পাহাড়পুরেও কিউই! :
কাননবিলাস সেরে সবে চা-পান করে মনমেজাজ তোফা হয়ে গেল, ওদিকে তখন বেলাও প্রায় গড়িয়ে এসেছে, তাই পঞ্চপাণ্ডবের চকিত সিদ্ধান্ত, এবার শহরের ধার থেকে একটু হাওয়া খেয়ে আসা যাক। অটোমামাকে বলতেই তিনি কিছু পথঘাট ঘুরিয়ে আমাদের একটা বেশ খোলামেলা জায়গায় নিয়ে গেলেন। তখন যাকে বলে আসলেই"বৃষ্টি শেষে রুপালী আকাশ", বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল। দেখলাম, জায়গাটাতে গরু-টরু বেশ নির্বিবাদে চরে বেড়াচ্ছে। একজনকে জায়গার নাম শুধাতেই আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। এই (প্রায়) মগের মুল্লুকে এসেও কিউইদের দেখা পাব ভাবিনি। আচ্ছা খোলাসা করেই বলি, বেশ অনেককাল আগে জনৈক প্রবাসী এই স্থানে এসে বলেছিলেন, আরে এ জায়গা তো দিব্যি নিউজিল্যান্ডের মতো ঠেকছে। সেই থেকে জায়গার নাম হয়ে গেল নিউজিল্যান্ড। তখনো শার্দুলদের হাতে পোড়াকপালে কিউইদের ধবলধোলাই হতে হয়নি, না হয় আমরা বেধড়ক মজাই পেতাম। তবে এহেন পাণ্ডববর্জিত স্থানে এসে নিউজিল্যান্ড তীর্থের পরম সৌভাগ্য হয়ে যাবে তা কস্মিনকালেও ভাবতে পারিনি। একটা ছিমছাম ক্যাফেও দেখলাম সেখানে আছে, ওমা, সেটার নামও নিউজিল্যান্ড ক্যাফে। আর যাই হোক, ভেট্টোরি এন্ড কোংকে অমন বেদম ঠ্যাঙ্গানির পর এ জায়গায় ঘুরিয়ে আনা উচিত ছিল, অন্তত হোম সিকনেসটা একটু হলেও প্রশমিত হত বৈকি। ঐ ক্যাফেতে হালকা পেটপুজো সারতে সারতেই দেখি, আলো বেশ মিইয়ে এসেছে। সেদিনকার মত সফরের তাই সেখানেই সমাপ্তি।
ধবলধোলাইয়ের দেশ নিউজিল্যান্ড
আলীবাবার গুহায় পাঁচ চোর:
আগেররাতে পাহাড়ি মুরগী ভুনা, কুচো চিংড়ি দিয়ে শশা আর মাছ ভাজা দিয়ে গলা পর্যন্ত উদরপূর্তি করার ফল হিসেবে পরের সকালে আমাদের ঘুম ভাংল ম্যালা দেরিতে। অথচ, সফরের মোদ্দা অংশটাই তখনও বাকি। তড়িঘড়ি করে হালকা প্রাতরাশ সেরে আমরা আলুটিলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। খাগড়াছড়ি মানেই আলুটিলা, এমন একটা ধারণা বহুকাল আগে থেকেই আমার মাথায় জেঁকে বসেছিল। আলুটিলা গুহায় ঢোকার মুখে দেখি মশালটশাল বিকিকিনি হচ্ছে। ভরা বর্ষার মৌসুম, বৃষ্টি থেকে থেকে ভিজিয়ে দিছিল, তবে সেটা উৎপাত মনে হয়নি মোটেও। আমরা কজন ছাড়া এমন বিটকেলে সময়ে সেখানে আর কোন ট্যুরিস্ট দলের নামনিশানাও ছিলনা। যাক ভালই হল, ভাবলাম আমরা, বেশ প্রেমসে গুহাটা চেখেচুখে দেখা যাবে। তবে অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার গন্ধটা মিলিয়ে যেতে দেরি হলনা যখন দেখলাম গুহার প্রবেশমুখ অবদি রীতিমত শান বানানো সিড়ি। বুঝলাম, প্রমোদভ্রমণপিপাপুদের