Sunday, May 15, 2011

কাছ থেকে দেখা যন্ত্রকৌশল উৎসব

ক্লাস টেস্ট, সেশনাল, অ্যাসাইনমেন্টের চাপে যখন আমাদের খাবি খাওয়ার দশা, ঠিক তখন বাতাসে উড়ো খবর, এই টার্মে নাকি মেকানিক্যাল ডে হবে। যাহা রটে তাহা কিছুটা হলেও ঘটে, আর রটনাকে সত্যি প্রমাণ করে আসলেই ডে আয়োজনের জন্য তোড়জোর শুরু হয়ে গেল। আমরা এখন ৪-১ এর অকালতত্ত্বজ্ঞানী মানব, বুয়েটের সাথে গাঁটছড়া ভেঙ্গে যাওয়ার আর খুব বেশি দেরি নেই। তাই, নিতান্তই জোলো, ম্যাদামারা এই টার্মে ডে হওয়ার খবর শুনে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম, নাহ! টার্মটা একেবারে নিস্ফলা যাবে না।

মেকানিক্যাল ফেস্টিভ্যাল কাগজে কলমে দুদিনের অনুষ্ঠান হলেও মূল ব্যপ্তি একদিনেরই, সেই একদিনেই দিনমান লেগে থাকে নানা আয়োজনের ধুম। সেই সাতসকাল(আমাদের মত নিশাচরদের জন্য সকাল ৮টা সাতসকালই বটে) থেকে কারো একবিন্দু দম ফেলার ফুরসত থাকেনা। তবে সারা দিনের এইসব অনুষ্ঠানের নেপথ্যে আগের কদিনের বিনিদ্র রজনী ও হাড়ভাঙ্গা খাটুনির খবর কজনই বা রাখে? যেমন যন্ত্রকৌশল বিভাগের অফিসিয়াল মুখপত্র অযান্ত্রিকের কথাই ধরি না কেন?(সম্পাদকমণ্ডলীর একজন হিসেবে এই মওকায় আগে এটার কাসুন্দি ফেঁদে বসলাম আর কি , হে হে) । ঠিক হয়েছিল, উৎসবের প্রথম প্রহরেই স্যারদের হাতে অযান্ত্রিকের ঝকঝকে তকতকে নতুন কপি শোভা পাবে। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই চাট্টিখানি কথা নয়, যদি ম্যাগাজিন বের হওয়ার প্রলম্বিত প্রক্রিয়ার কথা খেয়াল থাকে। লেখার জন্য ক্লাসে ক্লাসে নোটিস, সেই নোটিসের পর আবার ঘন ঘন তাগাদা, ডেডলাইন পেরিয়ে যাওয়ার পরও লেখা আসা, সেই লেখাগুলো আবার নীলখেতে ভ্যাপসা গরমে নাকাল হয়ে কম্পোজ করিয়ে আনা, সেগুলোর একদফা প্রুফ দেখা, লেখা যাচাই-বাছাই করা (এসময়টা আমাদের জন্য রীতিমত সংকটজনকই বলা চলে), সেই লেখা নিয়ে প্রেসে যাওয়া, এদিকে অ্যাডের জন্য আরেক দফা ছোটাছুটি, শেষ মুহুর্তে আরো কিছু অ্যাড যোগ হওয়া...উফ হাঁপিয়ে গেলাম। এরপরের দুইদিন প্রেসে বসে পুরো ম্যাগাজইনের লে-আউট দেখা, বারবার প্রুফ চেক করা এবং শেষ মুহুর্তেও স্থানাভাবে আরেক দফা লেখা কাঁটছাটের মত দুষ্কর কাজের কথা ভুলি কি করে? সবকিছুর পরে যখন সম্পাদকবাহিনীর (আশফাক, শাফি, জুয়েল, এবং এই অধম) যখন শেষমেশ হাতে ম্যাগাজিনের সদ্য ছাপা হওয়া কড়কড়ে অযান্ত্রিকের কপি এসে পৌঁছাল, সেই মুহুর্তের কথা আসলেই ভোলা যায়না, এক কথায় বললে অবিশেষণসম্ভব!

