Tuesday, September 1, 2015

কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে দাঁড়িয়ে...

একটা নিরেট গল্প ছাড়া কি কোনো ভালো ছবি হয়? বলতে পারেন, আরে মসলা ছাড়া আবার খাবার হয় নাকি ? কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে তো সেরকম কোনো গল্পই নেই। দার্জিলিংয়ে বনেদী একটা পরিবার ছুটি কাটাতে যায়। সেখানেই জীবনের টানাপোড়েনে তাদের কিছু কঠিন সত্যের সামনে দাঁড়াতে হয়। ব্যস, মোটাদাগে তো ছবির মূল গল্প এটাই। সেই অর্থে ওরকম কোনো ক্লাইম্যাক্সও নেই, নাটকীয় সংলাপ-টংলাপও খুব একটা নেই। তারপরও কেন আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবিগুলোর একেবারে শুরুর দিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা থাকবে ? 



এখানেই আসলে ছবিটার অসাধারণত্ব। কাঞ্চনজঙ্ঘায় যা নেই, তার জন্যই যেন ছবিটি এত প্রিয়। ছবিটা কিছু না বলেই যেন অনেক বেশি বাঙময়, রবীন্দ্রনাথের “অনেক কথা যাও যে বলি কোনো কথা না বলি” গানের মতো। একটা পাহাড়ি লেপচা ছেলের কন্ঠে একটা এই ছবিতে একটা গান আছে। অর্থটা না বুঝলেও হৃদয়ের কোথাও যেন টোকা লাগে অদ্ভুত সুরে। শেষদিকে ওই ছেলেটার হাতে একটা চকলেট তুলে দেন ছবির অন্যতম একটা চরিত্র ব্যানার্জি। ছোট্ট একটা কথা বলেছিলেন, “নে, তোরই জিত”। কাঞ্চনজঙ্ঘা কেন সময়ের চেয়ে অনেক অনেক বেশি এগিয়ে থাকা একটা ছবি, ওই ছোট্ট দৃশ্যটাই যেন সবকিছু বলে দিচ্ছে। 



এমনিতে পাহাড়ের কাছে আসলেই মানুষের মনে একটু অন্যরকম ছাপ ফেলে। নাগরিক পঙ্কিলতা অনেকটাই ছুয়ে মুছে যায়, লোকাচারকে মনে হয় লোক দেখানো। পাহাড় মানুষকে অনেক কিছুই আড়াল করতে দেয় না, নিজেও আড়াল হতে দেয় না। সেজন্যই তো একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে থাকা অশোক জাত্যাভিমানে আক্রান্ত চৌধুরীসাহেবদের মুখের ওপর চপেটাঘাত কষতে পারেন। সেজন্যই হয়তো স্বৈরিণী স্ত্রী স্বামীর কাছে অকপটে সবকিছু স্বীকার করতে পারেন, সেজন্যই হয়তো লৌকিক সম্পদ বা আরও অনেক কিছু মণির কাঁচা মনের ওপর কোনো আস্তর ফেলতে দেয় না। কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো বিশাল কিছুর সামনে জাগতিক তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতা কতটা অকিঞ্চিকিৎকর হয়ে পড়তে পারে সেটার সত্যজিতের চেয়ে ভালো আর কেই বা দেখাতে পারেন ?




এম্নিতে ছবিটা সত্যজিতভক্তদের অনেকেরই একদম শুরুর দিকের তালিকায় থাকবে না। তবে এটা কিন্তু তাঁর প্রথম মৌলিক গল্প নিয়ে তৈরি রঙিন ছবি, আলাদা একটা আবেদন তো আছেই। পরিচালনার দিক দিয়েও তাঁকে একটু বেশি মাথা খাটাতে হয়েছিল। সংলাপ তো এমনিতেই কম, লং শট বা ম্যুভমেন্ট দিয়ে আবহটা বোঝানোটা অনেক বেশি দরকার ছিল। অভিনেতা-অভিনেত্রিদের কাছ থেকেও সম্ভবত সেরাটুকুই বের করে আনতে পেরেছেন। নিস্তরঙ্গ, অচঞ্চল একটা ছবিতে মানুষের বিচিত্র সব সংকটকে দেখানো খুব একটা সহজ লাজ নয়। সেই কাজটা কমবেশি সবাই ভালোই পেরেছেন। সবচেয়ে ভালো বোধহয় পেরেছে ওই লেপচা শিশুটা, স্বর্গীয় একটা হাসিতে যেন বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রকৃতির কাছে আমরা কত তুচ্ছ!

No comments:

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...