Sunday, May 30, 2010

চর্মগোলকের সাথে বসবাস-২

ক্লাশ টেনের কথা।স্কুলের চৌকাঠ পেরুবো পেরুবো করছিলাম।পড়াশোনার হালকা পাতলা চাপও ছিল।স্যারদের কাছে প্রাইভেট তো দূরে থাক ,মায় স্কুলের ক্লাস কামাই করাটা রীতিমত দুষ্কর ছিল।ক্যাণ্ডিডেট ব্যাচ বলে স্যাররা আমাদের ওপর একেবারে শ্যেন দৃষ্টি রাখতেন,একদম এদিক ওদিক করার সুযোগ দিতেননা।ক্লাস শেষে তাই খেলার মাঠে দাপিয়ে বেড়ানোর মওকাও খুব একটা মিলতনা।সব মিলে বেশ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা,কদিন পরেই আমরা দস্তুরমত হাঁপিয়ে উঠলাম,আর কিছু করার জন্য ফন্দি ঠাওরাতে লাগলাম।স্যার কিন্তু আমাদের নিয়ম করে ধমকাতেন ,"ক্লাস শেষে কাউকে যাতে রাস্তায় না দেখি,একেবারে সোজা বাসায় চলে যাবি"।কিন্তু ব্যাপারটা হয়ে গেল অনেকটা পাগলকে সাঁকো নাড়তে নিষেধ করার মতই ,আমরাও নিয়ম করে গুরুর অমোঘবাণীকে কাঁচকলা দেখিয়ে প্রায়ই স্কুলের মাঠে গিয়ে আড্ডা জুড়ে দিতাম,নয় মোড়ের চায়ের দোকানে গিয়ে গুলতানি মারতাম। কিন্তু খেলাটা আর হয়ে উঠছিলনা মোটেই।ওদিকে সকালে স্কুল ,বিকেলে স্যারের বাসা,সবমিলিয়ে দুষ্ট ছেলের দলের অবস্থা তখন বেশ সঙ্গীন।


তো পরীক্ষা কাছে আসতেই স্কুলও একদিন ছুটি হয়ে গেল।উপরি লাভ হল এই ,স্যারের কাছে বিকেলের বদলে সকালে হাজিরা দিতে লাগলাম।তখন বর্ষাকাল। না বলে কয়েই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে যেত।এম্নি একদিনে তুমুল বৃষ্টিতে বর্ষাতি মাথায় দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম,গন্তব্য ওই স্যারের বাসা।আকাশের মুখ বেশ কালোপানা,আর আমার মুখ ঢের কালো।এই বাদলা দিনেও অঙ্ক ঠেঙ্গিয়ে বেড়াতে হবে,হুহ !স্যারের বাসায় এসে অবশ্য মেজাজটা বিলকুল তোফা হয়ে গেল।একগাল হেসে বন্ধু বলল,স্যারের কোন আত্মীয় নাকি মারা গেছেন ,তাই স্যার আজ পড়াবেননা।আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার আসল মাজেজা সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম।এক দোস্ত প্রস্তাব দিল,চল,মাঠে যাই।সবাই একবাক্যে রাজি।মাঠে গিয়ে দেখি অবস্থা বেগতিক।সারা মাঠ পানিতে পুরোপুরি সয়লাব,কিন্তু আমাদের দমাবে তখন কার সাধ্যি,আর মাঠ যেমনি হোক,খেলাটা মাঠে মারার যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠেনা।হাঁটু গুটিয়ে সবাই নেমে পড়লাম মাঠে।অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে,আর আমারা সমানে বলে লাথি মেরে চলছি।পজিশনিং এর কোন বাছবিচার নেই,পাসিং এর কোন লেশমাত্র নেই ,শুধু বল পেলেই ধুন্দুমার লাথি মারা।সে এক বিচিত্র অবস্থা।মাঠ হয়ে ছিল ভয়াবহ পিচ্ছিল,আর দৌড়াতে গিয়ে একেকজন চিতপ্টাং হচ্ছিল নিয়িমিত বিরতিতে।তাতেও কারো কোন বিকার নেই।বলটাকে প্যাদাতে তখন সবাই পাগলপারা।একটু একটু করে অবশ্য খানিক বাদে বৃষ্টি ধরে এল।আমরা অবশ্য তখনও খেলায় ইস্তফা দিইনি।তবে খানিক দূরব থেকে একটা মোটর সাইকেলের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম।কাছে আসতে কেমন যেন পরিচিত ঠেকছিল ,তবে খেলার জোশে তখন ঠাহর করতে পারছিলামনা।আচমকা গেট দিয়ে মোটর সাইকেল ঢুকতেই আমাদের হুঁশ হল,সবাই ব্যাগ নিয়ে পড়িমড়ি করে দে ছুট।আমিও চোঁ চোঁ করে দৌড় লাগালাম।

স্যার তখন পেছন থেকে সমানে চেঁচিয়ে চলছেন,"ওই রাস্কেলের দল,হল্ট,হল্ট"।রাগলে আবার স্যারের মুখ দিয়ে বাংলা বের হয়না কিনা !!

