Wednesday, November 10, 2010

এবার কাণ্ড খাগড়াছড়িতে-১

পাহাড়পুরেও কিউই! :

কাননবিলাস সেরে সবে চা-পান করে মনমেজাজ তোফা হয়ে গেল, ওদিকে তখন বেলাও প্রায় গড়িয়ে এসেছে, তাই পঞ্চপাণ্ডবের চকিত সিদ্ধান্ত, এবার শহরের ধার থেকে একটু হাওয়া খেয়ে আসা যাক। অটোমামাকে বলতেই তিনি কিছু পথঘাট ঘুরিয়ে আমাদের একটা বেশ খোলামেলা জায়গায় নিয়ে গেলেন। তখন যাকে বলে আসলেই"বৃষ্টি শেষে রুপালী আকাশ", বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল। দেখলাম, জায়গাটাতে গরু-টরু বেশ নির্বিবাদে চরে বেড়াচ্ছে। একজনকে জায়গার নাম শুধাতেই আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। এই (প্রায়) মগের মুল্লুকে এসেও কিউইদের দেখা পাব ভাবিনি। আচ্ছা খোলাসা করেই বলি, বেশ অনেককাল আগে জনৈক প্রবাসী এই স্থানে এসে বলেছিলেন, আরে এ জায়গা তো দিব্যি নিউজিল্যান্ডের মতো ঠেকছে। সেই থেকে জায়গার নাম হয়ে গেল নিউজিল্যান্ড। তখনো শার্দুলদের হাতে পোড়াকপালে কিউইদের ধবলধোলাই হতে হয়নি, না হয় আমরা বেধড়ক মজাই পেতাম। তবে এহেন পাণ্ডববর্জিত স্থানে এসে নিউজিল্যান্ড তীর্থের পরম সৌভাগ্য হয়ে যাবে তা কস্মিনকালেও ভাবতে পারিনি। একটা ছিমছাম ক্যাফেও দেখলাম সেখানে আছে, ওমা, সেটার নামও নিউজিল্যান্ড ক্যাফে। আর যাই হোক, ভেট্টোরি এন্ড কোংকে অমন বেদম ঠ্যাঙ্গানির পর এ জায়গায় ঘুরিয়ে আনা উচিত ছিল, অন্তত হোম সিকনেসটা একটু হলেও প্রশমিত হত বৈকি। ঐ ক্যাফেতে হালকা পেটপুজো সারতে সারতেই দেখি, আলো বেশ মিইয়ে এসেছে। সেদিনকার মত সফরের তাই সেখানেই সমাপ্তি।

ধবলধোলাইয়ের দেশ নিউজিল্যান্ড

40452_1367366901356_1147195504_30874879_7587762_n

ক্যাফেতে বৈকালিক আহার
39103_1532904969915_1453524600_1413452_2440458_n

আলীবাবার গুহায় পাঁচ চোর:

আগেররাতে পাহাড়ি মুরগী ভুনা, কুচো চিংড়ি দিয়ে শশা আর মাছ ভাজা দিয়ে গলা পর্যন্ত উদরপূর্তি করার ফল হিসেবে পরের সকালে আমাদের ঘুম ভাংল ম্যালা দেরিতে। অথচ, সফরের মোদ্দা অংশটাই তখনও বাকি। তড়িঘড়ি করে হালকা প্রাতরাশ সেরে আমরা আলুটিলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। খাগড়াছড়ি মানেই আলুটিলা, এমন একটা ধারণা বহুকাল আগে থেকেই আমার মাথায় জেঁকে বসেছিল। আলুটিলা গুহায় ঢোকার মুখে দেখি মশালটশাল বিকিকিনি হচ্ছে। ভরা বর্ষার মৌসুম, বৃষ্টি থেকে থেকে ভিজিয়ে দিছিল, তবে সেটা উৎপাত মনে হয়নি মোটেও। আমরা কজন ছাড়া এমন বিটকেলে সময়ে সেখানে আর কোন ট্যুরিস্ট দলের নামনিশানাও ছিলনা। যাক ভালই হল, ভাবলাম আমরা, বেশ প্রেমসে গুহাটা চেখেচুখে দেখা যাবে। তবে অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার গন্ধটা মিলিয়ে যেতে দেরি হলনা যখন দেখলাম গুহার প্রবেশমুখ অবদি রীতিমত শান বানানো সিড়ি। বুঝলাম, প্রমোদভ্রমণপিপাপুদের জন্যই মূলত এই ব্যবস্থা। তবে ভয় একটা ছিলই, সেটা ছিল জোঁকের। জোঁকসংহারের জন্য লবণও নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এসব আঁটঘাট বেঁধে কা তব কান্তা বলে গুহায় ঢুকে পড়ি। ভেতরে একরত্তি আলো নেই, পানি কেটে এগুতে হচ্ছিল বটে, কিন্তু সেটা খুব ধর্তব্যের মধ্যে নয়। মনে করেছিলাম, আর কিছু না হোক, নিদেনপক্ষে একটা দুটো রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার না হলে কি চলে? এমনিভাবে মিনিট দশেক ঘোরার পর সামনে দেখি মিহি আলো চুইয়ে পড়ছে। যাব্বাবা, গুহায় ঢুকতে না ঢুকতেই শেষটা দেখে ফেলেছি, তাহলে আর মজাটা রইল কই? মশালটশাল নিয়ে বেশ একটা থ্রিল ফিল করছিলাম, বেমক্কা সূর্যের আলোর নিচে এসে আমরা একে অন্যের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলাম। একি হল, গুহায় ঢোকাই হল সার, আর জোঁকের জুজুতে খামোখাই কুঁকড়ে ছিলাম, জোঁকের পাত্তাই নেই।

আলীবাবার গুহায়-

39103_1532905129919_1453524600_1413456_3653382_n

ঝর্ণা কিন্তু পাহাড়ের কান্নাই বটে:

আলুটিলার সম্ভাব্য রোমহর্ষক সফর এভাবে মাঠে মারা যাওয়ার পর আমরা কেউ কেউ নখ কামড়াচ্ছিল, আর বাকিরা সুখটান দিচ্ছিলাম। মনটা তখন ভীষণ দমে ছিল। হঠাৎ আমাদের চা-সিগারেট সরবরাহকারী মামার মুখে শুনলাম, আলুটিলা থেকে আরেকটু সামনে গেলে একটা ঝর্ণা দেখতে পাওয়া যায়। আমরা তখনই যাওয়ার জন্য দুপায়ে খাড়া। সুলুকসন্ধান করে জানলাম, আলুটিলা থেকে বাসে মিনিট বিশেক যাওয়ার পর একটা জায়গায় নেমে যেতে হবে। সেখান থেকে পদব্রজে আরো দুই-আড়াই কিলো হাঁটার পর রিছাং ঝর্ণার দেখা মিলবে। তেতে ওঠা মেজাজটা তখন একটু ঠান্ডা হওয়া শুরু করেছে। লোকাল বাসের পা-দানিতে কোনমতে পা রেখে দেখতে না দেখতে আমাদের বাস সটান নামিয়ে দিয়ে গেল। এরপর হাঁটার পালা, তবে সেটাও বেশ চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, আমাদের তাকতেরও বেশ পরীক্ষা হয়ে যাবে। হাঁটার সময় দেখি দূর পাহাড়ে জুম চাষ হচ্ছে,আবার হলুদ না আদা চাষ করা হচ্ছে সেটা নিয়েও আমাদের দুবন্ধুর একপ্রস্থ বাহাস হয়ে গেল। ওদিকে মাঝে খাড়া পাহাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের জিভ বেরিয়ে পড়ল। দম নেওয়ার জন্য একটি ঘরে খানিক বসার দেখি, এতো ছোটখাট দোকানই বটে। এহেন কুস্থানে মিনারেল ওয়াটারের বোতল দেখে আমাদের ধড়ে আসলেই প্রাণ ফিরে এল। তবে ঝর্ণার কাছাকাছি আমরা প্রায় এসে পড়েছি। আর কিছুদুর হাঁটতেই দেখি সামনে কিসের কুলকুল শব্দ শোনা যাছে। মোটামুটি পড়িমরি করেই পরের সিড়িগুলো আমরা ভাঙ্গতে শুরু করলাম। ইয়াহু! রিছাং ঝর্ণায় পৌঁছে গেছি।

যাত্রা তবে শুরু হোক...

