলে নাগরিক সভ্যতা গড়ে উঠতে শুরু করে। তবে গানফাইটের সব বর্ণনা বাস্তব নয় পুরোপুরি, কথায় কথায় হয়তো ডুয়েলও হতো না। কিন্তু ছেলেবেলায় যে পশ্চিম কল্পনা করেছিলাম, একটু বড় হয়ে তার অনেকটুকুর দেখা পেলাম পর্দায়। সেটার মূল কুশীলব পাঞ্চো পরা একজন চৌকোনো মুখের আমেরিকান, ক্লিন্ট ইস্টউড যার নাম। আর পর্দার পেছনে ছিলেন দুজন। হলিউডে বুনো পশ্চিমের মূল রূপকার  পরিচালক সার্জিও লিওন আর সুরের ভুবনটা ভরিয়ে তুলতেন এনিও মরিকনি। লিওন চলে গেছেন আগেই, আজ নব্বই পেরিয়ে চলে গেলেন মরিকনি।

ওয়েস্টার্ন ছবি যারা দেখেছেন, যে কোনো একটা ছবির কথা বলতে গেলে বেশির ভাগ বলবেন ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দা আগলির কথা।’ আর অতি অবশ্যই মস্তিষ্কে টুংটাং করে বাজবে সেই অমর সুর। সমগ্র চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অবচেয়ে আইকনিক সংগীতগুলোর একটি এই গুড ব্যাড এন্ড দ্য আগলির সেই সুর। এক্সট্যাসি অব গোল্ড (মেটালিকা ভক্তেরা এটার নাম বিলক্ষণ শোনার কথা) এই ছবিরই যুগন্ধর কাজ, পরবর্তীতে যেটা বহুবার বহু জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে। আরও দুইটি ছবির নাম এসে পড়ে সম্পূরকভাবেই। ফর আ ফিউ ডলারস মোর এবং আ ফিস্টফুল অব ডলারও একইরকমভাবে অবিস্মরণীয় কিছু কাজ করেছেন। আমার কাছে সব সময় মনে হয়, এই সঙ্গীতায়োজনের জন্যই ডলার ট্রিলজি আরও বেশি অমর হয়ে আছে। 

ওয়েস্টার্ন ছবি মানে শুধু বন্যতা বা গানফাইট নয়, এখানে মিশে আছে উদাসী কাউবয়ের অ্যাপালুসার পিঠে মাইলের পর মাইল পাড়ি দেওয়ার রোমান্টিকতা। এখানে আছে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের অদ্ভুত একটা ছবি। এই কোমল-কঠোরে মেশানো প্রকৃতির মূল সুরটা খুব ভালোভাবে ধরতে পেরেছিলেন মরিকনি। এজন্যই যত বার ডলার ট্রিলজির সুর বেজে ওঠে, ততবার কেমন যেন আনমনা হয়ে যাই। পরে জানতে পেরেছি, এই সিনেমাগুলো করতে পুরো অর্কেস্ট্রা করার মতো বাজেটই ছিল না মরিকনির। সেজন্য কিছুটা ‘ইম্প্রোভাইজ’ করতে হয়েছিল, বন্দুকের গুলি, চাবুকের শব্দ, বাঁশি এসব ব্যবহার করতে হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে আ ফিস্টফুল অব ডলারসের শুরুর পর এই ধারাটাই পরিচিত হয়ে যায় স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন নামে। এরপর থেকে লিওন আর মরিকনি এই ধারার ছবির ক্ষেত্রে হয়ে ওঠেন হরিহর আত্মা। মরিকনি সম্ভবত তার সেরা কাজগুলোর একটি করেছেন ‘ওন্স আপন আ টাইম ইন দ্য ওয়েস্টে’। এই ছবির উত্থান-পতনটা একটু জটিল ছিল, মরিকনি সেই দ্বন্দ্বটা ধরতে পেরেছিলেন দারুণভাবে।

শুধু ওয়েস্টার্ন ছবির কথাই বলা হচ্ছে, তবে মরিকনির এর বাইরেও মনে রাখার মতো আরও অনেক কাজ আছে। আনটাচেলবস, ব্যাটল ফ্রম আলজিয়ার্স থেকে আরও অনেক কিছুই। কুইন্টিন টারান্টিনো ছিলেন তার বড় ভক্ত, সেই কিল বিলেই মরিকনির স্কোর ব্যবহার করেছিলেন। পরে ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস, হেইটফুল এইটেও শোনা গিয়েছিল মরিকনির চেনা সিম্ফোনি। অস্কার পেয়েছিলেন পরে টারান্টিনোর সঙ্গে কাজ করে।

