Friday, December 31, 2010

মেঘ, নদী আর পাহাড়ের দেশে-৩

থানচি যখন ছেড়ে গেলাম আকাশটা সোনারঙা রোদে ঝকঝক করছে, আগের রাত্তিরের বৃষ্টির কোন ছিঁটেফোঁটাও তখন আর অবশিষ্ট নেই, দিব্যি ঝকঝকে আকাশ।মনটা আমাদের তখন বেজায় ফুরফুরে। তবে মুশকিলটা এই যে, নৌকায় উঠে আমাদের একজায়গায় গ্যাঁট হয়েই বসে থাকতে হল, নো নড়ন চড়ন। এমনিতেই এগারজনের ব্যাকপ্যাক তো ছিলই, তার ওপর যোগ হল চাল,কলা্‌, চিড়ের ভারি বোঝার হ্যাপা। আগেই জানতাম, এই যাত্রাটা হতে যাচ্ছে বেশ লম্বা, নদীতে পানি আচমকা বেড়ে যাওয়ায় রেমাক্রিবাজারে ঠিক কতক্ষণে পৌঁছুতে পারব সেটা তখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছিলনা। মাঝির কথাবার্তা শুনে ঠাহর করতে পারলাম, আজকের দিনটা মোটামুটি কলা-চিড়ের ওপর দিয়েই পার করে দিতে হবে। দুপুর নাগাদ রেমাক্রিবাজারে ঠাঁই গাঁড়তে পারব এমন ভরসাও খুব একটা নেই। ঠিক ঐ মুহুর্তে এসব অযাচিত ভাবনা বয়ে বেড়ানোর কোন খায়েশ আমাদের ছিলনা। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল না করে পারলামনা, আগেরদিনের চেয়ে পানির উচ্চতা বেশ বেড়েছে বলে মনে হল। সেই সাথে স্রোতের ধাক্কাটাও দেখলাম বেশ জোরদার। এক রাতের বর্ষণেই এই অবস্থা, ঘোর বর্ষাকালে না জানি কি দশা হয়?

পাহাড়ে গোত্তা খাওয়া মেঘ

DSC04525

অপরূপা সাঙ্গু

DSC04555

সাঙ্গু পাহাড়ি নদী, থানচি থেকে নাফাখুমের দিকে যেতে পুরোটাই যেতে হবে স্রোতের বিপরীতে, তারমানে আমাদের সময়টা লাগবে অনেক বেশি। পাহাড়ী নদী বলে এর আচরণ ঠিকঠাক অনুমান করাটাও দুরুহ কর্ম, তবে এটা নিশ্চিত এর মাঝে বেশ ক জায়গায় কিছু জেন্টল স্লোপ পার হতে হবে। সেসব জায়গায় নৌকা কিভাবে এই প্রবল স্রোত উজিয়ে চলবে, সেটা ভাবতেই আমাদের শিরদাড়া দিয়ে উদ্বেগের চোরাস্রোত বয়ে গেল। তবে বলতেই হবে,নদীর দুপারের দৃশ্য দেখলে চোখ ফেরানো যায়না। তখনও আমরা থানচি পেরিয়ে এসেছি খুব বেশি দেরি হয়নি, সাঙ্গু এখানে অনেকটাই স্থিরমতি, আচমকা বেগড়বাই করার কোন লক্ষণও আপাতত প্রকাশ পাচ্ছেনা। দুদিকের লোকালয়ের আভাস তখনো পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি, মাঝে মাঝে চকিতের জন্য পাহাড়ের কোলে কাঠের খুদে বাড়িও চোখ এড়াবেনা। এই করতে করতে ঘন্টা দেড়েক পার হয়ে গেল, এবার আস্তে আস্তে নদী আপনবেগে পাগলপারা হওয়ার লক্ষণ দেখাচ্ছে, জল এখন অনেকটাই ঘোলা, নৌকার গতিও কমে গেছে অনেকখানি। সামনে তাকিয়ে দেখলাম, দুপাশে বেশ কিছু পাথর, তার মধ্য দিয়ে সটান যেন ওপরের দিকে উঠে গেছে। বুঝলাম, সামনেই আমাদের প্রথম নতি পার হতে হবে।

তবে হাত নৌকায় এলে যে ব্যাপারটা চরম আত্মঘাতী হত, সেটা আমরা এর আগেই হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করেছি। আমাদের সাথেই ঘাট থেকে আরেকদল অভিযাত্রী হাত নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এমনিতেই মন্থর গতি, তায় স্রোতের খপ্পরে হাঁসফাঁস করতে করতে অচিরেই তাদের এক পা এগোয় দুই পা পিছোয় দশা। আমরা যখন তাদের বেশ দূরে ফেলে এসেছি, খেয়াল করলাম তাদের নৌকা উল্টোদিকে ঘুরছে। ঐ নৌকার মাঝির দেখলাম বেজায় সাহস, কিন্তু এটা বুঝতে অন্তত দেরি হয়নি হাত নৌকায় বেশিদূর গিয়ে সেঁধে স্রোতে ভেসে যাওয়ার কোন মানে হয়না। যাই হোক, যা বলছিলাম, নদী্র এসব স্টেপ আপের সময় ইঞ্জিন নৌকাই আখেরে বেকায়দায় পড়ে যায়। কারণ এমনিতেই নৌকার ওজন বেশি, তারওপর কোন পাথরের সাথে গোত্তা খেয়ে তলা ফেঁসে যাওয়ার আশঙ্কাও অনেক। হাত নৌকার পলকা হওয়াতে এসব জায়গায় কিছুটা বাড়তি সুবিধে পায়। প্রথমবারের স্টেপ আপের সময় অবশ্য খুব একটা কষ্ট হলনা, সশব্দে ধুঁকতে থাকা ইঞ্জিন নৌকার ওপর সওয়ার হয়েই ওটা পার করে দিলাম আমরা।

কিন্তু পরের বার থেকেই লাগল যত গোল। এর মধ্যে আমরা তখনও তিন্দুতে এসে পৌঁছাইনি, ওদিকে বেলা এরই মধ্যে অনেকটা গড়িয়ে গেছে। পরের স্টেপ ডাউনে ইঞ্জিন পুরোদমে চালিয়েও দেখলাম নৌকা একবিন্দু নড়ছেনা, ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। দুপাশে তখন ভয়ংকরভাবে ফুঁসে ওঠা স্রোত আমাদের পাশ দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। বোঝা গেল, ইঞ্জিনের ওপর ভরসা করা বৃথা, এবার নৌকা থেকে না নামলেই নয়। খুব সাবধানে আমরা খানিকটা তীর ঘেঁষে নেমে পড়লাম। নদী অবশ্য খুব একটা গভীর নয় তখনো। তলায় কিছু আলগা পাথর ছিল, তাই প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হচ্ছিল অতি সন্তর্পণে। তবে যে জায়গাটায় ঠিক নৌকা আটকে আছে ওখানে স্রোত রীতিমত ঘূর্ণিপাক তৈরি করেছে। সেখানে একবার পড়লে আমাদের লাইফজ্যাকেটও যে কোন ফায়দা দেবেনা সেটা বুঝতে খুব একটা কষ্ট হলনা কারো। ততক্ষণে মাঝিরা অবশ্য দড়ি দিয়ে নৌকা বেঁধে রীতিমত টানাহেঁচড়া শুরু করে দিয়েছে। আমরাও মিছে বসে না থেকে হাত লাগাতে শুরু করলাম। এর মধ্যে খুব সতর্কতার সাথে বড় পাথরগুলোকে পাশ কাটিয়ে নৌকা একতিল করে সামনে এগোতে শুরু করল। মাঝিদেরকে দেখে বুঝলাম তাদের দস্তুরমত ঘাম ছুটে যাচ্ছে। অবশেষে প্রথম স্টেপ ডাউনটা আমরা কোন হ্যাপা ছাড়াই পার হলাম।

প্রথম স্টেপ আপ

DSC04591

দড়ি ধরে মার টান

DSC04607

DSC04613

তিন্দুতে নামার ঠিক আগে যে স্টেপ আপটা পেলাম, সেটা অবশ্য আরো গোলমেলে। এখানে পাথরগুলো খুবই বিপজ্জনক, কিছু কিছু তো রীতিমত চোখা। এ জায়গায় নদী অনেকটা চওড়া হয় গিয়েছে, তাই আগের মত "দড়ি ধরে মার টান" পদ্ধতিতে লোকবলও লাগল দ্বিগুন। আমাদের মত কিছু উঁনপাজুরে গেলবার রেহাই পেলেও এবার সবাইকে শক্ত হাতে দড়ি ধরতে হল। এর পর শুরু হল মরণপণ টান। এই করতে করতে এবারের স্টেপ আপটাও মোটামুটি নির্বিবাদে পার হওয়া গেল। আর আমাদের একজনের এক পাটি জুতো সাঙ্গুর জলে চিরতরে হারিয়ে গেল, আফসোস বলতে এটাই। এরপর তিন্দু পৌঁছাতে আমাদের খুব একটা সময় লাগেনি। তবে কাকতাল যে কতটা বিটকেলে হতে পারে, সেটা বুঝলাম তিন্দুতে এসে। আমাদের আরো কিছু ভার্সিটি ফ্রেন্ড দেখি এখানে আড্ডা গেড়ে আছে। তবে তাদের সাথে কথা বলে মনটাই দমে গেল। আগেরদিনের বৃষ্টিতে নাফাখুমের পানি নাকি বেশ বেড়ে গেছে, কোনো গাইডই নাকি নাকি তাদের নিয়ে যেতে রাজি হচ্ছেনা। বাধ্য হয়ে তারা রেমাক্রিবাজার থেকেই নাফাখুম প্রজেক্ট ইস্তফা দিয়ে চলে এসেছে। ভাবনায় পড়ে গেলেও আমরা খুব একটা পাত্তা দিলামনা, দেখাই যাক সামনে কী আছে কপালে। তিন্দু একটা বেশ জনাকীর্ণ পাড়া(অন্তত এসব এলাকার নিরিখে তো বটেই)। আমাদের মাঝি ভাইয়েরা এখানে দেখলাম বেশ প্রেমসে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নিচ্ছে। আমাদেরও পেটে খিদেটা বেশ ভালমত চাগিয়ে উঠল, কিন্তু বেরসিক সময় বাগড়া দেওয়ায় সে যাত্রায় ডাল-ভাতের ভোজনের পাট মুলতবি রেখে কলা চিড়ের ফলার দিয়েই দুপুরের পেটপুজোটা সেরে নিতে হল।

তিন্দুতে...