39103_1532905649932_1453524600_1413469_7455060_n

যেখানে জিরিয়েছিলাম দুদণ্ড

39103_1532905369925_1453524600_1413462_7762065_n

রিছাং ঝর্ণা একটু আজব কিসিমের, অনেকটা ওপর থেকে ঝর্ণা সশব্দে পড়ছে। আর সেই পানি খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচের জলাশয়ে এসে পড়ছে। ঠাহর করে দেখলাম, আরে পাহাড়ের মাথায় উঠে তো স্লাইড দিয়ে নিচে নামা যায়, কোথায় লাগে এর কাছে ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের বালখিল্য রাইড। তবে ওপরে উঠতে গিয়ে বুঝলাম, কাজটা সহজ নয় মোটেও। এখন সূর্য তেতে উঠলেও খানিক আগের বৃষ্টিতে পাথুরে পাহাড়ের ঢাল বিপজ্জনক রকমের পিচ্ছিল, আমাদের এক কমরেড উঠতে না উঠতেই একেবারে পপাত ধরণীতল। তাও রক্ষে, গোড়ার দিকে হয়েছিল সে যাত্রা বড় কোন অঘটন ঘটেনি। আমিও বারকয়েক আছাড় খেতে খেতে শেষমেশ ইস্তফা দিলাম। ওদিকে আরেকজন কিন্তু তখন রীতিমত আমাদের কাঁচকলা দেখিয়ে স্লাইড দিতে শুরু করে দিয়েছে। তবে আমরা কজন রণে ভঙ্গে দিয়ে নিচেই নেমে আসলাম। নিচে এসে দেখি এখানেও জলকেলির দারুণ বন্দোবস্ত। ঝর্ণার তীব্র জলে গা এলিয়ে দিয়ে আমরা হুটোপুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। গাত্র-প্রক্ষালণ শেষ, এবার ফেরার পালা।

জলকেলি!

38930_1367381221714_1147195504_30874972_5834575_n

মুখ ভার করে থাকা আকাশ

39103_1532905689933_1453524600_1413470_7712217_n

ফেরার পথটা আমাদের সহ্যশক্তির চুড়ান্ত পরীক্ষাই নিয়েছিল। সকালের এক পশলা বর্ষণের পর সূর্য তখন সক্রোধে মাথার ওপর চড়ে বসেছে। খানিক আগেই গোসল সেরেছি, কিন্তু এর মাঝেই ঘামে জামা ভিজে জবজব করছিল। তারওপর ক্রমাগত চড়াই-উৎরাই পেরুনোর হ্যাপা তো আছেই। ওদিকে দুকিলো পথকে মনে হচ্ছিল দুইশ মাইল রাস্তা। এইভাবে কোনমতে চলতে চলতে আবার পানিপানের বিরতি নিয়ে একটু ধাতস্ত হলাম। আমাদের ফেরার কথা আলুটিলা থেকে, বাসের সময় ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। ওদিকে পাদুটো মারাত্মক টনটন করছে, আর ছুঁচোগুলো পেটের ভেতর ডন বৈঠক দিচ্ছে। পাহাড়ের ওপর একটা রিসোর্টে ডিমভাজা, বাঁশের তরকারি আর পরাটা দিয়ে ঝটপট উদরপূর্তি সেরে নিলাম( তবে সাধু সাবধান, ও জায়গায় খাবারের বিল দেখে পাহাড় থেকে বেঘোরে পড়ে গেলে আমায় দুষবেননা যেন)। আকাশ তখন আবার কালো করেছে, একটা তুমুল ঝটকা এলো বলে। ওদিকে আমাদের বাসও এসে পড়েছে, ফের পড়তে শুরু করেছে বৃষ্টিও। আর মাটিরাঙ্গার উঁচুনিচু পথ পেছনে ফেলে আমরা চলেছি চাঁটগার পানে।

Thursday, November 4, 2010

নোলানের খোয়াবনামা

১.