Monday, May 24, 2010

চর্মগোলকের সাথে বসবাস

তখন পড়তাম ক্লাস ওয়ানে ,বয়স আর কতই বা হবে ,বড়জোর ছয়।সালটা ১৯৯৪।এমনিতে আলাদাভাবে বছরটিকে মনে রাখার মত খুব একটা কারণ নেই । কিন্তু এতদিন বাদে আজ হঠাৎ সেই নাবালক বয়সের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানোরও কারণ আছে বৈকি ।তখনই যে ঠিকঠাক চিনতে শিখেছিলাম সাদা কালো চর্মগোলকটিকে! আর মোটামুটি হলফ করে বলা যায় ,ফুটবলের সাথে আমার গাঁটছড়া বাঁধার শুরুটাও ওই বছরেই। বছরটা বিশ্বকাপের।তবে বিশ্বকাপ কী বস্তু সেটা ভালমত ঠাউরে উঠতে পারিনি তখনো। শুধু ভাসাভাসা মনে পড়ে,মাঝরাতে বাবা-চাচার আচমকা গোল বলে চিৎকার করে ওঠা,পরিণামে ঘুম ঘুম চোখে আমার পিটপিট করে খানিক টিভির দিকে তাকিয়ে থাকা ,এবং চোখ খোলা রাখার প্রাণপণ প্রয়াস সত্ত্বেও খানিক বাদেই ফের ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যাওয়া। বলা যায় ,গোল শব্দটার সাথে আমার পরিচয়ও তখনই। বলতে কসুর নেই ,এতসব কেচ্ছার কিছু কিছু মায়ের মুখেই শোনা।

ওই বছর প্রথমবারের মার্কিন মুলুকে বিশ্বকাপের আসর বসে। আমাদের সাথে তাদের সময়ের ব্যবধান দুস্তর ,তাই খেলার সময়সূচী ছিল খানিকটা বেকায়দা গোছের ,বেশিরভাগ খেলাই হত মাঝরাত্তিরে ।এহেন বেমক্কা সময়ের খপ্পরে পড়েও নাকি আমার ফুটবল পাগল বাবা-চাচারা নিরস্ত হতেননা,পরের দিনের অফিসের চোখরাঙ্গানিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সেই মাঝরাতেই আমাদের আটপূরে বৈঠকখানায় একেবারে ধুন্দুমার লেগে যেত। বাবা ছিলেন ব্রাজিলের সাপোর্টার ,মামা -চাচারা আর্জেন্টিনা।তবে যুদ্ধংদেহী ভাব যেটাকে বলে ,তেমনটা খুব একটা দানা বেঁধে উঠতে পারেনি ড্রাগ কেলেংকারীতে ম্যারাডোনার জড়ানো ,এবং পরিণামে আর্জেন্টিনার চটজলদি পাততাড়ি গোটানোই হয়ত ছিল এর কারণ।

তবে সত্যিকারের ফুটবল ফ্যানাটিক(আজকের দিনে যাদের হুলিগান নামের গালভরা নামে ডাকা হয় !) ছিলেন আমার ছোট চাচা। তাকেই আমি প্রথম দেখেছি ব্রাজিল আর্জেন্টিনার বাইরে অন্য দলকে সমর্থন দিতে,তাও আবার যেনতেন নয় ,একেবারে পাঁড় সমর্থক।নেদারল্যান্ডের আগাপাশতলা ভক্ত ছিলেন তিনি,ওই সময় থেকেই ইউরোপিয়ান ফুটবলের নিয়মিত খবরাখবর রাখতেন। কোয়ার্টার ফাইনালে নাকি নেদারল্যান্ড ব্রাজিলের কাছে হেরে যাওয়ায় ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলেন।টোটাল ফুটবল টার্মটাও তার মুখ থেকেই প্রথম শোনা,পরে বেশ বড় হয়েও এর অর্থ জেনেছিলাম।আমার ফুটবলাসক্তির হাতেখড়িটা মূলত তার হাত ধরেই ,মাঠে গিয়ে টুকটাক বলে লাথি মারতে শেখাটাও।

স্বাভাবিকভাবেই , ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার তুমুল দ্বন্দ্ব ঠাহর করার তাকত ওই বয়সে তখনো হয়নি ,তখন আমি যে দলের পোশাক মনে ধরত ,তাকেই নির্বিবাদে সমর্থন দিয়ে যেতাম।তবে ওই বিশ্বকাপের একটা ঘটনার কথা আমার এখনো পষ্ট মনে পড়ে। তখন বিটিভির রাত আটটার খবর বাসায় দেখা হত ,একদিন খেলার সংবাদে দেখি সাদা-সবুজ জার্সি পড়া মিশমিশে কালো এক লোক বল নিয়ে ছুটছে তো ছুটছেই,মাঠের মাঝ বরাবর থেকে বল নিয়ে কীভাবে কীভাবে যেন বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের পাশ কাটিয়ে বলটি জালেও জড়িয়ে দেয়। অমন খ্যাপাটে দৌড় তখন পর্যন্ত আমি আর দেখিনি (এখনও এমন দৌড় খুব একটা দেখা যায়না) ,আর বলাই বাহুল্য সৌদি আরবের সাইদ আল ওয়াহরাইনের দেওয়া সেই অতিমানবীয় গোল আমার মনে রাখা প্রথম কোন গোলের স্মৃতি।

পরে বড় হয়ে যখন ৯৪ বিশ্বকাপের গোলগুলোর ক্লিপিংস দেখি ,তখন আলটপকা চোখের সামনে কিছু কিছু মুহুর্তের ঝাপসা কায়া ভাসতে থাকে, আর আমিও প্রথম প্রেমের মতই প্রথম বিশ্বকাপের ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি ,নিজের অজান্তেই স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠি।

অতঃপর এক্সাম ফোবিয়া .........