DSC04620

কান্ডারি হুঁশিয়ার..

DSCF0553

তিন্দু ফেলে যখন এসেছি, তখন ঘড়ির কাটা প্রায় বারটা ছুইঁ ছুঁই। তবে আশার কথা এই, সামনের পথ আর খুব বেশি বাকি নেই। আর আশঙ্কার কথা হল, এরই মধ্যে আমাদের একাধিকবার নৌকা ঠেলতে হতে পারে, বিশেষ করে বড়পাথরের ওখানে তো বটেই। বড়পাথর জায়গাটার একটু বর্ণনা এই মওকায় দিয়ে রাখি। বড়পাথর (অনেকে হয়তো আবার রাজাপাথর বলেও চিনে থাকতে পারেন) তিন্দু থেকে বেশ খানিকটা সামনে। হঠাৎ করে দূর থেকে দেখলে মনে হবে, নদীগর্ভে পেল্লায় কিছু পাথর আকাশ ফুঁড়ে উদয় হয়েছে। এটা বোধহয় বলে না দিলেও চলে, এসব দানবাকৃতি পাথরের জন্যই জায়গাটার নাম বড়পাথর। বড়পাথরে পাথরগুলো যেমন বিশাল, স্রোতের তীব্রতাও তেমনি প্রচণ্ড। এ জায়গায় এসে আমাদের কপালে দুশ্চিন্তার বিশাল খাঁজ পড়ে গেল, নৌকা তো স্রোত পেরিয়ে কোনভাবেই যেতে পারবেনা, তবে উপায়? এর আগে যেখানেই নেমেছি, নদীর গভীরতা ছিল কম, কিন্তু এখানে গভীরতা যে আসলে ঠিক কতটুকু তা বলার কোন উপায় নেই। আর একবার পাথরগুলোর সাথে ধাক্কা খেলে আর দেখতে হবেনা বৈকি। কিন্তু উপায়ান্তর না দেখে পাথরগুলোর কিনার ঘেঁষে আমাদের নেমে পড়তে হল। এখানে মোটামুটি উদর পর্যন্ত পানি, তবে স্রোতটা তীব্র বলে আমরা মানবশিকল তৈরি করে নিয়েছিলাম। এ জায়গাটায় নামতেও হিম্মত লাগে, নৌকা ঠেলা তো দিল্লি দূর অস্ত। কিন্তু অন্তত দুজনকে হাত লাগাতে হবেই। আমাদের অনেকের সাহসটা একটু বেশিই ছিল, তাই নৌকা ঠেলে বড়পাথরও পার করে ফেললাম। তারপরও শেষ রক্ষা হতনা, যদিনা আমাদের অকুতোভয় মাঝি অংসাপ্রু একটা ঘূর্ণিপাকে পড়ে তলিয়ে যেতেন। ভাগ্য সেদিন সহায় না হলে আমাদের একজন মাঝিকে সাথে সাথে ধরে ফেলতে পারতনা, আর মাঝিও নিশ্চিতভাবে পাথরগুলোতে গিয়ে ধাক্কা খেত।

বড়পাথর
DSC00241

DSC00237

DSC00238

বড়পাথরের পর আর তেমন কোন ঝক্কি রইলনা। এবার পাহাড়গুলো আরো গগনচুম্বী হয়ে উঠেছে। এর মাঝে আমরা অনেকটুকু পথ পেরিয়ে এসেছি। বড়পাথরের পরও আরো বার দুয়েক নৌকা টানতে নেমে পরতে হয়েছিল, তবে অসব জায়গায় স্টেপআপগুলো অতটা খাড়া ছিলনা, তাই আমাদের খুব একটা বেগ পোহাতে হয়নি। এসব করতে করতে মোটামুটি বেলা তখন তিনটা ছুঁই ছুঁই। অনেক দূর থেকে পাহাড়ের ওপর একটা ছোট্ট বাড়ি চোখে পড়ল। তিন্দু ছেড়ে আসা অবধি আর কোন ধরনের লোকালয় আমাদের চোখে পড়েনি। বুঝতে পারলাম, রেমাক্রিবাজার এসে গিয়েছি। হিসেব করে দেখলা, সকাল আটটা থেকে বেলা তিনটা, প্রায় সাত ঘন্টার এক রোমহর্ষক সফর আমরা সাঙ্গুবক্ষে কাটিয়ে এলাম। জার্নি বাই বোট বোধহয় একেই বলে!

Saturday, December 25, 2010

মেঘ, নদী আর পাহাড়ের দেশে-২

যাত্রীরা হুঁশিয়ারঃ

আগে থেকেই জানতাম, থানচি আদতে একটা থানা। তবে এখানেও আমাদের জন্য বেশ বড়সড় একটা চমকই অপেক্ষা করছিল। চাঁদের গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে দেখি, সামনে কোন রিকশা বা ভ্যানের টিকিটিরও দেখা নেই। আচ্ছা মুসিবতে পড়া গেল তো! সামনে এগিয়ে তো বিলকুল কপালে হাত, আমাদের আস্ত একটা নদীই পার হতে হবে, তাও একেবারে দেশি হাতনৌকায়। অবস্থা বেগতিক দেখে আমরা খানিক দোনোমনা করছিলাম কিন্তু খানিক বাদে দেখলাম মানুষজন পিলপিল করে নির্বিবাদে ওই নৌকায়ই পার হচ্ছে। এবার আর গড়িমসির বালাই না করে নৌকায় চড়ে বসলাম। নদীটা অবশ্য ও জায়গায় খুব বেশি চওড়া ছিলনা, তার পার হতে খুব একটা সময় লাগেনি।

যাহা ছিল নিয়ে গেল কাঠের তরী...

DSCF0486

দুষ্টু ছেলের দল

DSCF0489

DSCF0487

বাসস্থান বিড়ম্বনাঃ

থানচি বাজারে গিয়ে এর চেয়েও বড় গ্যাড়াকলে পড়া গেল, গতর রাখার জন্য একটুকরো আশ্রয় এখন কই মেলে? বাজারে খোঁজখবর করে জানলাম এখানে একটা সরকারী বিশ্রামাগার আছে, বরাত ভাল হলে ওটাতেই ঠাঁই মিলতে পারে। বরাতটা আসলে আমাদের একটু বেশি রকমেরই ভাল ছিল, কারণ দৈবক্রমে রেস্টহাউসের কেয়ারটেকারের সাথে আমাদের বাজারেই দেখা হয়ে গেল। তিনি জানালেন, আপাতত রেস্টহাউস ফাঁকাই আছে, আমাদের জন্য তিনটে রুমেরও আশ্বাস দিয়ে দিলেন। আমরা তখন রাতটা যেনতেনপ্রকারে কাটানোর জন্য তৈরি ছিলাম, আর এ যে মেঘ না চাইতেই জল! জলদি মালপত্র রেস্টহাউসে রেখে একটু হাঁফ ছাড়া গেল। ওদিকে পেটের ভেতর ছুঁচোরা তখন ডনবৈঠক করছে। বাজারেই শুনলাম, এই সময়টাতে নাফাখুম প্রত্যাবর্তনকারীদের হারটা খুব বেশি, গত দুদিন নাকি দেদার মানুষ থানচি ছেড়ে গেছে। আর কি অদ্ভুত কাকতাল, সেখানে আবার আমাদেরই জনাকয়েক ভার্সিটিফ্রেন্ডদের সাথে দেখা, ওরা অবশ্য রাতটা থানচিতে কাটাবেনা, দুপুরের খাওয়া সেরেই তিন্দু নামের আরেকটা জায়গায় রওনা দেবে, রাতটা তাদের ওখানেই(তিন্দুতে) কাটানোর খায়েশ।

ঠাঁই মিলেছিল যেথায়ঃ

DSCF0732

একরত্তি বাজার

DSCF0509

জীবনজোব্বাই জীয়নকাঠি!:

থানচি একদমই একটেরে একটা জায়গা, একটা সরু পাকা রাস্তা বাজারের বুক চিরে চলে গেছে, তারই দুপাশে সব দোকানপাট। বিদ্যুতের জন্য সূর্যদেবই ভরসা, সেটা দিয়েই নৈমিত্তিক প্রয়োজন মেটাতে হয় থানচিবাসীকে। রাজ্যের খিদে নিয়ে আমরা যখন একটা হোটেলে ঢুকে পড়লাম বেলা তখন তিনটা ছুঁই ছুঁই। আমাদের হকিকত ছিল এমনই, ওরকম উটকো সময়ে এসব বিটকেলে জায়গায় যা পাওয়া যায় তাই সই। তাই আন্ডার ঝোলের সাথে কচুর তরকারি দিয়ে গলা পর্যন্ত গিললাম, তবে দামটাও কিন্তু ছিল গলাকাটাই। এরকম আনকোরা স্থানে ট্যুরিস্টদের কিছু মালকড়ি গচ্চা দিতেই হয়, তা ও নিয়ে আর খুব একটা গা করিনি। সে যাকগে, খেয়েদেয়ে এসে এবার আমাদের রোখ চাপল, এই মওকায় আমাদের সাধের লাইফজ্যাকেটগুলো নিয়ে একটু হাত-পা মকশো করা যাক, সুযোগ যখন পেয়েছিই। আমাদের রেস্টহাউস থেকে সামনে এগুলে একটা পুকুর ,জলটাও মনে হল বেশ টলটলে। পারলে তো তখনই লাফ দেই এ অবস্থা। যাই হোক, জীবনজোব্বাগুলো গায়ে চড়িয়ে আমরা নেমে পড়লাম জলকেলিতে। ওইদিন সূর্যের তেজ ছিল দারুণ কড়া, আমরা ঘেমে নেয়ে তখন মোটামুটি সারা। পানিতে নামার সাথে সাথে একটা দুর্দান্তরকম প্রশান্তিতে মনটা ভরে উঠল, আর প্রথমবারের মত পানিতে ভাসার মজা তো ছিলই, হোক সেটা লাইফজ্যাকেটের আনুকূল্যে। কিছুক্ষণ হাস্যকরভাবে বেধড়ক হাত পা ছোঁড়ার পর খেয়াল হল, পুকুরের ওপাশে একটা স্কুল, আর সেই স্কুল থেকে কচি কাঁচার দল আমাদের দিকে পলক না ফেলে তাকিয়ে আছে। বুঝলাম ওদের জন্য কতক মাথাবিগড়ানো তরুণের বালসুলভ জলকেলির এমন দুর্লভ বিনোদন হাতছাড়া করা আসলেই শক্ত। ব্যাপার বুঝে আর বেশি সময়ক্ষেপণ করিনি, ওবেলার মত জলক্রীড়ায় ইস্তফা দিতে হল।

নেটওয়ার্কের বাইরে!

এসবকায়কারবার শেষ করতে করতে বেলা ততক্ষণ অনেকদূর গড়িয়ে পড়েছে। আমাদের শরীরে তখন রাজ্যের ক্লান্তি, তাই বিছানায় শুতে না শুতেই সটান ঘুম। ঘুম ভাঙ্গার পর দেখি বাইরের আলো ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে, সন্ধ্যা হয়ে এল বলে। এখন এক কাপ চা না হলেই নয়। আর আশপাশটা একটু ঘুরে বেড়ালেও মন্দ লাগবেনা। তাই পরের আধাঘন্টায় সবাইকে ঘুম থেকে টেনেহিঁচড়ে তুলে বাজারমুখী হলাম। থানচি বাজার যে নেহায়েতই গরিবী হালের সেটা আগেই আভাস দিয়েছিলাম। তবে ভালমত ঘুরে টের পেলাম, ছোট হলেও মোটামুটি সব ধরনের জিনিসই এখানে সহজলভ্য। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, থানচির মানুষ বেশ ভাল রকম দেশপ্রেমিকও বটে। এখানে এসে একটা জরুরী ফোন করতে গিয়ে দেখি, গ্রামীণের নেটওয়ার্ক বেমালুম গায়েব। রবি, বাংলালিংক বা ওয়ারিদের (হালের এয়ারটেল) অবস্থাও তথৈবচ। তখন আমাদের মধ্যে একমাত্র টেলিটকধারীর মুখে ষাট ওয়াটের ঝকঝকে হাসি। জানা গেল, এখানে টেলিটকের একচেটিয়া ব্যবসা। দেশের টাকা বাইরে লোপাট হতে না দেওয়ার জন্য থানচিবাসীকে একটা ধন্যবাদ তাই দেওয়াই যায়।

ভোরের থানচি

DSCF0504

সূয্যিমামা ওঠার আগে উঠব আমি জেগেঃ

DSCF0738

এবার তবে উপায়?:

মুশকিলটা শুরু হল আসলে ঠিক এরপর। আমামদের পরদিন ভোরেই থানচি থেকে রেমাক্রিবাজার যাওয়ার প্ল্যান, তাই নৌকা ঠিক করে ফেলা তখন আশু দরকার। হাতে বিকল্প ছিল দুটি, বৈঠা নৌকা আর ইঞ্জিনচালিত নৌকা। বৈঠা নৌকার অসুবিধে হল সময়টা লাগবে অনেক বেশি, অয়ার উল্টোপিঠে সুবিধা এই, ইঞ্জিনের কর্ণবিদারী ঘ্যাড়ঘেড়ে আওয়াজ থেকে নিস্তার মিলবে। খরচের দিক দিয়েও বৈঠা নৌকাই সাশ্রয়ী ছিল। তো সাতপাঁচ ভেবে আমরা বৈঠা নৌকার পক্ষেই রায় দিলাম। প্ল্যান তো ঠিক হল, এবার কার্যোদ্ধারের পালা। বাজার চষে বেড়িয়ে একজন মাঝি ঠিক করে ফেলা হল, তিনি আশ্বাস দিলেন দুটো নৌকাতেই আমাদের কাজ চলে যাবে, আর ভাড়াটাও আমাদের নাগালের মধ্যেই। এসব যোগাড়যন্তর করতে করতে নৈশভজের সময় হয়ে এল। লইট্টা মাছ আর শুটকির তরকারি দিয়ে আহার শেষে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, তখন নয়টাও বাজেনি। ওদিকে থানচি তখনই বেশ শুনশান হয়ে পড়েছে, আমাদের রেস্টহাউজেও কেমন এক ধরনের ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা। একজন প্রস্তাব দিল, চল, ছাদ থেকে খানিক ঘুরে আসি। ছাদটাও দিব্যি খোলামেলা, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, অগুণিত তারাদের মেলা বসেছে। ইটকাঠের জঞ্জালে তারা দেখার আসল মজা কখনোই ঠিকমত পাইনি, একসাথে এত তারা দেখে আমাদের নবিশ চোখ তাই আদপেই টেঁসে গিয়েছিল।

সাঙ্গু নদীর তীরেঃ

DSCF0491

সহস্র সারসঃ

DSCF0510

সার বাঁধা নৌকাঃ

DSCF0485

ও মাঝি নাও ছাইড়া দে...:

আড্ডা মারতে মারতে তখন ঘন্টাদুয়েক পেরিয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটা বারটা ছুঁই ছুঁই। পরেরদিন খুব ভোরে উঠতে না পারলে সারাদিনের প্ল্যান মাটি, তাই আড্ডার পাট ওখানেই চুকিয়ে দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে টের পেলাম, শেষরাতের দিকে ভালই একপশলা বাদলা হয়েছে, সবকিছু আর ঝকঝক করছে। কিন্তু এই উটকো বৃষ্টির জন্য খানিক বাদেই যে আমাদের হাপিত্যেশ করতে হবে সেটা আমরা কস্মিনকালেও ভাবিনি। চটজলদি মালপত্র গুছিয়ে যখন নাস্তা করতে বের হব, তখন আমাদের মাঝি দিল আচমকা দুঃসংবাদ। আগের রাতের উটকো বৃষ্টিতে নদীর পানি নাকি বেশ বেড়ে গেছে, তাই দুজন মাঝির একজন নিমরাজি থাকলেও আরেকজন ধনুকভাঙ্গা পণ করেছে, সে যাবেইনা। ব্যাপার শুনে আমাদের মাথায় হাত। খোঁজ নিয়ে জানলাম, নদীর বেশ ক জায়গায় আমাদের খাড়া চড়াই এর মত পার হতে হবে, তাই হাত নৌকা নিয়ে গেলে সাড়ে সর্বনাশ হতে পারে। এখন মুশকিল আসান করতে আমাদের মাথার চুল ছেঁড়ার উপক্রম। বেমক্কা এখন নতুন নৌকা পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, যাত্রা্টাও এভাবে অকালে মাঠে( পড়ুন থানচিতে) মারা যায় কিনা সেটা ভেবে আমরা তখন জেরবার। এমন সময় খবর পেলাম একটা ইঞ্জিননৌকা ফাঁকা আছে, কিন্তু মওকা পেয়ে তারা দামটাও হাঁকালো ভালই। আমাদের ধড়ে অবশ্য ততক্ষণে প্রাণ ফিরে এসেছে, তাই মুলোমুলির ভাবনা ঝেড়ে ফেলে ওটাতেই চেপে বসলাম। এদিকে লাগল আরেকটা কেলো, আমাদের থানচির বিডিআর চেকপোস্ট থেকে অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি নেওয়ার হ্যাপাও অনেক, সবার নামধাম ঠিকানা দিতে দিতে অনেক সময়ক্ষেপণ হয়ে গেল।কাকভোরে রওনা দেওয়ার কথা থাকলেও দেখতে দেখতে বেলাও গড়িয়ে গেল অনেক। অবশেষে সকাল আটটা নাগাদ আমরা এগার জন ইঞ্জিননৌকায় সওয়ার হয়ে থানচি ছেড়ে গেলাম। এবারের গন্তব্য রেমাক্রিবাজার।