স্বপ্ন নিয়ে কাঁটাছেড়া এ পর্যন্ত নেহায়েত কম হয়নি, কিন্তু সত্যি করে বললে তার কতটুকুই বা আমরা জানি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বলা যায় স্বপ্নের কথা প্রায়ই আমার মনে থাকেনা, আর যেটুকুও মনে থাকে সেটুকুও বোধহয় অনেকটাই আটপৌরে। কোন উঁচু স্থান থেকে নিচে পড়ে যাওয়া, পরীক্ষার হলে সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে অথচ একটি প্রশ্নের উত্তরও ঠিকঠাক দিতে পারছিনা বা কোন কিছু আমাকে তাড়া করছে, আমি ক্রমাগত ছুটছি- এসব স্বপ্নই ঘুরেফিরে আমার ঘুমে হানা দেয়। মজার ব্যাপার হল, আচমকা যখন ঘুম ভেঙ্গে যায় তখনই স্বপ্নটা মাথায় গেঁথে থাকে। একটু তলিয়ে দেখতে গিয়ে জানলাম, আমাদের ঘুমের একটা সুনির্দিষ্ট স্তরেই এই স্বপ্ন দেখার কাজটা ঘটে। এই স্তর আবার ঘুমের মাঝেই বেশ কবার ঘটে থাকে। তো এই পর্যায়ে এসে যখন ঘুমটা কেঁচে যায় তখনই ওই স্বপ্নটা ছাপ রেখে যায়। এজন্যই বোধহয় আমাদের সুখস্বপ্নগুলোর স্মৃতি খুব একটা মনে থাকেনা, অথচ দুঃস্বপ্নের স্মৃতি সবারই কমবেশি থেকে থাকে।

২.

স্বপ্নের নিখুঁত ঠিকুজির সুলুকসন্ধান বিজ্ঞানীরা এখনো ঠিক পাননি, এক্ষেত্রে আবার নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ এমনকিও একথাও ঠাউরে থাকেন, স্বপ্ন আদপে এক ধরনের ঐশীবাণীই বটে। তাদের মতে, স্বপ্নই এক অজানা জগতের সাথে আমাদের যোগাযোগের চাবিকাঠি। এমন দাবি হয়তো অনেকের কাছেই কষ্টকল্পনা ঠেকবে, কিন্তু ওবিই বা আউট অফ বডি এক্সপেরিয়েন্সের কথা মাথায় রাখলে এক লহমায় এ দাবি উড়িয়ে দেওয়া যায়না। অনেকেই হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কাজগুলোর অনুভূতি অনেকসময় স্বপ্নে বেশ প্রকট হয়ে ওঠে। ধরা যাক, আপনি স্বপ্নেই কোন জায়গা থেকে পড়ে যাচ্ছেন, ওই মুহুর্তে কিন্তু আপনার অনুভূতি পুরোটাই ভয়াবহ রকমের জান্তব, অথচ পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু আপনার ঘুমের মাঝেই ঘটছে। দেহ থেকে আত্মার এই সাময়িক বিচ্ছেদের সময় এই ধরনের অভিজ্ঞতার গোমরটা আসলে তাহলে কোথাও? এই প্রশ্নের উত্তরও ব্যাপকই ঘোলাটে, এ বিষয়ে গবেষণা এখনও জোরেসোরে চলছে, তাই বিভিন্ন তত্ত্বের কথা বলা হলেও একেবারে চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা এখনো কোনটি পায়নি। কেউ কেউ বলে থাকেন, আমাদের চেতনা দেহ থেকে ভিন্ন একটি সত্ত্বা বা বলা ভাল দেহবিহীন চেতনা এবং চেতনাবিহীন দেহ দুই-ই সম্ভব। এই জন্যই দেহবিচ্ছিন্ন হয়েও স্রেফ আমাদের চেতনার কারণে আমরা স্বপ্নের মাঝেও স্বাদ, গন্ধ, স্পর্শের মত অনুভূতিও পেতে পারি। তবে এটা একটা থিওরি মাত্র, এরকম এন্তার থিওরি আছে এবং সেগুলো নিয়ে আগাপাশতলা ব্যবচ্ছেদ আজ অবধি জারি রয়েছে। আরেকটা কথা বলে রাখা ভাল, স্বপ্ন পারলৌকিক বা অন্য জগতের সাথে মেলবন্ধনের যোগসূত্র এমনটা যারা ভেবে থাকেন, তাদের মতে স্বপ্ন আসলে জাগরণেরই বিকল্প একটি রুপ। কিন্তু এই যুক্তি খোঁড়া মনে হয় একারণে যে , স্বপ্ন আসলে অবচেতন মনেরই একটা দশা মাত্র, আর স্বপ্নের সময় আমাদের ব্রেইনের সংকেতগুলো এ ধারণাই দেয়।

৩.

