Monday, February 14, 2011

ও ফেনোমেনন, মাই ফেনোমেনন !!


১.

কতই বা বয়েস, এর চেয়ে ঢের বুড়ো খেলোয়াড়ারদের(এই মুহুর্তে চট করে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের রায়ান গিগসের নামটাই মাথায় আসল) মাঠ দাপিয়ে বেড়ানোর এন্তার রেকর্ড আছে। তবে দীর্ঘদিন বিষফোঁড়া হয়ে থাকা ইনজুরির সাথে শেষমেশ হার মানতে বাধ্য হলেন তিনি। মাত্র চৌত্রিশ বয়েসেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ঢের হয়েছে, এইবার বুটজোড়া তুলে না রাখলেই নয়। আর কখনো ফুটবল মাঠে ডিফেন্ডারদের তুর্কি নাচন নাচাবেননা তিনি। আদিওস...রোনালদো লুইস নাজারিও দে লিমা, আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে দুর্দান্ত স্ট্রাইকারটিকে আর কখনো মাঠে দেখা যাবেনা।

২.

তখনও ফুটবলের সাথে গাঁটছড়া অতটা মজবুত হয়নি, ইউরোপিয়ান লীগে মজে থাকার সময়টা এসেছিল আরো পরে। পত্রিকা মারফতই খবর যা একটু রাখা হত। সে সময়টাও বেশ আগের, তখন প্রাইমারি স্কুলের চৌকাঠ পার হইনি। এমন সময় শুরু হয়ে গেল বিশ্বকাপ ফুটবল। ফ্রান্সে অনুষ্ঠেয় ওই আসরের শুরু থেকেই টেকো মাথার দোহারা গড়নের এক খেলোয়াড় নিজের জাত চিনিয়ে দিচ্ছিল। ব্রাজিল সমর্থকদের চোখের মনিতে পরিণত হতেও খুব বেশি সময় লাগলনা। ক্ষিপ্রগতির সাথে পেনাল্টি বক্সে দুর্দান্ত ফিনিশিং এর কারণে বাকিদের থেকে সহজেই তাকে আলাদা করে যেত। এর মধ্যে ব্রাজিলও তরতর করে ফাইনালে উঠে গেল। প্রতিপক্ষ ফ্রান্স, আর সাথে স্বাগতিক দেশের স্বতঃস্ফূর্ত দর্শক সমর্থন। ব্রাজিলের পাঁড় সমর্থক আমার বাবার মত বাংলাদেশের লাখো ব্রাজিল ভক্ত তখন একাট্টা , টানা দ্বিতীয়বারের মত শিরোপা এবার ঘরে না এসেই পারেনা। আর তুরুপের তাস ফর্মের তুঙ্গে থাকা রোনালদো তো ছিলই। কিন্তু সব আশায় জল ঢেলে দিয়ে ফাইনালে নায়ক হয়ে গেলেন আরেক জীবন্ত কিংবদন্তী, জিনেদিন জিদান। পুরো মাঠে রোনালদো নিজের ছায়া হয়েই রইলেন। ব্রাজিলকে ধরাশায়ী করে বিশ্বকাপ গেল লা ব্লুজদের ঘরে। রোনালদোকে ওইদিন কাঁদতে দেখেছিলাম কিনা মনে নেই, তবে ব্রাজিল ভক্ত বাবার চোখের কোণে চিকচিক করা অশ্রু এখনো আমার স্পষ্ট মনে পড়ে।

৩.

মূলত তখনই রোনালদো নিয়ে আমার মুগ্ধতার শুরু। বার্সেলোনা থেকে রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফি তে ইণ্টারন্যাসিওনালে(ইন্টার মিলান বললেই মানুষ বেশি চেনে) আসার খবরও আমার অজানা নয়। ইতালিয়ান ফুটবলের রাজপথটা তখনও ঠিকঠাক চেনা হয়ে ওঠেনি, ফলে খবরের পাতায় রোনালদোর কেরদানির কথা পড়েই মন ভরাতে হত। এর মধ্যেই অবশ্য ইনজুরির সাথে মিতালী বেশ জমে উঠেছে। তবে দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকার কারণে বিস্মৃতির গর্ভ তলিয়ে যাওয়ার যে সূক্ষ্ণ আশঙ্কাটা ছিল সেটাকে তিনি অচিরেই ভুল প্রমাণ করলেন তিনি। সময়টা ২০০২ সাল। এশিয়ার মাঠে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের আসর। একদিকে শিরোপাধারী ফ্রান্স, আর হট ফেভারিট আর্জেন্টিনার ভীড়ে সেলেকাওদের অনেকেই হয়তো গণায় ধরতে ভুলে গিয়েছিলেন। পরের ইতিহাসটা অবশ্য সবার জানা। এলাম, দেখলাম ,জয় করলাম স্টাইলে ইনজুরি থেকে তার প্রত্যাবর্তনটা হল দুর্দান্ত রকমের রাজসিক। নিজে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পাশাপাশি দলকেও এনে দিলেন বহুল আরাধ্য পেন্টা। আগের বিশ্বকাপের দুঃসহ স্মৃতিকেও দারুণভাবে ধামাচাপা দিলেন।

৪.