জন্যই মূলত এই ব্যবস্থা। তবে ভয় একটা ছিলই, সেটা ছিল জোঁকের। জোঁকসংহারের জন্য লবণও নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এসব আঁটঘাট বেঁধে কা তব কান্তা বলে গুহায় ঢুকে পড়ি। ভেতরে একরত্তি আলো নেই, পানি কেটে এগুতে হচ্ছিল বটে, কিন্তু সেটা খুব ধর্তব্যের মধ্যে নয়। মনে করেছিলাম, আর কিছু না হোক, নিদেনপক্ষে একটা দুটো রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার না হলে কি চলে? এমনিভাবে মিনিট দশেক ঘোরার পর সামনে দেখি মিহি আলো চুইয়ে পড়ছে। যাব্বাবা, গুহায় ঢুকতে না ঢুকতেই শেষটা দেখে ফেলেছি, তাহলে আর মজাটা রইল কই? মশালটশাল নিয়ে বেশ একটা থ্রিল ফিল করছিলাম, বেমক্কা সূর্যের আলোর নিচে এসে আমরা একে অন্যের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলাম। একি হল, গুহায় ঢোকাই হল সার, আর জোঁকের জুজুতে খামোখাই কুঁকড়ে ছিলাম, জোঁকের পাত্তাই নেই।
আলীবাবার গুহায়-
ঝর্ণা কিন্তু পাহাড়ের কান্নাই বটে:
আলুটিলার সম্ভাব্য রোমহর্ষক সফর এভাবে মাঠে মারা যাওয়ার পর আমরা কেউ কেউ নখ কামড়াচ্ছিল, আর বাকিরা সুখটান দিচ্ছিলাম। মনটা তখন ভীষণ দমে ছিল। হঠাৎ আমাদের চা-সিগারেট সরবরাহকারী মামার মুখে শুনলাম, আলুটিলা থেকে আরেকটু সামনে গেলে একটা ঝর্ণা দেখতে পাওয়া যায়। আমরা তখনই যাওয়ার জন্য দুপায়ে খাড়া। সুলুকসন্ধান করে জানলাম, আলুটিলা থেকে বাসে মিনিট বিশেক যাওয়ার পর একটা জায়গায় নেমে যেতে হবে। সেখান থেকে পদব্রজে আরো দুই-আড়াই কিলো হাঁটার পর রিছাং ঝর্ণার দেখা মিলবে। তেতে ওঠা মেজাজটা তখন একটু ঠান্ডা হওয়া শুরু করেছে। লোকাল বাসের পা-দানিতে কোনমতে পা রেখে দেখতে না দেখতে আমাদের বাস সটান নামিয়ে দিয়ে গেল। এরপর হাঁটার পালা, তবে সেটাও বেশ চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, আমাদের তাকতেরও বেশ পরীক্ষা হয়ে যাবে। হাঁটার সময় দেখি দূর পাহাড়ে জুম চাষ হচ্ছে,আবার হলুদ না আদা চাষ করা হচ্ছে সেটা নিয়েও আমাদের দুবন্ধুর একপ্রস্থ বাহাস হয়ে গেল। ওদিকে মাঝে খাড়া পাহাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের জিভ বেরিয়ে পড়ল। দম নেওয়ার জন্য একটি ঘরে খানিক বসার দেখি, এতো ছোটখাট দোকানই বটে। এহেন কুস্থানে মিনারেল ওয়াটারের বোতল দেখে আমাদের ধড়ে আসলেই প্রাণ ফিরে এল। তবে ঝর্ণার কাছাকাছি আমরা প্রায় এসে পড়েছি। আর কিছুদুর হাঁটতেই দেখি সামনে কিসের কুলকুল শব্দ শোনা যাছে। মোটামুটি পড়িমরি করেই পরের সিড়িগুলো আমরা ভাঙ্গতে শুরু করলাম। ইয়াহু! রিছাং ঝর্ণায় পৌঁছে গেছি।
যাত্রা তবে শুরু হোক...