একটা মজার ঘটনার কথা বলি। আমাদের এক বন্ধু বলছিল তার স্বপ্নের কথা। মাসতিনেক আগে সে স্বপ্ন দেখে সে কয়েকজন অচেনা ছেলের সাথে একটা হোটেলের কামরায় আড্ডায় মশগুল। ঐ সময় আচমকা তার ঘুম ভঙ্গে যায়। পরে তার রুমমেটকে সে ওই স্বপ্নের বয়ান দেয়। মজার ব্যাপার হল, ঠিক কদিন আগে আমাদের বান্দরবান ট্যুরে ঐ বন্ধুই আরো কজনের সাথে এক কামরায় রাত কাটায়। বলাই বাহুল্য, তাদের পরিচয়টা ওই ট্যুরেই পয়লা ঘটেছিল। স্বপ্নের অলোকদর্শন ক্ষমতার এমন নজির খুব বেশি বিরল নয়। আর এ ধরনের প্রোফেটিক স্বপ্নের জন্যও স্বপ্ন নিয়ে বিভিন্ন উদ্ভট থিওরি হালে পানি পেয়ে যায়। অলোকদর্শন (যদি ব্যাপারটা আসলেই থেকে থাকে) স্বপ্নের একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষংগ, সমস্যা হল নিতান্তই কাকতাল বলে এ ধরনের স্বপ্নকে হয়তো কনফার্মেশন বায়াস বা অন্যকোন পরিসংখ্যানের গেরোয় ফেলে দিয়ে দিব্যি নাকচ করা যায়, তাই বলে ব্যাপারটা কি আদতেই এক লহমায় উড়িয়ে দেওয়া যায় কি?

৪.

বলতে দ্বিধা নেই, স্বপ্ন নিয়ে এসব ভাবনার খোরাক পয়লা পাই গুনী ফিল্মমেকার ক্রিস্টোফার নোলানের সাম্প্রতিকতম ছবি "ইনসেপশন" দেখার পর। প্রেস্টিজ, মেমেন্টো, ডার্ক নাইটের মত বহুল পরিচিত বা ফলোয়িং এর মত স্বল্প পরিচিত সিনেমাগুলো দেখার পর এমনিতেই নোলানের ভক্ত বনে গিয়েছিলাম, তাই ইনসেপশন নিয়ে কৌতূহলের পারদটা খুব চড়াই ছিল। হাতের কাছে পাওয়া মাত্র দেখে ফেলতে তাই কসুর করিনি মোটেই। সিনেমাটি তুঙ্গে ওঠা সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছে কিনা এমন সওয়ালের জওয়াব দেওয়ার আগে স্বপ্ন নিয়ে নোলানের চিন্তাভাবনাটা একটু বলা দরকার। ইনসেপশনের ধারণা নোলান অনেকদিন ধরেই পেলেপুষে বড় করেছিলেন, তবে ঠিক কীভাবে এটাকে ফুটিয়ে তুলবেন সেটা নিয়ে শুরুতে তার মনে একটু দ্বিধাই ছিল। ভাবনাটা দানা বাঁধতে শুরু করে যখন নোলান এমন একটা জগতের কথা কল্পনা করেন যেখানে সবার স্বপ্নগুলো একটি অবিচ্ছিন্ন স্বপ্নরাজ্যে মিশে একাকার হয়ে আছে। সম্পূরক চিন্তা হিসেবে তার মাথায় তখনই আসে, আরে তাই যদি হতো, তবে স্বপ্ন নিয়ে নয়-ছয়ও হতে পারে বৈকি। মোদ্দা কথা হল, ইনসেপশনের মূল যে বুনিয়াদ, অর্থাৎ স্বপ্নচুরির আইডিয়া তখনই তার মাথায় আসে। নোলানের এই স্বপ্নবাজি শুরু হয় ষোল বছর বয়েসে, যখন এক ল্যুসিড ড্রিমের পর তার মাথায় এই চিন্তা আসে। নোলান অবশ্য বলতে কসুর করেননি, বোর্হেসের লেখা পড়ে তিনি এই দুরুহ কাজে হাত দিতে বেশ ভাল রকমের প্রণোদিত হন।