ওয়েস্টার্ন ছবির বাইরে আমার মরিকনির সবচেয়ে প্রিয় কাজ সিনেমা পারাদিসো। এই সিনেমাটা নানা কারণে নস্টালজিয়া জাগায়, খুব প্রিয় ছবির ছোট তালিকায়ও তা থাকবে। সালভাতোরে যখন নানা উত্থান পতনের পর সিসিলিতে নিজের শহরে ফিরে আসে, আলফ্রেডোর প্রয়াণ তাকে দাঁড় করিয়ে দেয় অমোঘ এক সত্যের সামনে। থিয়েটারে আলফ্রেডোর কেটে রাখা ফিল্মগুলো তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় হারানো শৈশবে। সিনেমা পারাদিসো এই সমাপ্তির জন্যই আরও বেশি স্মরণীয়, আর সেটার অনেকটুকু কৃতিত্ব মরিকনির মিউজিকের। সুর দিয়েই ওরকম বুক উথাল পাতাল করা অনুভূতি আর কেউ করতে পারতেন বলেও মনে হয় না।

সালভাতোরে বা তোতোর সেই ছবির মতো আজ স্মৃতি হয়ে গেলেন মরিকনিও। এই লেখার সময়েই পেলাম এন্ড্রু কিশোরের চলে যাওয়ার খবর। আমাদের সুরের ভুবনে আজ তাই শুধুই বিষাদের সিম্ফোনি।


Sunday, June 7, 2020

স্মৃতিমেদুর শাহাদুজ্জামানের সঙ্গে বিহবল কয়েকটি ঘন্টা

আসলে জীবন মানেই শৈশব; জীবনভর মানুষ এই একটা ঐশ্বর্যই ভাঙ্গিয়ে খায়, আর কোনো পুঁজিপাট্টা নেই তার।
মাহমুদুল হকের এই কথাটা আজ যেন বার বার ফিরে এসেছিল শাহাদুজ্জামানের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডায়। শাহাদুজ্জামান এই সময়ের অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক, তার সাহিত্যকর্ম নিয়েই কথা বলার রসদ রয়েছে বিস্তর। তবে বইপড়ুয়ার সঙ্গে শনিবারের আড্ডায় শাহাদুজ্জামান হয়ে পড়লেন স্মৃতিমেদুর, ফিরে গেলেন শাহজিবাজার থেকে শুরু করে খাকি চত্বরের খোয়ারির সেই দিনগুলোতে, বিদ্যুচ্চমকের মতো ফিরে এলো চলচ্চিত্র সংসদের সেইসব দিন। সঙ্গে নিজের সাহিত্য দর্শনের কথাও উঠে এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে, পাঠক তাতে পেয়েছেন ভাবনার অনেক খোরাক।
শাহাদুজ্জামান তাঁর বেড়ে ওঠার দিনগুলো নিয়ে আগেও কথা বলেছেন কিছু আড্ডায়। ক্যাডেট কলেজের দিনগুলো নিয়ে আস্ত একটা বই-ই আছে তার। তবে আজ অনেক দিন পর নিজের শৈশবের সেই নদীতে অবগাহন করলেন পরমানন্দে। প্রকৌশলী বাবার কর্মসূত্রে শৈশব কেটেছে নানা জায়গায়। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায়, খুলনায়, বরিশালে ছিলেন একসময়। তবে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটে আছে হবিগঞ্জের শাহজিবাজারের স্মৃতি। পাহাড়ঘেরা এই জনপদে কাটিয়েছেন শৈশবের সোনালী কিছু সময়। শাহজিবাজার একটা সময় একেবারেই নিস্তরঙ্গ পাহাড়ি জনপদ ছিল, তবে পাওয়ারপ্ল্যান্ট হওয়ার পর থেকে বদলে যায় দৃশ্যপট। শাহাদুজ্জামানরা তখন সেখানে বসবাস শুরু করেন। তবে যান্ত্রিকতার দাপটের পরও প্রকৃতির সান্নিধ্য বেশ ভালোমতোই পেয়েছেন। শেয়াল, বাগঢাশ দেখেছেন কাছ থেকে, পাহাড়ে পাহাড়ে ঘরে বেরিয়েছেন। পাগলা মেলায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা মানুষ দেখেছেন।  তার একটা মুরগির খামারও ছিল সেখানে। এই শাহজিবাজার থেকেই দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, শকুনের নখর এখনো মনে দাগ কেটে আছে তার। যুদ্ধের সময় একটা কক্ষে অন্তরীণ হয়ে ছিলেন অনেক দিন। জগতের বীভৎসতার সঙ্গে পরিচয়ও তখন থেকে।
এই স্মৃতিচারণের মধ্যেই অবশ্য লেখক হিসেবে তার বেড়ে ওঠার গল্পও এলো। বাবা প্রকৌশলী হলেও সুকুমারবৃত্তি চর্চা করতেন ভালোমতোই। শাহাদুজ্জামানের ভাষায়, ‘আমার বাবা ছিলেন আসমানদারি মানুষ, খুব মিনিয়েচার লেভেলে টোটাল মানুষ হওয়ার চেষ্টা ছিল। মূল চেষ্টা ছিল লেখার, সাহিত্যের পাঠক ছিলেন। গান করতেন। ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। জীবন হচ্ছে একটা আনন্দের ব্যাপার। এই ব্যাপারটা দেখতাম তার ভেতর আনন্দের কমতি ছিল না। পড়তে পড়তে বিরক্ত হলে গান শুরু করতেন। খুলনায় সরকারি কোয়ার্টারে একবার প্ল্যান করলেন ওয়াল পেইন্টিং করবেন। সেই ছবিটা এখনো আছে।’
ক্যাডেট কলেজে যখন পড়তেন, তখনও যে লিখবেন এমন কিছু ভাবেননি শাহাদুজ্জামান। পড়তেন প্রচুর, একই সঙ্গে আগ্রহ ছিল বিতর্ক আর বক্তৃতায়। তবে লেখার ঠিক ঝোঁক ছিল না। ক্যাডেট কলেজের দেয়ালপত্রিকা বা ম্যাগাজিনেও সেভাবে লেখেননি কখনো। ওই সময় বাংলা রচনা লিখতে হতো স্কুলের পরীক্ষায়। সেখানে একটা রচনার বিষয় ছিল-তোমার জানালা থেকে। ক্লাসের কেউ তা চেষ্টা করেননি। তবে শাহাদুজ্জামান প্রেরণা নিয়েছিলেন বাবার একটা গল্প থেকে। তাঁর বাবা লেখালেখি করলেও সেগুলো প্রকাশে খানিকটা কুন্ঠা ছিল তাঁর। শাহাদুজ্জামান যেমন বলছেন,  তাঁর গল্পটা ছিল লেখক হতে চাওয়া একজন মানুষের চন্দ্রযাত্রার। সেখানে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বিভূতি, শরৎ, মানিকসহ অনেকের দেখা হয়। বাবার সেই গল্প থেকে পাওয়া আইডিয়া রচনায় ব্যবহার করে শিক্ষকদের চমৎকৃত করেছিলেন শাহাদুজ্জামান।
এই প্রসঙ্গেই এলো রফিক কায়সারের কথা। এই শিক্ষকের কথা আগেও অনেক জায়গায় বলেছেন শাহাদুজ্জামান। ডেড পোয়েটস সোসাইটির জন কিটিংয়ের মতো ইনিও কিশোর শাহাদুজ্জামানের মনে বুনে দিয়েছিলেন সাহিত্যের জন্য সত্যিকারের ভালোবাসার বীজ, সামনে খুলে দিয়েছিলেন বিশাল একটা জানালা। কিশোর ফটিকের মনস্তত্ব থেকে শাহাদুজ্জামান রফিক কায়সারের হাত ধরে ঘুরে এসেছিলেন বিশ্বসাহিত্যে। ইনিই বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্পকার হিসেবে কমলকুমার মজুমদারের কথা। সেই বয়সে কমলকুমার শাহাদুজ্জামান কেন, তার আশেপাশের মানুষের কাছেও প্রায় অজ্ঞাত ছিলেন। ধীরে ধীরে কমলকুমারের হাত ধরে অন্য একটা জগতে ঢুকে পড়লেন লেখক