যেখানে জিরিয়েছিলাম দুদণ্ড
রিছাং ঝর্ণা একটু আজব কিসিমের, অনেকটা ওপর থেকে ঝর্ণা সশব্দে পড়ছে। আর সেই পানি খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচের জলাশয়ে এসে পড়ছে। ঠাহর করে দেখলাম, আরে পাহাড়ের মাথায় উঠে তো স্লাইড দিয়ে নিচে নামা যায়, কোথায় লাগে এর কাছে ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের বালখিল্য রাইড। তবে ওপরে উঠতে গিয়ে বুঝলাম, কাজটা সহজ নয় মোটেও। এখন সূর্য তেতে উঠলেও খানিক আগের বৃষ্টিতে পাথুরে পাহাড়ের ঢাল বিপজ্জনক রকমের পিচ্ছিল, আমাদের এক কমরেড উঠতে না উঠতেই একেবারে পপাত ধরণীতল। তাও রক্ষে, গোড়ার দিকে হয়েছিল সে যাত্রা বড় কোন অঘটন ঘটেনি। আমিও বারকয়েক আছাড় খেতে খেতে শেষমেশ ইস্তফা দিলাম। ওদিকে আরেকজন কিন্তু তখন রীতিমত আমাদের কাঁচকলা দেখিয়ে স্লাইড দিতে শুরু করে দিয়েছে। তবে আমরা কজন রণে ভঙ্গে দিয়ে নিচেই নেমে আসলাম। নিচে এসে দেখি এখানেও জলকেলির দারুণ বন্দোবস্ত। ঝর্ণার তীব্র জলে গা এলিয়ে দিয়ে আমরা হুটোপুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। গাত্র-প্রক্ষালণ শেষ, এবার ফেরার পালা।
জলকেলি!
মুখ ভার করে থাকা আকাশ
ফেরার পথটা আমাদের সহ্যশক্তির চুড়ান্ত পরীক্ষাই নিয়েছিল। সকালের এক পশলা বর্ষণের পর সূর্য তখন সক্রোধে মাথার ওপর চড়ে বসেছে। খানিক আগেই গোসল সেরেছি, কিন্তু এর মাঝেই ঘামে জামা ভিজে জবজব করছিল। তারওপর ক্রমাগত চড়াই-উৎরাই পেরুনোর হ্যাপা তো আছেই। ওদিকে দুকিলো পথকে মনে হচ্ছিল দুইশ মাইল রাস্তা। এইভাবে কোনমতে চলতে চলতে আবার পানিপানের বিরতি নিয়ে একটু ধাতস্ত হলাম। আমাদের ফেরার কথা আলুটিলা থেকে, বাসের সময় ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। ওদিকে পাদুটো মারাত্মক টনটন করছে, আর ছুঁচোগুলো পেটের ভেতর ডন বৈঠক দিচ্ছে। পাহাড়ের ওপর একটা রিসোর্টে ডিমভাজা, বাঁশের তরকারি আর পরাটা দিয়ে ঝটপট উদরপূর্তি সেরে নিলাম( তবে সাধু সাবধান, ও জায়গায় খাবারের বিল দেখে পাহাড় থেকে বেঘোরে পড়ে গেলে আমায় দুষবেননা যেন)। আকাশ তখন আবার কালো করেছে, একটা তুমুল ঝটকা এলো বলে। ওদিকে আমাদের বাসও এসে পড়েছে, ফের পড়তে শুরু করেছে বৃষ্টিও। আর মাটিরাঙ্গার উঁচুনিচু পথ পেছনে ফেলে আমরা চলেছি চাঁটগার পানে।