বলা যায়, এই ভাবনা অঙ্কুরিত হতে বেশ সময় নিয়েছে। গোড়ায় তো নোলান ভেবেই রেখেছিলেন ম্যুভিটা হবে ভৌতিক আবহের। কিন্তু হরর ম্যুভিগুলোর সেই চিরকালীন সমস্যা- আবেগ বা অনুভূতিগুলো শেষমেশ খেলো হয়ে যাওয়ার কারণে এই ধারণা থেকে তিনি সরে আসেন। এইখানে অবশ্য আমি নিজে নোলানকে বাহবা দেব, কারণ স্বপ্নের মত একটা দুর্বোধ্য ভাবনা লালনা করার জন্য হরর ব্যাকগ্রাউন্ড আদপেই ঠিক যুতসই হয়না। এভাবে বছর দশেক ব্যয় হয় স্ক্রিপ্টটাকে ঠিকঠাক করে মূল ব্যাপারগুলোকে একসুতোয় গাঁথার জন্যে। এটাও মেলা আগের কথা, ঠিকঠাক বললে ২০০১ সালের দিকে। তবে তখনই ঠিক করেন সিনেমাটা তিনি রয়েসয়ে বড়সড় বাজেট নিয়ে বানাবেন। স্বপ্নে কিন্তু মানুষ এক নিমেষে অসাধ্য সাধন করতে পারে, আর মানুষের মনের ক্ষমতার দৌড় কদ্দুর, তা নিয়ে আজ অবধি কোন সঠিক মাপজোখ পাওয়া যায়না। শেষমেশ নোলান ঠিক করেন, স্বপ্ন নিয়ে কারবার করতে হলে বিশাল একটা স্কেলেই কাজ করা সমীচীন। আজ তাই দীর্ঘদিনের স্বপ্নবাজির ফসল আজকের ২০১০ সালের ইনসেপশন।

৫.

যাই হোক, একজন দর্শক হিসেবে যদি বলি, সিনেমাটা দেখতে গিয়ে কোথাও টাল খেতে হয়নি, পুরো সময়টা জুড়েই রোলারকোস্টারে চড়ার মত একটা টানটান উত্তেজনার স্বাদ পেয়েছি, একথা বলতেই হবে। তবে স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন ব্যাপারটা আমাকে আসলেই তাজ্জব করে দিয়েছে। স্বপ্নের ভেতর আরেকটা স্বপ্নের কথা না হয় মানা গেল, কিন্তু তার ভেতরেই আরেকটা স্বপ্ন? ব্যাপারটা কিঞ্চিত ঠাহর করতে পারতেই আমার মাথায় যে প্রশ্নের উদয় হল, এই দ্বিতীয় স্তরের মাঝেই আরেকটা স্তরও কি অসম্ভব? আদতে নোলান কিন্তু তাই দেখালেন, আর এটাই দর্শকের একটা পেলব অনুভূতির রেশ কাটিয়ে মাথার ভেতর ভাবনার ঝড়ে বইয়ে দেওয়ার নোলানের নিজস্ব কারিকুরি। আর কিছু কিছু ব্যাপার, যেমন স্বপ্নের স্তরগুলোর গভীরতা যতই বাড়তে থাকবে ততই তাদের সময়ের ব্যপ্তিও বাড়তে থাকবে। সোজা কথায় বললে বাস্তবে যখন আমরা ঘুমের যে সময়টুকু নিয়ে স্বপ্ন দেখি, তার স্থায়িত্বকাল কিন্তু খুবই কম। কিন্তু ওই সময়েই স্বপ্নের ব্যপ্তিকাল অনেক বেশি। এ ব্যাপারগুলো মোটামুটিভাবে অনেকের কাছে বোধগম্য, ম্যুভি দেখার সময় কোন জগতটা বাস্তব আর কোন জগতটা স্বপ্নের, আর স্বপ্নের হলেই এর কোন স্তরের এ নিয়ে কোন খটকায় অন্তত আমাকে পড়তে হয়নি। তবে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, স্তরগুলো নিয়ে ঘোরতর কুহক নোলান বুঝেশুনেই এড়িয়ে গেছেন, অন্তত এই ক্ষেত্রে তিনি দর্শককে ঘোল খাওয়াতে চাননি চিনি।

