Thursday, January 13, 2011

মেঘ, নদী আর পাহাড়ের দেশে-৪

গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়ার হ্যাপা এতদিন কেবলই শুনেছি, তবে রেমাক্রিবাজারে এসে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। সামনে বেশ উঁচুমতন একটা টিলা, ওটার নিচে ইঞ্জিন নৌকা আমাদের নামিয়ে দিল। এবার তো একগাদা মালপত্তর নিয়ে ঐ পাহাড় টপকাতে হবে, ভাবতেই মন খানিকটা দমে গেল। কালঘাম ছুটিয়ে আমরা যখন পাহাড়ের ওপরে ইউএন্ডিপির রেস্টহাউজে পৌঁছে কুকুরের মত জিভ বের করে হাপাচ্ছি, তখন মেজাজটা দ্বিতীয় দফায় খিঁচড়ে গেল। রেস্টহাউজে একটাই বেশ বড়সড় কক্ষ, তবে সেটা থানচিতে সাক্ষাত হওয়া আমাদের আরেক বন্ধুদের কব্জায় তখন। এখন উপায়? খোঁজ নেওয়ার জন্য আমরা কজন চললাম বাজারের দিকে। সেখানেও অবস্থা তথৈবচ, ঠা ঠা রোদ্দুরের পড়ন্ত দুপুরে সেখানে খুব একটা জনমনিষ্যির পাত্তা দেখলামনা। তবে বাজারটা যতটা ছোট মনে করেছিলাম, ততটা ফেলনা নয় মোটেই। বেশ বড় খোলামেলা একটা জায়গা, চারদিকে বেশ কিছু দোকান। বরাতটা অবশ্য বেশ ভালই বলতে হবে, শেষ পর্যন্ত থাকার একটা বুদ্ধি মিলে গেল। রেস্টহাউজের বারান্দাটা পুরোটাই কাঠের, সেখানেই চাদর বিছিয়ে একরাত দিব্যি পার করে দেওয়া যাবে। শেষমেশ এক রেস্টহাউইজেই আমরা একই ভার্সিটির উনিশজন ব্যাচমেট, কাকতালটা বেশ জবরদস্ত বলতেই হবে। এর মাঝে নৌকায় উদরপুর্তির জন্য বরাদ্দকৃত চিড়ে-কলা তখনো পুরোপুরি সাবাড় করতে পারিনি, শির হল দুপুরে আর কিছু না খেয়ে সেটা দিয়েই চালিয়ে দেওয়া হবে। সবাই তখন টানা ছ ঘন্টার দুর্ধর্ষ জার্নি বাই বোটের পর রীতিমত জেরবার, ঐ কাঠের মেঝেতেই চাদর বিছিয়েই সটান শুয়ে পড়লাম। এই করতে করতে বিকেল গড়িয়ে গেল।



রেমাক্রিবাজারে কোন মোবাইল নেটওয়ার্কের প্রশ্নই ওঠেনা, তবে একেবারেই পাণ্ডববর্জিত বলতে একটু ভুল হবে। রেস্টহাউজের পেছনে একটা বিডিয়ার ক্যাম্প, সেখানে গিয়ে আমাদের উপস্থিতি জানান দিতে হল। এই দুর্গম স্থানে একদুদিনের জন্য আসাটা আমাদের জন্য অ্যাডভেঞ্চারের দারুণ মওকা হতে পারে, কিন্তু মাসের পর মাস সবকিছু থেকে সংশ্রবহীন অবস্থায় এখানে দায়িত্বব্রত পালনের তাগিদে পড়ে থাকা যে সহজ কম্মো নয়, সেটা ওই দশায় খানিকটা হলেও ঠাহর করতে পেরেছিলাম। তবে সুবিধা এই যে, যোগাযোগের জন্য হেলিকপ্টারের সাহায্য নেওয়া যায়, খানিক বাদেই দেখলাম আমাদের সামনেই একটা কপ্টার সশব্দে উড়ে গেল।


