Sunday, November 3, 2013

ক্রিকেটের সাথে বেড়ে ওঠা

তখন আমার ছিল হাফপ্যান্ট পরার বয়স। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অ্যাকশন প্র্যাকটিস করতাম, হ্যাঁ, ঠিক এভাবে বলটা ছুঁড়তে হবে! আমাদের দুকামরার ঘরে একরত্তি জায়গাটা চ্ছিল আমার রানআপের জন্য বরাদ্দদিনমান কেটে যেত এভাবে। বিকেলে সামনের উঠোনে নাম বেটে খেলা। খুব জোরে বল করা যাবে না, বলটা যে হারিয়ে যাবে! আরেকটা বল, ওরে বাবা, পাক্কা ১৫ টাকা দাম। কে দেবে অত টাকা? 

তখন টিভি বলতে চিনতাম শুধু বিটিভি। ঈদের সময় আনন্দমেলা, শুক্রবার সকালে মনের মুকুরে, দুপুরে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি। তখন বাসায় রাখতাম ভোরের কাগজ।  বুঁদ হয়ে পড়তাম টেন্ডুলকার, লারাদের জাদুকরী সব ইনিংসের কথা। ওই যে, সাদাকালো ছবিতে বযাট উঁচিয়ে আছে টেন্ডুলকার! হাতটা ব্যাট বানিয়ে শ্যাডো করতে করতে ভাবতাম, একদিন আমিও...

এমন সময় পড়লাম মালয়েশিয়ায় কিলাত ক্লাব মাঠে আইসিসি ট্রফি হচ্ছে। সেটাতে ফাইনালে উঠলে নাকি বিশ্বকাপে খেলবে। বিশ্বকাপ! তখনো মাত্র জয়াসুরিয়া, কালুভিতারানাদের স্মৃতি চোখে লেগে আছে। সে কি ধুন্দুমার মার!সেই টেন্ডুলকার স্টামড হিয়ে গেল জয়াসুরিয়ার বলে।  আর রিচি রিচার্ডসনের শট তো আম্পায়ারের কানটাই ফাটিয়ে দিয়েছিল। সেই বিশ্বকাপে খেলবে বাংলাদেশ!

পেপারে-টেপারে কী লিখেছিল এখন আর অতশত মন নেই। হঠাৎ একদিন ছোটমামা এসে পড়ল, বাংলাদেশ হল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে গেছে। এই ম্যাচটা জিতলেই নাকি বিশ্বকাপ। আমার ছোট্ট মনের বিশ্বকাপের আকাশ ছোঁয়ার বয়স তখনো হয়নি।

এমন সময় একদিন হঠাৎ ছুটি হয়ে গেল স্কুল। বিজ্ঞান টিচার এসে বললেন, বাংলাদেশ স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে গেছে। তার মানে বিশ্বকাপ! আকরাম, বুলবুলদের নামটাম তখন শুনেছিলাম শুধু। আর  একটু একটু পড়েছিলাম পেপারে। বিশ্বকাপে ওঠার আনন্দে আমরা একটা আস্ত টেনিস বল কিনে ফেলি। কোত্থেকে যেন স্কুলে একটা ব্যাটও জোগাড় হয়ে যায়। সেদিন আর আমরা কেউ লারা-টেন্ডুলকার নই, সবাই আকরাম, বুলবুল, নান্নু।

ফাইনাল কেনিয়ার সাথে। সকালে ছোটমামা এসে বলল,চল রেডিওতে খেলা শুনবি। মামাবাড়ির ট্রানজিস্টরটা ছিল মস্ত। সেখান থেকে গমগম করে কার যেন ধারাভাষ্য শোনা যাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম, কেনিয়ার ওদুম্বে-টিকোলো নামের দুইজন বেদম পিটুনি দিচ্ছে। আমাদের সবার একটু মন খারাপ হলো। আইসিসি ট্রফিটা কি আমাদের আর জেতা হবে না ?