এই বছরটা অবশ্য রোনালদোর জন্য আলাদাভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই বছরেই যে রিয়ালের নক্ষত্রমণ্ডলের আরো একটি জ্বলজ্বলে তারা হিসেবে নিজের নাম লেখালেন তিনি। তবে রোনালদোর সাথে আমার এরপরের স্মৃতি খুব একটা সুখপ্রদ নয়। তখন আমি ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের অন্ধ সমর্থক। সেই সময়কার লাল শয়তানের দলও নেহাত ফেলনা ছিলনা। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লীগের নক-আউট স্টেজে ওল্ড ট্রাফোর্ডেই ম্যানইউর বিপক্ষে দুর্ধর্ষ এক হ্যাট্রিক করে বসলেন তিনি। পরের বছরগুলোতে রিয়ালে তার থাকাটা খুব একটা সুখকর হয়নি। ফেরারীর মত ধাওয়া করা সেই ইনজুরি তো ছিলই, সেই সাথে বল্গাহীন ওজন এবং মাঠের বাইরের উটকো সব কারণে তিনি নিয়মিতই সংবাদের শিরোনাম হতে থাকেন।ফলাফল, কোচের গুডবুক থেকে তার নাম কাটা পড়ার দশা হয়। এর মধ্যেই এসে যায় আরেকটি বিশ্বকাপ।

৫.

এইবার তাকে দলে নেওয়া নিয়ে বেশ একচোট সমালোচনা হয়ে যায়। ততদিনে তিনি বেশ মুটিয়ে গেছেন, বেঢপ শরীরে তাকে চেনা হয়ে পড়ে দায়। তারপরও ধারে না কাটলেও ভারে নিশ্চয় কাটবেন, এমন আশায় কোচ পাহেইরা তাকে দলে রাখেন। কোচের আস্থার প্রতিদান তিনি এবার আর সেভাবে দিতে পারলেননা। ব্রাজিলের হেক্সা স্বপ্নও কোয়ার্টার ফাইনালে মুখ থুবড়ে পড়ে। এখনো আমার মনে পড়ে, ওইবার স্থূলদেহের রোনালদোকে বলের পেছনে দৌড়ানোর নিস্ফল প্রয়াস দেখে মনে হচ্ছিল, এ আমি কাকে দেখছি? এ কি সেই খেলোয়াড়, যিনি ঝড়ের বেগে বক্সে ঢুকে একমেবাদ্বিতীয়ম বডি ডজে মার্কারদের ছিটকে ফেলে দেন এবং বলাই বাহুল্য, নির্ভুল মুন্সীয়ানায় বলটাকে জালে জড়িয়ে দেন? তারপরেও বিশ্বকাপের ইতিহাসে নিজের নামটাকে পাকাপাকিভাবে খোদাই করার ভুল তিনি করেননি। গার্ড মুলারকে ছাড়িয়ে রোনালদো হয়ে যান বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোল করা খেলোয়াড়। এর মাঝে ক্লিন্সমানের পরে টানা তিন বিশ্বকাপে কমপক্ষে তিন গোল করা খেলোয়াড়ও হন তিনি।

৬.

এরপরের সময়টাকে আমি বিস্মৃতির সময়ই বলব। রিয়াল থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে খুব তাড়াতাড়ি তিনি এসি মিলানে চলে আসেন। ইতিমধ্যে ফর্মহীনতা,ওজন সমস্যার সাথে সেই পুরনো শত্রু ইনজুরির সাথে তার লড়াই চলতে থাকে। এদিকে মেঘে মেঘে বেলাও কম গড়ালনা, য়ারেক রোনালদোর আবির্ভাবে একে একে সবাই তাকে ভুলতে বসে। সত্যি বলতে কী, এরপর নিজের আসল ফর্মের ধারেকাছেও তিনি কখনও যেতে পারেননি। তাই ও নিয়ে কথা আর না বাড়াই। তবে তিনবারের ফিফা ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার, বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা, ইন্টার-মিলান বা রিয়াল-বার্সার মত অবিস্মরনীয় দ্বৈরথগুলোর মুদ্রার দুপিঠ থেকেই দেখতে পারার দুর্লভতম অভিজ্ঞতা সহ এমন আরো অনেক অর্জন এই লম্বা সময়ে তিনি নিজের ঝুলিতে পুরেছেন। ক্লাবের হয়ে ৫১৫ ম্যাচে ৩৫২ গোল বা দেশের হয়ে ৯৭ ম্যাচে ৫২ গোল, এসব পরিসংখ্যানও নিঃসন্দেহে ঈর্ষাজাগানিয়া। তবে রেকর্ড অনেক কথাই বলবে, তবে আমি নিজে অন্তত তাকে মনে রাখব ডিফেন্সচেরা থ্রু গুলো আঁচ করতে পারার বিরলপ্রজ স্ট্রাইকিং ইন্সটিংক্ট, মার্কারদের ছিটকে ফেলার দারুণ ক্ষমতা, পেনাল্টি বক্সে চিতার মত ক্ষিপ্রতা, দুপায়েই শট নেওয়ার দক্ষতা এবং অসাধারণ ফিনিশিংয়ের কারণে। আমাদের সময়ে বিশ্ব ফুটবলে সবচেয়ে বড় মঞ্চে তার মত আর কেউ বোধকরি নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি। এর মধ্যেই আরো অনেক স্ট্রাইকার আসবে, অনেকে গোলের তুবড়ি ছোটাবেন কিন্তু দ্য ফেনোমেনন আদপে একজনই।

একজন আর্জেন্টাইন সমর্থক হয়েও বিদায়বেদায় তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি, গুরু...তোমায় সেলাম। টেকো মাথার লোকটিকে আমার মত লাখো ফুটবলামদীদের পক্ষ থেকে আরো একবার স্যালুট!!

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...