এই প্রসঙ্গেই ধীরে ধীরে এলো সুবিমল মিশ্রের নামও। এই নিরীক্ষাধর্মী লেখকের পাঠককুল সীমিত হলেও তার মধ্যে ছক ভেঙে নতুন কিছু করার চেষ্টা ছিল। শাহাদুজ্জামান বলছেন, আরও অনেক বাংলাদেশি লেখকের মতো কলকাতার লেখকদের নিয়ে গদগদ ভাব তার ছিল না। অনেকবার কলকাতায় গিয়েও তারকা কোনো লেখকের সঙ্গে আলাদা করে দেখা করার তাগিদ অনুভব করেননি। শুধু সুবিমল মিশ্রর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য একবার কলকাতা ছেড়ে গিয়েছিলেন দূরে আরেক জায়গায়, যেখানে একটা গ্রাম্য স্কুলে সুবিমল মিশ্র পড়াতেন। সেই সাক্ষাৎকারের স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল শাহাদুজ্জামানের মাথায়।
এলো চলচ্চিত্র সংসদের গুরু মোহাম্মদ খসরুর কথাও। বাংলাদশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রের এই পথিকৃতের সঙ্গে একসময় অনেকটা সময় কাটিয়েছেন শাহাদুজ্জামান। জানাচ্ছেন, ‘খসরু ভাই-ই প্রথম আর্লি সিক্সটিজে বাংলাদেশ ফিল্মস সোসাইটি করেন। ওয়াহিদুল হক ছিলেন তার সঙ্গে। তিনি গানবাজনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর খসরু ভাই পরে সেটি চালিয়েছেন। এককভাবে এই চলচ্চিত্র সংসদ তৈরি করার কাজ করেছেনফিল্ম যে ক্রিটিক্যাল চর্চার ব্যাপার, উনি সেটা বিশ্বাস করতেন। প্রথম উনি ফিল্ম ট্রেনিং শুরু করলেন। সতীশ বাহাদুরকে আনলেন ভারত থেকে। ছবি যোগাড় থেকে শুরু করে লেখা করেছেন অনেক কিছুযেমন সূর্যদীঘল বাড়ি যখন হলো, শাকের ভাই (মসিহউদ্দিন শাকের, পরিচালক) একেবারে খসরু ভাইয়ের হাতে তৈরি।’
আবার মোহাম্মদ খসরুর কাছে ভালো কাজ নিয়ে আপসহীনতার দীক্ষাও পেয়েছেন। মিথ্যে স্তোক নয়, সব সময় সরাসরি কথা বলেছেন খসরু। কাউকে কাজ নিয়ে খোসামোদ করেননি, সেজন্য কটুভাষী হিসেবেও দুর্নাম ছিল তার। শাহাদুজ্জামান এখন বলছেন, এই নির্মোহ থাকার অভ্যাসটা লেখক হিসেবেও জরুরি। পাঠকের মন যোগানোর জন্য নয়, তাদের মন জাগানোর জন্যই লেখককে হতে হবে আপসহীন। পাঠকের রুচিকে অনুসরণ করার চেয়ে তৈরি করাটাই তার কাছে আগে। সেজন্য নিজের লেখায় গতানুগতিক পাঠকপ্রিয়তার কথা না ভেবে নিজের কথাগুলো বলতে চেয়েছেন আগে। সেজন্য তিনি কমলকুমার বা সুবিমলের সাহসের তারিফ করেন। তবে সবিনয়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন, তিনি তাদের কারও মতোই হতে চাননি। তাদের ভাবনাটা ধারণ করেছেন, অনুসরণ করেননি। সেজন্য লেখা্লেখি সবসময় তার কাছে ম্যারাথন রেসের মতো, একশ মিটার স্প্রিন্ট নয়। তিনি যেটা বলতে চেয়েছেন, সেটাই সময় নিয়ে লেখার মাধ্যমে জানাতে চেয়েছেন। জীবানন্দের মতো অত তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাননি।