Saturday, December 18, 2010

মেঘ,নদী আর পাহাড়ের দেশে-১

টার্মের শেষদিকে সবার অবস্থা হয়ে পড়ে ঝড়ো কাকের মত; ক্লাসটেস্ট, অ্যাসাইনমেন্ট আর কুইজের খপ্পরে রীতিমত ত্রাহি মধুসূদন দশা। এই সময় আমাদের মত বিটকেলে কজন সবার কানে মন্ত্রণা জপে দিতে থাকি, চল বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে একটা ট্যুর দিয়ে আসি। এক দুজন করতে করতে দলও ক্রমে ভারি হয়ে উঠতে থাকে, কিন্তু গোলটা বাঁধে গন্তব্য নিয়েই, যাবটা কই? একজন কক্সবাজারের নাম প্রস্তাব করলে বাকিরা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেই, ওজায়গায় কদিন আগেই তো দিব্যি চেখে আসা হয়েছে, এবার নতুন কোথাও, একদম আনকোরা কোথাও যাওয়া চাই। কিন্তু বেমক্কা এরকম নতুন জায়গার হদিস পাই কী করে, যেখানে গিয়ে অন্তত বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চারের সোয়াদ পাওয়া যাবে। ওরকম জায়গা বলতেই তো চোখের সা্মনে বান্দরবানের নামটা আগে ভেসে ওঠে। ও একটা জায়গায় আমাদের কারো খুব একটা ঢুঁ মারা হয়নি। তো বান্দরবান বলতে তো বগা লেকের নামটা চট করে মাথায় চলে আসে, এছাড়া আর কোন দ্রষ্টব্য স্থান সম্পর্কে আমরা ওয়াকেফহাল ছিলামনা। এমন সময় আমাদের আরেক বন্ধু উপযাজক হয়ে প্রস্তাব দেয়, তোরা নাফাখুম থেকে ঘুরে আসতে পারিস, আমরা কদিন আগেই পুজোর ছুটিতে ওজায়গা ঘুরে আসলাম। বন্ধুবর একটু গপ্পোবাজ গোছের হলেও বর্ণনা শুনে মনে হল, তার কথার সিকিভাগও যদি চাপা হয়, তবে আমাদের মজা ষোলআনা উসুল হতে বাধ্য। খানিক বাদে ছবি দেখেতো সবার চোখ কপালে উঠে গেল, নাহ! ব্যাটা আসলেই বাড়িয়ে বলেনি খুব একটা। এর মাঝে সে বিপদসংকুল যাত্রাপথের রোমহর্ষক ফিরিস্তি ফেঁদে আমাদের উৎসাহে জল ঢালার কোশেশ একেবারে করেনি, তা না। কিন্তু আমাদের তখন আর রোখে কে? অতএব ,মিশন নাফাখুমের পরিকল্পনা চূড়ান্ত, এবার ব্যাকপ্যাক নিয়ে রওনা হওয়ার পালা।

নাফাখুমের নাম এর যে শুনিনি তা নয়। ইতোমধ্যে খানকতক পোস্টও পড়েছিলাম নাফাখুম নিয়ে, তবে নাফাখুমের ঢলটা মূলত শুরু হয় প্রথম আলোর চটকদার নকশা পাতায় বেশ ফলাও করে নাফাখুম অভিযানের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর।এর মধ্যে খবর পেলাম, আমাদের আরো কজন বন্ধু ওখান থেকে ঘুরে এসেছে। আমাদের মূল ট্র্যাকটা হবে এরকম, ঢাকা থেকে বাসে বান্দরবান, বান্দরবান থেকে চাঁদের গাড়িতে থানচি,আর থানচি থেকে নৌকাযোগে আরো ঘন্টা পাঁচেক পরে রেমাক্রিবাজার। এখানেই শেষ নয়, রেমাক্রিবাজার থেকে আবার তিন ঘন্টার হাঁটা পথ পাড়ি দিলে তবেই দেখা মিলবে আরাধ্য নাফাখুমের। তবে সবার কন্ঠে অভিন্ন সুর, যেতে হলে কালক্ষেপণ না করে যাত্রা শুরু করা উচিত, কারণ শুকনো মৌসুমে নাফাখুমের সৌন্দর্য খুব একটা খোলতাই হবেনা, তাই যাওয়ার মজা মাটি হয়ে যেতে পারে। তখন সবে অক্তোবরের শেষ হপ্তা চলছে, কিন্তু কার্তিকের মাঝামাঝি সময়ে মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হানা দিয়ে যাচ্ছিল। ঢাকাতেই যখন এ অবস্থা , ধারণা করলাম বান্দরবানের ওদিকে নিশ্চয় দুএক পশলা বর্ষণ হয়েছেই, আর নাফাখুমও শুকিয়ে খটখটে হয়ে যায়নি। তবে সফরের প্রস্তুতি নিতেই শুরুর গেরোটা বাধল। আমাদের দলে তখন বেশ ভিড়ভাড়াক্কা, সবমিলিয়ে ১১ জন এর মাঝেই কবুল বলে ফেলেছে। এর মধ্যে সাঁতার জানে মোটে ৩ জন,(এর মাঝে দুজনকে আবার ছাটাই করে দেওয়া যায়, তারা নাকি কেবল ভেসে থাকতে পারে)। আমরা বাকিরা ডাঙ্গায় নিজেদের তখন নিজেদের বাঘ ভাবতে শুরু করে দিলেও জলে যে রীতিমত কেঁচো, একথা স্বীকার করতে কসুর করিনি। অথচ নাফাখুমজয়ীদের ভাষ্যমতে, সেখানে তিনচারজায়গায় নদী পার হতে হয়, এর মধ্যে একবার পুরোদস্তুর সাঁতার পানিতে। সাব্যস্ত হল, সাঁতারকানাদের জন্য লাইফজ্যাকেট কেনা হবে। এরপরের একদিন এই জীবনজোব্বা জোগাড়ের যন্ত্রণায় পার হল। অনেক হ্যাপার পর, নবাবপুরের এক চিপার ভেতর থেকে সবার জন্য বাহারি লাইফজ্যাকেট কেনা হল। শুরুতে সাঁতারুদের জন্য না কেনার সিদ্ধান্ত হলেও পরে তাদের পৌনঃপুনিক পীড়াপীড়িতে তাদের জন্যেও কেনা হয় (তখন আমরা বুঝতে পারলাম তাদের সাঁতারের দৌড় আসলে কদ্দুর ) । এর মাঝে আমাদের আরেক বন্ধু একদিন দেখি হেলতে দুলতে একটা বিশাল ঔষধের লিস্টি নিয়ে হাজির। আমরা যখন বন্ধুটি কোন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত তা নিয়ে কেচ্ছা ফেঁদে বসছিলাম, তখনই সে বেরসিকের মত বলে বসল, এসব দাওয়াই এবারের অভিযানের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। লিস্টটা ভালমত দেখে পরে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ, জ্বর, সর্দি-কাশি,পেটের ব্যামো থেকে শুরু করে মায় ম্যালেরিয়ার ঔষধও সেখানে রয়েছে। পরে অবশ্য এসবের অনেকগুলোই মোক্ষম সময়ে কাজে এসেছিল, তাই আমাদের মেডিকেল অফিসার বন্ধুও কেন ডাক্তারি পড়লনা, তাই নিয়ে বেশ কিছুদিন আফসোসও করেছিল।

এর মাঝে একফাঁকে আমাদের বাসের টিকিটও কেটে ফেলা হয়। আরেকটা দিন যায় সবার জন্য পাহাড়ি পথে চলার পাদুকা আর চওড়া কিনারঅলা টুপি কিনতে। যাত্রার মাহেন্দ্রক্ষণও দেখতে দেখতে ঘনিয়ে আসে। রাতের বাসে ঢাকা ছেড়ে যাব, আর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ভোরের আলো থাকতে থাকতে আমরা বান্দরবান পৌঁছে যাব। তাই কা তব কান্তা বলে আমরা কজন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো মানুষ বান্দরবানগামী শ্যামলীর বাসে চেপে বসি।

গরীবের ঘরে হাতির পা!

ঢাকা থেকে রওনা দেওয়ার পর যে আশঙ্ককাটা বারবার মনের ভেতর উঁকি মারছিল, সেটা হল রাস্তায় উটকো যানজটের খপ্পরে পড়লে আমাদের প্ল্যানটা একেবারে কেঁচে যাবে, তখন আবার হ্যাপাটাও পোহাতে হবে বিস্তর। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে দেখলাম কুমিল্লায় চলে এসেছি। মধ্যরাত্রির পেটপূজো ও তামাকসেবন শেষে আমরা ফের গাড়িতে চড়ে বসি। তবে বরাত ভাল, যে শঙ্কার ভয়ে কাবু হয়ে ছিলাম সেটা আর মোকাবিলা করতে হনি। বেশ নির্বিবাদেই আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছে যাই। এখান থেকে আবার আরেক প্রস্থ ঝামেলার পর আমাদের এক বন্ধু যোগ দেয়। সে যাকগে, বান্দরবানে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্যের আলো ফুটি ফুটি করছে। তবে বাঁচোয়া এই যে, বাইরে শীতের উপদ্রব ছিলনা খুব একটা, হালকা যা ছিল সেটা আমরা বেশ উপভোগই করছিলাম। ব্যাগট্যাগ নিয়ে আমরা শহরে চলে আসি প্রাতঃরাশটা সেরে ফেলতে। তখন মোটামুটি বাজার সরগরম হতে শুরু করেছে। তবে শহরে একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে সেটা আমাদের চোখ এড়ালোনা। ভাজা ডিম,আর পরোটা দিয়ে একটা জম্পেশ আহারের পর গরম চা , মেজাজটা তখন দারুণ তোফা! হোটেলের ম্যানেজারকে শুধালে উনি একগাল হেসে বললেন, গরীবের রবিনহুড,বস্তিবাসীর নয়নের মণি নাম্বার ওয়ান শাকিব খান নাকি শ্যুটিং করতে সদলবদলে বান্দরবানে হাজির। সেটাই দেখলাম তখন টক অব দ্য টাউন। আমাদের আফসোসও যে একেবারে হয়নি তা বলবনা, এহেন জীবন্ত কিংবদন্তীকে এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় দেখার বড় খায়েশ ছিল। কিন্তু সময়ের সংকটের কারণে ও প্ল্যানে সাময়িকভাবে ইস্তফা দিতে হল।

