Wednesday, December 14, 2011

চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়-১ (র‍্যাগ কর্নার)

বুয়েট জীবনের শুরু থেকে তেরছাভাবে ওইদিকে তাকিয়ে থাকতাম, মেশানো ছিল খানিকটা সম্ভ্রম আর শ্রদ্ধা। ক্যাফেটেরিয়ার এক কোনায় ঐ সংকীর্ণ জায়গাটা আসলে কি, এমন সওয়ালও মনে হামেশা উদয় হত। একদিন জানলাম ওটার নাম র‍্যাগ কর্নার। ওখানে র‍্যাগ দেওয়া হয়না জানতাম, পরে জেনেছিলাম ওটা ছিল শেষ বর্ষের ছাত্রদের জন্যই এক্সক্লুসিভলি বরাদ্দকৃত। এরপর অনেকগুলো টার্ম পেরিয়ে গেল, ক্যাফেটেরিয়ার দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় আড়চোখে চেয়ে প্রায়ই ভাবতাম, আর বেশি দেরি নেই, এবার র‍্যাগ কর্নারে একটা আস্তানা গেঁড়ে ফেলবই।

দেখতে না দেখতেই(বলা ভাল কিছু বুঝে ওঠার আগে) ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র বনে গেলাম। এইবার আর আমাদের ঠেকায় কে? এতদিন সিনিয়রদের গানের তালে তালে হল্লামাস্তি করতে দেখেছি, এবার আমাদের মওকা। শুরুর দিন থেকেই মনে বেশ একটা উড়ো উড়ো ভাব, আমরা র‍্যাগ ব্যাচ, আমাদের জন্য র‍্যাগ কর্নার আদপেই ছিল একটা স্পেশাল প্রিভেলেজ। এবার শুরু হল র‍্যাগ কর্নারকে নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজানোর পালা। অনেক হ্যাপার পর, ক্যানভাসার রংমিস্ত্রিদের মুন্সীয়ানায় একসময় র‍্যাগ কর্নার বেশ একটা খোলতাই রূপ নিল। ক্যানভাস ০৬ এর বর্ণালীতে তখন সেটা উদ্ভাসিত। আমরাও কিঞ্চিত কালবিলম্ব না করে ঝটপট ছবি তুলে ফেলতে লাগলাম, বলা বাহুল্য অনেকটা আয়োজন করেই।

গোড়ার দিকে অবশ্য র‍্যাগ কর্নারে ছেলেপেলে খুব একটা ঢুঁ মারতনা, আমরা, ক্যাম্পাসের চেনা কিছু মুখগুলোই কুমীরের বাচ্চার মত করে নিজেদের হতশ্রী বদন নিয়ে বসে থাকতাম চাতক পাখির মত। কিন্তু ৪-১ এর বেশ কিছুদিন পরে যখন সাউন্ডবক্স চলে আসল তখন আমাদের যাকে বলে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত দশা। নিজেদের ইচ্ছেমত গান বাজিয়ে পুরো পলাশীস্থিত এলাকা মাত করে দিয়ে আমরা ক্ষরিক অর্থেই পৈশাচিক আনন্দ পেতাম। আমরা নাম্বার অফ দ্য বিস্টের সাথে সজোরে মাথা ঝাঁকাতাম, সুইট চাইল্ড ও মাইনের সাথে আনমনে গুনগুন করে উঠতাম, পাগলা হাওয়ার তোড়ে হেঁড়ে গলা ছেড়ে গান ধরতাম। এরপর র‍্যাগ কর্নার ধীরে ধীরে জমজমাট হওয়া শুরু করল। চায়ের কাপে, সিগ্রেটের ধোঁয়ার কুন্ডলীতে আমাদের দিনগুলো কেটে যেত বেশ। আগে ব্যস্ততা যাদের অবসর দিতনা তারাও এখন সুযোগ পেলেই একপলক দেখা করে যেতে ভুলতনা। ক্লাসের অবসরে আমরা দল বেঁধে জড়ো হতাম, ব্রেকের পরেও আড্ডার তোড়ে কখন আরেকটি ক্লাসের সময় এসে যেত টের পেতামনা। দেখা যেত, ম্যানইউ-আর্সেনালের তোপে, এল ক্লাসিকোর দাপটে, কখনোবা আশরাফুলের চোদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ক্লাসগুলোও ফাঁকি মেরে পালিয়ে যেত।

৪-২ থেকে অবশ্য র‍্যাগ কর্নারের আসল মহিমা আমরা মর্মে মর্মে টের পেতে শুরু করি। একদিন সাহস করে একটা দুষ্টু গানের সাথে উদ্দাম নৃত্যের পর একটু একটু করে আমাদের সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। এরপর আমরা যেমন রক অ্যান্ড রোলের তালে তালে গলা মেলাতাম, ঠিক তেমনি চটুল গানের সাথে রুপবানেরাও কোমর দুলিয়ে নাচতাম। র‍্যাগ কর্নার এবার আসলেই জমজমাট, যারা আগে কস্মিনকালেও ক্যাফের ছায়া মাড়ায়নি, তারাও একে একে আমাদের মত অপোগণ্ডদের দলে বিলকুল মিশে গেল। তড়িৎকৌশল, কম্পুকৌশলের দোস্তরাও এবার ফাঁক পেলেই সেই সাত সমউদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে পলাশীর প্রান্তর থেকে জড়ো হত এখানে। এমনিভাবে অনেক নতুন মুখের সাথে দেখা হল, অনেকের সাথে অন্তরঙ্গতাও হয়ে গেল ভীষণভাবে। সাথে সাথে সামনের একচিলতে খালি জায়গায় ব্যাট বল নিয়ে কসরত করা হত ফুরসত পেলেই। সাউন্ড সিস্টেমের প্রকম্পিত গানের সাথে খেলা, সাথে সাথে সব টিপ্পনী ফোঁড়ন কাটা তো চলতই।

র‍্যাগ কর্নারের পিক হাওয়ার যদি বলি, তাহলে সেটা বেলা একটাতেই। থিসিস, ক্লাসটেস্ট দিয়ে হেঁদিয়ে পড়া জনগণ তখন জুড়ে দিত নাচের মচ্ছব, আর কি বিচিত্র সেইসব নাচের মুদ্রা। শোভন-অশোভন সবরকম গানের সাথেই চলত সব নিত্য উদ্ভাবিত নাচের মুদ্রার জলসা।বেলা একটা দুইটা প[আর হয়ে যেত, কিন্তু নাচের আসর কমতনা। এমনকি ক্যাফের সামনেও নৃত্যপটিয়সী আমাদের প্রায়ই শরীর ঝাঁকাতে দেখা যেত। ওদিকে প্রতিদিনই চলত ফটোসেশন, একেকজনের ছবি তোলার আবদার মেটাতে মেটাতে ক্যামেরবাজরা প্রায়ই জেরবার হয়ে পড়ত। তবু যেন কারো আঁশ মেটেনা, ফেসবুক প্রোফাইলে দুদিন পর পর খোমা পরিবর্তনই এর উৎকৃষ্টতম সাক্ষী।

আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি, এই কদিনে র‍্যাগ কর্নারে ফূর্তির বহর আসলেই ছিল লাগামছাড়া। মিউসিক্যাল চেয়ারে রোল নাম্বার পাওয়া নিয়ে সবার অত্যুৎসাহ সেই ফূর্তিতে যোগ করল নতুন মাত্রা। কারো কারো দৈনিক রুটিন এখন আদতেই র‍্যাগ কর্নার টু হল, হল টু র‍্যাগ কর্নার, ক্লাসের কোন ছায়া না মাড়িয়েই। এই সময়টাতে এসে মনে হচ্ছে, আর কিছুদিন পরেই আমরা এই নিজভূমে হয়ে পড়ব আগন্তুক, আপন জায়গাটা হয়ে পড়বে অচেনা। দুত্তোর, এইসব মন খারাপ করা ছেদো কথা আর না লিখি, আরও তো কটা দিন আছেই। দেখা হবে র‍্যাগ কর্নারে সপ্তা পেরিয়েই, আমি আসছি, আপনি আসছেন তো?

Tuesday, August 23, 2011

অস্তিত্বের সংকট ও কয়েকটি আত্মজিজ্ঞাসা

ফ্রান্স আর ইতালির সীমানার খুব কাছে, আল্পস পর্বতের কোল ঘেঁষে ইউরিয়াজ নামের ছিমছাম একটি গ্রাম। পাইন, ফার ,এলমের ছায়াঘেরা এই প্রত্যন্ত জনপদে মধ্যরাতের সুনসান নীরবতা। ভালমত কান পাতলে পাণ্ডববর্জিত সেই প্রত্যন্ত জনপদের এক নিভৃত গৃহকোণে কলমের খসখস শব্দই শোনা যাবে কেবল। গৌরবর্ণের সেই মানুষটা লিখে চলেছে অবিরত, খানিক পর চশমাটা আলগোছে পাশে রেখে কী যেন ভেবে চলেছেন চুপচাপ। আবার তিনি মৌনীর মত সেই পিনপতন নীরবতার মাঝে কলম তুলে নেন, লিখে ফেলেন লাইনের পর লাইন। কী ভাবছেন এই সুদর্শন আগন্তুক, যার নিবাস ফ্রান্স থেকে যোজন যোজন দূরের এক দেশে?

ফ্রান্স থেকে সটান চলে যাব বাংলার এক অজ পাড়াগাঁয়েতখনো সেখানে শীতের কুয়াশা জেঁকে বসেনি, পাতলা সরের মত তার একটা পরত পড়েছে মাত্র। জ্যোৎস্নাশোভিত সেই রাতে একজন যুবক শিক্ষক দেখতে পায় একজন অর্ধ উলঙ্গ যুবতি নারীর নিস্পন্দ দেহ। সেই দেহ থেকে প্রাণপাখি অনেক আগেই উড়ে গেছে, একথা ঠাহর করতেও কষ্ট হয়না যুবকের। সেই আশ্চর্যউজ্জ্বল রাতে এই উটকো আবিষ্কার যুবকের ভেতরটা তোলপাড় করে দেয়, সে জড়িয়ে পড়ে এক অযাচিত দৈব দুর্বিপাকে।

এদিকে ফ্রান্সের সেই গাঁয়ে লেখকের কলম তখন তুফান গতিতে ছুটছে। তার মাথার ভেতরে তখন এক অতীন্দ্রিয় জগত, যেখানে একজন যুবক শিক্ষক অস্তিত্বের দ্বন্দ্বে খাবি খাচ্ছে, পড়ে গিয়েছে ভয়-দ্বিধা-সংশয়ের এক অতল গহবরে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নামের ওই ভিনদেশী লেখক বুঁদ হয়ে আছেন এক জাদুবাস্তবতার জগতে, লিখে চলেছেন তার এক কালজয়ী কীর্তি, চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসখানি।

চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসের প্রেক্ষাপট আদপে একেবারেই অনুল্লেখযোগ্য, দুলাইনেই এর সারগর্ভকে এক খোঁচায় লিখে ফেলা যায়। কিন্তু এই আপাত নিস্তরঙ্গ, নিথর উপন্যাস হাতে না নিলে বোঝা দায়, কি এক অদ্ভুত প্রহেলিকা প্রোথিত আছে এই উপন্যাসের ভেতর। উপন্যাসের শুরুটা আগেই জানান দেওয়া হয়েছে। যুবক গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের আশ্রিত শিক্ষক, এক শীতের রাতে কোন এক বিচিত্র খেয়ালে সেই পরিবারের একজন সদস্য কাদেরের পিছু নেয়। কাদের একজন স্বল্পবাক ব্যক্তি, নিজেকে রহস্যের মোড়কে আবৃত করে রাখতেই পছন্দ করেন। অন্তুর্মুখী কাদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন, এমন কথা অনেকে বলতে কসুর করেননা। কিন্তু তার অলৌকিক ক্ষমতা থাক আর নাই থাক, নিজেকে ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন করে রাখার কারণে আকে নিয়ে অনেকের মাঝেই শ্রদ্ধামিশ্রিত সমীহভাব কাজ করে। এই অতিসাধারণ অর্বাচীন যুবক শিক্ষক আরেফ আলীও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই এই সমীহজাগানিয়া কৌতূহল নিবৃত্ত করতে না পেরেই সেই রাতে কাদেরের পিছু নেয় শিক্ষক। কিন্তু ঘটনাচক্রে সে বাঁশঝাড়ে আবিষ্কার করে বসে এক গ্রাম্য রমণীর মৃতদেহ। এবং এই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার শেষে সে কাদেরের সাথে মুখোমুখি হয়ে পড়ে। ঐ নির্জন স্থানে একটি শবদেহের আবিষ্কার, এবং এরপর হঠাৎ রহস্যময় কাদেরের আকস্মিক উদয় যুবককে ফেলে দেয় এক দুর্বোধ্য জটাজালে।

অবাক হতে পারেন, উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ বলতে গেলে এটুকুই। কিন্তু এই অঘটনের পর যুবক শিক্ষকের টানাপোড়েন আর দ্বন্দ্বই মূলত উপন্যাসের উপজীব্য। দরবেশসুলভ ভাবমূর্তির জন্য কাদেরকে ওই মৃত্যুর জন্য দায়ী করতে না পারা যুবক শিক্ষকের মানসিক অসহায়ত্বকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আবার মুদ্রার উলটো পিঠে কাদেরের সাথে সেই নারীর কোন সংযোগ স্থাপনে অক্ষমতা তাকে নিদারুণ পীড়া দিতে থাকে। লৌকিক, প্রচলিত ধারণার বাইরে কোন অসংস্কৃত, অগ্রহণযোগ্য সমাধানের দিকে পৌঁছানোর দীনতা তাকে কুরে কুরে খায়। বরং নিজের দুর্বলতার জন্য তার মাঝে এমন ভাব্নাও আসে, কাদের কি তাকেই হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেছিল? এ ধরনের পরস্পরবিরোধী এক ইন্দ্রজালে ধীরে ধীরে লেখক পাঠককে জড়িয়ে ফেলেন, ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের চিরন্তন সংজ্ঞার ব্যবচ্ছেদে প্রলুব্ধ করেন।

বলতে দ্বিধা নেই, এক লহমায় গোগ্রাসে গেলার মত বই এটি নয়। যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি লেখক পাঠককে করতে চেয়েছেন, সেসব সওয়ালের জবাব দিতে হলেও ভাবনার ঘূর্ণাবর্তে পড়ে যেতে হবে নিশ্চিত। অস্তিত্বের এই নানামুখী সংঘাতে যুবক শিক্ষক নাচার হয়ে পড়েন, কিন্তু শেষমেশ প্রকৃত ঘটনার নগ্ন রুপ উন্মোচিত হয়, এবং সেই দুরুহ সত্য তাকে তিলে তিলে গ্রাস করে। এবং অবধারিতভাবে এই সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখতে না পারার মাশুল তাকে দিতে হয়, পাকেচক্রে তার ঘাড়ে বর্তায় হত্যাকাণ্ডের দায়ভার। এসবই মোটামুটি অনুমেয় পরিণতি, কিন্তু যেটা অননুমেয়,তা হল এই সত্য আবিষ্কারের পথের নানান ঘাত প্রতিঘাত। কীভাবে একজন আপাতভীরু শিক্ষক অবস্থার ফেরে দুর্দান্ত সাহসী হয়ে ওঠে, সেটারই এক উত্থানপতনবহুল দ্বন্দ্বমুখর বয়ান এই বইটি।

ওয়ালীউল্লাহর এই উপন্যাস বিভিন্ন দিক দিয়েই অভিনব, উল্লেখ করার মত হাতেগোনা কটি চরিত্র, কিন্তু সেগুলোকেই তিনি ছাঁচে ঢেলেছেন নিপুণ হাতে। পাঠকের মর্মমূলে গিয়ে তিনি আঘাত করেছেন বারংবার, তাকে দাঁড় করিয়েছেন সাক্ষীর কাঠগড়ায়। অস্তিত্ববাদী উপন্যাসের সংজ্ঞা না জেনেও তাই সচেতন পাঠকের কাছে চরিত্রগুলোর অস্তিত্বের সংকট ধামাচাপা থাকেনা, পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত ধীরে ধীরে বিমূর্ত হয়ে উঠতে থাকে।

রেখাচিত্রঃ একটি অনন্য ভূয়োদর্শন


রেখাচিত্র লেখকের ভাষায় আত্মজীবনী নয়- বরং স্মৃতিকথা মাত্র। বলাই বাহুল্য, বিশিষ্ট সাহিত্যিক আবুল ফজলের এ রচনা তার অন্যতম সাহিত্যকীর্তি। তাই স্মৃতিকথার গণ্ডি পেরিয়ে এ গ্রন্থখানি তে আত্মজীবনীর সব রকম রসদই এন্তার মজুদ আছে, তার সাথে অভিনিবেশকারী পাঠক একমত হবেন বলেই ধারণা। বইটিকে গত শতকের গোড়ার দিক থেকে শুরু করে ষাটের দশকের আগ পর্যন্ত একটা অত্যন্ত ঘটনাবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ের প্রামাণ্য দলিল বললে মোটেই অত্যুক্তি হবেনা। লেখক জন্মেছিলেন ১৯০৩ সালে, তখনো পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ মানসিক গড়নটি অতটা খোলতাই হয়নি। ইংরেজ শাসনের অধীনে তখনো মুসলমানেরা সামাজিকভাবে বেশ খানিকটা পিছিয়েই ছিল। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে যাদের প্রচেষ্টা প্রাতঃস্মরণীয়, তাদের মাঝে আবুল ফজলের নাম নির্দ্বিধায় স্মরণ করা যায়। তবে এই প্রক্রিয়া যে মোটেই সহজ ছিলনা, বরং ছিল নানা অযাচিত প্রতিবন্ধকতার ছোবল, তা আমরা রেখাচিত্র পড়েই জানতে পারি। একটি আগাগোড়া ধর্মভীড়ু মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও আবুল ফজল কীভাবে সাহিত্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন তাও আমরা এই গ্রন্থের মাধ্যমেই জানতে পারি।

পুরনো ঢাকার হকিকত সম্বন্ধে আমরা অনেকেই জানি, ঢাকার নবাবদের শানশওকতের কথা আজ কিংবদন্তীই বটে। অথচ চট্টগ্রামের আলোছায়ায় বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও সেকালের চাঁটগার কোন হদিস আমি এই বইটি পড়ার আগে জানতামনা। লেখকের জন্ম সাতকানিয়ার প্রত্যন্ত জনপদে হলেও পিতার কর্মসূত্রে শিক্ষাদীক্ষার পাট তিনি শহরেই নেন।তবে পিতার কর্মসূত্রের ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা এখানে করতেই হবে। লেখকের পিতা ছিলেন চট্টগ্রামের ইতিহাসপ্রসিদ্ধ জুমা মসজিদের ইমাম, দীর্ঘ বত্রিশ বছর তিনি এ গুরুদায়িত্ব পালন করেন। পিতার শ্যেন দৃষ্টিতে থাকার পরও কীভাবে লেখকের ভেতরে প্রগতিশীলতার বীজ বপন হয় সেটাও খানিকটা অভাবনীয়ই বটে।আগেই বলেছি, লেখকের শিক্ষার হাতেখড়ি হয় চাটগাঁতেই। এ সুবাদে সেই সময়ের চট্টলার একটা অবয়ব তার লেখাতে ধরা পড়ে।চট্টলার ঐতিহ্যবাহী কাজী বাড়িতে বালক বয়সেই তিনি জায়গীর নেন। এবং পাকেচক্রে এই কাজীবাড়ির সাথেই তিনি এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে যান। পরবর্তীতে ওই এলাকাতেই পাকাপোক্তভাবে আস্তানা গাঁড়ার মাধ্যমে এ সম্পর্ক আরও জোরদার হয়।

এইখানে কয়েকটা লক্ষণীয় বিষয়ের কথা না বললেই না। কাজীবাড়িতে জায়গীরের ঘটনা লেখকের ভাষায় পিতার কঠোর শাসন থেকে মুক্তির একটি মোক্ষম উপলক্ষ। তখনও মাদ্রাসা শিক্ষাকেই তিনি আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন, তবে এই ধর্মনির্ভর শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধা না হোক বৈরাগ্যের আঁচ কিন্তু তার লেখাতে ধরা পড়ে। জুমা মসজিদের প্রধান ইমামের পুত্র, তাই পিতার ভাবমূর্তির কারণে তাকেও মসজিদে আযান দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক কাজে প্রায়ই জড়িয়ে যেতে হত। ব্যাপারটা তার জন্য খুব স্বস্তিদায়ক ছিলনা, একথা না বললেও চলে। তার নিজের ভাষায়,ইমামের ছেলে ইমামতি করবে এত নেহাত যুক্তিসঙ্গত। আমার সম্বন্ধেও এ মন্তব্য মাঝে মাঝে না শুনেছি তা নয়। তবে দুনিয়ায় যুক্তিসঙ্গত ঘটনা কটাই বা ঘটে? বিশেষ করে উত্তরাধিকারের ব্যাপারে? বংশগতি ও মানব চরিত্র এত দুর্জ্ঞেয় ও রহস্যময় যে যুক্তি তাতে কদাচিৎ হালে পানি পায়। মূলত পিতার পদাঙ্ক যে তিনি অনুসরণ করবেননা, একথা ছেলেবেলাতেই আবুল ফজল ঠাহর করতে পেরেছিলেন।একথা অস্বীকার করার জো নেই, চাটগাঁতে থাকার ফলেই লেখকের মাঝে এই ধর্মীয় ঘেরাটোপ থেকে মুক্তির স্পৃহা ধীরে ধীরে জোরদার হয়ে উঠতে থাকে। তবে পিতার প্রভাব থেকে সটকে পড়ার ফিকির করলেও পিতার ভাবমূর্তির দুরন্ত আকর্ষণকে তিনি বোধকরি উপেক্ষা করতে পারেননি। সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠাকে ব্রত হিসেবে নেওয়া পিতার পরিচয়ে তাই তিনি আদপে কুন্ঠিত হননি, বরং প্রচ্ছন্নভাবে শ্লাঘাসুলভ মনোভাবের কথাও জানান দিয়েছেন।