ঘটনা ১ ঃ


আহসানউল্লাহ হলের পেছনে একটা বেশ বড়সড় উঠোনের মত জায়গা আছে।এমনিতে ও পথটা কেউ খুব একটা মাড়ায়না,কিন্তু ওইদিন বেশ একটা জটলামত দেখা যাচ্ছিল।ব্যাপারখানা হোল,এক ছেলে কোন কারণ ছাড়াই গাছে উঠে বসে আছে তো আছেই,আর নামার নাম করে না।খানিক বাদে হন্তদন্ত হয়ে প্রভোস্ট নিজেই হাজির।

"এই ছেলে গাছে কি,নেমে এসো বলছি",প্রথমে উনি বেশ হুমকি ধ্মকি দিচ্ছিলেন।কিন্তু বিধিবাম,কোন লাভ হলোনা।ব্যাটা মুখে রা ও কাড়ে না।নিচে তখন আগ্রহী ছাত্রদের হল্লা ক্রমেই বাড়ছে।সবাই ফিসফাস ,কানাকনি করছে।কিন্তু থলের বেড়াল আর বেরোয়না,আসল ব্যাপারখানাও কেউ আঁচ করতে পারেনা।

এবার প্রভোস্ট পরিস্থিতি বুঝে সুর নরম করে ফেলেন।বেশ মোলায়েম কন্ঠে বলেন,"বাবা,ওখানে আর কতক্ষণ থাকবে।অনেক সময় তো কেটে গেল।এবার নেমে এস,তোমার বাবা মা আসছে তোমাকে নিতে।"

এরক্ষণ ছেলেটি মোটামুটি নির্বিকার ছিল,এবার সে একটু চোখ পিটপিট করে তাকাল।হঠাৎ সমবেত জনতাকে হতভম্ব করে দিয়ে সে বলে বসল,

"স্যার ক্লকওয়াইজ নামব না অ্যান্টিক্লকওয়াইজ ?"


ঘটনা ২ ঃ

রশিদ হলের এক অজ্ঞাত ফ্লোরের বারান্দা ।সকাল হয়েছে কি হয়নি।ভোরের পাখিরাও ওঠেনি তখনো।এক বিদগ্ধ বুয়েটিয়ান পড়ার টেবিল থেকে মাত্র উঠলো।সারারাত থার্মোডায়ানামিক্স ভাজাভাজা করে ফেলার মহানন্দে রাত জাগার অবসাদও তখন তার কাছে নস্যি।এবার তার মনে হোল,এবার গোসল টোসল করে ভাল একটা ঘুম দেওয়া যাবে।তো ভালভাবে শরীর প্রক্ষালণ শেষে রুমে গিয়ে বসার পর তার রুমমেটরা আবিষ্কার করল,সে অনাবৃত নিম্নাঙ্গেই রুমে চলে এসেছে!

ঘটনা ৩ ঃ

আবুল।এমনিতে ছেলেটিকে আর দশটা ছেলের চেয়ে আলাদা করাটা একটু মুশকিল,টিপিক্যাল ছাত্রদের মতই ক্লাস করে, খায় দায় ,টিউশনি করে ।কিন্তু বছরের বিশেষ একটা সময়ে তার ওপর সিন্দাবাদের না হলেও কোন এক অজানা কিসিমের ভূত যেন চেপে বসে।কথাবার্তা তখন তার নিতান্তই অসংলগ্ন,মাঝে মাঝে সামান্য কথাতেই জোরে হেসে ওঠে,আর বেশ খানিকক্ষণ সে হাসি থামার নামগন্ধও থামেনা ।

ঘটনাগুলো আপাতদৃষ্টিতে বিক্ষিপ্ত,বেশ কসরৎ করলেও কোন ধরনের যোগসূত্র বের করাটা একটু ফ্যাসাদই বটে।তবে একটা জায়গায় বেশ ভাল মিল আছে,ঘটনাগুলোর সব কয়টা কিন্তু টার্ম ফাইনালের সময়ের।বলাই বাহুল্য,তাদের এই পরিণতি টার্ম ফাইনাল নামক ভয়াবহ মেন্টাল টর্চারেরই ফসল।

(এখানে বলে রাখা ভাল,এসব কাহিনী কিন্তু পুরোদস্তুর অসমর্থিত সূত্র থেকে প্রাপ্ত,এই ব্লগে বা অন্য কোথাও কারো সাথে মিলে গেলে তার দায়ভার কিন্তু এই অধমের ওপর বর্তাবেনা।তবে আরো একটা ফুটনোট,সব কয়টি আখ্যানই অত্র এলাকায় কিংবদন্তী,তাই এসব কেচ্ছার বয়সের গাছপাথর নিরূপণ করাও এখন দুষ্কর বৈকি।)