চন্দ্রশকটে আমরা কজনঃ

নাস্তা শেষে এবারের গন্তব্য থানচি। আমরা সাকুল্যে ছিলাম এগার জন, একটা চাঁদের গাড়ি রিজার্ভ করা হবে এমনটাই ঠিক হল। তখন আমাদের প্ল্যানই ছিল যত দ্রুত সম্ভব রওনা দেওয়া, কারণ মাঝে চিম্বুক-নীলগিরি ইত্যাদি জায়গায় ক্যামেরাবাজির জন্য বেশ কিছু সময় বরাদ্দ রাখতে হবে। কিন্তু আমাদের আরেক বন্ধু বেরসিকের মত সেই প্ল্যানে বাগড়া দিয়ে বসল। যেই আমরা চাঁদের গাড়িতে উঠতে যাব হঠাৎ ও ঘোষণা দিয়ে বসল, প্রকৃতি তাকে ভীষণভাবে ডাকছে, ওই ডাকে সাড়া না দিলেই নয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমরা ওকে অনুমতি প্রদান করলাম (বা বলা ভাল, দিতে বাধ্য হলাম)। কিন্তু একি অবস্থা, সে গেলো তো গেলোই, ফেরার আর নামগন্ধ নেই। এদিকে আমরা ঘনঘন ঘড়ি দেখছি আর কুমিল্লায় ঠেসে খাওয়ার জন্য সবাই সবাইকে শাপশাপান্ত করছি। এমন সময় বন্ধু অপেক্ষার পালা সাঙ্গ করে হাজির, শুরুতে বেশ একটা রামধমক দিলেও ওর মুখে অনির্বচনীয় পরিতৃপ্তির হাসি দেখে সে যাত্রায় আর কিছু বললামনা।

চাঁদের গাড়িতে যুত করে চেপে বসার পর শুরু হল আসল মজা। আঁকাবাকা পাহাড়ি রাস্তা, অনেক ওপর থেকে নিচে তাকালে মনে হয় কোন ময়াল সাপ সর্পিল ভঙ্গিতে রোদ পোহাচ্ছে। এর মাঝে ড্রাইভার যেভাবে দক্ষ হাতে গাড়িটা চালিয়ে নিচ্ছিল, তাতে তার এলেমের প্রশংসা করতেই হয়। ওরকম বিটকেলে রাস্তায় এই পথে যে কোন আনকোরা ড্রাইভারই নয়ছয় বাঁধিয়ে ফেলতে পারেন, আর কিছু হলেই একেবারে গিয়ে পড়তে হবে অনেক নিচের খাদে। আমাদের অবশ্য তখন এসব ভাবার ফুরসত ছিলনা, যা দেখছিলাম তাতেই আমরা চোখ বিস্ময়ে ঠিকরে পড়ছিল। এর মাঝে আমরা শৈলপ্রপাতে খানিকক্ষণের জন্য যাত্রাবিরতি করলাম। শৈলপ্রপাত শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। শান বাঁধানো সিঁড়ি দেখে মালুম হল, এখানে পর্যটকেরা হামেশাই হামলা করে থাকেন। শৈলপ্রপাতের মূল আকর্ষণ বলতে তিরতির করে বয়ে চলা একটি ক্ষীণস্রোতা ঝর্ণা। তখনও আমরা নাফাখুমের মাতাল সৌন্দর্য দেখিনি, তাই ওটাই ছিল আমাদের কাছে মহার্ঘ্য। ঝটপট বেশ কয়েকটা ফটোসেশন শেষে আমরা ফের গাড়িতে চেপে বসলাম। নেক্সট স্টপেজ নীলগিরি, এর আগে আর কোন থামাথামি নেই।

শৈলপ্রপাত-

DSCF0367

DSCF0374

DSCF0364

আঁকাবাঁকা পথেঃ

DSC04485

নীলগিরির বুকেঃ

নীলগিরিতেও হেলিপ্যাড!

DSC00150

নীলগিরির নাম আগেও শুনেছি, সেটা যে সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটা রিসর্ট বিশেষ সেটাও জানতাম। গিয়ে দেখলাম জায়গাটা বেশ গমগম করছে, আর বেশ সাজান গোছানো, সবকিছুতেই কেমন যেন যত্নের আতিশায্য স্পষ্ট। এই মগের মুল্লুকে এমন বনেদী ব্যবস্থা দেখে আমার বেশ অস্বস্তি হতে লাগল, তবে ভাগ্য এই যে, এখানে আমাদের থাকার কোন প্ল্যানট্যান ছিলনা (বলা ভাল, আসলে মুরোদ ছিলনা, আপনি জলপাইগোত্রীয় না হলে মোটা টাকা পকেট থেকে খসাতে হবে কিন্তু)। তবে বলতে কসুর নেই, এতকিছুর পরেও জায়গাটা ছবি তোলার জন্য রীতিমত দারুণ। মেঘের দল মনে হচ্ছিল পাশ দিয়ে আলগোছে চলে যাচ্ছে, হাত বাড়ালেই এসে ছুঁয়ে দেবে।অনেক দূরে চিকন ফিতার মত রূপালী নদী আবছা আবছা দেখা যাচ্ছিল, নদীর নামটা অবশ্য সে যাত্রায় আর জানা হলনা। মেঘগুলোকে মনে হচ্ছিল ধোঁয়ার দঙ্গল, হাত দিলেই ধরা দেবে। নীলগিরি অবশ্য সৌখিন পর্যটকদের ভিড়ে সারাবছরই সরগরম থাকে, সামনে গাড়ির বহর দেখে সেখানে যে মানুষ দেদার হানা দেয়, সেটাও বোঝা গেল।

DSC04350

DSCF0475

DSCF0457

ক্যামেরাবাজের অভাব নেই!

DSC04378

আগ্নেয়গিরি বলে ভ্রম হয় নাকি?

DSCF0402

এক নজরে বান্দরবানঃ

DSC04430

নীলগিরির পাট চুকোতে চুকোতে দেখি বেলা অনেকদূর গরিয়ে এসেছে। তখনও থানচি যাওয়ার পথের মেলা দেরি, আমরা কেবলমাত্র অর্ধেকের সামান্য কিছু বেশি পথ পেরিয়েছি। তবে খুব শীঘ্রই বুঝলাম, এ দূরত্বটাও দেখতে না দেখতে খতম হয়ে আসবে। চারপাশে তখন শ্বাসরোধ করা দৃশ্য কেবলই বাড়ছে, আর বাড়ছে আমাদের হল্লা-মাস্তি। এর মাঝে একদুবার দেখি গা কেমন ভিজে ভিজে যাচ্ছে, ভালমত ঠাহর করতে দেখলাম, আমরা আসলে মেঘ ফুঁড়ে এগিয়ে চলছি। এরকম বারকয়েক হালকা ভেজার পর মেঘের দলকে পেছনে ফেলে আমরা ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করলাম। তবে সটান নিচে নামা যাকে বলে তা নয়, লাট্টুর মত পাক খেতে খেতে মন্থর গতিতে ড্রাইভার সুকৌশলে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছিল। এর মাঝে আমরা পেরিয়ে আসলাম বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাস্তা পিক ৬৯, সামরিক বাহিনী এই দুর্গম দুরতিক্রম্য অঞ্চলে কিভাবে এই অসাধ্য করেছে কে জানে! এভাবে দেখতে দেখতে বলিপাড়াও পেরিয়ে এলাম। এটাও বেশ বড়সড় একটা পাড়া, শুনেছি এদিক দিয়ে নাকি কেওক্রাডং যাওয়ার একটা পথ আছে, তবে সেটা বেশ ঝক্কির,বিপদসংকুলও বটে। দেখতে দেখতে আমরা থানচির কাছাকাছি চলে এলাম। চাঁদের গাড়ির পাট চুকালো বলে।

Wednesday, November 10, 2010

এবার কাণ্ড খাগড়াছড়িতে-১

পাহাড়পুরেও কিউই! :

কাননবিলাস সেরে সবে চা-পান করে মনমেজাজ তোফা হয়ে গেল, ওদিকে তখন বেলাও প্রায় গড়িয়ে এসেছে, তাই পঞ্চপাণ্ডবের চকিত সিদ্ধান্ত, এবার শহরের ধার থেকে একটু হাওয়া খেয়ে আসা যাক। অটোমামাকে বলতেই তিনি কিছু পথঘাট ঘুরিয়ে আমাদের একটা বেশ খোলামেলা জায়গায় নিয়ে গেলেন। তখন যাকে বলে আসলেই"বৃষ্টি শেষে রুপালী আকাশ", বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল। দেখলাম, জায়গাটাতে গরু-টরু বেশ নির্বিবাদে চরে বেড়াচ্ছে। একজনকে জায়গার নাম শুধাতেই আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। এই (প্রায়) মগের মুল্লুকে এসেও কিউইদের দেখা পাব ভাবিনি। আচ্ছা খোলাসা করেই বলি, বেশ অনেককাল আগে জনৈক প্রবাসী এই স্থানে এসে বলেছিলেন, আরে এ জায়গা তো দিব্যি নিউজিল্যান্ডের মতো ঠেকছে। সেই থেকে জায়গার নাম হয়ে গেল নিউজিল্যান্ড। তখনো শার্দুলদের হাতে পোড়াকপালে কিউইদের ধবলধোলাই হতে হয়নি, না হয় আমরা বেধড়ক মজাই পেতাম। তবে এহেন পাণ্ডববর্জিত স্থানে এসে নিউজিল্যান্ড তীর্থের পরম সৌভাগ্য হয়ে যাবে তা কস্মিনকালেও ভাবতে পারিনি। একটা ছিমছাম ক্যাফেও দেখলাম সেখানে আছে, ওমা, সেটার নামও নিউজিল্যান্ড ক্যাফে। আর যাই হোক, ভেট্টোরি এন্ড কোংকে অমন বেদম ঠ্যাঙ্গানির পর এ জায়গায় ঘুরিয়ে আনা উচিত ছিল, অন্তত হোম সিকনেসটা একটু হলেও প্রশমিত হত বৈকি। ঐ ক্যাফেতে হালকা পেটপুজো সারতে সারতেই দেখি, আলো বেশ মিইয়ে এসেছে। সেদিনকার মত সফরের তাই সেখানেই সমাপ্তি।

ধবলধোলাইয়ের দেশ নিউজিল্যান্ড

40452_1367366901356_1147195504_30874879_7587762_n

ক্যাফেতে বৈকালিক আহার
39103_1532904969915_1453524600_1413452_2440458_n

আলীবাবার গুহায় পাঁচ চোর:

আগেররাতে পাহাড়ি মুরগী ভুনা, কুচো চিংড়ি দিয়ে শশা আর মাছ ভাজা দিয়ে গলা পর্যন্ত উদরপূর্তি করার ফল হিসেবে পরের সকালে আমাদের ঘুম ভাংল ম্যালা দেরিতে। অথচ, সফরের মোদ্দা অংশটাই তখনও বাকি। তড়িঘড়ি করে হালকা প্রাতরাশ সেরে আমরা আলুটিলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। খাগড়াছড়ি মানেই আলুটিলা, এমন একটা ধারণা বহুকাল আগে থেকেই আমার মাথায় জেঁকে বসেছিল। আলুটিলা গুহায় ঢোকার মুখে দেখি মশালটশাল বিকিকিনি হচ্ছে। ভরা বর্ষার মৌসুম, বৃষ্টি থেকে থেকে ভিজিয়ে দিছিল, তবে সেটা উৎপাত মনে হয়নি মোটেও। আমরা কজন ছাড়া এমন বিটকেলে সময়ে সেখানে আর কোন ট্যুরিস্ট দলের নামনিশানাও ছিলনা। যাক ভালই হল, ভাবলাম আমরা, বেশ প্রেমসে গুহাটা চেখেচুখে দেখা যাবে। তবে অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার গন্ধটা মিলিয়ে যেতে দেরি হলনা যখন দেখলাম গুহার প্রবেশমুখ অবদি রীতিমত শান বানানো সিড়ি। বুঝলাম, প্রমোদভ্রমণপিপাপুদের জন্যই মূলত এই ব্যবস্থা। তবে ভয় একটা ছিলই, সেটা ছিল জোঁকের। জোঁকসংহারের জন্য লবণও নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এসব আঁটঘাট বেঁধে কা তব কান্তা বলে গুহায় ঢুকে পড়ি। ভেতরে একরত্তি আলো নেই, পানি কেটে এগুতে হচ্ছিল বটে, কিন্তু সেটা খুব ধর্তব্যের মধ্যে নয়। মনে করেছিলাম, আর কিছু না হোক, নিদেনপক্ষে একটা দুটো রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার না হলে কি চলে? এমনিভাবে মিনিট দশেক ঘোরার পর সামনে দেখি মিহি আলো চুইয়ে পড়ছে। যাব্বাবা, গুহায় ঢুকতে না ঢুকতেই শেষটা দেখে ফেলেছি, তাহলে আর মজাটা রইল কই? মশালটশাল নিয়ে বেশ একটা থ্রিল ফিল করছিলাম, বেমক্কা সূর্যের আলোর নিচে এসে আমরা একে অন্যের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলাম। একি হল, গুহায় ঢোকাই হল সার, আর জোঁকের জুজুতে খামোখাই কুঁকড়ে ছিলাম, জোঁকের পাত্তাই নেই।

আলীবাবার গুহায়-

39103_1532905129919_1453524600_1413456_3653382_n

ঝর্ণা কিন্তু পাহাড়ের কান্নাই বটে:

আলুটিলার সম্ভাব্য রোমহর্ষক সফর এভাবে মাঠে মারা যাওয়ার পর আমরা কেউ কেউ নখ কামড়াচ্ছিল, আর বাকিরা সুখটান দিচ্ছিলাম। মনটা তখন ভীষণ দমে ছিল। হঠাৎ আমাদের চা-সিগারেট সরবরাহকারী মামার মুখে শুনলাম, আলুটিলা থেকে আরেকটু সামনে গেলে একটা ঝর্ণা দেখতে পাওয়া যায়। আমরা তখনই যাওয়ার জন্য দুপায়ে খাড়া। সুলুকসন্ধান করে জানলাম, আলুটিলা থেকে বাসে মিনিট বিশেক যাওয়ার পর একটা জায়গায় নেমে যেতে হবে। সেখান থেকে পদব্রজে আরো দুই-আড়াই কিলো হাঁটার পর রিছাং ঝর্ণার দেখা মিলবে। তেতে ওঠা মেজাজটা তখন একটু ঠান্ডা হওয়া শুরু করেছে। লোকাল বাসের পা-দানিতে কোনমতে পা রেখে দেখতে না দেখতে আমাদের বাস সটান নামিয়ে দিয়ে গেল। এরপর হাঁটার পালা, তবে সেটাও বেশ চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, আমাদের তাকতেরও বেশ পরীক্ষা হয়ে যাবে। হাঁটার সময় দেখি দূর পাহাড়ে জুম চাষ হচ্ছে,আবার হলুদ না আদা চাষ করা হচ্ছে সেটা নিয়েও আমাদের দুবন্ধুর একপ্রস্থ বাহাস হয়ে গেল। ওদিকে মাঝে খাড়া পাহাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের জিভ বেরিয়ে পড়ল। দম নেওয়ার জন্য একটি ঘরে খানিক বসার দেখি, এতো ছোটখাট দোকানই বটে। এহেন কুস্থানে মিনারেল ওয়াটারের বোতল দেখে আমাদের ধড়ে আসলেই প্রাণ ফিরে এল। তবে ঝর্ণার কাছাকাছি আমরা প্রায় এসে পড়েছি। আর কিছুদুর হাঁটতেই দেখি সামনে কিসের কুলকুল শব্দ শোনা যাছে। মোটামুটি পড়িমরি করেই পরের সিড়িগুলো আমরা ভাঙ্গতে শুরু করলাম। ইয়াহু! রিছাং ঝর্ণায় পৌঁছে গেছি।

যাত্রা তবে শুরু হোক...

39103_1532905649932_1453524600_1413469_7455060_n

যেখানে জিরিয়েছিলাম দুদণ্ড

39103_1532905369925_1453524600_1413462_7762065_n

রিছাং ঝর্ণা একটু আজব কিসিমের, অনেকটা ওপর থেকে ঝর্ণা সশব্দে পড়ছে। আর সেই পানি খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচের জলাশয়ে এসে পড়ছে। ঠাহর করে দেখলাম, আরে পাহাড়ের মাথায় উঠে তো স্লাইড দিয়ে নিচে নামা যায়, কোথায় লাগে এর কাছে ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের বালখিল্য রাইড। তবে ওপরে উঠতে গিয়ে বুঝলাম, কাজটা সহজ নয় মোটেও। এখন সূর্য তেতে উঠলেও খানিক আগের বৃষ্টিতে পাথুরে পাহাড়ের ঢাল বিপজ্জনক রকমের পিচ্ছিল, আমাদের এক কমরেড উঠতে না উঠতেই একেবারে পপাত ধরণীতল। তাও রক্ষে, গোড়ার দিকে হয়েছিল সে যাত্রা বড় কোন অঘটন ঘটেনি। আমিও বারকয়েক আছাড় খেতে খেতে শেষমেশ ইস্তফা দিলাম। ওদিকে আরেকজন কিন্তু তখন রীতিমত আমাদের কাঁচকলা দেখিয়ে স্লাইড দিতে শুরু করে দিয়েছে। তবে আমরা কজন রণে ভঙ্গে দিয়ে নিচেই নেমে আসলাম। নিচে এসে দেখি এখানেও জলকেলির দারুণ বন্দোবস্ত। ঝর্ণার তীব্র জলে গা এলিয়ে দিয়ে আমরা হুটোপুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। গাত্র-প্রক্ষালণ শেষ, এবার ফেরার পালা।

জলকেলি!

38930_1367381221714_1147195504_30874972_5834575_n

মুখ ভার করে থাকা আকাশ

39103_1532905689933_1453524600_1413470_7712217_n

ফেরার পথটা আমাদের সহ্যশক্তির চুড়ান্ত পরীক্ষাই নিয়েছিল। সকালের এক পশলা বর্ষণের পর সূর্য তখন সক্রোধে মাথার ওপর চড়ে বসেছে। খানিক আগেই গোসল সেরেছি, কিন্তু এর মাঝেই ঘামে জামা ভিজে জবজব করছিল। তারওপর ক্রমাগত চড়াই-উৎরাই পেরুনোর হ্যাপা তো আছেই। ওদিকে দুকিলো পথকে মনে হচ্ছিল দুইশ মাইল রাস্তা। এইভাবে কোনমতে চলতে চলতে আবার পানিপানের বিরতি নিয়ে একটু ধাতস্ত হলাম। আমাদের ফেরার কথা আলুটিলা থেকে, বাসের সময় ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। ওদিকে পাদুটো মারাত্মক টনটন করছে, আর ছুঁচোগুলো পেটের ভেতর ডন বৈঠক দিচ্ছে। পাহাড়ের ওপর একটা রিসোর্টে ডিমভাজা, বাঁশের তরকারি আর পরাটা দিয়ে ঝটপট উদরপূর্তি সেরে নিলাম( তবে সাধু সাবধান, ও জায়গায় খাবারের বিল দেখে পাহাড় থেকে বেঘোরে পড়ে গেলে আমায় দুষবেননা যেন)। আকাশ তখন আবার কালো করেছে, একটা তুমুল ঝটকা এলো বলে। ওদিকে আমাদের বাসও এসে পড়েছে, ফের পড়তে শুরু করেছে বৃষ্টিও। আর মাটিরাঙ্গার উঁচুনিচু পথ পেছনে ফেলে আমরা চলেছি চাঁটগার পানে।

Thursday, November 4, 2010

নোলানের খোয়াবনামা

১.