তখন মুসলিম নবজাগরণের জোয়ার বইছে, চাটগাঁতে বসেও সেই দিগন্তপ্লাবী অনলশিখার হল্কা তার গায়ে লাগল। নজরুলের সাহিত্যকর্ম লেখকের মনোজগতে এক বিপুল নাড়া দিল, তিনি যেন এক জীয়নকাঠির পরশ পেলেন। তার নিজের মুখে, এসবকে যদি মনের দিক থেকে, আবেগ অনুভূতির দিক থেকে কিছুটা প্রস্তুতি বলা যায় তাহলে ঢাকায় ছাত্রজীবন শুরু হওয়ার আগে সাহিত্যের পথে আমার এ প্রস্তুতিটুকুন মাত্র ঘটেছিল।এর মাঝেই নানান ঘটন-অঘটনের মাঝে লেখক ম্যাট্রিক পাশ করে ফেলেন।এবার হল যাকে বলে নির্ভেজাল ত্রিশঙ্কু দশা, লেখকের বরাবর বাসনা ছিল ঢাকায় গিয়ে আই.এ পড়ার। কিন্তু পিতা তার আকাঙ্ক্ষায় আক্ষরিক অর্থেই জল ঢেলে দিলেন। মাদ্রাসা পড়ে উলা পাশ করতে হবে, তিনি সাফ সাফ বলে দিলেন। এবার অবশ্য শুভাকাংখীদের হস্তক্ষেপে লেখক আই.এ পড়ার অনুমতি পেয়ে যান। মূলত এই ঢাকাযাত্রার মাধ্যমেই আবুল ফজলের ভবিষ্যত পথচলার মোড়টি বিলকুল ঘুরে যায়। সাতকানিয়ার প্রত্যন্ত জনপদের চৌহদ্দি পেরিয়ে পয়লা চট্টগ্রাম শহর, এবং পরে ঢাকায় পাড়ি জমানো তার নিয়তি মোক্ষমভাবে নির্ধারণ করে দেয়।

তবে বইয়ের যে অধ্যায়ের নাম আলাদা করে বলতেই হবে, সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে লেখকের অভিজ্ঞতার কথা। তখনো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড কেবল উঠন্তি মূলো, ছাত্রসংখ্যাও খুব একটা বেশি নয়। এর মাঝেই সেই সুদূর চাটগাঁ থেকে লেখক ঢাকা শহরে পাড়ি জমান। এখানে তার বর্ণনায় উঠে আসে সেকালের ডাকসাইটে সব শিক্ষকদের কথা। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় সহ নামজাদা সব মানুষদের সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন সেই সময়। এর মাঝে ঢাকায় কবিগুরুর আবির্ভাব,মুসলিম হলে তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে মোলাকাত ঘটে যায় লেখকের। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা মুসলিল্ম সাহিত্য পরিষদের, যার মাধ্যোমে আরো অনেক গুণীজনের কথা উঠে আসে। এদিকে সমানতালে সাহিত্য নিয়ে লেখকের অক্লান্ত ভাবনার কথাও আমরা জানতে পারি। বন্ধুপ্রতিম কবি আবদুল কাদিরসহ আরো কজন উৎসাহী তরুণের চেষ্টায় এবং কয়েকজন প্রগতিশীল সাহিত্যমনস্ক ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় তখনো হামাগুড়ি দিতে থাকা মুসলিম সাহিত্যের একটা কাঠামো ধীরে ধীরে পরিস্ফুট হতে থাকে। বিভিন্ন পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে, যার মাঝে সওগাতের নাম করাই যায়। পরবর্তীতে লেখকের সম্পাদনায় শিখা পত্রিকা প্রকাশিত হয় ।

এর মাঝে লেখক তার সহজিয়া ঢঙ্গে নিজের বিচিত্র কাহিনির কথা বলে যান, আর আমরা বুঁদ হয়ে থাকি সেইসব আশ্চর্য অভিজ্ঞতার মায়াজালে। কলকাতায় গিয়ে ওকালতি পড়ার ব্যর্থ চেষ্টা এবং পরে শিক্ষকতাকে ধ্যানজ্ঞ্যান করেছিলেন আবুল ফজল। বইটি পড়ার সবচেয়ে মজার দিক হল, পড়তে গিয়ে কোথাও বেগ পেতে হয়না, স্মৃতিকথার বিচারে তার ভাষা যেমন স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল তেমনি সাহিত্যগুণসম্পন্নও বটে। লেখায় তিনি সবখানেই সময়ের ক্রম অনুসরণ করেননি, মাঝে মাঝে তিনি ক্ষণিকের জন্য ডুব দিয়েছেন সুদূর ভবিষ্যতে, বয়ান করেছেন অন্য কোন গল্প। তাই বলে এতে বইয়ের রস আস্বাদনে মোটেও বেগ পেতে হয়না, টাল খেতে হয়না একরত্তি। যে ভূয়োদর্শনের নজির তিনি রেখেছেন, সেটা আজকের যুগের জন্য একটি দুর্দান্ত স্মারকগ্রন্থও বটে। অনেক অভিনব ঘটনার বর্ণনাই এই বইতে আছে, নাম করলে সেসবের সংখ্যা ফুরোবেনা। সব মিলিয়ে লেখকের লেখার দ্যুতিতে, প্রজ্ঞার মাহাত্ম্যে বইটি হয়ে ওঠেছে একটি সময়ের, একটি যুগের প্রতিনিধিত্বকারী, হয়ে ওঠেছে ইতিহাসের এক অসামান্য দলিল,যেন একদম পলকাটা হীরে।

Wednesday, June 8, 2011

আজি হইতে দুটি বৎসর আগে

৯ ই জুন,২০০৭ঃ

সেদিন বেশ টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। ঘুমটা ভেঙ্গেছিল বেশ আগেই,না না ভুল হলো,ঘুম তো আসলে হয়ইনি।হবে কি করে,পরদিন যে আমি জীবনের চলার পথে আরেকটি মাইলফলক পাড়ি দিতে যাচ্ছি।সারারাত আনন্দ-শিহরণ-কৌতুহলের এক অদ্ভূত মিশেলে কখন যে পার হয়ে গেল,টেরই পেলামনা।যাকগে,চটপট নাস্তা সেরে নেওয়ার পরও ঘড়ি জানান দিল,ক্লাস শুরু হয়ার আরো মেলা দেরি।কিন্তু তর যেন কিছুতেই সইছিলনা।বাইরে তখন বর্ষা আরেকটু সজোরে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল।ভয় হল,এই বুঝি শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি।আর কালক্ষেপন করলামনা।বর্ষাতি সম্বল করে বেরিয়ে পড়লাম লক্ষ্যপানে।কেন জানিনা,রাস্তার ধারের ধূসর প্রকৃতিকেও মনে হচ্ছিল আশ্চর্য সুন্দর।এরই মধ্যে বুয়েট ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছুলাম।এক পরিচিত বলল(তখনকার পরিচিত এখন আমার জিগরি দোস্ত),ক্লাস নাকি ওএবিতে হবে।ওএবিতে প্রবেশ করে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম,এ যে গোলকধাঁধা বই আর কিছু নয়।পথভ্রষ্ট নাবিকের মত বেশ খানিকখন এদিক ওদিক ঢুঁ মেরে অবশেষে ধরা দিল সেই প্রহেলিকাময় ওএবি ২২২ নাম্বার রুম।একসময় স্যার আসলেন,চোখে মুখে এক অদ্ভূত মুগ্ধতা নিয়ে স্যারদের আপ্তবাণী তন্ময় হয়ে গিললাম।এরই মাঝে ক্লাসের সময়ও শেষ হয়ে এল।বাইরে তখন অঝোর বর্ষনের পর আকাশ যেন খানিকটা হাঁপ নিচ্ছে।ফুরসৎ পেয়ে বেরিয়ে এলাম ক্যাম্পাসে।ঘোরলাগা দৃষ্টিতে বুয়েট তখন আমার কাছে এক অপার বিস্ময়।

৯ই জুন,২০০৯ঃ

সেই ঘোরলাগা দৃষ্টির পর্দা একসময় ধীরে ধীরে কেটে গেছে।চোখের নীচে ধীরে ধীরে কালি জমেছে,একসময়ের সেই ইন্দ্রজাল এখন মরীচিকা মাত্র।তারপর একদিন ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম,দেখতে দেখতে দুই দুইটি বছর যেন মিলিয়ে গেল।মনে হচ্ছিল,এইতো সেদিন এই ক্যাম্পাসে এসেছিলাম।তবে এখন আর স্যারদের সেই মুখনিঃসৃত বাণী বেদবাক্য মনে হয়না,সেই রোমান্টিসিজম আর নেই,বরং পরীক্ষায় পাশ করার অতি বাস্তববাদী ইচ্ছা থেকে তাদের মহাবাক্যগুলো ক্লাসে বসে গলাধকরণ করতে হয়।ক্লাস টেস্ট ,সেশনাল আর অ্যাসাইন্মেন্টের খপ্পড়ে পড়ে এখন আর কোন কষ্টকেই কষ্ট মনে হয়না,নির্লিপ্ততা আজ আমার আটপৌরে সংগী।মাঝে মাঝে আসলেই জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা ধরে যায়।

পাদটীকাঃ

তারপরও ক্যাফেটেরিয়ায় ঘন্টার পর ঘন্টার আড্ডা,ধূমায়িত চায়ের সাথে রাজা-উজির মারা,অঝোর বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ফুটবল খেলা,ক্লাসের অবসরে ম্যুভির জগতে ডুবে যাওয়া আমাদের নির্বিকারত্বকে ভুলিয়ে দেয়।তাই এই মধ্যরাতে কিবোর্ডে টাইপ করতে করতে ভাবি,আর মাত্রই তো দুটি বছর,এরপর কি ফেলে আসা দিনগুলোরত জন্য মনের আকাশে একটুও কি কালো মেঘ জমবেনা?