একইভাবে স্বপ্ন ছিনতাই বা স্বপ্নের মাঝে আরেকটা ভাবনার বীজ বুনে দেওয়ার ব্যাপারটাও নোলানীয় কারদানিই বটে। স্বপনের ভেতরকার জগতটাকে গড়ে তোলা ও নিয়ন্ত্রণ করার মত বিটকেলে ব্যাপারগুলোও নোলান আশ্চর্য দক্ষতায় দেখিয়েছেন। সিনেমার কাহিনি মূলত এ নিয়েই, ডমিনিক কবের(লিওনার্দো দি ক্যাপ্রিও) নেতৃত্বে একদল কর্পোরেট স্পাইয়ের স্বপ্ন চুরির মিশনের ওপর ভর করেই কাহিনি এগি্যেছে। বলাই বাহুল্য, ব্যাপারটা এত সরল আর থাকেনা, ধীরে ধীরে এক জটিল আবর্তে তারা সবাই বাঁধা পড়ে যায়। তারপর...থাক, কাহিনির বয়ানে আর না যাই, সে গপ্পো পরেও ফেঁদে বসা যাবে। তবে একটা কথা না বললেই নয়, কাহিনিতে কবের স্ত্রী মলের(ম্যারিওন কোটিয়ার্ড) ভূমিকা শুরুতে খুব একটা প্রকট না থাকলেও শেষমেশ কিন্তু এই চরিত্রটির উপস্থিতি আলাদাভাবে ঠাহর করা গেছে। আর যে বারদুয়েক আমি সামান্য সময়ের জন্য ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম, সেটাও ওই মলকে নিয়ে তৈরি করা ধোঁয়াশার কারণেই।

সত্যি করে বললে , সিনেমাটির অসাধারণ কন্সেপ্ট বাদ দিলে আলাদাভাবে উচ্চকিত হওয়ার খুব বেশি কিছু বোধহয় নেই। সিনেমার একেবারে শেষের দৃশ্যের হালকা রহস্য ছাড়া তব্দা খেয়ে যাওয়া নোলানীয় মোচড়ও দেখা পাওয়া ভার, তবে আমার নিজস্ব খেদ থেকে থাকবে এই কারণে এই দুর্দান্ত আইডিয়াটার শেষটা একটু জোলোই হল। স্বপ্নবাজির ব্যাপারগুলো স্তব্ধ করে দেওয়ার মতই ছিল, থ্রিলটাও ছিল পুরোদমে, কিন্তু ওই যে নোলানীয় সিগনেচারটা ঠিক যেন দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। তবে নোলানের আত্মপক্ষ সমর্থনে কিন্তু এই জিনিসটাই চলে আসে, তিনি অকপটে স্বীকার করেন এই সিনেমা দেখতে গিয়ে দর্শকদের কোন জট না ছাড়ানো জটিল ধাঁধার সন্ধান দেওয়া তার অভিপ্রায় ছিলনা মোটেই। তাই নোলান নিজেই যখন বলেন, সিনেমাটা আসলে একটা রোলার কোস্টার রাইড, আর ব্যাপার আসলে একটাই, রাইডটাকে স্রেফ উপভোগ করা- তখন আমাদের আশায় তিনি আক্ষরিক অর্থেই জল ঢেলে দেন। তবে স্বপ্ন নিয়ে আমার ভাবনাগুলোকে উস্কে দেওয়া জন্য নোলান একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন বৈকি।

ফুটনোটঃ শুরুতে স্থির করেছিলাম, ইনসেপশন নিয়ে একটা গোছানো রিভিউই লিখব, পরে রিভিউ লিখতে গিয়ে পাছে বেরসিক স্পয়লার অ্যালার্টের উটকো খপ্পরে পড়ে যাই, সে চিন্তায় ওই প্রজেক্টে ইস্তফা দেই। শেষমেশ পোস্টটা দাঁড়ালো স্বপ্ন নিয়ে কিছু উড়ুক্কু বাতচিতের গপ্পো।

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...