এভাবেই চলতে থাকে আড্ডা। বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের তুলনা, বাংলা সাহিত্যের নিরীক্ষা, মহামারী নিয়ে সাহিত্য এসব প্রসঙ্গ এসেছে। কেন সিনেমা লেখালেহির চেয়ে সহজে মানুষের দুয়ারে পৌঁছে যেতে পারে, সেই আলোচনা এসেছে। বাংলাদেশের সিনেমা যে বাজেট নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতার অভাবেই বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নিতে পারছে না- নিজের এই বিশ্বাসের কথাও বলেছেন শাহাদুজ্জামান।  করোনার এই সময়ে সাহিত্যের ভূমিকা নিয়েও কথা হয়েছে। এই ক্রান্তিকালে পেশাগতভাবে নিজের ব্যস্ত ভূমিকার কথাও বলেছেন সন্তর্পণে। তবে সবকিছুর পর আরও অনেক বিষয় নিয়ে কথাই হয়নি। বইপড়ুয়ার নজরুল সৈয়দ, হিল্লোল দত্ত ও সুহান রিজওয়ানের সঙ্গে পরের আড্ডায় হয়তো শাহাদুজ্জামানের সঙ্গে এমন আরও কয়েকটি বিহবল ঘন্টা কাটবে- আপাতত সেই আশা করতে দোষ নেই।



Sunday, May 24, 2020

দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে


কাজটা করতে হবে খুব সাবধানে। সবার একদম অগোচরে, যেন কাকপক্ষীও টের না পায়।
কথাটা ভাবতে ভাবতে সদরুলের আধখাওয়া সিগ্রেটের ধূসর ছাই সন্তর্পণে আশ্রয় নিতে থাকে ছাইদানিতে। ‘কাকপক্ষী’ কথাটা অবশ্য সে সেভাবে ভাবেনি, অনেকটা চিন্তার টানেই এসে পড়েছে। এই ঢাকা শহরে আজকাল চড়ুইয়ের দেখা মেলাটাই কঠিন, আর সেখানে পক্ষী! ভূতের গলির আট তলার ছাদের কার্নিশে কোনোদিন কাক দেখেছে বলেও মনে পড়ে না তার। আচ্ছা, ঢাকা শহর থেকে কাকেরা সব উধাও হয়ে গেল নাকি? এরই নাম কি তাহলে কাকস্য পরিবেদনা?
কী অদ্ভুত, একটা ভয়ংকর কাজ করার আগেও সদরুলের করোটিতে এসব হাস্যকর ভাবনা ঘাঁই দিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেক দিন ধরে ব্যাপারটা নিয়ে সে ভাবছে। তবে কাজটার ধরন এমন, অনেকে ভাবলেও শেষ পর্যন্ত প্রায় কেউই সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারে না। আবার কেউ আছে চেষ্টা করতে গিয়েও পারে না, পরে কেলেঙ্কারির একশেষ। আর কয়েকজন যারা শেষ পর্যন্ত পেরে যায়, তাদের ধরনটা ঠিক সদরুলের পছন্দ নয়। তার দরকার অভিনব একটা উপায়, যেটা কেউ আগে ভাবেনি। সবচেয়ে ভালো হয়, ‘খুনটা’ ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে চালিয়ে দিতে পারলে। কিন্তু সেরকম কি কোনো উপায় আছে? নিজেকে কীভাবে খুন করলে সেটা ঠিক ঠিক একটা দুর্ঘটনার মতো দেখাবে?