বলছিলাম টার্ম ফাইনালের কথা।সূর্য মাত্রই পুবে ওঠে,পশ্চিমে অস্ত যায়;প্রতিটি সরকার মাত্রই জনতার পশ্চাৎদেশে বাঁশ ঢুকিয়ে যায় ,আর বুয়েটে টার্ম ফাইনাল মাত্রই পিছায়।"ইহা এখন একটি আদি ও অকৃত্রিম সত্য",তাপগতবিদ্যার তিনটি সূত্রের মত এ সূত্রটিও এখন তাবৎ হবু প্রকৌশলীদের জানা,শুধু প্রমাণটা পরীক্ষার খাতায় লিখতে হয়না, এই যা।
দুচ্ছাই,কি সব ছাতা লিখছি, যা অমোঘ তা নিয়ে ক্যাচাল করে তো আর ফায়দা নেই,বরং কাজের কথায় আসি।

এমনিতে শেষ সপ্তাহের খাটুনি খেটে সবাই নাকাল হয়ে পড়ে,তাই পিএল(
প্রিপারেটরি লিভ)শুরু থেকেই কোমর বেঁধে পাঠ্যপুস্তকের এস্পার ওস্পার করতে শুরু করে,এমন কুতুব খুব কমই আছে,(অন্তত আমার দৃষ্টিকোণ থেকে তো বটেই।)।তবে ধীরে ধীরে সময় ঘনিয়ে আসতে থাকে,পলাশীর মোড়ে ফটোকপির দোকানে ভিড় বাড়তে থাকে,প্রবাসী(ঢাকাবাসী বুয়েটিয়ানদের এই নামে সম্বোধন করা হয়ে থাকে) বুয়েটিয়ানদের ও আনাগোনা বাড়তে থাকে,কেউ কেউ আবার জবরদখল হয়ে যাওয়া সিট উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে,ওদিকে চানখারপুলের পেনাং বা পলাশীর মোড়ে রাতজাগা পড়ুয়ারা দলবেঁধে উদরপূর্তি করে,আর ...............ও হ্যাঁ
এতদিন যারা পরকালের আজাবের ভীতিও যাদের গ্রাস করতে পারেনি,বরং নানান দুনিয়াবী কাজ করে নিজ ঈমানের বারোটা বাজিয়েছে, আজ হল মসজিদের সামনে রাশি রাশি পাদুকার জমায়েত দেখে অনুসিদ্ধান্তে আসা যায় ,তাদের মত নালায়েকদেরও ধর্মে মতি হয়েছে,আর আর চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়...............

পরীক্ষা সমাগতপ্রায়।

(পরের পর্বে সমাপ্য)

Thursday, May 20, 2010

কবিতা -ফোবিয়া

বাঙ্গালী মাত্রই কবিতাপ্রিয় ,আর দশটা বাঙ্গালীর মত সেই শৈশবকাল থেকে কবিতার প্রতি আমারও এক দুনির্বার মোহ কাজ করত।কথাটিতে একটু ভুল হল,কবিতা কি জিনিস তা অনুধাবন করার মুরোদ তো সে সময় আমার ছিলনা,বরং বলা যায় সেই মোহ ছিল অনেকটাই ছন্দের প্রতি।আর সেই বালসুলভ আকাঙ্খার বর্শবর্তী হয়ে ছন্দ মেলানোর অন্ধ আক্রোশে লিখেও হয়তো ফেলেছিলাম খানকয়েক ছড়া।বলাই বাহুল্য ,সেই ছড়াতেই আমার দৌড় যে কদ্দুর তার আভাস ভালভাবেই মেলেছিলা।কিন্তু অবুঝ বয়েসের সাত খুনও মাপ,তাই কাঁচা হাতের সেই ছড়ারুপী ছন্দ মেলানোর আকুল প্রয়াস দেখেও মনে মনে যাই ভাবুননা কেন,মুখে বাবা মা মায় ক্লাসটিচার পর্যন্ত এই সুবোধ বালকটির পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, লেগে থাক বাবা ,তোমাকে দিয়েই হবে (এটা অবশ্য হলফ করে বলতে পারছিনা,স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে থাকে আর কি ! ) আমার তো এমনকি এও মনে হত,রবি ঠাকুরও তো এই বয়েসে "জল পড়ে পাতা নড়ে টাইপের " ছাইপাশ লিখেছিলেন,তার চেয়ে আমার কবিতা নিশ্চয় অনেকই উচ্চমার্গীয় ,কিন্তু হায় এই অর্বাচীনের যদি বোঝার সাধ্য থাকত,ওই জল পড়ার নড়ার মাঝে যে ভাব লুকিয়ে আছে, তা বোঝা এই অপোগন্ডের কম্মো নয় তাহলে ওই প্রজেক্টে বহু আগেই ইস্তফা দেওয়া হত।