স্বপ্ন নিয়ে কাঁটাছেড়া এ পর্যন্ত নেহায়েত কম হয়নি, কিন্তু সত্যি করে বললে তার কতটুকুই বা আমরা জানি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বলা যায় স্বপ্নের কথা প্রায়ই আমার মনে থাকেনা, আর যেটুকুও মনে থাকে সেটুকুও বোধহয় অনেকটাই আটপৌরে। কোন উঁচু স্থান থেকে নিচে পড়ে যাওয়া, পরীক্ষার হলে সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে অথচ একটি প্রশ্নের উত্তরও ঠিকঠাক দিতে পারছিনা বা কোন কিছু আমাকে তাড়া করছে, আমি ক্রমাগত ছুটছি- এসব স্বপ্নই ঘুরেফিরে আমার ঘুমে হানা দেয়। মজার ব্যাপার হল, আচমকা যখন ঘুম ভেঙ্গে যায় তখনই স্বপ্নটা মাথায় গেঁথে থাকে। একটু তলিয়ে দেখতে গিয়ে জানলাম, আমাদের ঘুমের একটা সুনির্দিষ্ট স্তরেই এই স্বপ্ন দেখার কাজটা ঘটে। এই স্তর আবার ঘুমের মাঝেই বেশ কবার ঘটে থাকে। তো এই পর্যায়ে এসে যখন ঘুমটা কেঁচে যায় তখনই ওই স্বপ্নটা ছাপ রেখে যায়। এজন্যই বোধহয় আমাদের সুখস্বপ্নগুলোর স্মৃতি খুব একটা মনে থাকেনা, অথচ দুঃস্বপ্নের স্মৃতি সবারই কমবেশি থেকে থাকে।

২.

স্বপ্নের নিখুঁত ঠিকুজির সুলুকসন্ধান বিজ্ঞানীরা এখনো ঠিক পাননি, এক্ষেত্রে আবার নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ এমনকিও একথাও ঠাউরে থাকেন, স্বপ্ন আদপে এক ধরনের ঐশীবাণীই বটে। তাদের মতে, স্বপ্নই এক অজানা জগতের সাথে আমাদের যোগাযোগের চাবিকাঠি। এমন দাবি হয়তো অনেকের কাছেই কষ্টকল্পনা ঠেকবে, কিন্তু ওবিই বা আউট অফ বডি এক্সপেরিয়েন্সের কথা মাথায় রাখলে এক লহমায় এ দাবি উড়িয়ে দেওয়া যায়না। অনেকেই হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কাজগুলোর অনুভূতি অনেকসময় স্বপ্নে বেশ প্রকট হয়ে ওঠে। ধরা যাক, আপনি স্বপ্নেই কোন জায়গা থেকে পড়ে যাচ্ছেন, ওই মুহুর্তে কিন্তু আপনার অনুভূতি পুরোটাই ভয়াবহ রকমের জান্তব, অথচ পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু আপনার ঘুমের মাঝেই ঘটছে। দেহ থেকে আত্মার এই সাময়িক বিচ্ছেদের সময় এই ধরনের অভিজ্ঞতার গোমরটা আসলে তাহলে কোথাও? এই প্রশ্নের উত্তরও ব্যাপকই ঘোলাটে, এ বিষয়ে গবেষণা এখনও জোরেসোরে চলছে, তাই বিভিন্ন তত্ত্বের কথা বলা হলেও একেবারে চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা এখনো কোনটি পায়নি। কেউ কেউ বলে থাকেন, আমাদের চেতনা দেহ থেকে ভিন্ন একটি সত্ত্বা বা বলা ভাল দেহবিহীন চেতনা এবং চেতনাবিহীন দেহ দুই-ই সম্ভব। এই জন্যই দেহবিচ্ছিন্ন হয়েও স্রেফ আমাদের চেতনার কারণে আমরা স্বপ্নের মাঝেও স্বাদ, গন্ধ, স্পর্শের মত অনুভূতিও পেতে পারি। তবে এটা একটা থিওরি মাত্র, এরকম এন্তার থিওরি আছে এবং সেগুলো নিয়ে আগাপাশতলা ব্যবচ্ছেদ আজ অবধি জারি রয়েছে। আরেকটা কথা বলে রাখা ভাল, স্বপ্ন পারলৌকিক বা অন্য জগতের সাথে মেলবন্ধনের যোগসূত্র এমনটা যারা ভেবে থাকেন, তাদের মতে স্বপ্ন আসলে জাগরণেরই বিকল্প একটি রুপ। কিন্তু এই যুক্তি খোঁড়া মনে হয় একারণে যে , স্বপ্ন আসলে অবচেতন মনেরই একটা দশা মাত্র, আর স্বপ্নের সময় আমাদের ব্রেইনের সংকেতগুলো এ ধারণাই দেয়।

৩.

একটা মজার ঘটনার কথা বলি। আমাদের এক বন্ধু বলছিল তার স্বপ্নের কথা। মাসতিনেক আগে সে স্বপ্ন দেখে সে কয়েকজন অচেনা ছেলের সাথে একটা হোটেলের কামরায় আড্ডায় মশগুল। ঐ সময় আচমকা তার ঘুম ভঙ্গে যায়। পরে তার রুমমেটকে সে ওই স্বপ্নের বয়ান দেয়। মজার ব্যাপার হল, ঠিক কদিন আগে আমাদের বান্দরবান ট্যুরে ঐ বন্ধুই আরো কজনের সাথে এক কামরায় রাত কাটায়। বলাই বাহুল্য, তাদের পরিচয়টা ওই ট্যুরেই পয়লা ঘটেছিল। স্বপ্নের অলোকদর্শন ক্ষমতার এমন নজির খুব বেশি বিরল নয়। আর এ ধরনের প্রোফেটিক স্বপ্নের জন্যও স্বপ্ন নিয়ে বিভিন্ন উদ্ভট থিওরি হালে পানি পেয়ে যায়। অলোকদর্শন (যদি ব্যাপারটা আসলেই থেকে থাকে) স্বপ্নের একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষংগ, সমস্যা হল নিতান্তই কাকতাল বলে এ ধরনের স্বপ্নকে হয়তো কনফার্মেশন বায়াস বা অন্যকোন পরিসংখ্যানের গেরোয় ফেলে দিয়ে দিব্যি নাকচ করা যায়, তাই বলে ব্যাপারটা কি আদতেই এক লহমায় উড়িয়ে দেওয়া যায় কি?

৪.

বলতে দ্বিধা নেই, স্বপ্ন নিয়ে এসব ভাবনার খোরাক পয়লা পাই গুনী ফিল্মমেকার ক্রিস্টোফার নোলানের সাম্প্রতিকতম ছবি "ইনসেপশন" দেখার পর। প্রেস্টিজ, মেমেন্টো, ডার্ক নাইটের মত বহুল পরিচিত বা ফলোয়িং এর মত স্বল্প পরিচিত সিনেমাগুলো দেখার পর এমনিতেই নোলানের ভক্ত বনে গিয়েছিলাম, তাই ইনসেপশন নিয়ে কৌতূহলের পারদটা খুব চড়াই ছিল। হাতের কাছে পাওয়া মাত্র দেখে ফেলতে তাই কসুর করিনি মোটেই। সিনেমাটি তুঙ্গে ওঠা সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছে কিনা এমন সওয়ালের জওয়াব দেওয়ার আগে স্বপ্ন নিয়ে নোলানের চিন্তাভাবনাটা একটু বলা দরকার। ইনসেপশনের ধারণা নোলান অনেকদিন ধরেই পেলেপুষে বড় করেছিলেন, তবে ঠিক কীভাবে এটাকে ফুটিয়ে তুলবেন সেটা নিয়ে শুরুতে তার মনে একটু দ্বিধাই ছিল। ভাবনাটা দানা বাঁধতে শুরু করে যখন নোলান এমন একটা জগতের কথা কল্পনা করেন যেখানে সবার স্বপ্নগুলো একটি অবিচ্ছিন্ন স্বপ্নরাজ্যে মিশে একাকার হয়ে আছে। সম্পূরক চিন্তা হিসেবে তার মাথায় তখনই আসে, আরে তাই যদি হতো, তবে স্বপ্ন নিয়ে নয়-ছয়ও হতে পারে বৈকি। মোদ্দা কথা হল, ইনসেপশনের মূল যে বুনিয়াদ, অর্থাৎ স্বপ্নচুরির আইডিয়া তখনই তার মাথায় আসে। নোলানের এই স্বপ্নবাজি শুরু হয় ষোল বছর বয়েসে, যখন এক ল্যুসিড ড্রিমের পর তার মাথায় এই চিন্তা আসে। নোলান অবশ্য বলতে কসুর করেননি, বোর্হেসের লেখা পড়ে তিনি এই দুরুহ কাজে হাত দিতে বেশ ভাল রকমের প্রণোদিত হন।

বলা যায়, এই ভাবনা অঙ্কুরিত হতে বেশ সময় নিয়েছে। গোড়ায় তো নোলান ভেবেই রেখেছিলেন ম্যুভিটা হবে ভৌতিক আবহের। কিন্তু হরর ম্যুভিগুলোর সেই চিরকালীন সমস্যা- আবেগ বা অনুভূতিগুলো শেষমেশ খেলো হয়ে যাওয়ার কারণে এই ধারণা থেকে তিনি সরে আসেন। এইখানে অবশ্য আমি নিজে নোলানকে বাহবা দেব, কারণ স্বপ্নের মত একটা দুর্বোধ্য ভাবনা লালনা করার জন্য হরর ব্যাকগ্রাউন্ড আদপেই ঠিক যুতসই হয়না। এভাবে বছর দশেক ব্যয় হয় স্ক্রিপ্টটাকে ঠিকঠাক করে মূল ব্যাপারগুলোকে একসুতোয় গাঁথার জন্যে। এটাও মেলা আগের কথা, ঠিকঠাক বললে ২০০১ সালের দিকে। তবে তখনই ঠিক করেন সিনেমাটা তিনি রয়েসয়ে বড়সড় বাজেট নিয়ে বানাবেন। স্বপ্নে কিন্তু মানুষ এক নিমেষে অসাধ্য সাধন করতে পারে, আর মানুষের মনের ক্ষমতার দৌড় কদ্দুর, তা নিয়ে আজ অবধি কোন সঠিক মাপজোখ পাওয়া যায়না। শেষমেশ নোলান ঠিক করেন, স্বপ্ন নিয়ে কারবার করতে হলে বিশাল একটা স্কেলেই কাজ করা সমীচীন। আজ তাই দীর্ঘদিনের স্বপ্নবাজির ফসল আজকের ২০১০ সালের ইনসেপশন।

৫.