‘আত্মহত্যা’ শব্দটা সদরুলের ঠিক পছন্দ নয়। একটা সেকেলে ভাব আছে এতে, একটা ‘অপরাধ অপরাধ’ গন্ধও আছে। আর লেপ্টে আছে সামান্য একটু গ্লানি, সঙ্গে একটু অগৌরব। বরং ‘স্বেচ্ছা-প্রত্যাহার’ শব্দটা সদরুলের মনে ধরেছে বেশি। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া, তাতে আদৌ কোনো অগৌরব আছে কি না সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে সদরুলের। অনেকের এই সিদ্ধান্তের পেছনে অনেক কারণ থাকে। কেউ ধারদেনায় ডুবে এই কাজ করে, কেউ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে করে, আবার কেউ করে কেলেঙ্কারি থেকে। কারণ অবশ্য ঘুরেফিরে একটাই, ভালোবাসাহীনতা আর গভীর বিষাদ। এখন নাকি সেটার একটা গালভরা নামও হয়েছে, ‘ডিপ্রেশন’। সদরুলের অবশ্য সেই অর্থে ঠিক যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। বাবা বহু আগেই মাকে ছেড়ে চলে গেছেন, পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন মা-ও। এরপর প্রথম কয়েকটা মাস মনে হয়েছিল, কী লাভ বেঁচে থেকে? ভাই-বোনও ছিল না কেউ, কিন্তু সদরুল কিন্তু সামলে নিয়েছিল ধাক্কাটা। যে চাকুরি করত, তাতে নিজের ভরণপোষণের বাইরে চিন্তার সুযোগ খুব বেশি নেই, কাজেই একাকীত্বটা ঘোঁচানোর খুব একটা উপায়ও ছিল না। আর এমন কেউ নেইও, সদরুলকে এ নিয়ে তাগাদা দেবে। মা মারা যাওয়ার পর চারটা বছর কেটে গেছে একরকম নির্বিবাদেই। সমস্যা হয়েছে, গত কিছু দিনে। জীবনটা হঠাৎ করেই ভীষণ রকম একঘেয়ে হয়ে উঠেছে সদরুলের। নয়টা-পাঁচটা অফিসের বাইরে করারও নেই কিছু। একটা খেলা খুব করেই দরকার ছিল সদরুলের। নিজেকে শেষ করে দেওয়াটা তাই আর সব ‘স্বেচ্ছা-প্রত্যাহারের’ মতো নয় তার আছে, একটা শেষ পরীক্ষাও বটে। এই পরীক্ষায় তাকে পাশ করতেই হবে, তবে সেটা নকল করে করতে চায় না কোনোভাবেই।
কথাটা আবার ভাবে সদরুল। নিজেকে ঠিক কীভাবে শেষ করে দিলে সেটা একটা চমৎকার দুর্ঘটনার মতো দেখাবে? জীবনানন্দ দাশ হঠাৎ সদরুলের ধূসর নিউরনে টোকা দিয়ে যান। কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় ট্রামের নিচে পড়ে কেউ মরবে, সেটাও কি সম্ভব? জীবনানন্দের সেই মৃত্যু দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখা হয়ে আসছে, যদিও সদরুল জানে সেটা নিখুঁত পরিকল্পনা করে সাজানো একটা ‘স্বেচ্ছা-প্রত্যাহার’। নইলে ‘যখন ডুবে গিয়েছে পঞ্চমীর চাঁদ, মরিবার হলো তার সাধের’ মতো বাক্য তিনি লিখবেন কেন? মাল্যবান বা কারুবাসনা উপন্যাসে নিজের প্রাণহননের অমন স্পষ্ট ইঙ্গিতই বা দেবেন কেন? সদরুল এসব নিছক কাকতাল বলে মানতে রাজি নন মোটেই। তবে এটা ঠিক, জীবনানন্দের মতো ট্রামের তলার মৃত্যুটা ঠিক মেনে নিতে পারে না। জীবনানন্দের আগে পরে কলকাতায় আর কেউ ট্রাম দুর্ঘটনাতেই মরেনি, তাতে যে কবি মরবেনই এমন কোনো গ্যারান্টি তো ছিল না? জেনেশুনে এমন ভুল তো সদরুল করতে পারে না। তার মৃত্যু হবে সুনিশ্চিত, তাতে ব্যর্থতার কোনো জায়গা থাকবে না।