Sunday, May 15, 2011

কাছ থেকে দেখা যন্ত্রকৌশল উৎসব

ক্লাস টেস্ট, সেশনাল, অ্যাসাইনমেন্টের চাপে যখন আমাদের খাবি খাওয়ার দশা, ঠিক তখন বাতাসে উড়ো খবর, এই টার্মে নাকি মেকানিক্যাল ডে হবে। যাহা রটে তাহা কিছুটা হলেও ঘটে, আর রটনাকে সত্যি প্রমাণ করে আসলেই ডে আয়োজনের জন্য তোড়জোর শুরু হয়ে গেল। আমরা এখন ৪-১ এর অকালতত্ত্বজ্ঞানী মানব, বুয়েটের সাথে গাঁটছড়া ভেঙ্গে যাওয়ার আর খুব বেশি দেরি নেই। তাই, নিতান্তই জোলো, ম্যাদামারা এই টার্মে ডে হওয়ার খবর শুনে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম, নাহ! টার্মটা একেবারে নিস্ফলা যাবে না।

মেকানিক্যাল ফেস্টিভ্যাল কাগজে কলমে দুদিনের অনুষ্ঠান হলেও মূল ব্যপ্তি একদিনেরই, সেই একদিনেই দিনমান লেগে থাকে নানা আয়োজনের ধুম। সেই সাতসকাল(আমাদের মত নিশাচরদের জন্য সকাল ৮টা সাতসকালই বটে) থেকে কারো একবিন্দু দম ফেলার ফুরসত থাকেনা। তবে সারা দিনের এইসব অনুষ্ঠানের নেপথ্যে আগের কদিনের বিনিদ্র রজনী ও হাড়ভাঙ্গা খাটুনির খবর কজনই বা রাখে? যেমন যন্ত্রকৌশল বিভাগের অফিসিয়াল মুখপত্র অযান্ত্রিকের কথাই ধরি না কেন?(সম্পাদকমণ্ডলীর একজন হিসেবে এই মওকায় আগে এটার কাসুন্দি ফেঁদে বসলাম আর কি , হে হে) । ঠিক হয়েছিল, উৎসবের প্রথম প্রহরেই স্যারদের হাতে অযান্ত্রিকের ঝকঝকে তকতকে নতুন কপি শোভা পাবে। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই চাট্টিখানি কথা নয়, যদি ম্যাগাজিন বের হওয়ার প্রলম্বিত প্রক্রিয়ার কথা খেয়াল থাকে। লেখার জন্য ক্লাসে ক্লাসে নোটিস, সেই নোটিসের পর আবার ঘন ঘন তাগাদা, ডেডলাইন পেরিয়ে যাওয়ার পরও লেখা আসা, সেই লেখাগুলো আবার নীলখেতে ভ্যাপসা গরমে নাকাল হয়ে কম্পোজ করিয়ে আনা, সেগুলোর একদফা প্রুফ দেখা, লেখা যাচাই-বাছাই করা (এসময়টা আমাদের জন্য রীতিমত সংকটজনকই বলা চলে), সেই লেখা নিয়ে প্রেসে যাওয়া, এদিকে অ্যাডের জন্য আরেক দফা ছোটাছুটি, শেষ মুহুর্তে আরো কিছু অ্যাড যোগ হওয়া...উফ হাঁপিয়ে গেলাম। এরপরের দুইদিন প্রেসে বসে পুরো ম্যাগাজইনের লে-আউট দেখা, বারবার প্রুফ চেক করা এবং শেষ মুহুর্তেও স্থানাভাবে আরেক দফা লেখা কাঁটছাটের মত দুষ্কর কাজের কথা ভুলি কি করে? সবকিছুর পরে যখন সম্পাদকবাহিনীর (আশফাক, শাফি, জুয়েল, এবং এই অধম) যখন শেষমেশ হাতে ম্যাগাজিনের সদ্য ছাপা হওয়া কড়কড়ে অযান্ত্রিকের কপি এসে পৌঁছাল, সেই মুহুর্তের কথা আসলেই ভোলা যায়না, এক কথায় বললে অবিশেষণসম্ভব!

ডে এর বাকি আর মাত্র দেড় হপ্তা, শুরু হল এই উপলক্ষে নির্মিত ছবি নির্মাণের আরেক এলাহী কারবার। চিত্রনাট্য, শুটিং ইত্যাদি নিয়ে হ্যাপার পরিমাণ কতটা বেশি হতে পারে, তা নিজ চোখে দেখেই বুঝেছিলাম। একেকটা শটই রীতিমত বিশাল ব্যাপার। তবে পরিচালনায় আমাদের ্নাসির হককে নবীন বা নবিস যাই বলুন না কেন, অভিনয় কিন্তু সবাই ষোলআনা জানে, সেটা শুটিং দেখার সময় বুঝেছিলাম। ইচ্ছে ছিল, তারিয়ে তারিয়ে পুরো ব্যাপারটা চেখে দেখব, শত হলেও এমন মওকা আর বারবার আসেনা, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সে ফুরসত মিলল কই? তবে মনে মনে ছবিটার একটা ছাঁচ ঠিকই কল্পনা করে নিয়েছিলাম, এখন এক হপ্তা পর সেই কল্পনা মেলাবার পালা কেবল।

এবার চলুন ঘুরে আসি একটু খেলার মাঠ থেকে। আপাতদৃষ্টিতে উৎসবের সাথে প্রত্যক্ষ সংশ্রব না থাকলেও এই ডে উপলক্ষে আয়োজিত ইণ্টারব্যাচ টুর্নামেন্ট চৌধুরী জাফরুল্লাহ শারাফাতের ভাষায় বলতে গেলে,"অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানজনক একটি খেতাব"। আর এই ব্যাপারে কোন হল্লামাস্তি হবেনা, তা কী করে হয়? তাই, দীর্ঘদিনের জং ধরা শরীরকে বশে আনতে আমরা মাঠে ছুটে চললাম। আমরা, মানে ০৬ ব্যাচ ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন এবং এই মুহুর্তে সিনিয়র ব্যাচ। তাই, প্রত্যাশার পারদটাও আমাদের কাছে অনেক বেশি চড়া। তবে দুদিন গা গরমের পর আমরা মুখোমুখি হলাম ০৯ ব্যাচের। এ ম্যাচটা অবশ্য আমরা হেসেখেলে জিতে গেলাম, আমাদের সারপ্রাইজ প্যাকেজ সাফায়েতের দুর্দান্ত দুই গোলে আমরা চলে গেলাম ফাইনালে। ওদিকে উঠল ০৭ ব্যাচ, ঠিক গতবারের ফাইনালের পুনরাবৃত্তি। ফাইনালের দিন পুরো মাঠ সরগরম, এদিন যে মেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টের এক ক্লাসিকো! অত্যন্ত শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে খেলা শুরু হল। বরাতটাও এবারও আমাদের পক্ষে ছিল, দ্বিতীয়ার্ধে অসাধারণ এক গোল করে সৌরভ জয় ছিনিয়ে আনল। এই বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখিয়ে আরেকবার আমরা জিতে নিলাম শিরোপা। এবারো কাপ গেল মেকা সকারুজের হাতে।

খেলার মাঠ থেকে চলুন এবার একটু ঢুঁ মেরে আসি ইএমই ভবনে। ঘড়িতে এখন বাজে সন্ধ্যা ছটা। ক্লাস-সেশনালের পাট চুকেছে মেলা আগে, কিন্তু ক্লাসরুমে হইচইয়ের খামতি নেই। এখানে যে ডে উপলক্ষে আয়োজিতব্য সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা স্পন্দনের প্রস্তুতি চলছে। আমাদের এই সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাকে নিয়ে কিন্তু সবার প্রত্যাশাটা একটু বেশিই থাকে, অনেক দিন ধরেই এটাই বুয়েটের অলিখিত রেওয়াজ। তাই, সেই সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে, এরকম একটা তাগিদ এবারও ছিল। এদিকে সমানে চলছে স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ, আর ওদিকে চলছে রিহার্স্যাল। গান, নাচ, বাংলা সিনেমা, নাটিকা, কমেডি শো সবকিছুর প্রস্তুতি চলছে বিপুল বিক্রমে, আজ বাদে কাল ডে, আর কোন ফুরসত নেই।

এদিকে ফুরিয়ে আসছে সময়, এগিয়ে আসছে মাহেন্দ্রক্ষণ, প্রেসে সমান তালে চলছে অযান্ত্রিকের ছাপা, ক্লাসে চলছে তুমুল বেগে রিহার্স্যাল, আর খাওয়া, টি শার্ট, গেম শো, ক্যাড কন্টেস্ট, ফোটোগ্রাফিক এক্সিবিশনসহ অন্যান্য সব অনুষ্ঠানের কথা আর নাই বা বললাম। হাতে আছে আর মাত্র একদিন, এখনো স্টেজ সাজানো হয়নি। আগের রাতে তাই তাই সমানে চলে নেপথ্য কুশীলবদের হাত, কারো একদন্ড জিরিয়ে দেওয়ার অবসর নেই। এদিকে তখনও ম্যুভির শেষমুহুর্তের কাজ চলছে, কাল বিকেলেই যে সবাই জড়ো হবে দেখতে।

দেখতে দেখতে রাত ফুরিয়ে এল, দিনটাও এসেই গেল। তবে সকালের জব সেমিনার আর গেমশোর ডামাডোলে স্পন্দনের প্রস্তুতি কিন্তু থেমে থাকেনি। গেমশোর কথা একটু বলেই ফেলি, তিহানের সুরসিক উপস্থাপনায় স্যাররাও এমনকি বারবার হেসে লুটিয়ে পড়ছিলেন। আর এই মওকায় আবার নিজের ঢোল পিটিয়ে যাই, সম্পূর্ণ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অগণতান্ত্রিক পরিবেশে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আমি হাটে থুড়ি মাঠে হাড়ি ভেঙ্গেই ফেলি। সকালবেলার এইসব আয়োজনের পর বিকেল গড়িয়ে এল, এবার সময় ্নাসির হক পরিচালিত ম্যুভি "ক্যাম্পাস" দেখার। চোখ ধাঁধানো পোস্টারিং আগেই সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছিল, তাই শো শুরুর আগেই অডিটোরিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ। শুরু হয়ে গেল ম্যুভি। এরপরের আধ ঘন্টার চেয়ে কিছু বেশি সময় কেটে গেল মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। এসব তো আমাদেরই কথা, কিন্তু দেখলাম একেবারেই অন্য চোখ দিয়ে। শো শেষে দর্শকের হাততালিতে টেকা দায়, ক্যাম্পাস আক্ষরিক অর্থেই কাঁপিয়ে(কাউকে কাউকে হয়তো কাঁদিয়েও) দিয়ে গেল সবাইকে।

এদিকে বেজে গেছে সন্ধ্যা সাতটা, আর খানিকক্ষণ পরেই পর্দা উঠবে স্পন্দন ২০১১ এর। ম্যুভির পর দর্শকদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী, সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে। খানিকটা বিলম্বের পর শুরু হয়ে প্রোগ্রাম, মিফতুর গান

দিয়ে। উঠন্তি মুলো পত্তনেই চেনা যায়, তাই এরপর আলীবাবা চল্লিশ ল্যাগের পর যখন হাততালিতে অডিটোরিয়াম ফেটে পড়ল, তখনই বোঝা গেল, আজকের দিনটা আমাদেরই। বাকি অংশ কেবলই ইতিহাস, এরপর এতটুকুর জন্য ছন্দপতন হয়নি কোথাও। কল্লোল, সেতু, অনিন্দ্য, তৃণা, আমাদের প্রিয় এহসান স্যারের গান সবাই তন্ময় হয়ে শুনল। এই সুযোগে বলে রাখি, সংগীতায়োজন ছিল লাজওয়াব, এজন্য এর সাথে জড়িত গাইয়ে বাজিয়েদের আরেক দফা ধন্যবাদ। ওদিকে নাটকও কম যায়না। পাবলিক টয়লেট, যাত্রা কোথাও এতটুকু টাল খায়নি, তরতরিয়ে চলেছে। এদিকে নাচ, বাংলা সিনেমা, গুপি বাঘাও উতরে গেছে। তবে আলাদাভাবে বলব দুটি আইটেমের কথা। স্ট্যান্ড আপ কমেডিতে ছোটন ছিল আক্ষরিক অর্থেই বিস্ময়বালক , দর্শক কেবল হাত তালি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, দাঁড়িয়েই গিয়েছিল। ব্যাপারটা আরো বেশি দুর্দান্ত হয় যখন শুনি এই আধুনিক হোজ্জা সাহেব কেবল ১০ ব্যাচের। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, পুরো প্রোগ্রাম যখন চলছিল, তখনো চলছে টক শর স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ। ওদিকে টকশোর নেপথ্য কুশীলবেরা তখনো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শেষমেশ একবার মাত্র দায়সারা রিহার্স্যাল দিয়েই নেমে পড়ল তারা। আর যা হওয়ার তাই হল, ইম্প্রোভাইজেশনের অনন্য নমুনা দেখিয়ে ইফতি, নাহিয়ান, জিমি যথারীতি হিট।