পরদিন শুনি বৃষ্টির জন্য খেলা আবার শুরু হয়েছে। আবার রেডিওতে কান লাগিয়ে উৎকর্ন হয়ে অপেক্ষা। এবার টার্গেট ছোট, ওভারও অবশ্য কম। কিন্তু সেদিনটা আসলে আমাদেরই ছিল। একেকটা চার হয়, আর আমরা উল্লাসে ফেটে পড়িতে থাকি। শুরুর দিকে এসে আম্মু মুখ ঝামটা দিয়ে যাচ্ছিলেন, ক্রিকেট ক্রিকেট করে ছেলেপেলে সব বরবাদ হয়ে গেল। একটু পর দেখি, আম্মা নিজেই এসে বলছেন, ভলিউমটা বাড়িয়ে দে, রান্না করতে করতে শুনব। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি

খেলা তখন শেষের দিকে। ধারাভাষ্যকার বারবার বলছেন, ম্যাচে টানটান উত্তেজনা। হঠাৎ চিৎকার, ছক্কা! পাইলট নাকি বল সীমানার ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছে। আনন্দ, রোমাঞ্চের অদ্ভুত এক অনুভূতিতে আমি কাঁপতে থাকি। চলে আসে শেষ বল। এক বলে তখন দরকার এক রান। আমরা সবাই থরোথরো করে কাঁপছি। সবার শুধু দেহটা দেশে, মন ওই কিলাত ক্লাবে। জিতে গেছি, হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন ছোটমামা। আমার একন জানি বিশ্বাস হতে চায় না! যাহ, আমরা টুর্নামেন্ট জিতে গেছি ? আসলেই ? কে যেন একটু পর এসে আমাকে রঙ মাখিয়ে দেয়। জীবনে সেই প্রথমবার রঙ লাগে গায়ে। ক্রিকেট এরপর অবশ্য আরও অনেকবার আমাদের মনে রঙ লাগিয়েছে বটে।

সেই শুরু। এরপর আরও কতোশতো স্মৃতি। বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। বিশ্বকাপের আগে সে কী প্রতীক্ষা। সারাদিন বসে থাকতাম, কখন বিটিভিতে গুডলাক বাংলাদেশ গনিটা দেখাবে। “পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমার ঢেউ বিশ্ব দেখুক... যাত্রা শুভ হোক”... হুনহুন করে গাইতে গাইতে কী যে দারুণ একটা অনুভূতি হতো। তখন আরেকটু সেয়ানা হয়েছি, ক্রিকেটের অন্ধিসন্ধির খবর জানতে শুরু করেছি।

চলে আসল বিশ্বকাপ। একেকটা রানও তখন আমাদের কাছে কত মহার্ঘ্য ! মাঝে মাঝে আবার নান্নুর ব্যাটের কানায় লেগে চার হয়ে যায়। সেসব অবশ্য আমরা টিভিতেই দেখতে পাচ্ছিলাম। ওই যে রক্তমাংসের শান্ত, পাইলট। এর মধ্যেই আবার হারিয়ে দিল স্কটল্যান্ডকে। এরপর পাকিস্তানকেও হারানো, উরেব্বাস! মনে আছে আব্বার বন্ধুরা মিলে একটা মেজবানের আয়োজন করেছিলেন সেই উপলক্ষে।
দুঃখও কী কম দিয়েছে ? ঈদের আগের দিন, আয়েশ করে গ্রামের বাড়িতে বসে আছি জয় দেখব বলে। ওমা, কোথাকার কোন কানাডা এসে হারিয়ে দিয়ে গেল। সেবারের মতো ম্যাদামারা, পানসে ঈদ আজ অবধি কাটাইনি। পুরো ঈদটাই যেন মাটি হয়ে গিয়েছিল।

কান্না ? সেটাও দিয়েছে। এশিয়া কাপের সেই ফাইনালের কথা কি সারাজীবনেও ভোলা যাবে? মাঠে কাঁদছিল মুশফিক, সাকিবরা, আর তাদের সাথে কাঁদছিল পুরো দেশ। 

স্বপ্ন যেখানে দেখার সুযোগ, সেখানে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা থাকবেই। আনন্দের সাথে গলাগলি করে থাকবে বেদনারা। প্রাপ্তির সাথে থাকবে হতাশা, বঞ্চনা। ক্রিকেট ছাড়া এতসব অনুভূতির সাথে আমাদের আর একাত্ম করেছে কে?  ভাবতে অবাক লাগে, এক সময় একটা জয়ের অপেক্ষায় আমরা বসে থাকতাম দিনের পর দিন, এখন সেই জয় কতো অনাআয়সেই না আসে। ভাবা যায়, একসময় টানা পাঁচ বছর আমরা একটা ম্যাচও জিতিনি! একসময় একটা জয় পেলে টিএসসি ছুটে যেত সবাই, এখন সিরিজ জিতলেও তেমন কোনো উৎসব হয় না। কে জানে , পরেরবার হয়তো বিশ্বকাপ পেলেই...