প্রথাগত উপায়গুলো রোমান্টিক নয় বলে অনেক আগেই বাদ দিয়েছে সদরুল। হাত কেটে মরা? নাহ, তাতে রক্তপাত অনেক বেশি। সদরুল দুর্বলচিত্তের মানুষ, রক্তপাত সে সইতে পারে না। বিষ জোগাড় করা সহজ, কিন্তু স্বেচ্ছা-প্রত্যাহারের জন্য সেটা খুবই অনিশ্চিত একটা উপায়। আর তাতে বেঁচে গেলেও কষ্টের একশেষ।  একটা পিস্তল পেলে অবশ্য এক মুহূর্তে কাজ হয়ে যেত, আর মাথায় গুলি করলে হাজার বারের মধ্যে মরার সম্ভাবনা ৯৯৯ বার। কিন্তু সদরুল কারও সাতে পাঁচে না থাকা মানুষ, সে পিস্তল পাবে কোথায়? হেমিংওয়ে হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তাই হয়ে ওঠে না তার। পানিতে মরা একটা উপায় হতে পারে, কিন্তু সদরুল শুনেছে তাতে কষ্ট অনেক বেশি। তার নয়তলা বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে পড়লেও হয়, অথবা বাজার থেকে দড়ি কিনে এনে নেওয়া যায় ফাঁস। কিন্তু এসব তো করবে যারা হতাশা থেকে আত্মহত্যা করে! সদরুলের দরকার একদম নতুন কোনো উপায়, যাতে সেটা স্বেচ্ছা-প্রত্যাহার বলেই বোঝা না যায়।
সেই নতুন উপায় কী হতে পারে? দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিতে চাইলে একটা সহজ উপায় আছে, সোজা গিয়ে ১২ নম্বর বাসের তলায় লাফিয়ে পড়লেও হয়। আজকাল ঢাকা শহরের এমন অবস্থা, বাসের নিচে প্রতিদিন একজন মারা না পড়লে টিভি-পত্রিকাও কেমন যেন পানসে লাগে। সদরুলের বাবা-মা থাকলে অবশ্য সুবিধা হতো, দুর্ঘটনায় মরলে পাওয়া যেত নগদ বেশ কিছু টাকা। আর মরাটা একটু বীভৎস আর একটু জনাকীর্ণ জায়গায়  হলে হয়তো একটা গলি বা নিদেনপক্ষে ফুটওভার ব্রিজও তার নামে হতে পারে। সদরুলের মতো একজন প্রায় বিশেষত্বহীন মানুষের জন্য সেটাও বা কম কীসে? কিন্তু সদরুল এই ভাবনাটা দুইটি কারণে ঠিক বরদাশত করতে পারে না। প্রথমত, বাসের নিচে লাফ দিলেই যে পড়বেই সেটার একশতভাগ গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। কোনো কারণে হতচ্ছাড়া ড্রাইভার ব্রেক কষে ফেললেই শেষ। তার চেয়ে বরং ট্রেনের নিচে লাফিয়ে পড়া ভালো, তাতেই সেই সংশয় নেই। কিন্তু সেটা তো দুর্ঘটনা হিসেবে চালানো কঠিন, বরং সেই ‘আত্মহত্যা’ বলেই খবরের কাগজের পাঁচ নম্বর পাতায় সিঙ্গেল কলামে ১০০ শব্দ ছাপা হবে। আর তার চেয়েও বড় কথা, বাসের নিচে লাফিয়ে পড়লে খেলাটা তো ঠিক জমে না।
সদরুল ভাবে, বাংলাদেশে জাপানের আওকিগাহারার মতো একটা স্বেচ্ছা-প্রত্যাহারের অভয়ারণ্য থাকলে বেশ হতো। বনভোজন করার নামে সেখানে লেগে যেত মৃত্যুর মচ্ছব, একটা না একটা উপায় মিলতোই। কেউ বিষ খেয়ে নীল হয়ে আছে, কেউ গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়েছে বা কেউ বনের কিনারে জলাশয়ে ডুব দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে; যার যেমন ইচ্ছা। অনেক বছর ধরে অবশ্য সরকার এখানে ওখানে ‘জীবন নিজের হাতে তুলে দেবেন না’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখে দিচ্ছে, তবে তাতে কাজ হচ্ছে কই? মৃত্যুও যে একটা উৎসব, সেটা জাপানিদের চেয়ে ভালো আর কে-ই বা বুঝেছে? তবে সেই যুগ এখন আর নেই, আজকাল নির্বিবাদে নিজের মতো মরাও অনেক বড় হ্যাপা।