নাহ! অনেক হল, এবার ক্ষান্ত দেওয়া দরকার। এই লেখাটা যখন লিখছি, চোখের সামনে তখনো ভাসছে গতকালের দিন, প্রতিটি মুহুর্ত এখনো মাথায় গেঁথে রয়েছে। সিনিয়র ব্যাচ হিসেবে এটাই আমাদের শেষ ডে, তাই অনুভূতিটা ছিল একটু আলাদা। শেষে সবাই যখন উচ্চস্বরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গাইছিলাম, একদিন ঘুমভাঙ্গা শহরে...তখন হলফ করে বলতে পারি, কারো কারো বুক অব্যক্ত ব্যথায় চিনচিন না করে পারেনি, কারো কারো কন্ঠও হয়তো বাষ্পরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এই কথাগুলো টাইপ করতে হাত কেঁপে যাচ্ছে, তারপরও করছি, আমরা হাসব না...আমরা ভাসব না...শুধুই মিস করব...মিস করব......

Thursday, April 28, 2011

বিহবল গল্পের পর...

শাহাদুজ্জামানের সাথে পয়লা মোলাকাত হয়েছিল কয়েকটি বিহবল গল্প বইটিতে। আক্ষরিক অর্থেই গল্পগুলো পড়ে বিহবল হয়েছিলাম, বাঁধাগতের বাইরে একেবারেই আলাদা ঢঙ্গে লেখা, তারিয়ে তারিয়েই পড়েছিলাম। এরপর প্রথম মওকাতেই পড়ে ফেললাম তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ। এই বইটিতেও নিরীক্ষা নিয়ে লেখকের প্রয়াস লক্ষণীয়, প্রথাগত ধারার বাইরে গিয়ে এই বইতে আমি আবিষ্কার করি নতুন একজন শাহাদুজ্জামানকে।

১৮৯৯ সংখ্যাটা শুনলে কবিতাপ্রেমীদের মাথায় ঝট করে একটা নামই আসার কথা। কাব্যপ্রিয় আমাকে বলা যাবেনা কোন অর্থেই, তাই শিরোনামের মাহাত্ম্য টের পেতে আমাকে কিছুদূর অবধি পড়ে যেতেই হল। ছোটগল্পের মানদন্ডেও গল্পের কলেবর একেবারেই পৃথুল নয়, শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এর মাঝেই জীবনানন্দের প্রতি উৎসারিত প্রগাঢ় অনুরাগ ঠাহর করতে বেগ পেতে হয়না বৈকি।

শুরুর গল্পটা পড়ে বইটা ছেড়ে ওঠা মুশকিল হয়ে পড়ে, এরপর তরতর করে বাকিগুলো পড়ে ফেলতে কসুর করিনা। তবে এর মাঝে একটি গল্পের কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়, আন্না কারেনিনার জনৈক পাঠিকা। এই গল্পের শুরু পুরনো বইয়ের দোকানে লেখকের আন্না কারেনিনা বইটি কেনার পরের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। গল্পটাকে বলা যায় গল্পের মধ্যেই যেন আরেকটা গল্প, অনেকটা আমার দারুণ পছন্দের একটা ছবি দ্য ফল এর মত। আন্না কারেনিনা বইয়ের মার্জিনে একজন পাঠিকার কিছু মতামত, মতামত না বলে অবশ্য দর্শন বলাটাই যুৎসই। হাসান ভাই নামের একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে মমতার ছুঁড়ে দেওয়া কিছু আপাতসরল জিজ্ঞাসা লেখককে তাড়িত করে, বইটা পড়ার সময় লেখকের সামনে উন্মোচিত হয় একজন আনকোরা কিন্তু মনোযোগী পাঠিকার নতুন অলিন্দ। এইসব প্রশ্ন থেকে উপজাত হিসেবে বেরিয়ে আসে কিছু অমোঘ প্রশ্ন, মমতা-হাসানের সম্পর্কের একটা হালকা আঁচও পাওয়া যায় এতে। তাই গল্পে লেখকের পাঠক সত্ত্বার চেয়ে অনুসন্ধিৎসু সত্ত্বা প্রবল হয়ে ওঠে অনেকটা এভাবে-

এ ছাড়াও আরও কয়েকটি টুকরো মন্তব্যে লক্ষ করি নানা সামাজিক প্রসঙ্গে আমাদের এই পাঠিকার মনোযোগী পর্যবেক্ষণ।আন্না কারেনিনায় দেখা যাচ্ছে, সে সময় ধনাঢ্য রুশদের মধ্যে নিজের ভাষা ছেড়ে মাঝে মধ্যে ফরাসী বলার একটা ফ্যাশন ছিল। লেভিনের বন্ধুর স্ত্রী ডল্লি যখন তেমনি তার মেয়ের সঙ্গে ফাঁকে ফাঁকে ফরাসী বলছিল লেভিন তখন ভাবছিলেন- ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ফরাসী ভাষায় কেন কথা বলছেন উনি? কি অস্বাভাবিক আর কৃত্রিম। ছেলেমেয়েরাও টের পায় সেটা, এই ফরাসী শেখা আর স্বাভাবিকতা ভোলা। মমতা পাশে লিখেছেন- ঠিক যেমন আজকাল এদেশের বড়লোক পরিবারগুলোতে ইংরেজি বলা। ওদেরগুলোও মনে হয় কি অস্বাভাবিক আর কৃত্রিম।

এইভাবে একটি বইয়ের "মার্জিনে মন্তব্যে"র সূত্র ধরে লেখকের সামনে এক অনালোকিত জগতের দুয়ার খুলে যায়। এই ঠাস বুনোটের শহরে একজন অচিন পাঠিকার হারানো ঠিকুজির তিনি সন্ধান করে চলেন, আমরাও পড়ে ফেলি গল্পের মধ্যে আরেকটি গল্প।

তবে বইটির যে গল্পটা আমার চোখে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আদল নিয়েছে সেটা হল, ইব্রাহীম বক্সের সার্কাস। অন্যান্য গল্পের মত এটি স্বল্পবপু নয়, তবে গল্পের কিছুদূর এগিয়ে এটাও লেখকের ভুয়োদর্শনমূলক বলে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। গল্পের কাহিনি এক প্রত্যন্ত গ্রামে একজন তরুণ চিকিৎসকের কিছু অভিনব অভিজ্ঞতা নিয়ে। সদ্যপাশকৃত এই ডাক্তার বদলি হয়ে চলে আসেন এই দুর্গম জনপদে। এই পরিস্থিতিতে যেটা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক; গ্রামের কুসংস্কারপীড়িত মানুষের ভ্রান্ত ধারণা, রোগ বালাই নিয়ে তাদের উদ্ভট খেয়াল, আধুনিক চিকিৎসা সম্পর্কে অজ্ঞানতা এসবই ডাক্তারকে মোকাবেলা করতে হয়। এই পর্যন্ত গল্পটিকে আটপৌরে মনে করলে আসলে খুব বেশি দোষ ধরাও যায়না। কিন্তু এরপর প্রাত্যহিকতার আবডালে আরেকটি অতীন্দ্রিয় জগতের হদিস পান ডাক্তার, যেখানে বাস করে ইব্রাহিম বক্সের মত খামখেয়ালি, রহস্যময় একজন লোক, বকরি বুড়ির মত একজন আপাতপমূর্খ কিন্তু দুর্বোধ্য গ্রাম্য প্রবীণার। গ্রাম্য সংস্কারের আড়ালে ইব্রাহিম বক্সের কৌতূহলী মন আর বৈজ্ঞানিক সত্ত্বার ঠিকুজি ডাক্তারকে দ্বিধায় ফেলে দেয়, এতদিনের আধুনিক কলাকৌশলের সাথে এসব উন্মার্গিক অথচ সৃষ্টিশীল প্রজ্ঞার সন্ধান তাকে ফেলে দেয় ভয়ানক টানাপোড়েনে। এক লহমায় ইব্রাহিম বক্সের চিকিৎসা বিষয়ক মতবাদকে উড়িয়ে দিতে যেমন পারেননা, ঠিক তেমনি পারেননা নিজের যুক্তিবাদী সত্ত্বার সাথে টক্কর দিয়ে সবকিছু মেনে নিতে। অবশ্য নিয়তি অচিরেই তাকে এই সংকট থেকে মুক্তি দেয়, সেই গণ্ডগ্রামে ডাক্তারগিরির পাট চুকিয়ে অচিরেই তিনি ফিরে যান নিজের শেকড়ে। গল্পটা একদিক দিয়ে খানিকটা প্রথাগতই বটে, এখানেই তিনি নিরীক্ষার আশ্রয় নিয়েছেন সবচেয়ে কম। চরিত্রগুলোকে স্বাভাবিক বিকাশের পথ দেখিয়েছেন, ঘটনাগুলোকে একসূত্রে গেঁথেছেন দক্ষ হাতে।


তবে অন্যগল্পগুলো নিয়ে কিছু না বললে অন্যায়ই হবে। শিং মাছ, লাল জেল এইসব গল্পে লেখক আসলে একটি থিমের ওপর কিছু ছোট ছোট চুটকি ফেঁদেছেন। গল্পটা ভীষণ রকম সুখপাঠ্য, এ ধরনের গল্প পড়ার আনন্দ অসামান্য, তবে এসব গল্প ভুলে যাওয়াটাও অনেকটা সহজ। অন্যদিকে পন্ডিত গল্পে লেখকের বিদ্রুপের তীর্যক সুর অনেকটাই স্পষ্ট, সখেদে তিনি অর্থগৃধু বুদ্ধিব্যবসায়ীদের অন্তসারশূন্যতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, বাস্তবের কর্কশ জমিনের সাথে সংশ্রবহীন তত্ত্বকথার ঝান্ডাধারীদের একহাত দেখে নেন। এসব গল্পে লেখক অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত, পাঠক হিসেবে এ ধরনের গল্পের প্রতিও আমার একটা বাড়তি পক্ষপাত আছে অবশ্য।

