শাংগ্রিলা। শুনলেই পুরাণের কোন এক
ইউটোপিয়ার কথা মনে পড়ে । কত বছর ধরে মানুষের কল্পনায় বেঁচে আছে ওই শান্ত সমাহিত
স্থান। কত জন সেটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু খোঁজাই হয়েছে সার।
শাংগ্রিলা মরীচিকার মতো বিভ্রম হয়ে চিরকালই থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এই যুগে এসে শাংগ্রিলা আর কেউ
খোঁজে না। “কোথায় শান্তি পাব, কোথা গিয়ে” বলে মানুষ এখন শুধু হাপিত্যেশ করতে পারে। তবে নদীয়ার একটা
গ্রামে সেরকম আরেকটি পরম আরাধ্য জিনিস লুকিয়ে আছে। শাংগ্রিলায় যেমন শান্তি আর সুখ
মেলে, মোহিনী নামের সেই গ্রামে তেমন মেলে প্রেম। সেখানে গেলেই নাকি প্রেম জিনিসটা
বলেকয়েই হয়ে যায়। যারা কখনও প্রেমে পড়েনি, প্রেম কী জিনিস যাদের জানা নেই তাদেরও!
আষাড়ে গল্পের মতো মনে হচ্ছে
? বাকিটা ব্যক্তিগত ছবিটা দেখলে মোটেই
সেরকম কিছু মনে হবে না। প্রমিতও শুরুতে শাংগ্রিলার মতো কিছুই খোঁজ করছিল। মানুষের
এত সব সমস্যা, মানুষ আসলে কী চায় ? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে খুঁজতে প্রমিতের মনে
হলো, আচ্ছা, প্রেম জিনিসটা কীভাবে হয় ? সবার প্রেম হয় তার হয় না কেন ? সে পেশায়
তথ্যচিত্রনির্মাতা, সার্বক্ষণিক সঙ্গী ক্যামেরাম্যান অমিত। ক্যামেরা নিয়েই সে এই
প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে।
শুরুটা যেমন “ধুর, বেঁচে থেকে কী হবে” গোছের, একটু একটু করে
গল্পটা কুন্ডলী পাকিয়ে আসতে থাকে। শুরুতে দৃশ্যপটে একজন জ্যোতিষ, সেই নরেন শাসমল
নামের একজন আধখ্যাপা বুড়োর সন্ধান দেয়। সেই বুড়োর কাছে আছে এক অদ্ভুত গ্রামের
হদিস। মোহিনী নামের সেই গ্রামে গেলে প্রেম হবেই। সেই প্রেম যাকে বলে স্বর্গীয়,
একবার হলে সে বন্ধন কাটানো অসম্ভব। বুড়ো নিজেও জানে না, কীভাবে সেখানে যেতে হয়।
প্রমিত অবশ্য হাল ছাড়ে না। বুড়োর কাছ থেকে তাঁর এক ছাত্রী মল্লিকা সাহার ঠিকানা
পায়। সেই মল্লিকাই বাতলে দেন মোহিনীতে যাওয়ার পথ।
ঠিক পথ বললে অবশ্য ভুল হবে।
মোহিনীতে যাওয়ার আসলে কোনো পথ নেই। নদীয়ার নাজিরপুর নামের একটা গ্রামে গিয়ে
অপেক্ষা করতে হয়। সেখান থেকে কেউ একজন এসে পৌছে নিয়ে যাবে মোহিনীতে। খুবই অদ্ভুত
কথা। কিন্তু প্রমিতের মাথায় রোখ চেপে গেছে। সে শেষ দেখে ছাড়বেই। অমিতকে নিয়ে সে
চলে যায় নাজিরপুরে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর আসলেই একজন এসে তাদের মোহিনীতে নিয়ে যায়।
কিন্তু ওখানে গিয়ে কি দুজনের জীবনে প্রেম আসে ?
বাকিটা ব্যক্তিগতই থাক।
অন্য সব মূলধারার হোক, বা
মূলধারার বাইরের হোক, এই ছবিটা অনেক দিক দিয়েই আলাদা। অমিতের হ্যান্ডিক্যামের
চোখেই পুরো ছবি দেখানো হয়েছে। পরিচালক
প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য এই সীমাবদ্ধতা আগে থেকেই জানতেন। চাইলেই সব দৃশ্য দেখাতে
পারবেন না। সেটা মেনেই ছবিটা একটু অদ্ভুতভাবেই এগিয়েছে। যেখানে অমিতের ক্যামেরা
আছে, কাহিনি শুধু সেই রেখা ধরেই এগিয়েছে।
এই ব্যাপারটাই কিন্তু ছবির প্রাণ।
অমিতের ক্যামেরার বেশিরভাগ ফ্রেমে শুধুই প্রমিত। তার আনন্দ, ছেলেমানুষি, ক্ষোভ,
হতাশা সবকিছুই এগিয়েছে ওই ক্যামেরাতেই। ঋত্ত্বিক চক্রবর্তীর মধ্যে কেমন যেন একটা
সহজাত ঘরোয়া ভাব আছে। যেটা করছেন, তার মধ্যে যেন কোথাও এতটুকু ছেনালিপনা নেই।
এই ছবির আরেকটি বড় শক্তি সঙ্গীত।
এখনকার ক্লিশে হয়ে যাওয়া গিটার, পিয়ানোর টোন থেকে দুদন্ড শ্বাস ফেলার সুযোগ করে
দিয়েছেন প্রদীপ্ত। বাউল গান এসেছে নানা অনুষঙ্গে, সবুজের কাছাকাছি গিয়ে এক হয়ে
গেছে একতারার সুর। ধানের শীষের সাথে মিশে গেছে বাঁশির বাঁশরী, পুরো ছবিতেই সুরের
প্রাচুর্য থাকলেও সেটা কখনও কানে ধাক্কা হয়ে আসে না। বরং কেমন যেন মধুবর্ষণই করে।
কিন্তু এই ছবিটা নিয়ে আলাদাভবে
লেখার একটা কারণ আছে। এখনকার সব ছবিতে যেটার অভাব, সেই প্রাণ জিনিসটা এখানে প্রচুর
পরিমানে আছে। প্রদীপ্ত জানেন তিনি কী দেখাতে চেয়েছেন। সেটা কতটুকু পেরেছেন এটা
নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু ছবিটা দেখার পর যেন রেশটা অনেকক্ষণ লেগে থাকে, রবীন্দ্রনাথের
ছোটগল্পের “শেষ হইয়াও হইলা শেষের ” মতো।
No comments:
Post a Comment