এক জায়গায় অবশ্য সদরুল সেদিন ভালো একটা আইডিয়া পেয়েছিল। একটা নির্দিষ্ট মা্ত্রার চেয়ে বেশি নয়-দশটি ইনসুলিন ভরা ইনজেকশন নিলেই নিশ্চিত মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাওয়া যাবে। সদরুলের খারাপ লাগেনি, উপায়টা একটু নতুনই মনে হয়েছে। কিন্তু তাতে তো তার আসল উদ্দেশ্য মার খেয়ে যাচ্ছে। তার ওপর কোনো সুইসাইড নোটও যখন পাওয়া যাবে না, সেটা দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাই প্রচুর।
কিন্তু সদরুলের পরিকল্পনা একেবারেই আলাদা। টিভিতে বা পত্রিকায় কোনোভাবেই যেন ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়ে দিতে না পারে। তার একাকীত্ব জীবনের সঙ্গে হতাশা-টতাশা মিলিয়ে গল্পটা ভালোই ফেঁদে বসতে পারেন সাংবাদিকেরা, সেটা সে জানে। ভাগ্য আরেকটু ভালো হলে কাউন্সেলিংয়ের অভাবে আত্মহত্যার সংখ্যা ইদানীং কেন বেড়ে যাচ্ছে, সেটা নিয়েও হয়তো এক দুই লাইন লেখা হবে। সদরুল অবশ্য এসবের কাউন্সেলিং-ফাউন্সেলিংয়ের উর্ধ্বে চলে উঠেছে অনেক আগেই। তার মধ্যে ওসব হতাশা বা বিষাদও কাজ করে না বহু আগে থেকে। বেঁচে থাকার অর্থ সে খুঁজে পায় না বটে, তবে সেটা তো আরও কত লোকই পায় না। কিন্তু ‘স্বেচ্ছা প্রত্যাহারের’ চিন্তা তো সবাই করে না। বা করলেও সাহস করতে পারে না। সদরুলের এসব নিয়ে কোনো ভাবাবেগ নেই। সে জানে, আগামী পাঁচ বছরেও তার প্রতিটি সকাল আর প্রতিটি সন্ধ্যা একই রকম কাটবে। তার ঘড়ির কাঁটার বাইরে এক মুহূর্তও কোনো কিছু এদিক সেদিক হয় না, বেঁচে থাকতে হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। ঠাণ্ডা মাথায় সে ভেবেছে, নিজেকে খুন করার খেলাটা খেলার তার জন্য এখন সবচেয়ে মোক্ষম সময়। সে জানে, তার ভাবনা একজন সাইকোপ্যাথের সঙ্গে অনেক খানি মিলে যায়। তবে চাইলে সে তর্ক করতে পারে, অন্যের ক্ষতি করার ইচ্ছা তার কখনোই নেই। আর সে রক্তপাত সহ্য করতে পারে না মোটেই। কেন তাকে খামাখা একজন সাইকোপ্যাথের অপবাদ নিতে হবে? তার চেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় নিজেকে শেষ করে দেওয়ার একটা চমৎকার প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবা যাক।
একবার সে ভাবে, এখানে দ্বিতীয় পক্ষকে জড়ালে কেমন হয়। কোথাও যেন পড়েছিল, এক লোক একবার ইচ্ছে করে গোক্ষুরের কামড় খেয়ে মারা গিয়েছিল। সাপটা এরকম দ্বিতীয় পক্ষ হতে পারে। কিন্তু ঢাকা শহরে সে বিষধর সাপ পাবে কোথায়? বিদ্যুচ্চমকের মতো তার মনে পড়ে যায়, নিজেকে খুন করানোর জন্য একজন পেশাদার খুনি ভাড়া করলে কেমন হয়? সদরুল একেবারেই নির্বিরোধী লোক, তাকে কে খুন করবে সেটা ভাবতে ভাবতেই জেরবার হয়ে যাবে পুলিশ। সে নিজেই টাকা দিয়ে কাউকে খুন করিয়েছে, সেটা ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবতে পারার কথা নয়। আর তাকে খুনের কোনো মোটিভও নেই কারও। পুলিশ খুনি ধরা দূরে থাক, সন্দেহ করার মতো কাউকে খুঁজে পেতেই ঘাম ছুটে যাবে। চিন্তা করেই একরকম পৈশাচিক আনন্দ হতে থাকে সদরুলের।