খুব স্থির একটি স্থির চিত্র গল্পটি আদপে স্রেফ একটা স্ন্যাপশট, যেখানে একটা খুব সংক্ষিপ্ত ঘটনার মাধ্যমে লেখক অনেকগুলো উপসংহার টেনেছেন। এখানে কাহিনি খোঁজাটা হবে অরণ্যে রোদন, তবে নিরীক্ষার ছাপ এই গল্পেও সুস্পষ্ট। উড্ডীন গল্পের ক্ষেত্রেও এই কথা অনেকটা খাটে, এই গল্পটা আমি ঠিক ধরতে পারিনি, মাঝেমাঝেই রাশটা ছুটে গিয়েছে বলে মনে হয়েছে। আয়নার ওপিঠ লাল একজন পঙ্গু মানুষের গল্প, অনেকটা ডাইভিং বেল অ্যান্ড দা বাটারফ্লাই ছবিটার কথা মনে করিয়ে দেয়। এই ঘরানার গল্পের একটা বিষাদমাখা সুর থাকে, সেটা আমাকে ছুঁয়ে যায় বৈকি। কিন্তু কতটা দাগ কেটেছে এ সওয়াল পুঁছলে সেটার উত্তর দিতে আমি খানিকটা ভাববই। চীনা অক্ষর অথবা লংমার্চের গল্পটিকে আমার কিছুটা কমজোরি মনে হয়েছে, ঠিক দানা বেঁধে উঠতে পারেনি ,কেন জানি মনে হয়েছে এটা হয়েছে "একটি হতে গিয়েও না হতে পারা " গল্প।

আরেকটি গল্পের কথা আলাদাভাবে বলব, নিজকলমোহনায় ক্লারা লিন্ডেন। একজন ভিনদেশী রমণী দোভাষীর সাহায্য নিয়ে গন্ডগ্রামে সন্তান প্রসবের ওপর গবেষণা করতে আসেন। অনেক চটকদার পিলে চমকানো তথ্যই তিনি জানতে পারেন, নিজের গবেষণার সাফল্যের কথা ভেবে তিনি উচ্ছ্বসিতও হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে এদেশীয় দোভাষীর কাছেও ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় দুর্বোধ্য এক প্রহেলিকার নাম, গ্রাম্য মিথের অভিনবত্ব তাকে চমকিত করে। প্রবীণ ধাত্রীর কাছে এর আবেদন আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন। গল্পের শেষলাইনটি আসলে অনেক কথাই বলে দেয়-

নিজকলমোহনায় তখন দুপুর। ঢেঁকিঘরে হাওয়া, সেখানে শ্বেতাঙ্গ, বাদামি, শ্যামবর্ণ তিনজন নারীর মিথস্ক্রিয়া।


বইটিতে আমরা একজন শক্তিমান লেখকের দেখা পাই, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যার নিবিড় পর্যবেক্ষণ রয়েছে, সমাজ- সংস্কার নিয়ে যার অভ্রভেদী দৃষ্টিভঙ্গি আছে। লেখক নিরীক্ষার প্রশ্নে কোন আপস করেননি, হয়ত গল্প হিসেবে সবগুলো ঠিক উতরে যেতে পারেনি, কিন্তু প্রত্যেকটি গল্প আলাদাভাবে ভাবতে বাধ্য করবে, চিন্তার খোরাক জোগাবে এটুকু হলফ করে বলা যায়। তাই, একজন পাঠক হিসেবে পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ পড়ে লেখকের কাছ থেকে প্রত্যাশার পারদও অনেকখানি চড়ে যায়।

Thursday, April 7, 2011

স্মৃতির শহরে রাশেদের সাথে

১.
দিনটা ছিল বোশেখের এক রৌদ্রতপ্ত দুপুর, এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। খাওয়ার সময় দুদন্ড জিরিয়ে নেওয়ার আগে আলগোছে হাতে তুলে নিয়েছিলাম বইটি। এরপরের ঘন্টাখানেক আমি আক্ষরিক অর্থেই বুঁদ হয়ে ছিলাম, মুহুর্তের জন্যও চোখ সরাইনি(বা বলা ভাল সরাতে পারিনি) বইয়ের পাতা থেকে । চোখের কোনায় পানি চকচক করেছিল কিনা মনে নেই, তবে পড়া শেষে ভেতরটা ভীষণরকম কুঁকড়ে গিয়েছিল, সেটা দিব্যি দিয়েই বলা যায়। রাশেদের সাথে আমার পয়লা মোলাকাত হল এভাবেই, আর প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের আমার বন্ধু রাশেদ চলে গেল প্রিয় বইগুলোর ছোট্ট তালিকার কাতারে।

২. ব্যাপারটা কাকতাল কিনা জানিনা, মোরশেদুল ইসলামের কাজের সাথে প্রথম পরিচয়ও কিন্তু মুহম্মদ জাফর ইকবালেরই আরেকটা দুর্দান্ত কিশোর উপন্যাস, দীপু নাম্বার টু এর মধ্য দিয়ে। মনে পড়ে, ছবিটা দেখে মনে হচ্ছিল, দীপু যেন আমার উড়ুক্কু কল্পনার দীপুর সাথে ঠিকঠাক মিলে গেল। তখনই ছবিটার প্রতি একটা দারুণ রকম মোহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর এটুকু হলফ করে বলতে পারি, বড়বেলায় ফের ছবিটা দেখার পর সেই মোহভঙ্গ হয়নি, সেই বালকবয়েসের মুগ্ধতার রেশ তখনও অনেকটা থেকে গিয়েছিল। এরপর মোরশেদুল ইসলামের খেলাঘর, দূরত্ব ছবি দুটো দেখেছি, তবে কোনটিই জাফর ইকবালে সাথে যুগলবন্দির ফিরিস্তি নয়। তবে কেন জানিনা প্রায়ই মনে হত, দুষ্টু ছেলের দল, হাতকাটা রবিন বা আমার বন্ধু রাশেদের মত কিশোর বয়সের দুমলাটের ভালবাসাকে সেলুলয়েডিত করতে মোরশেদুল ইসলামই হতেন সবচেয়ে যোগ্য লোক ।

৩. বেশ কিছুদিন আগেই শুনেছিলাম সরকারী অনুদানে মোরশেদুল ইসলামের পরিচালনাতেই রুপালী পর্দায় রাশেদকে দেখা যাবে। তখন থেকেই শুরু অপেক্ষার প্রহর গোনার। অবশেষে এই এপ্রিলে এসে মুক্তি পেল ছবিটি। আর দুদন্ড ফুরসত পেয়েই ছবি দেখার মওকা ছাড়লামনা, সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে একেবারে সোজা সিনেমা হলে। এখানে বলে রাখছি, আমার কাছে বইটার একটা নিজস্ব আবেদন আছে। সেই প্রীতির জায়গাটুকু থেকে ছবিটার কাছ থেকে প্রত্যাশা আকাশ না ছুঁলেও পারদটা অনেকটা চড়া ছিল। একেবারে যাকে বলে "স্ট্রাইকিং অ্যাপিয়ারেন্স" না হলেও প্রথমেই রাশেদকে দেখে সেই কল্পনার রাজ্য টলে যায়নি, সেজন্য পরিচালকের একটা বাহবা পাওনা থাকবে। বেশ নিপাট চেহারার চালাক চতুর গোছের রাশেদের প্রথম দর্শনে খুঁত যদি ধরতেই হয়, তবে বলব বয়সটা সামান্য বেশিই হয়েছে হয়তোবা। তবে সেটাকে খুব বেশি আমলে না নিলেও চলে। ইবুর চরিত্রটাও টাল খায়নি, তবে এই জায়গায় আমার একটু খেদ আছে, সে কথায় পরে আসছি। গল্পের কাহিনি অনেকেই জানেন, তাই সেটা নিয়ে লম্বা ফিরিস্তি দেওয়াটা জলঘোলা করাই হবে। সিনেমাটার প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধের ওপরে, তাই সেই সময়কার আবহটা পুরো ছবি জুড়েই ছিল। রাশেদ-ইবু সহ বাকিদের গেটআপ বা অন্যান্য দৃশ্যগুলো সেভাবেই সাজানো হয়েছে। সিনেমার শুটিং হয় ছিমছাম দিনাজপুর শহরে, নদীতীরের দৃশ্যগুলো ছিল এককথায় চমৎকার। সিনেমাটোগ্রাফি তাই বেশ ভালমত উতরে গেছে বলা যায়। তবে যে ব্যাপারটা আলাদা করে বলতেই হয় সেটা মূল উপন্যাসের সাথে দারুণ সামঞ্জস্য। বইয়ের পাতায় যেমনটি পড়েছিলাম, পর্দায় ঠিক সেই কাহিনিই দেখলাম। খুব বেশি নিরীক্ষার ব্যাপারে পরিচালক বেশ সংযত থেকেছেন, কোন উটকো মোচড় দিয়ে কাহিনির বারটা না বাজানোয় তাকে আরেকটা ধন্যবাদ দিতেই হয়। রাশেদের অভিনয়ে খানিকটা আড়ষ্টতা থাকলেও ওই বয়েসী ছেলেদের মধ্যে সেটা কিছুটা থাকাটাই স্বাভাবিক। এদিক দিয়ে ইবুকে কিছু জায়গায় বরং বেশি সাবলীল মনে হয়েছে। বাকি কিশোর অভিনেতারাও পাশ মার্ক পাবে। অন্যান্য কলাকুশলীদের কথা বলতে গেলে আলাদাভাবে বলবব রাইসুল ইসলাম আসাদ আর পীযুষ বন্দোপাধ্যায়ের কথা। অভিনয়ের এন্তার সুযোগ তাদের ছিলনা, তবে যেটুকু করেছেন সেটুকুতেই নিজেদের জাত চিনিয়েছেন। তবে আলাদাভাবে অরু আপা আর শফিক ভাইয়ের চরিত্রদুটোর কথা বলতেই হয়। হোমায়রা হিমুর অভিনয় কিছুটা মাত্রায় মেলোড্রামাটিক, কিছু জায়গায় একটু চপলমতীও মনে হয়েছে। এদিকে আরমান পারভেজ মুরাদ শফিক ভাইয়ের চরিত্রে আমার ভাবনার সাথে অবিকলই মিলে গেছেন।


৪. অভিনয়ের কাসুন্দি বাদ দিলে স্রেফ ডিরেকশনের বিচারে ছবিটাকে দুর্দান্ত না বলতে পারলেও ভাল বলতেই হবে। নদীতীরের বা রেলব্রিজের ওপরে লংশটের দৃশ্যগুলোর কথা আলাদাভাবে বলব। আবহ সঙ্গীত অনেকটাই প্রথাগত, যুদ্ধের দৃশ্যগুলোতে প্রথাগত দামামা বা পরিচিত দেশের গানের নেপথ্য সুরের কথা এই মুহুর্তে মনে পড়ছে। এখানেও বাঁধাগতের বাইরে গিয়ে অন্য কিছু করার যথেষ্টই অবকাশ ছিল। তবে একটা কথা বলতেই হবে, রাশেদের ওপর থেকে ফোকাসটা মাঝে মাঝেই সরে গিয়েছে বলে মনে হয়েছে। মূল বইটা না পড়া থাকলে এই ব্যবধান আসলে ঠিক গোচরে আসবেনা, তবে স্পটলাইট আরেকটু কম ইবুকেন্দ্রিক হলেও পারত। এটা অবশ্য আমার একান্তই নিজস্ব পর্যবেক্ষণ, এর সাথে একমত হবেননা এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া যেতেই পারে।

৫.