যাই হোক, বয়েস অল্প,চোখে রঙ্গিন স্বপ্ন ,খানিকটা মতিভ্রম হয়তো হয়ে থাকবে,তাই কবিতা লেখার ভূত তখনো মাথা থেকে চাপেনি।একদিন হঠাৎ মনে হল ,আমার এইসব কবিতা তো পত্র পত্রিকা পেলে লুফে নেবে।তখনো বুঝিনি,আদতে সেই মতিভ্রম খানিকটা আতঙ্কজনক পর্যায়েই চলে গিয়েছিল,নইলে এমন সর্বনাশা চিন্তা মাথায় কিভাবে এল তা ভেবে আমি এখনও শিউরে উঠি।তারওপর ক্লাসে ছিলাম শেয়াল বনের রাজা,তাই এসব ভাবনার পালে হাওয়া পেতে খুব একটা দেরি হয়নি।তাই আমার বিপুল সাহিত্য সম্ভার থেকে বেছে বছে সবচে কম উচ্ছিষ্ট আবর্জনাটা বের করে একদিন পাঠিয়ে দিলাম এক স্বনামধন্য পত্রিকার শিশু বিভাগে ।যদিও আমি নিজের লেখা শিশু বিভাগে পাঠানোর পক্ষে খুব একটা রাজি ছিলাম না (নিজেকে বেশ লায়েক মনে করতাম কিনা !),তথাপি নিজের প্রতিভা বিকাশের জন্য এর চেয়ে ভাল কোন প্লাটফর্মের কথা আমার জানা ছিলনা !

অতঃপর শুরু হল প্রতীক্ষার প্রহর,সপ্তাহের একটি বিশেষ দিনে হকারের আসার পথে একবারে চাতক পাখির মত অপেক্ষা করে থাকতাম ।বলাই বাহুল্য,প্রায় প্রতি সপ্তাতেই আমি নিরাশ হতে থাকি ,আর আমার হতাশাও চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে যেতে থাকে ।প্রতিবার মনে হয় ,লেখাটা বোধহয় খানিকটা দেরিতেই পৌচেছে ,আর আশায় বুক বাধতে থাকি ।কিন্তু বিধিবাম,মানুষের সবুরে মেওয়া ফলে আর আমার বেলায় মিলল কেবল মাকাল ফল ।অনেক বিনিদ্র রজনী পার করার পর একদিন এই লেখার কথা আমার মন থেকে মুছে যেতে থাকে আর ওদিকে আমার কবিতার খাতায়ও ধুলোর স্তর পুরু থেকে পুরু হতে থাকে।


এরপর অনেক দিন কেটে গেছে । কবিতার প্রতি মোহ আমার ততদিনে কেটে গেছে ।নৈমিত্তিকতার গ্রাসে কবিতা লেখার ইচ্ছের সলতে তখন নিভু নিভু হয়ে গিয়েছিল । একদিন হঠাৎ পুরনো বই খাতার স্তুপে আবিষ্কার করলাম আমার সেই কবিতার বই ।মলাট বলতে তখন আর কিছু নেই ,কেবল গুটি গুটি হরফে লেখা কিছু কথা সাক্ষ্য দিচ্ছিল আমার এককালীন বিরলপ্রজ প্রতিভার ।খাতা হাতে নিয়ে আমি উল্টোতে থাকলাম,আর নিজের অবিনশ্বর কীর্তির দিকে তাকিয়ে আপনমনেই মুচকি হাসলাম।

মোদ্দা কথা হল , কবিতার সাথে গাঁটছাড়া বাঁধার খায়েশ ষোলআনাই ছিল ,সেই আশা পূরণের কোশেশও খুব একটা কম করিনি ,কিন্তু সবার শেষ কথা হল তাখতই যদি হয় কমজোর,তাহলে মোল্লা আর বড়জোর কদ্দুর দৌড়াবে। মেঘমেদুর দিনে মেঘের ঘনঘটা দেখে আমি পুলকিত হইনা, বরং শিউরে উঠি এই বুঝি জরুরি কাজটা পন্ড হল বলে, হঠাৎ আসা বর্ষণে আমি ভেজা মাটিতে সোঁদা গন্ধ খুজে পাইনা ,বেয়াড়া প্রকৃতির জন্য আজকের সকালটা মাটি হল, এই ভেবেই আমি গজগজ করতে থাকি ।পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে গেলেও আমার মাথায় একরত্তি কাব্য আসেনা । আর মানুষ হিসেবে আমার রোমান্টিকতা তো দিল্লী দূর অস্ত ।সে আলাপ এখানে করা অনেকটা কাকস্য পরিবেদনার মতই শোনাবে ,তাই ওদিকে আর গেলামনা । বাশ বনে ঝড় বাতাস দেখে আমি কস্মিনকালেও প্রিয়ার এলোকেশ বলে ভাবিনা , বনলতা সেনের সন্ধানে নাটোর যাওয়ার ইচ্ছেও কখনো উকি দেয়নি ,মোটকথা ওসব কল্পনাবিলাস আমার ধাতে সয়না ।কবিতা পড়ে হদয়ঙ্গম করতে তাই আজকাল আমাকে জেরবার হতে হয় , নিজেকে সান্তনা দিই এই বলে যে এ যে আমার সক্ষমতারই অপ্রতুলতা। ভয় হয় ,কবিতার সাথে এই আপাত বিচ্ছেদের বোঝা আবার আমায় বেশিদিন বইতে না হয় ,কবিতার প্রতি আমার না আবার অ্যালার্জি পেয়ে বসে ।ডুবন্ত মানুষও খড়কুটো আঁকড়ে ধরে রাখে ,আমিও তাই আর হাপিত্যেশ না করে বরং আশায় আছি ,একদিন কবিতার দেবী হয়তো আমার দিকে মুখ তুলে তাকাবেন ,কবিতার সাথে আমার ফের মিতালী হবে ।