আমাদের প্রজন্মটা অনেক কারণে ভাগ্যবান। আমরা টেন্ডুলকার লারাদের স্বর্ণযুগ দেখেছি, দেখেছি ম্যাকগ্রা, আকরাম, ওয়ার্ন, মুরালিদের। কিন্তু ব্যাঘ্রশাবকদের যে বেড়ে ওঠাটা চোখের সামনের দেখেছি, সেটাকেই আমি এই প্রজন্মের পরম পাওয়া বলে মেনে নেব।

দিনশেষে ক্রিকেটেই তো আমরা দুদন্ড শান্তি খুঁজি !

Saturday, August 31, 2013

হুদাই ১ (জীবনে ফেরা)

১।
দুপাশে সাঁই সাঁই করে গাছেরা সরে যাচ্ছে। মাতাল হাওয়ায় উড়ছে চুল, দুধারে নীল পাহাড়ের হাতছানি। একবার তাকালে আর চোখ সরানো যায় না। সামনেই বাঁক, জোরে হাঁক দিয়ে উঠলাম- মামা, আস্তে...
ড্রাইভার সে কথা শুনলে তো! দারুণ দক্ষতায় গতি খুব একটা না কমিয়েই বাঁক কাটিয়ে যায়। আমি কান গুজে দেই হেডফোনে। চারপাশে বন্ধুদের সোল্লাস চিৎঅকার, গাড়ির টায়ারের কর্কশ শব্দ, বাতাসের হিসহিস ধ্বনি... সবকিছু থেকে চট করে আলাদা হয়ে যাই। ডুব মারি অতল জলের স্পন্দনে।
হোয়ার ওয়ার ইউ, হোয়েন আই ওয়াজ বার্নড অ্যান্ড ব্রোকেন। হোয়াইল দ্য ডে সিজড বাই ফ্রম মাই উইনডো ওয়াচিং...
এটুকু শুনেই চোখ মুদে ফেলি। আহ! কী অসাধারণ একটা গান। স্বর্গে গেলে কী এমন গান শোনা যাবে? 

গান বস্তুটা যথেষ্ট গোলমেলে। কখন কোন গান আপনার ভাল লাগবে সেটা বলা ভারি মুশকিল। হঠাৎ করে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, বহুদিন পরে পরিচিত একটা গানের কলি শুনে মন হয়ে উঠেছে স্মৃতিমেদুর- এমন অনুভূতি প্রায় সবার কখনো না কখনো হয়েছে সেটা হলফ করেই বলা যায়। সুর তো আমাদের সবার রক্তেই, কারো কারো সেটা বের হয় গলা দিয়ে, আর বাকিদের মনের স্বরতন্ত্রীতে সেটা গুঞ্জরিত হতে থাকে অহর্নিশ।
আমি দ্বিতীয় দলে পড়ি। গানের ব্যাপারে আমি সর্বভূক,কোনো ধরনের গানেই আমার অরুচি নেই। প্রিয় গানের নাম বলতে বললে আমি তাই চট করে কিছু বলতে পারব না। কারণ, একেকটা গান আমার কাছে স্মৃতির প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেওয়ার মতো, কোন গানের সাথে কোনটা জড়িয়ে আছে বলা কঠিন। আমি সময় মনে রাখি সুরকে দিয়ে, স্মৃতি হাতড়াই গানের বাণীতে। সেজন্য প্রিয় গান মানে আমার কাছে নিভৃত স্মৃতিচারণের অনুভূতি।