সমস্যা হচ্ছে, অন্ধকার জগতের সঙ্গে সদরুলের কোনো জানাশোনা নেই। সত্যি বলতে, তার সঙ্গে খুব কম লোকেরই পরিচয় আছে। এই ৩০ বছরের জীবনে তার বন্ধুও নেই তেমন, সহপাঠীদের সঙ্গেও ক্লাসের বাইরে আলাদা কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি কোনো। অফিসেও পেশাগত সম্পর্কের বাইরে কারও সঙ্গে বাড়তি হৃদ্যতা নেই। তবে পাড়ার দোকানে আজিজের কাছ থেকে সিগ্রেট কিনতে হয় বরং কিছুটা কথাবার্তা হয়। আজিজ একবার কথাচ্ছলে তাকে বলেছিল, ‘বুঝলেন ভাইজান, একটা কথা কই, কাউরে আবার কইয়েন না যেন। সেদিন রাত বারটায় দোকানডা মাত্র বন্ধ কইরা হুইয়া আসি, আইতকা নাম ধইরা চিক্কুর। খুইলা দেখি, রফিক ভাই ডাকে, আজিজ সিগ্রেট দে। আমি ঘুমের ঘোরে বেন্সন না গোল্লিপ দিসি হেই খেয়ালও নাই। পরের দিন হুনি, রফিক ভাইয়ের নাকি ‘ডিউটি’ ছিল আরেক জাগায়। এক দুইটা লাশ নামান দেওন কিন্তু তার কাছে ঘটনা না। হেইদিন তাদের কথা বার্তা হুইনা যা ঠাওর করলাম, এই কামই কইরা আসছিল।’
সদরুল এসব এসব পাত্তা দেয়নি। সে সিগ্রেটের ব্যাপারী, কালাশনিকভের খবর রেখে তার লাভ কী? তবে এখন মনে হচ্ছে, রাখলে খারাপ হতো না। সে মনে মনে প্লটটা সাজাতে শুরু করে। রফিককে বোঝানোটাই হবে এখানে সবচেয়ে কঠিন কাজ। প্রথমে সে সদরুলকে নির্ঘাত পাগল বলে ঠাওরাবে, হেসে উড়িয়ে দেবে। মেজাজ মর্জি খারাপ থাকলে এরকম ফালতু কথা বলার জন্য গায়ে হাত টাতও দিয়ে বসতে পারে। কিন্তু টাকার লোভটা কি রফিক এড়াতে পারবে? সদরুল একা মানুষ, টাকা নেই নেই করেও কিছু থেকে গেছে। আর মাও কিছু টাকা রেখে গিয়েছিলেন। সেই টাকা নিয়ে কী করবে, ভাবনাটা এক সময় বিস্তর ভুগিয়েছিল তাকে। কিন্তু আলস্য আর অবসাদে সে টাকাটা আর খরচই করতে পারেনি। এবার ভালো একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু রফিক যদি টাকাটা নিয়ে কাজটা না করে? আর এখানে তো কাজ শেষে টাকা দেওয়ারও উপায় নেই। এমনও হতে পারে, অর্ধেক শুরুতে দিল আর অর্ধেক কাজ শেষের পরে। কিন্তু রফিক যদি না মেরে স্রেফ পায়ে একটা গুলি করে বাকি টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়? মানুষ খুন করার দায় যদি সে নিতে না চায়? আর সদরুল যদি পুলিশের কাছে বলেও গুলিটা করার টাকা সে দিয়েছে সোজা তাকে মানসিক হাসপাতালে চালান করে দেবে পুলিশ। এখানে তাকে অনেক ‘যদি আর কিন্তুর’ ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, সদরুল ভাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজটা করতে পারলে তার খেলাটা বেশ জমে।
এইসব ভাবতে ভাবতে সদরুল খেয়াল করে, সিগ্রেট শেষ হয়ে গেছে তার। আজিজের দোকানে যেতে হবে একবার। সিড়ি দিয়ে নামার সময়ও সে ভাবতে থাকে রফিকের কথা। আজিজকেই বা কথাটা কীভাবে বলবে? আনমনা থাকাতে খেয়াল করে না, মোড়টা হঠাৎ করে ভীষণ রকম শুনশান। লক্ষ্য করে না, দুই পাশে সাদা আর নীল মাইক্রোবাস থেকে অস্ত্র হাতে দুই দল অবস্থান নিয়ে রাস্তার দু ধারে। নিজের মৃত্যুসম্ভাবনা নিয়ে তুমুল ব্যস্ত থাকায় সদরুল দেখে না, নিঃশব্দ আততায়ীর মতো একটা বুলেট এসে ঠিক তার ঘাড় ফুটো করে বেরিয়ে যায়। নিজেকে খুন করার ভাবনাটা তাই কালচে রক্ত হয়ে জমাট বাঁধে শুকনো পিচের ওপর।
আর পরদিন সকালে ভোরের বাণীতে প্রথম পাতায় সংবাদ ছাপা হয়, ‘সন্ত্রাসীদের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে ভুতের গলিতে সদরুল নামের একজন নিরীহ পথচারী মৃত। তার পরনে ছিল সবুজ শার্ট, নীল জিন্স। ধারণা করা হচ্ছে, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রফিক আর শওকত গ্রুপের দ্বন্দ্বের জেরেই প্রাণ হারান সদরুল। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত শওকত ধরা পড়লেও রফিক পলাতক। পুলিশ এখন পর্যন্ত তাকে ধরতে পারেনি।’
কেউ দেখেনি, মর্গে বেওয়ারিশ পড়ে থাকা সদরুলের মুখে তখন এক চিলতে হাসি।


ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...