Wednesday, May 19, 2010

স্মৃতিতে মাহে রমজান এবং তারাবী লা লীগা

রোজার দিনের বেশুমার স্মৃতি থেকে ছেঁকে ছেঁকে সবচে মজারগুলো বের করে আনা সহজ কম্মো নয় সেহরী ইফতারের মজা তো সবাই অল্পবিস্তর করেছে ,তবে আমি ছিলাম আরও এককাঠি সরেস মনে পড়ে ,ছেলেবেলায় বাবা -চাচারা ইফতারের পর খানিক জিরিয়ে তারাবীর উদ্দেশ্যে রওনা দিতেন তখন আমিও গাড়লের মত তাদের সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরতাম কিন্তু আমার মত নেহায়েত পিচ্চি যে ২০ রাকাত নামাজ পড়তে পেরেশান হয়ে পড়বে ,তা জানা ছিল বলে আমাকে তারা নিতে চাইতেননা কিন্তু কাহাঁতক আর প্রতিদিন আমার ত্রাহি চিৎকারে কান বুঝে থাকা যায় তাই একদিন আমার এহেন অন্যায় আবদারের ঠেলা সইতে না পেরে আমাকে তারাবীতে নিয়ে যান খানিক বাদেই টের পেলাম আমার যারপরনাই ঘুম ঘুম আসছে ইমামা সাহেব ওদিকে কোরানের আয়াত পাঠ করছেন আর আমি দাঁড়াতে দাঁড়াতে ত্যাক্ত এবং অবশেষে ক্লান্ত বিরক্ত হয়ে কখন যে চোখ বুজে ফেলতাম তা আমি নিজেই জানিনা প্রথম চার ছয় রাকাত তাও যা ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে আমি মোটামুটি কান খাড়া করে ইমামের আয়াত শোনার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পরে এমনই অবস্থা হল ,ইমাম সাহেব রুকুতে যেতে আল্লাহু আকবার বলার আগ পর্যন্ত এক রাকাত মোটামুটি আরবী ঘোড়ার মত ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলাম এরপর যখন বিশ রাকাত শেষ হল তখন দুর্বল পায়ে আর একরত্তি শক্তি ছিলনা বলাই বাহুল্য ,ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায় আর এরপর আমি ঐ বয়েসেই বুঝে গিয়েছিলাম ,এই আবদার ফের করলে আরও গাড্ডায় পড়তে হবে,তাই এটা না করাই সমীচীন



খানিক বড় হতে আরো একটু বুদ্ধি যখন মাথায় গজাল তখন আমি বাবার সাথে তারাবীতে যাওয়ার জন্য বের হতাম ঠিকই ,কিন্তু মওকা পেলেই ফুড়ুত করে সটকে পড়ার ধান্দা করতাম ।তখনা আবার আমাদের কলোনীতে আমার বেশ কিছু বিচ্ছু দোস্ত জুটে গিয়েছিল ।আমরা এমনই দস্যি ছিলাম যে ,কেলাসে টিচারের হোমওয়ার্ক থেকে শুরু করে মায় তারাবীর নামাজেও কিভাবে সবার নজর এড়িয়ে ফাঁকি দেওয়া যায় ,তার তরিকাও আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম ।প্ল্যানমাফিক তারাবী শুরু হলে ভাল ছেলের মত আমরা সটান দাঁড়িয়ে অপরিসীম মনোযোগের সাথে নামাজ পড়তাম ।খানিক বাদে চুপিচুপি এলাকার মুরব্বীদের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে আমরা সব কটা জমায়েত হতাম মসজিদের পেছনে ।এরপর শুরু হত ওখানেই আমার ইন্সট্যান্ট বাঁদরামো ।দুই রাকাত পর পর নতুন ভাবে ইমাম সাহেব যখন নিয়্যাত ধরতেন তখনও আমরা ব্যস্ত ছিলাম একজন আরেকজনের ঘাড়ে চিমটি কাটায়, মৃদুস্বরে হিহি করে হাসাহাসি করায় ।এরপর যখন ইমাম রুকুতে যেতেন তখনই পড়ি কি মরি করে আমরাও চলে যেতাম রুকুতে ।উচ্চতায় আরও খানিক লম্বা হলে আমাদের বাঁদরামির তলিকায় নিত্যনতুন সৃজনশীল কৌশল যোগ হতে থাকে ।কারও চপ্পল লুকিয়ে রাখা বা কারও একপাটি চপ্পলের সাথে অন্য কারওটা বদলে দেওয়া এসব তো ছিল মোটামুটি কমন ।আমি নিজে অবশ্য নিজে প্রায়ই এই হামলা থেকে বেঁচে যেতাম ,কিন্তু ভুক্তভোগীরাদের রীতিমত নরক গুলজার করে ছাড়তাম আমরা ।