বলছিলাম পিঙ্ক ফ্লয়েডের কথা। তখনো ক্লাসিক রকের সাথে ওভাবে সখ্য গড়ে ওঠেনি। ফিরিঙ্গি গান বলতে বেশির ভাগ শোনা হত ধাতবসংগীত। তাও বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে। আমার নিজের ধাত সবসময় ধীরলয়ের দিকে। সেটার দৌড় তখনো বাংলাতেই ছিল। ক্লাসিক রকের অসাধারণ জগতটা আমার কাছে থেকে গিয়েছিল অনালোকিত।
ঠিক সেসময় আমার জগতটাকে লন্ডভন্ড করে দিল পিঙ্ক ফ্লয়েড। এক বন্ধুর পরামর্শে শুনলাম কামিং ব্যাক টু লাইফ। প্রথম দেখাতেই প্রেমের অনুভূতি কী সেটা আমি জানি না, কিন্তু প্রথম শোনাতেই প্রেমের অনুভূতিটা আমি ভালোমতই জানি। এই গানটাই আমাকে শিখিয়েছিল সেটা ।

কাকতালীয়ভাবে এই গানটা শোনার পরেরদিনই বেরিয়ে পড়েছিলাম বাক্সপ্যাটরা নিয়ে। গন্তব্য বান্দরবান। যাওয়ার সময় মোবাইলে ভরে নিলাম গানটা। কে জানত সামনের কয়দিন আমাকে বুঁদ হয়ে থাকবে গোলাপী জাদুকরদের মূর্ছনায় ?
সেটাই ছিল বান্দরবানের গহীনে আমার প্রথম সফর। প্রথমবারের মতো পাহাড়কে কাছ থেকে দেখা, তারিয়ে তারিয়ে তার সৌন্দর্য উপভোগ করা। মেঘ চিরে যখন আমাদের চাঁদের গাড়ি বেরিয়ে আসত রৌদ্রালোকিত রাস্তায়, এখনও  মনে আছে তখন “আই ওয়াজ স্টেয়ারিং স্ট্রেইট, ইন্টু দ্যা শাইনিং সান” লাইনটা যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেল অন্য এক জগতে।
নাহ, উপমাটা ঠিক ভালো হলো না। আসলে যেভাবে গানটার সঙ্গে স্মৃতির অনুভূতিটা ঠিক লিখে বোঝানো যাবে না। এই গানটা শুনেই মনে হয়েছে, এমন কিছু সৃষ্টি করেই চিরতরের জন্য শান্তিতে চোখ মুদে ফেলা যায়। এমন একটা গানই গিলমোরকে দেবে অমরত্বের স্বাদ।


Wednesday, July 24, 2013

মাঝরাতের আগে...

Like sunlight, sunset, we appear, we disappear. We are so important to some, but we are just passing through

ইংরেজিতে বিফোর মিডনাইট, বাংলায় মাঝরাতের আগে। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের পর এবার মাঝরাত। একটা জীবনকে যেন বেঁধে দেওয়া বন্ধনহীন গ্রন্থিতে। যেন পুরো জীবনটাকেই তুলে আনা সেলুলয়েডের আলাদা তিনটি ফ্রেমে। আর বিফোর মিডনাইট যেন আগের দুটোর চেয়েও অনেক পরিণত, অনেক বেশি জীবনঘনিষ্ঠ।


সেলিন (জুডি ডেলপি) আর জেসে (ইথান হক) এই সিনেমায় মধ্যবয়স্ক দুইজন মানুষ। সেই ফ্রান্সে যখন শেষ দেখা হয়েছিল, নয় বছর পর তাদের যুগলবন্দি আবার দেখলাম। এই কয় বছরে বদলে গেছে অনেককিছু, জেসে এখন ঔপন্যাসিক হিসবে বেশ নামডাক কামিয়েছে। আগের সম্পর্ক যুকিয়ে দিয়ে এখন ঘর বেঁধেছে সেলিনের সঙ্গে।  কাগজে কলমে বিয়ে হয়নি তাদের। একসাথে থাকছে বটে। ফুটফুটে দুটো জমজ মেয়ে আছে তাদের।


সিনেমার কাহিনি শুরু গ্রিসে ছুটি কাটানোর শেষ দিনটিতে। আগের স্ত্রীর সন্তান হাঙ্ককে বিমানে তুলে দেওয়ার দৃশ্যতেই চোখ আটকে যাবে আপনার। সেই থেকে শুরু, এরপরের এক ঘণ্টা ৪৮ মিনিট যেন আমাদের সবার জীবনের একটুকরো ছবি।
জীবনটা আসলে কী? এই এগিয়ে যাওয়া পৃথিবীতে আসলে কি খুঁজছে সবাই ? ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটিতে গিয়ে আসলে কি বিসর্জন দিতে হচ্ছে মানুষকে? প্রিয়জনকে বিদায় জানানোর বেদনা আসলে কতটুকু? এবং সবার ওপরে মানুষ শেষ পর্যন্ত কি একরকম আপোসেই মেনে নেয় সবকিছু? যে জীবনটা সে কাটাতে চায় সেটা আসলে কাটাতে পারে কয়জন?