ডে এর বাকি আর মাত্র দেড় হপ্তা, শুরু হল এই উপলক্ষে নির্মিত ছবি নির্মাণের আরেক এলাহী কারবার। চিত্রনাট্য, শুটিং ইত্যাদি নিয়ে হ্যাপার পরিমাণ কতটা বেশি হতে পারে, তা নিজ চোখে দেখেই বুঝেছিলাম। একেকটা শটই রীতিমত বিশাল ব্যাপার। তবে পরিচালনায় আমাদের ্নাসির হককে নবীন বা নবিস যাই বলুন না কেন, অভিনয় কিন্তু সবাই ষোলআনা জানে, সেটা শুটিং দেখার সময় বুঝেছিলাম। ইচ্ছে ছিল, তারিয়ে তারিয়ে পুরো ব্যাপারটা চেখে দেখব, শত হলেও এমন মওকা আর বারবার আসেনা, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সে ফুরসত মিলল কই? তবে মনে মনে ছবিটার একটা ছাঁচ ঠিকই কল্পনা করে নিয়েছিলাম, এখন এক হপ্তা পর সেই কল্পনা মেলাবার পালা কেবল।

এবার চলুন ঘুরে আসি একটু খেলার মাঠ থেকে। আপাতদৃষ্টিতে উৎসবের সাথে প্রত্যক্ষ সংশ্রব না থাকলেও এই ডে উপলক্ষে আয়োজিত ইণ্টারব্যাচ টুর্নামেন্ট চৌধুরী জাফরুল্লাহ শারাফাতের ভাষায় বলতে গেলে,"অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানজনক একটি খেতাব"। আর এই ব্যাপারে কোন হল্লামাস্তি হবেনা, তা কী করে হয়? তাই, দীর্ঘদিনের জং ধরা শরীরকে বশে আনতে আমরা মাঠে ছুটে চললাম। আমরা, মানে ০৬ ব্যাচ ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন এবং এই মুহুর্তে সিনিয়র ব্যাচ। তাই, প্রত্যাশার পারদটাও আমাদের কাছে অনেক বেশি চড়া। তবে দুদিন গা গরমের পর আমরা মুখোমুখি হলাম ০৯ ব্যাচের। এ ম্যাচটা অবশ্য আমরা হেসেখেলে জিতে গেলাম, আমাদের সারপ্রাইজ প্যাকেজ সাফায়েতের দুর্দান্ত দুই গোলে আমরা চলে গেলাম ফাইনালে। ওদিকে উঠল ০৭ ব্যাচ, ঠিক গতবারের ফাইনালের পুনরাবৃত্তি। ফাইনালের দিন পুরো মাঠ সরগরম, এদিন যে মেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টের এক ক্লাসিকো! অত্যন্ত শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে খেলা শুরু হল। বরাতটাও এবারও আমাদের পক্ষে ছিল, দ্বিতীয়ার্ধে অসাধারণ এক গোল করে সৌরভ জয় ছিনিয়ে আনল। এই বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখিয়ে আরেকবার আমরা জিতে নিলাম শিরোপা। এবারো কাপ গেল মেকা সকারুজের হাতে।

খেলার মাঠ থেকে চলুন এবার একটু ঢুঁ মেরে আসি ইএমই ভবনে। ঘড়িতে এখন বাজে সন্ধ্যা ছটা। ক্লাস-সেশনালের পাট চুকেছে মেলা আগে, কিন্তু ক্লাসরুমে হইচইয়ের খামতি নেই। এখানে যে ডে উপলক্ষে আয়োজিতব্য সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা স্পন্দনের প্রস্তুতি চলছে। আমাদের এই সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাকে নিয়ে কিন্তু সবার প্রত্যাশাটা একটু বেশিই থাকে, অনেক দিন ধরেই এটাই বুয়েটের অলিখিত রেওয়াজ। তাই, সেই সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে, এরকম একটা তাগিদ এবারও ছিল। এদিকে সমানে চলছে স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ, আর ওদিকে চলছে রিহার্স্যাল। গান, নাচ, বাংলা সিনেমা, নাটিকা, কমেডি শো সবকিছুর প্রস্তুতি চলছে বিপুল বিক্রমে, আজ বাদে কাল ডে, আর কোন ফুরসত নেই।

এদিকে ফুরিয়ে আসছে সময়, এগিয়ে আসছে মাহেন্দ্রক্ষণ, প্রেসে সমান তালে চলছে অযান্ত্রিকের ছাপা, ক্লাসে চলছে তুমুল বেগে রিহার্স্যাল, আর খাওয়া, টি শার্ট, গেম শো, ক্যাড কন্টেস্ট, ফোটোগ্রাফিক এক্সিবিশনসহ অন্যান্য সব অনুষ্ঠানের কথা আর নাই বা বললাম। হাতে আছে আর মাত্র একদিন, এখনো স্টেজ সাজানো হয়নি। আগের রাতে তাই তাই সমানে চলে নেপথ্য কুশীলবদের হাত, কারো একদন্ড জিরিয়ে দেওয়ার অবসর নেই। এদিকে তখনও ম্যুভির শেষমুহুর্তের কাজ চলছে, কাল বিকেলেই যে সবাই জড়ো হবে দেখতে।