এরপর ধীরে ধীরে কৈশোরের রঙ চড়ানোর সাথে সাথে আমাদের তারাবী পড়ার উৎসবে খানিকটা ভাটা পড়তে শুরু করে ।এরই মাঝে আমরা চলে আসি নতুন বাসায়,সেখানে আমার নতুন কিছু বন্ধুও জোটে এবং অবধারিতভাবে এখানে শুরু হয় তারাবীতে ফাঁকি দেওয়ার নতুন অপারেশন ।আগে ফাঁকি দিতাম কিছুটা রয়েসয়ে ,মুরুব্বীদের চক্ষুলজ্জার ভয় তো ছিলই ,তার ওপর নিজেদের মধ্যেও বোধ হয় কিঞ্চিত ভালমানুষী অবশিষ্ট ছিল ।কিন্তু কখন যে ইবিলিশ শয়তানের ওসওয়াসায় সেইটুকুও যে ধুয়ে মুছে সাফ হুয়ে গেছে তা বুঝতেও পারিনি ।তাই তারাবীতে ফাঁকি দিতে আমরা হয়ে উঠলাম অনেক বেশি ডেসপারেট আর ইনোভেটিভ ।আমাদের এই নতুন বাসা আবার ছিল স্কুলের সাথে লাগোয়া ,তাই আমরা তারাবীতে যাওয়ার নাম করে সবকটা দল বেঁধে স্কুলে চলে আসতাম ।স্কুলের ভেতরের ছোট্ট মাঠে টিমটিম করে দুটি একশ ওয়াটের বাতি জ্বলত ,সেই আলো আঁধারিতেই আমরা সবাই সক্রোশে বলের ওপর লাথি হাকাতাম ।আমাদের এই নৈশকালীন ফুটবলের কোড নেম ছিল তারাবী লা লীগা ।তারাবী শুরু হওয়ার সাথে সাথে আমাদের এই ফুটবল স্যাগা শুরু হয়ে যেত আর তারাবী শেষ হওয়ার খানিক আগে আমরা ইস্তফা দিতাম ।এরপর উদোম গায়ের ঘামটুকু ভালমত শুকিয়ে পাঞ্জাবি চাপিয়ে বাসায় ফিরে আসা ।কাউকে কাউকে তারপরও প্রশ্ন করা হত ,"কিরে তোর গায়ে এত ঘামের গন্ধ কেন ? " । যাদের বরাত খারাপ ,তারা জাঁদরেল বাবা মার দুর্ধর্ষ জেরার মুখে ফেঁসে যেত ,বাকিরা অবশ্য মোটামুটি সবাই উতরেই যেত বলা চলে । এমনকি কলেজে ওঠার পরেও আমাদের এই এই সিজনাল তারাবী লা লীগা মোটামুটি বহাল তবিয়তেই অনুষ্টিত হত ।


এখন ছুটিতে বাসায় গেলে সব বন্ধুদের একসাথে আড্ডায় ঘুরে ফিরে সেই তারাবী লা লীগার স্মৃতিই ঘুরে ফিরে উঠে আসে ,আমরা হয়ে পড়ি নস্টালজিক ।তারাবী না পড়ে নিজের পরকালীন জীবনের অপরিমেয় ক্ষতি হয়তো করেছি ,কিন্তু সেই দুরন্ত দিনগুলির জন্য এমন ক্ষতি স্বীকার করতেও আমি একপায়ে খাড়া

Tuesday, May 18, 2010

এ জার্নি বাই ট্রেন

ঝকঝকে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা এক লহমায় ভাল হয়ে গেল অপুর ।সত্যি বলতে কি ,আগের দিনের বিচ্ছিরি রকমের বৃষ্টিটা বেশ ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিল ওকে ।নাছোড়বান্দার মত ঝরছে ঝরছে তো ঝরছেই ,থামার আর নামগন্ধটুকুও নেই ,মনটাই তেতো হয়ে গিয়েছিল ওর ।সেই সাথেখানিকটা শঙ্কাও জেগেছিল বৈকি ।কালকের আকাশটা যদি এরকম থম মেরে থাকে তাহলে তার অর্ধেক আনন্দই মাটি ।তাই ম্যাদামারা মন নিয়েই ঘুমুতে হয়েছিল তাকে ।এই মুহুর্তে সে অবশ্য বেজায় খুশি ,ঠিক যেন বাইরের নির্মেঘ আকাশের সূর্যটির মত , আজকের দিনে আর উটকো বৃষ্টির ঝক্কি পোহাতে হবেনা ,এই ব্যাপারে অন্তত এই মুহুর্তে সে নিশ্চিত ।