আমাদের সবার মনেই কখনো না কখনো এই প্রশ্নগুলো এসেছে। জেসি আর সেলিনের কথোপকথনে চকিতে এগুলো হানা দিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার। এবং অবশ্যই একেবারে আটপৌরে ভঙ্গিতে। আমরা যেমনটা বলি, কথার পিঠে কথার সাথে যেমন জড়িয়ে থাকে গভীর জীবনদর্শন, অনেকটা সেরকম। এবং মানুষ যে উত্তরগুলোর সুলুকসন্ধান করে ফিরবে আরও অনেকদিন বোঝা গেছে সেটাও।

শেষদিকে বেশ কয়েকবার জেসকে দাঁড়াতে হয়েছে সেলিনের কাঠগড়ায়? কি চায় জেস? সে কি ঔপন্যাসিক হিসেবে নিজের কাটতি চায় , ছেলের সাথে থাকতে চায়? নাকি সেলিনের কথা মেনে নিয়ে সে ইউরোপেই থেকে যাবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে আপনাকে অবশ্য ছবিটা দেখতে হবে।

নিজের অনুভূতির কথা বলি। আমি ইথান হক আর জুডি ডেলপির ভক্ত। তাদের রসায়ন আমার কাছে খুবই সাবলীল লাগে। এমনিতেই অবশ্য ছবিটার চিত্রনাট্য লেখার সময় পরিচালক রিচার্ড লিঙ্কলেটারের সাথে এই দুজনও ছিলেন। সংলাপ যে ছবির আসল প্রাণ হতে পারে, এটা দেখার জন্য বিফোর ট্রিলজির চেয়ে ভালো উদাহরণ খুব কমই আছে। এই পড়তি বয়সে এসে দুইজনেই আগের চেয়েও যেন অনেক বেশি প্রাণবন্ত,অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত। অনেকটা পুরনো মদের মতো।
 
তবে সংলাপনির্ভর ছবির একটা দুর্বল দিক আছে। একটু একঘেয়েমি পেয়ে বসতে পারে দর্শককে। তবে আগের দুই পর্ব যারা দেখেছেন, তারা নিশ্চয় জানেন এই ছবিতে অন্তত সেরকম কিছু থাকবে না।  তাদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই, এটা বলেই দেওয়া যায়!


সব মিলিয়ে বিফোর ট্রিলজি আমার কাছে একটা স্পেশাল জায়গা পেয়ে গেল। পরের পর্ব যখন হবে, তখন সেলিন-জেসে আরও বুড়িয়ে যাবে। বুড়িয়ে যাব আমিও। কিন্তু যদি আসে, সেটা মিস করব না এটা হলফ করে বলে দিতে পারি। 