ছবির শেষ দিকের অংশটকুর জন্য আসলে অনেকটাই মুখিয়ে ছিলাম। যুদ্ধের ডামাডোলে একদল অকুতোভয় কিশোরের রোমাঞ্চকর কাহিনি যেমনি আচমকা শুরু হয়েছিল , অমনি সেটা আচমকাই শেষ হয়ে গেল। ইবু তার অনেক দিনের গোপন ক্ষত শত চেষ্টা করেও মুছে ফেলতে পারেনা, তাই সে টের পায়, রাশেদের সাথে তার অদৃশ্য এক ধরনের যোগসূত্র রয়েই যায়। সেই রাশেদ, যার বাবা খানিকটা "পাগলা কিসিমের", যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির হালহকিকত রাখে, সেই রাশেদ, যে কিনা ভয়ের তোয়াক্কা না করে গুলি বয়ে নিয়ে যায়, যে কিনা আহত মুক্তিযোদ্ধা শফিক ভাইকে দুঃসাহসিকভাবে ছিনিয়ে আনে, যে কিনা মৃত্যুকে আয়নায় দেখেও জয় বাংলা বলতে কুন্ঠাবোধ করেনা। এসবই বহবার পড়া, চোখ মুদলেই আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাই। সবকিছুর পরেও রাশেদের জন্য আমার ভেতরের স্পর্শকাতর অনুভূতিতে নাড়া দেওয়ার জন্য মোরশেদুল ইসলাম একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। তাই এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাদের প্রজন্মের যাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবেগের বিশেষ স্থান রয়েছে, যারা কৈশোরের মাতাল করা সময়ে "আমার বন্ধু রাশেদ" পড়ে এক অব্যক্ত বেদনায় কাতর হয়েছে, তাদের কিশোরবেলার সেই সুপ্ত স্মৃতির শহরে আরেকটা দুর্দান্ত সফরের জন্য এই ছবির চেয়ে মোক্ষম দাওয়াই আর কিছু হতে পারেনা।

Monday, February 14, 2011

ও ফেনোমেনন, মাই ফেনোমেনন !!


১.

কতই বা বয়েস, এর চেয়ে ঢের বুড়ো খেলোয়াড়ারদের(এই মুহুর্তে চট করে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের রায়ান গিগসের নামটাই মাথায় আসল) মাঠ দাপিয়ে বেড়ানোর এন্তার রেকর্ড আছে। তবে দীর্ঘদিন বিষফোঁড়া হয়ে থাকা ইনজুরির সাথে শেষমেশ হার মানতে বাধ্য হলেন তিনি। মাত্র চৌত্রিশ বয়েসেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ঢের হয়েছে, এইবার বুটজোড়া তুলে না রাখলেই নয়। আর কখনো ফুটবল মাঠে ডিফেন্ডারদের তুর্কি নাচন নাচাবেননা তিনি। আদিওস...রোনালদো লুইস নাজারিও দে লিমা, আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে দুর্দান্ত স্ট্রাইকারটিকে আর কখনো মাঠে দেখা যাবেনা।

২.

তখনও ফুটবলের সাথে গাঁটছড়া অতটা মজবুত হয়নি, ইউরোপিয়ান লীগে মজে থাকার সময়টা এসেছিল আরো পরে। পত্রিকা মারফতই খবর যা একটু রাখা হত। সে সময়টাও বেশ আগের, তখন প্রাইমারি স্কুলের চৌকাঠ পার হইনি। এমন সময় শুরু হয়ে গেল বিশ্বকাপ ফুটবল। ফ্রান্সে অনুষ্ঠেয় ওই আসরের শুরু থেকেই টেকো মাথার দোহারা গড়নের এক খেলোয়াড় নিজের জাত চিনিয়ে দিচ্ছিল। ব্রাজিল সমর্থকদের চোখের মনিতে পরিণত হতেও খুব বেশি সময় লাগলনা। ক্ষিপ্রগতির সাথে পেনাল্টি বক্সে দুর্দান্ত ফিনিশিং এর কারণে বাকিদের থেকে সহজেই তাকে আলাদা করে যেত। এর মধ্যে ব্রাজিলও তরতর করে ফাইনালে উঠে গেল। প্রতিপক্ষ ফ্রান্স, আর সাথে স্বাগতিক দেশের স্বতঃস্ফূর্ত দর্শক সমর্থন। ব্রাজিলের পাঁড় সমর্থক আমার বাবার মত বাংলাদেশের লাখো ব্রাজিল ভক্ত তখন একাট্টা , টানা দ্বিতীয়বারের মত শিরোপা এবার ঘরে না এসেই পারেনা। আর তুরুপের তাস ফর্মের তুঙ্গে থাকা রোনালদো তো ছিলই। কিন্তু সব আশায় জল ঢেলে দিয়ে ফাইনালে নায়ক হয়ে গেলেন আরেক জীবন্ত কিংবদন্তী, জিনেদিন জিদান। পুরো মাঠে রোনালদো নিজের ছায়া হয়েই রইলেন। ব্রাজিলকে ধরাশায়ী করে বিশ্বকাপ গেল লা ব্লুজদের ঘরে। রোনালদোকে ওইদিন কাঁদতে দেখেছিলাম কিনা মনে নেই, তবে ব্রাজিল ভক্ত বাবার চোখের কোণে চিকচিক করা অশ্রু এখনো আমার স্পষ্ট মনে পড়ে।

৩.

মূলত তখনই রোনালদো নিয়ে আমার মুগ্ধতার শুরু। বার্সেলোনা থেকে রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফি তে ইণ্টারন্যাসিওনালে(ইন্টার মিলান বললেই মানুষ বেশি চেনে) আসার খবরও আমার অজানা নয়। ইতালিয়ান ফুটবলের রাজপথটা তখনও ঠিকঠাক চেনা হয়ে ওঠেনি, ফলে খবরের পাতায় রোনালদোর কেরদানির কথা পড়েই মন ভরাতে হত। এর মধ্যেই অবশ্য ইনজুরির সাথে মিতালী বেশ জমে উঠেছে। তবে দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকার কারণে বিস্মৃতির গর্ভ তলিয়ে যাওয়ার যে সূক্ষ্ণ আশঙ্কাটা ছিল সেটাকে তিনি অচিরেই ভুল প্রমাণ করলেন তিনি। সময়টা ২০০২ সাল। এশিয়ার মাঠে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের আসর। একদিকে শিরোপাধারী ফ্রান্স, আর হট ফেভারিট আর্জেন্টিনার ভীড়ে সেলেকাওদের অনেকেই হয়তো গণায় ধরতে ভুলে গিয়েছিলেন। পরের ইতিহাসটা অবশ্য সবার জানা। এলাম, দেখলাম ,জয় করলাম স্টাইলে ইনজুরি থেকে তার প্রত্যাবর্তনটা হল দুর্দান্ত রকমের রাজসিক। নিজে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পাশাপাশি দলকেও এনে দিলেন বহুল আরাধ্য পেন্টা। আগের বিশ্বকাপের দুঃসহ স্মৃতিকেও দারুণভাবে ধামাচাপা দিলেন।

৪.

এই বছরটা অবশ্য রোনালদোর জন্য আলাদাভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই বছরেই যে রিয়ালের নক্ষত্রমণ্ডলের আরো একটি জ্বলজ্বলে তারা হিসেবে নিজের নাম লেখালেন তিনি। তবে রোনালদোর সাথে আমার এরপরের স্মৃতি খুব একটা সুখপ্রদ নয়। তখন আমি ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের অন্ধ সমর্থক। সেই সময়কার লাল শয়তানের দলও নেহাত ফেলনা ছিলনা। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লীগের নক-আউট স্টেজে ওল্ড ট্রাফোর্ডেই ম্যানইউর বিপক্ষে দুর্ধর্ষ এক হ্যাট্রিক করে বসলেন তিনি। পরের বছরগুলোতে রিয়ালে তার থাকাটা খুব একটা সুখকর হয়নি। ফেরারীর মত ধাওয়া করা সেই ইনজুরি তো ছিলই, সেই সাথে বল্গাহীন ওজন এবং মাঠের বাইরের উটকো সব কারণে তিনি নিয়মিতই সংবাদের শিরোনাম হতে থাকেন।ফলাফল, কোচের গুডবুক থেকে তার নাম কাটা পড়ার দশা হয়। এর মধ্যেই এসে যায় আরেকটি বিশ্বকাপ।

৫.

এইবার তাকে দলে নেওয়া নিয়ে বেশ একচোট সমালোচনা হয়ে যায়। ততদিনে তিনি বেশ মুটিয়ে গেছেন, বেঢপ শরীরে তাকে চেনা হয়ে পড়ে দায়। তারপরও ধারে না কাটলেও ভারে নিশ্চয় কাটবেন, এমন আশায় কোচ পাহেইরা তাকে দলে রাখেন। কোচের আস্থার প্রতিদান তিনি এবার আর সেভাবে দিতে পারলেননা। ব্রাজিলের হেক্সা স্বপ্নও কোয়ার্টার ফাইনালে মুখ থুবড়ে পড়ে। এখনো আমার মনে পড়ে, ওইবার স্থূলদেহের রোনালদোকে বলের পেছনে দৌড়ানোর নিস্ফল প্রয়াস দেখে মনে হচ্ছিল, এ আমি কাকে দেখছি? এ কি সেই খেলোয়াড়, যিনি ঝড়ের বেগে বক্সে ঢুকে একমেবাদ্বিতীয়ম বডি ডজে মার্কারদের ছিটকে ফেলে দেন এবং বলাই বাহুল্য, নির্ভুল মুন্সীয়ানায় বলটাকে জালে জড়িয়ে দেন? তারপরেও বিশ্বকাপের ইতিহাসে নিজের নামটাকে পাকাপাকিভাবে খোদাই করার ভুল তিনি করেননি। গার্ড মুলারকে ছাড়িয়ে রোনালদো হয়ে যান বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোল করা খেলোয়াড়। এর মাঝে ক্লিন্সমানের পরে টানা তিন বিশ্বকাপে কমপক্ষে তিন গোল করা খেলোয়াড়ও হন তিনি।

৬.