অপুর জন্য এই দিনটি অবশ্যই বিশেষ কিছু ।উচ্চতায় খুব বেশি নয় ,তায় আবার একহারা গড়নের বলে তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই ,এরই মধ্যে সে দশ দশটি ক্লাস পার করে মাধ্যমিক পরিক্ষা অবধি দিয়ে দিয়েছে ।নিজেকে সে এরই মধ্যে বেশ লায়েক ভাবতে শুরু করে দিয়েছে ।তাতে অবশ্য তাকে খুব বেশি দোষ দেওয়া যাবেনা ,কিন্তু তার মা বাবাকে এই কথা বোঝানো বেশ শক্তই ।ছেলেকে আদর দিয়ে মাথা খাননি বটে ,কিন্তু চোখে চোখে রাখার কাজটি তারা ঠিকই করেছেন ।তাইতো বাড়ির বাইরে ইচ্ছেমাফিক খুব বেশিদূর যাওয়ার জো তার কখনোই হয়নি।এবার একটা মওকা খুব ভালমতই মিলেছে তার ।পরীক্ষা শেষের লম্বা ছুটি ,হাতে অফুরান অবসর ।আর কাহাঁতক ঘরে বসে ভেরেন্ডা ভাজা যায় ।তাই মামার বাড়ি যাওয়ার জন্য সে তক্কে তক্কে ছিল ।অবশেষে অনেক কসরতের পর বাবা মার ক্লাছ থেকে পারমিশনও মিলে গেল তার ।আজ তাই সে ট্রেনে চেপে মামাবাড়ি যাচ্ছে সে ,এবং সবচেয়ে বড় কথা হল ,এটাই তার প্রথম একা ট্রেনে চেপে মামাবাড়ি যাওয়া ।


বরাতটা তার ভালই ছিল বলতে হবে ,জানালার পাশেই সিটটা মিলে গেল তার ।তবে পাশের যাত্রীর দিকে তাকিয়ে মনটা খানিকটা দমে গেল তার ।এরই মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে ,শহর পার হয়ে ট্রেন এগিয়েও চলেছে ,অথচ পাশের যাত্রীটি এখনো তার সাথে কথা কওয়া তো দূরে থাক ,ভালমত তাকিয়েও দেখেনি ।আর সবচে বড় ব্যাপার হল এমন গাড়লের মত ট্রেনে ওঠার সাথে সাথে কেউ সটান ঘুমিয়ে পড়তে পারে ,তা সে ভাবতেই পারিনি ।তবে একটু খেয়াল করলেই অপু দেখতে পেত ,ট্রেনের বেশির ভাগ লোকই বেঘোরে ঘুমুচ্ছে ,আর দুয়েকজন রাজা উজির পেটাচ্ছে ।খানিক বাদে সে অবশ্য এই কথা বিলকুল ভুলে গেল ,জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল দূরে যেন পাহাড়ের কায়া আবছা দেখা যাচ্ছে ,হঠাতই চোখের সামনে সবুজ পাহাড়ের সারি যেন মাটি ফুঁড়েই উদয় হল ।আজকের সূর্যটা একটু বেশি রকমেরই বেহিসাবী , তার আলো পাহাড়ের গায়ে পড়ে রীতিমত ধুইয়ে দিচ্ছিল ,আর অপুও যেন তারিয়ে তারিয়ে সেই মনলোভা দৃশ্য চেখে নিচ্ছিল ।সত্যি করে বললে ,সবুজের প্রতি তার দুর্বলতা একটু বেশিই ,আর তাই পাহাড় না সমুদ্র ,এই দুয়ের মাঝে সে বরাবরই চোখ বন্ধ করে সমুদ্রকে ছেটে ফেলেছে ।আর আজকের এই একলা ট্রেনজার্নিটাকে সে অনেক দিন থেকে খুব করে চাইছিল ।

ট্রেন চলছে দুদিকে ঘন পাহাড়কে সাক্ষী রেখে ।সাথে সাথে অপুও বাইরে দিকে নিনির্মেষ চেয়ে আছে ।মামাবাড়ি সে আগেও গিয়েছে ,কিন্তু সেসব বাসে ,রেলে এটাই তার মেইডেন জার্নি ।তার মনে হল ,এতকাল জার্নি বাই ট্রেন রচনায় সে কিসব গতবাধা ছাইপাশ লিখেছে ,বইয়ের ওসব লেখকেরা রেলভ্রমণের মাহাত্ম্য আদৌ বুঝেছে কিনা ,সে বিষয়েও তার গুরুতর সন্দেহ হতে লাগল ।

হঠাত সে সম্বিত ফিরে গেল পাশের যাত্রীটির ডাকে ,
-এমন হা করে কি দেখছ তুমি।
-পাহাড় দেখছি ,আপনি পাহাড় ভালবাসেন ?
অপু সাগ্রহে উত্তরের জন্য তাকিয়ে রইল ।
-পাহাড় ভালবাসব ?
এবার লোকটি খানিকটা অবাক,
-পাহাড় -টাহাড় কেউ আবার ভালবাসে নাকি ?আর ওসব দেখারই বা কি আছে ।এগুলো যত তাড়াতাড়ি পারা যায় কেটে সাফ করে ফেলাই ভাল ।

অপু ফ্যালফ্যাল করে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল ।বাকি সময়টা সে গল্পের বইয়েই গুঁজে রইল ,পাহাড়ের দিকে তাকানোর ফুরসত সে আর পায়নি ।

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...