Friday, May 31, 2013

একা এবং কয়েকজন

কলেবরে পৃথুল উপন্যাস পড়ার কিছু হ্যাপা আছে। সেরকম মন লাগিয়ে পড়তে আ পারলে আধাখেচড়া পড়ে থাকা বইয়ের সংখ্যা একেবারে কম না। আবার কিছু কিছু উপন্যাস আছে, যা নিজগুণেই টেনে ধরে রাখে চুম্বকের মতো। একবার শুরু করলে সেখান থেকে বেরুতে পারার সাধ্যি কয়জনের ?
আমরা নশ্বর মানব। এক জীবনে কটা বই-ই বা পড়া যায় ? শুধুই মনে হয় কতকিছু বাকি রয়ে গেল। তবে কিছু বই পড়ার পর মনে হয় এটা না পড়লে বড় একটা অতৃপ্তিই থেকে যেত। একা এবং কয়েকজন ঠিক সেরকম একটা উপন্যাস।
এমনিতেই সুনীলের কাছে আমার ঋণ অনেক। তাঁর বই পড়েই কাঁদতে শিখেছিলাম।  ছাপার কালো অক্ষরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কীভাবে বুঁদ হয়ে থাকা যায় সেটা তো সুনীলই শিখিয়েছিলেন। আমার কৈশোর তছনছ করে দেওয়া লোকটা তো আর কম লেখেননি জীবনে! কিন্তু একা এবং কয়েকজন পড়ার পর কেবলই মনে হচ্ছে এই ঋণের পাহাড়সম বোঝা বুঝি আমাকে সারাজীবনই বয়ে বেড়াতে হবে। শোধ করার উপায় খোঁজাও বুঝি নিরর্থক।
সুনীলের চরিত্রগুলোর ওপরও আমার বড্ড রাগ। এমন অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে যায় আমার সবটুকুর সঙ্গে চাইলেও তাদের এড়িয়ে চলা কঠিন। এখন যদি আমি বলি আমার শয়নে শপনে জাগরণে শুধুই সূর্য, বাদল, রেণু তাহলে সেটা বড্ড নাটুকে হয়ে যাবে। কিন্তু পড়ার ঘোরলাগা সময়টুকুতে যে তারা আমার আত্মার আত্নীয় হয়ে ওঠে সেই সত্য আমি অস্বীকার করি কি করে ?
কে বলেছিল সূর্যকে এমন হতে ? পুরো পৃথিবীর ওপর যেন তাঁর প্রচন্ড অভিমান। নিজেকে গুটিয়ে রাখবে খোলসে ঢাকা শামুকের মতো। যখনই কেউ সেটা খুলে দেখতে যাবে তখনই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেবে তাদের। কে বলেছিল সুনীলকে এমন উদ্ধত একটা চরিত্র জন্ম দিতে ? নিরবতা কেমন হিরন্ময় হতে পারে সেটা তো সূর্যের চেয়ে বেশি কেউ বোঝাতে পারেনি । নিজেকে শেষ করে দেওয়ার এমন দুর্মর ইচ্ছাটা কি আমাদের সবারই কখনো না কখনো হয় না ? কিন্তু আমরা তো একটা পুতুলনাচের কুশীলব মাত্র। নাটাইটা কার হাতে আমরা জানি না, কিন্তু অভিনয় করে যাচ্ছি দিনের পর দিন; কোন ক্লান্তি, শৈথিল্য ছাড়াই।
বাদল, রেণু এরা তো আমাদের চারপাশেরই সবাই। নিজেকে বোঝার নিরন্তর অভিপ্রায় আমাদের মজ্জার ভেতর আছে, আমি আসলে কী সেটা তো গোটা এক জনমেও বুঝতে পারি না অনেকে। কিন্তু বাদল যেন আমাদের পথটা দেখয়ে দেয়। আবার দেখিয়ে দিয়েও যেন নিজেই সরে যায় অভিমানীর মতো।
চিরঞ্জীব, বড়বাবু, দীপ্তিদেরই বা ভুলে থাকি কি করে? তারা কী চায়, কেন তারা বেঁচে থাকে নিজেরাই জানে না। তাদের সবার মধ্যে হয়তো রক্তের বন্ধন নেই, কিন্তু তার চেয়েও অনেক বড় একটা বন্ধন তাদেরকে গেঁথে রাখে অদৃশ্য সুতোয়। এত কাছের , তাও যেন বহুদূরের এসব মানুষদের কে এমন মমতা দিয়ে গড়ে তুলতে পারবেন সুনীল ছাড়া ?

বইটা পড়ার পর এসব কথাই মাথার ভেতর  ঘুরপাক খাচ্ছে অবিরত। জানি, এসব নেহাতই ছেঁদো কথা, ভাবাবেগ দিয়ে তো আর জীবন চলে না! এখানেই সুনীলের ওপর আমার ভীষণ রাগ। চাইলেও কি এদের ভুলে থাকা যায় ? মলাট বন্ধ করলেই তো আর একটা জগৎকে অস্বীকার করা যায় না। কোথাও না কোথাও আমরা যেমন দূরের নক্ষত্রদের মতো একা, আবার কোথাও কোথাও সেই একাকীত্বই যেন আমাদের সঙ্গ দেয় পরম সুহৃদের মতো। সুনীল না থাকলে এই বোধটুকুও বুঝি কখনো হতো না ! 

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...