দেখতে দেখতে রাত ফুরিয়ে এল, দিনটাও এসেই গেল। তবে সকালের জব সেমিনার আর গেমশোর ডামাডোলে স্পন্দনের প্রস্তুতি কিন্তু থেমে থাকেনি। গেমশোর কথা একটু বলেই ফেলি, তিহানের সুরসিক উপস্থাপনায় স্যাররাও এমনকি বারবার হেসে লুটিয়ে পড়ছিলেন। আর এই মওকায় আবার নিজের ঢোল পিটিয়ে যাই, সম্পূর্ণ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অগণতান্ত্রিক পরিবেশে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আমি হাটে থুড়ি মাঠে হাড়ি ভেঙ্গেই ফেলি। সকালবেলার এইসব আয়োজনের পর বিকেল গড়িয়ে এল, এবার সময় ্নাসির হক পরিচালিত ম্যুভি "ক্যাম্পাস" দেখার। চোখ ধাঁধানো পোস্টারিং আগেই সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছিল, তাই শো শুরুর আগেই অডিটোরিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ। শুরু হয়ে গেল ম্যুভি। এরপরের আধ ঘন্টার চেয়ে কিছু বেশি সময় কেটে গেল মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। এসব তো আমাদেরই কথা, কিন্তু দেখলাম একেবারেই অন্য চোখ দিয়ে। শো শেষে দর্শকের হাততালিতে টেকা দায়, ক্যাম্পাস আক্ষরিক অর্থেই কাঁপিয়ে(কাউকে কাউকে হয়তো কাঁদিয়েও) দিয়ে গেল সবাইকে।

এদিকে বেজে গেছে সন্ধ্যা সাতটা, আর খানিকক্ষণ পরেই পর্দা উঠবে স্পন্দন ২০১১ এর। ম্যুভির পর দর্শকদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী, সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে। খানিকটা বিলম্বের পর শুরু হয়ে প্রোগ্রাম, মিফতুর গান

দিয়ে। উঠন্তি মুলো পত্তনেই চেনা যায়, তাই এরপর আলীবাবা চল্লিশ ল্যাগের পর যখন হাততালিতে অডিটোরিয়াম ফেটে পড়ল, তখনই বোঝা গেল, আজকের দিনটা আমাদেরই। বাকি অংশ কেবলই ইতিহাস, এরপর এতটুকুর জন্য ছন্দপতন হয়নি কোথাও। কল্লোল, সেতু, অনিন্দ্য, তৃণা, আমাদের প্রিয় এহসান স্যারের গান সবাই তন্ময় হয়ে শুনল। এই সুযোগে বলে রাখি, সংগীতায়োজন ছিল লাজওয়াব, এজন্য এর সাথে জড়িত গাইয়ে বাজিয়েদের আরেক দফা ধন্যবাদ। ওদিকে নাটকও কম যায়না। পাবলিক টয়লেট, যাত্রা কোথাও এতটুকু টাল খায়নি, তরতরিয়ে চলেছে। এদিকে নাচ, বাংলা সিনেমা, গুপি বাঘাও উতরে গেছে। তবে আলাদাভাবে বলব দুটি আইটেমের কথা। স্ট্যান্ড আপ কমেডিতে ছোটন ছিল আক্ষরিক অর্থেই বিস্ময়বালক , দর্শক কেবল হাত তালি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, দাঁড়িয়েই গিয়েছিল। ব্যাপারটা আরো বেশি দুর্দান্ত হয় যখন শুনি এই আধুনিক হোজ্জা সাহেব কেবল ১০ ব্যাচের। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, পুরো প্রোগ্রাম যখন চলছিল, তখনো চলছে টক শর স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ। ওদিকে টকশোর নেপথ্য কুশীলবেরা তখনো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শেষমেশ একবার মাত্র দায়সারা রিহার্স্যাল দিয়েই নেমে পড়ল তারা। আর যা হওয়ার তাই হল, ইম্প্রোভাইজেশনের অনন্য নমুনা দেখিয়ে ইফতি, নাহিয়ান, জিমি যথারীতি হিট।

নাহ! অনেক হল, এবার ক্ষান্ত দেওয়া দরকার। এই লেখাটা যখন লিখছি, চোখের সামনে তখনো ভাসছে গতকালের দিন, প্রতিটি মুহুর্ত এখনো মাথায় গেঁথে রয়েছে। সিনিয়র ব্যাচ হিসেবে এটাই আমাদের শেষ ডে, তাই অনুভূতিটা ছিল একটু আলাদা। শেষে সবাই যখন উচ্চস্বরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গাইছিলাম, একদিন ঘুমভাঙ্গা শহরে...তখন হলফ করে বলতে পারি, কারো কারো বুক অব্যক্ত ব্যথায় চিনচিন না করে পারেনি, কারো কারো কন্ঠও হয়তো বাষ্পরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এই কথাগুলো টাইপ করতে হাত কেঁপে যাচ্ছে, তারপরও করছি, আমরা হাসব না...আমরা ভাসব না...শুধুই মিস করব...মিস করব......

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...