এরপরের সময়টাকে আমি বিস্মৃতির সময়ই বলব। রিয়াল থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে খুব তাড়াতাড়ি তিনি এসি মিলানে চলে আসেন। ইতিমধ্যে ফর্মহীনতা,ওজন সমস্যার সাথে সেই পুরনো শত্রু ইনজুরির সাথে তার লড়াই চলতে থাকে। এদিকে মেঘে মেঘে বেলাও কম গড়ালনা, য়ারেক রোনালদোর আবির্ভাবে একে একে সবাই তাকে ভুলতে বসে। সত্যি বলতে কী, এরপর নিজের আসল ফর্মের ধারেকাছেও তিনি কখনও যেতে পারেননি। তাই ও নিয়ে কথা আর না বাড়াই। তবে তিনবারের ফিফা ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার, বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা, ইন্টার-মিলান বা রিয়াল-বার্সার মত অবিস্মরনীয় দ্বৈরথগুলোর মুদ্রার দুপিঠ থেকেই দেখতে পারার দুর্লভতম অভিজ্ঞতা সহ এমন আরো অনেক অর্জন এই লম্বা সময়ে তিনি নিজের ঝুলিতে পুরেছেন। ক্লাবের হয়ে ৫১৫ ম্যাচে ৩৫২ গোল বা দেশের হয়ে ৯৭ ম্যাচে ৫২ গোল, এসব পরিসংখ্যানও নিঃসন্দেহে ঈর্ষাজাগানিয়া। তবে রেকর্ড অনেক কথাই বলবে, তবে আমি নিজে অন্তত তাকে মনে রাখব ডিফেন্সচেরা থ্রু গুলো আঁচ করতে পারার বিরলপ্রজ স্ট্রাইকিং ইন্সটিংক্ট, মার্কারদের ছিটকে ফেলার দারুণ ক্ষমতা, পেনাল্টি বক্সে চিতার মত ক্ষিপ্রতা, দুপায়েই শট নেওয়ার দক্ষতা এবং অসাধারণ ফিনিশিংয়ের কারণে। আমাদের সময়ে বিশ্ব ফুটবলে সবচেয়ে বড় মঞ্চে তার মত আর কেউ বোধকরি নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি। এর মধ্যেই আরো অনেক স্ট্রাইকার আসবে, অনেকে গোলের তুবড়ি ছোটাবেন কিন্তু দ্য ফেনোমেনন আদপে একজনই।

একজন আর্জেন্টাইন সমর্থক হয়েও বিদায়বেদায় তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি, গুরু...তোমায় সেলাম। টেকো মাথার লোকটিকে আমার মত লাখো ফুটবলামদীদের পক্ষ থেকে আরো একবার স্যালুট!!

Thursday, January 13, 2011

মেঘ, নদী আর পাহাড়ের দেশে-৪

গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়ার হ্যাপা এতদিন কেবলই শুনেছি, তবে রেমাক্রিবাজারে এসে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। সামনে বেশ উঁচুমতন একটা টিলা, ওটার নিচে ইঞ্জিন নৌকা আমাদের নামিয়ে দিল। এবার তো একগাদা মালপত্তর নিয়ে ঐ পাহাড় টপকাতে হবে, ভাবতেই মন খানিকটা দমে গেল। কালঘাম ছুটিয়ে আমরা যখন পাহাড়ের ওপরে ইউএন্ডিপির রেস্টহাউজে পৌঁছে কুকুরের মত জিভ বের করে হাপাচ্ছি, তখন মেজাজটা দ্বিতীয় দফায় খিঁচড়ে গেল। রেস্টহাউজে একটাই বেশ বড়সড় কক্ষ, তবে সেটা থানচিতে সাক্ষাত হওয়া আমাদের আরেক বন্ধুদের কব্জায় তখন। এখন উপায়? খোঁজ নেওয়ার জন্য আমরা কজন চললাম বাজারের দিকে। সেখানেও অবস্থা তথৈবচ, ঠা ঠা রোদ্দুরের পড়ন্ত দুপুরে সেখানে খুব একটা জনমনিষ্যির পাত্তা দেখলামনা। তবে বাজারটা যতটা ছোট মনে করেছিলাম, ততটা ফেলনা নয় মোটেই। বেশ বড় খোলামেলা একটা জায়গা, চারদিকে বেশ কিছু দোকান। বরাতটা অবশ্য বেশ ভালই বলতে হবে, শেষ পর্যন্ত থাকার একটা বুদ্ধি মিলে গেল। রেস্টহাউজের বারান্দাটা পুরোটাই কাঠের, সেখানেই চাদর বিছিয়ে একরাত দিব্যি পার করে দেওয়া যাবে। শেষমেশ এক রেস্টহাউইজেই আমরা একই ভার্সিটির উনিশজন ব্যাচমেট, কাকতালটা বেশ জবরদস্ত বলতেই হবে। এর মাঝে নৌকায় উদরপুর্তির জন্য বরাদ্দকৃত চিড়ে-কলা তখনো পুরোপুরি সাবাড় করতে পারিনি, শির হল দুপুরে আর কিছু না খেয়ে সেটা দিয়েই চালিয়ে দেওয়া হবে। সবাই তখন টানা ছ ঘন্টার দুর্ধর্ষ জার্নি বাই বোটের পর রীতিমত জেরবার, ঐ কাঠের মেঝেতেই চাদর বিছিয়েই সটান শুয়ে পড়লাম। এই করতে করতে বিকেল গড়িয়ে গেল।



রেমাক্রিবাজারে কোন মোবাইল নেটওয়ার্কের প্রশ্নই ওঠেনা, তবে একেবারেই পাণ্ডববর্জিত বলতে একটু ভুল হবে। রেস্টহাউজের পেছনে একটা বিডিয়ার ক্যাম্প, সেখানে গিয়ে আমাদের উপস্থিতি জানান দিতে হল। এই দুর্গম স্থানে একদুদিনের জন্য আসাটা আমাদের জন্য অ্যাডভেঞ্চারের দারুণ মওকা হতে পারে, কিন্তু মাসের পর মাস সবকিছু থেকে সংশ্রবহীন অবস্থায় এখানে দায়িত্বব্রত পালনের তাগিদে পড়ে থাকা যে সহজ কম্মো নয়, সেটা ওই দশায় খানিকটা হলেও ঠাহর করতে পেরেছিলাম। তবে সুবিধা এই যে, যোগাযোগের জন্য হেলিকপ্টারের সাহায্য নেওয়া যায়, খানিক বাদেই দেখলাম আমাদের সামনেই একটা কপ্টার সশব্দে উড়ে গেল।


আগেই টের পেয়েছিলাম, এখানে রাতের খাওয়াটা বেশ আগেই সেরে ফেলতে হপবে। সে অনুযায়ী বাজারে বিলিব্যবস্থাও করে ফেলেছিলাম। খাবারের আইটেম বলতে কেবল সেদ্ধ আন্ডা, তার সাথে মসুরের ডাল, আর পাহাড়ী চালের লালচে ভাত। তবে স্থান-কাল-হাতযশ গুণে সেটাই আমরা গোগ্রাসে গিললাম, এবং বেশ তৃপ্তি করেই খেলাম। খেয়েদেয়ে হাতঘড়িতে দেখি মোটে রাত আটটা, অথচ ইলেকট্রিসিটিবিহীন রেস্টহাউজে আমাদের সামনে গোটা রাত পড়ে আছে। শুরু হল ম্যারাথন আড্ডা। এবারও স্থান-কালের একটা প্রভাব প্রচ্ছন্ন তো ছিলই, তা না হলে আদিরসাত্মুক রসরসিকতার ধার না ধেরে আড্ডাটাই বা খুব দ্রুত আধিভৌতিক গপ্পোর দিকে মোড় নেবেই বা কেন? সবাই নিজের থলি থেকে যতসব অদ্ভুতূড়ে কাহিনি ফেঁদে বসতে লাগল। বাইরে ঘুটঘুটে আঁধার, কেমন যেন একধরনের অপার্থিব নৈঃশব্দ, তারওপর গোটা রাতটাও কাটাতে হবে রেস্টহাউজের বারান্দায়,সব মিলিয়ে আমাদের কজনের গা যে একেবারেই ছমছম করেনি, বললে ভুল হবে। এমনকি দু একজন তো কুকুরের ডাক শুনেই সেটাকে কোন অভিশপ্ত প্রেতাত্মার আর্তনাদ বলে রায় দিয়ে ফেলল। যাই হোক, মেলাক্ষণ আড্ডা শেষে মুখে হাতে কষে মশকরোধী ওডোমস মেখে আমরা ঘুমুতে গেলাম।


পরদিন সকালে আমাদের এক বন্ধু শুধাল, দোস্ত, কাল রাতে বৃষ্টি পড়েছে নাকি? বন্ধুবর কোনদিন গঞ্জিকা সেবন করেছে বলে জানা নেই, তারপরও আমরা এক নিমিষে তাকে গাঁজাখোর বানিয়ে দিলাম। চারদিক শুকনো খটখট করছে, এর মধ্যে আবার বৃষ্টি আসবে কোত্থেকে? ওদিকে বন্ধু তো নাছোড়বান্দা, নাহ! কানের কাছে আমি বিষ্টি পড়ার আওয়াজ শুনেছিই, কোন ভুল নেই। আমরা পড়ে গেলাম ফাঁপড়ে। ঘটনা কী তবে? খানিক বাদেই ফাঁস হল গোমর। মাঝরাত্তিরে আরেক বন্ধুকে প্রকৃতি বেমক্কা ভীষণভাবে ডাক দেয়, কিন্তু ভূতের গল্প টল্প শুনে সে আর কিছুতেই নিচে নামার সাহস করতে পারেনা। শেষমেশ নচ্ছারটা ওই বারান্দা থেকেই আরেকজনের গায়ের ওপর দিয়ে কম্ম কাবার করে ফেলে। আর সেই শব্দকেই বন্ধুপ্রবর আধো ঘুমের ঘোরে বৃষ্টি বলে ঠাউরে নেয়। বুঝুন ব্যাপার!



পরের দিনটা এবারের সফরের সবচে গুরুত্বপূর্ন দিন, যাকে বলে গোল অফ দ্য জার্নি, সেই বহুল প্রতীক্ষিত বহুলশ্রুত নাফাখুম যাত্রা। খুব সকাল বেলা উঠে ভালমত পয়-পরিষ্কার হয়ে নিলাম। সামনে আট কিলোর মত হেঁটে পার হতে হবে, ফলে পেটে কিছু দানাপানি না পড়লেই নয়। এই কিম্ভুত স্থানে সকালে কি পাওয়া যাবে কে জানে? তবে ভাগ্যের কথা, চিড়ে কলা এখানে সুলভ, সেটা পেটে পুরলে আপাতত ভাবনার একটা সুরাহা করা যায়। চিড়ে কলা তো পেলামই, খেলামও আচ্ছাসে, তবে উপরি হিসেবে পেলাম বিনিভাত( এই জিনিসটা চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রচলিত একটা খাবার, চালকে খানিকটা ফার্মেন্টাইজ করে এটা তৈরি করা হয়, তাই এটা খেয়ে খানিকটা তন্দ্রার ভাব আসেই।) বিনিভাতের রান্নাও দেখলাম দারুণ সুস্বাদু, সবাই অবশ্য চেখে দেখার সাহস করলনা, তবে আমরা বেশ ভালই খেলাম। ওদিকে আমাদের সাথে ঢাকা ভার্সিটির আরেক গ্রুপও জুটে গেল। দুজন পাহাড়ী গাইডের বন্দোবস্তও করে ফেলা হয়েছে, তাদের দেখানো পথেই আমাদের নাফাখুম যেতে হবে। সামনের লম্বা পথের সবরকম রসদই মজুত। তাই ভোর থাকতে থাকতেই আমাদের ছাব্বিশ জনের বিশাল বহর রেমাক্রিবাজার থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সামনে নাফাখুমের হাতছানি।

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...