আগেই টের পেয়েছিলাম, এখানে রাতের খাওয়াটা বেশ আগেই সেরে ফেলতে হপবে। সে অনুযায়ী বাজারে বিলিব্যবস্থাও করে ফেলেছিলাম। খাবারের আইটেম বলতে কেবল সেদ্ধ আন্ডা, তার সাথে মসুরের ডাল, আর পাহাড়ী চালের লালচে ভাত। তবে স্থান-কাল-হাতযশ গুণে সেটাই আমরা গোগ্রাসে গিললাম, এবং বেশ তৃপ্তি করেই খেলাম। খেয়েদেয়ে হাতঘড়িতে দেখি মোটে রাত আটটা, অথচ ইলেকট্রিসিটিবিহীন রেস্টহাউজে আমাদের সামনে গোটা রাত পড়ে আছে। শুরু হল ম্যারাথন আড্ডা। এবারও স্থান-কালের একটা প্রভাব প্রচ্ছন্ন তো ছিলই, তা না হলে আদিরসাত্মুক রসরসিকতার ধার না ধেরে আড্ডাটাই বা খুব দ্রুত আধিভৌতিক গপ্পোর দিকে মোড় নেবেই বা কেন? সবাই নিজের থলি থেকে যতসব অদ্ভুতূড়ে কাহিনি ফেঁদে বসতে লাগল। বাইরে ঘুটঘুটে আঁধার, কেমন যেন একধরনের অপার্থিব নৈঃশব্দ, তারওপর গোটা রাতটাও কাটাতে হবে রেস্টহাউজের বারান্দায়,সব মিলিয়ে আমাদের কজনের গা যে একেবারেই ছমছম করেনি, বললে ভুল হবে। এমনকি দু একজন তো কুকুরের ডাক শুনেই সেটাকে কোন অভিশপ্ত প্রেতাত্মার আর্তনাদ বলে রায় দিয়ে ফেলল। যাই হোক, মেলাক্ষণ আড্ডা শেষে মুখে হাতে কষে মশকরোধী ওডোমস মেখে আমরা ঘুমুতে গেলাম।


পরদিন সকালে আমাদের এক বন্ধু শুধাল, দোস্ত, কাল রাতে বৃষ্টি পড়েছে নাকি? বন্ধুবর কোনদিন গঞ্জিকা সেবন করেছে বলে জানা নেই, তারপরও আমরা এক নিমিষে তাকে গাঁজাখোর বানিয়ে দিলাম। চারদিক শুকনো খটখট করছে, এর মধ্যে আবার বৃষ্টি আসবে কোত্থেকে? ওদিকে বন্ধু তো নাছোড়বান্দা, নাহ! কানের কাছে আমি বিষ্টি পড়ার আওয়াজ শুনেছিই, কোন ভুল নেই। আমরা পড়ে গেলাম ফাঁপড়ে। ঘটনা কী তবে? খানিক বাদেই ফাঁস হল গোমর। মাঝরাত্তিরে আরেক বন্ধুকে প্রকৃতি বেমক্কা ভীষণভাবে ডাক দেয়, কিন্তু ভূতের গল্প টল্প শুনে সে আর কিছুতেই নিচে নামার সাহস করতে পারেনা। শেষমেশ নচ্ছারটা ওই বারান্দা থেকেই আরেকজনের গায়ের ওপর দিয়ে কম্ম কাবার করে ফেলে। আর সেই শব্দকেই বন্ধুপ্রবর আধো ঘুমের ঘোরে বৃষ্টি বলে ঠাউরে নেয়। বুঝুন ব্যাপার!



পরের দিনটা এবারের সফরের সবচে গুরুত্বপূর্ন দিন, যাকে বলে গোল অফ দ্য জার্নি, সেই বহুল প্রতীক্ষিত বহুলশ্রুত নাফাখুম যাত্রা। খুব সকাল বেলা উঠে ভালমত পয়-পরিষ্কার হয়ে নিলাম। সামনে আট কিলোর মত হেঁটে পার হতে হবে, ফলে পেটে কিছু দানাপানি না পড়লেই নয়। এই কিম্ভুত স্থানে সকালে কি পাওয়া যাবে কে জানে? তবে ভাগ্যের কথা, চিড়ে কলা এখানে সুলভ, সেটা পেটে পুরলে আপাতত ভাবনার একটা সুরাহা করা যায়। চিড়ে কলা তো পেলামই, খেলামও আচ্ছাসে, তবে উপরি হিসেবে পেলাম বিনিভাত( এই জিনিসটা চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রচলিত একটা খাবার, চালকে খানিকটা ফার্মেন্টাইজ করে এটা তৈরি করা হয়, তাই এটা খেয়ে খানিকটা তন্দ্রার ভাব আসেই।) বিনিভাতের রান্নাও দেখলাম দারুণ সুস্বাদু, সবাই অবশ্য চেখে দেখার সাহস করলনা, তবে আমরা বেশ ভালই খেলাম। ওদিকে আমাদের সাথে ঢাকা ভার্সিটির আরেক গ্রুপও জুটে গেল। দুজন পাহাড়ী গাইডের বন্দোবস্তও করে ফেলা হয়েছে, তাদের দেখানো পথেই আমাদের নাফাখুম যেতে হবে। সামনের লম্বা পথের সবরকম রসদই মজুত। তাই ভোর থাকতে থাকতেই আমাদের ছাব্বিশ জনের বিশাল বহর রেমাক্রিবাজার থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সামনে নাফাখুমের হাতছানি।

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...