যাই হোক, একজন দর্শক হিসেবে যদি বলি, সিনেমাটা দেখতে গিয়ে কোথাও টাল খেতে হয়নি, পুরো সময়টা জুড়েই রোলারকোস্টারে চড়ার মত একটা টানটান উত্তেজনার স্বাদ পেয়েছি, একথা বলতেই হবে। তবে স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন ব্যাপারটা আমাকে আসলেই তাজ্জব করে দিয়েছে। স্বপ্নের ভেতর আরেকটা স্বপ্নের কথা না হয় মানা গেল, কিন্তু তার ভেতরেই আরেকটা স্বপ্ন? ব্যাপারটা কিঞ্চিত ঠাহর করতে পারতেই আমার মাথায় যে প্রশ্নের উদয় হল, এই দ্বিতীয় স্তরের মাঝেই আরেকটা স্তরও কি অসম্ভব? আদতে নোলান কিন্তু তাই দেখালেন, আর এটাই দর্শকের একটা পেলব অনুভূতির রেশ কাটিয়ে মাথার ভেতর ভাবনার ঝড়ে বইয়ে দেওয়ার নোলানের নিজস্ব কারিকুরি। আর কিছু কিছু ব্যাপার, যেমন স্বপ্নের স্তরগুলোর গভীরতা যতই বাড়তে থাকবে ততই তাদের সময়ের ব্যপ্তিও বাড়তে থাকবে। সোজা কথায় বললে বাস্তবে যখন আমরা ঘুমের যে সময়টুকু নিয়ে স্বপ্ন দেখি, তার স্থায়িত্বকাল কিন্তু খুবই কম। কিন্তু ওই সময়েই স্বপ্নের ব্যপ্তিকাল অনেক বেশি। এ ব্যাপারগুলো মোটামুটিভাবে অনেকের কাছে বোধগম্য, ম্যুভি দেখার সময় কোন জগতটা বাস্তব আর কোন জগতটা স্বপ্নের, আর স্বপ্নের হলেই এর কোন স্তরের এ নিয়ে কোন খটকায় অন্তত আমাকে পড়তে হয়নি। তবে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, স্তরগুলো নিয়ে ঘোরতর কুহক নোলান বুঝেশুনেই এড়িয়ে গেছেন, অন্তত এই ক্ষেত্রে তিনি দর্শককে ঘোল খাওয়াতে চাননি চিনি।

একইভাবে স্বপ্ন ছিনতাই বা স্বপ্নের মাঝে আরেকটা ভাবনার বীজ বুনে দেওয়ার ব্যাপারটাও নোলানীয় কারদানিই বটে। স্বপনের ভেতরকার জগতটাকে গড়ে তোলা ও নিয়ন্ত্রণ করার মত বিটকেলে ব্যাপারগুলোও নোলান আশ্চর্য দক্ষতায় দেখিয়েছেন। সিনেমার কাহিনি মূলত এ নিয়েই, ডমিনিক কবের(লিওনার্দো দি ক্যাপ্রিও) নেতৃত্বে একদল কর্পোরেট স্পাইয়ের স্বপ্ন চুরির মিশনের ওপর ভর করেই কাহিনি এগি্যেছে। বলাই বাহুল্য, ব্যাপারটা এত সরল আর থাকেনা, ধীরে ধীরে এক জটিল আবর্তে তারা সবাই বাঁধা পড়ে যায়। তারপর...থাক, কাহিনির বয়ানে আর না যাই, সে গপ্পো পরেও ফেঁদে বসা যাবে। তবে একটা কথা না বললেই নয়, কাহিনিতে কবের স্ত্রী মলের(ম্যারিওন কোটিয়ার্ড) ভূমিকা শুরুতে খুব একটা প্রকট না থাকলেও শেষমেশ কিন্তু এই চরিত্রটির উপস্থিতি আলাদাভাবে ঠাহর করা গেছে। আর যে বারদুয়েক আমি সামান্য সময়ের জন্য ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম, সেটাও ওই মলকে নিয়ে তৈরি করা ধোঁয়াশার কারণেই।

সত্যি করে বললে , সিনেমাটির অসাধারণ কন্সেপ্ট বাদ দিলে আলাদাভাবে উচ্চকিত হওয়ার খুব বেশি কিছু বোধহয় নেই। সিনেমার একেবারে শেষের দৃশ্যের হালকা রহস্য ছাড়া তব্দা খেয়ে যাওয়া নোলানীয় মোচড়ও দেখা পাওয়া ভার, তবে আমার নিজস্ব খেদ থেকে থাকবে এই কারণে এই দুর্দান্ত আইডিয়াটার শেষটা একটু জোলোই হল। স্বপ্নবাজির ব্যাপারগুলো স্তব্ধ করে দেওয়ার মতই ছিল, থ্রিলটাও ছিল পুরোদমে, কিন্তু ওই যে নোলানীয় সিগনেচারটা ঠিক যেন দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। তবে নোলানের আত্মপক্ষ সমর্থনে কিন্তু এই জিনিসটাই চলে আসে, তিনি অকপটে স্বীকার করেন এই সিনেমা দেখতে গিয়ে দর্শকদের কোন জট না ছাড়ানো জটিল ধাঁধার সন্ধান দেওয়া তার অভিপ্রায় ছিলনা মোটেই। তাই নোলান নিজেই যখন বলেন, সিনেমাটা আসলে একটা রোলার কোস্টার রাইড, আর ব্যাপার আসলে একটাই, রাইডটাকে স্রেফ উপভোগ করা- তখন আমাদের আশায় তিনি আক্ষরিক অর্থেই জল ঢেলে দেন। তবে স্বপ্ন নিয়ে আমার ভাবনাগুলোকে উস্কে দেওয়া জন্য নোলান একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন বৈকি।

ফুটনোটঃ শুরুতে স্থির করেছিলাম, ইনসেপশন নিয়ে একটা গোছানো রিভিউই লিখব, পরে রিভিউ লিখতে গিয়ে পাছে বেরসিক স্পয়লার অ্যালার্টের উটকো খপ্পরে পড়ে যাই, সে চিন্তায় ওই প্রজেক্টে ইস্তফা দেই। শেষমেশ পোস্টটা দাঁড়ালো স্বপ্ন নিয়ে কিছু উড়ুক্কু বাতচিতের গপ্পো।

Tuesday, October 19, 2010

ওয়েন রুনি-নামা ও একজন ব্রায়ান ক্লাফ


১.

কদিন ধরেই ফুটবলপাড়া সরগরম, সত্যিই কি ওয়েন রুনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছেড়ে চলে যাচ্ছে? পক্ষে বিপক্ষে নানান সমীকরণ, তবে বুড়ো ফার্গির একরোখা মনোভাবকে মাথায় রাখলে ব্যাপারটা আমলে না নিয়ে পারা যায়না। তার ওপর স্টাম, বেকহাম, তেভেজ ,নিস্টলরয় বা হালের রোনালদোরদের কথাই বা ভোলা যায় কী করে? ফার্গির সাথে তাদের বাহাস কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওল্ড ট্রাফোর্ড ছেড়ে যাওয়ার মাধ্যমেই মিটেছে। মজার ব্যাপার হল, এইসব দলত্যাগীদের সিংহভাগেরই ঠিকানা হয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। রুনির বারেও তেমনটাই ঘটার সম্ভাবনা আপাতত সবচেয়ে বেশি মনে হচ্ছে। গত বেশ ক ম্যাচেই গোড়ালির ইনজুরির ধুয়া তুলে তাকে সাইডবেঞ্চে বসিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ ইংল্যান্ডের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে রুনি এই ইনজুরির কথা বেমালুম চেপে গেছেন। তাই দুয়ে দুয়ে যারা চার মিলিয়ে ফেলছিলেন, তাদের ভাবনার পালে হাওয়া দিতে এবার খোদ ফার্গিই স্বীকার করলেন, রুনি সত্যিই ক্লাব ছাড়তে চাইছেন। তবে খবর অনুযায়ী [url=http://soccernet.espn.go.com/news/story?id=834208&sec=england&cc=4716]তারকা খেলোয়াড় দলে না ভেড়ানোর[/url] কারণেই রুনি দল ছাড়তে পাগলপারা, যদিও অবস্থাদৃষ্টে সে যুক্তি ধোপে টেকেনা বলেই মনে হছে। ফার্গি বরাবরই দাপুটে মেজাজের, তার সাথে একঘাটে জল খাওয়ার হিম্মত তিনি মোটেই বরদাশত করেননা। রুনির সাম্প্রতিক গোলখরা মাথায় রেখেও তাই বলা যায়, এই আকস্মিক প্রস্থান আদপে গুরু শিষ্যের সম্পর্কের চরম অবনতির দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। অথচ, গিগস, স্কোলসের আসন্ন বিদায়ের পর রুনিকেই সবাই ম্যানইউর পরবর্তই আইকন হিসেবে ঠাউরেছিলেন। দেখা যাক, জল কদ্দুর গড়ায়। তবে রুনির বিদায়ে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের বেহাল অবস্থা আরো প্রকট হবে, সাধারণ্যে আপাতত এটাই ধারণা।

২. রুনি ডামাডোলে আরেকটি খবর বিলকুল চাপা পড়ে গেছে, হ্যাঁ, লিভারপুলের হতশ্রী দশার কথাই বলছি। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম সফলতম ক্লাবটি এখন রেলিগেশনের খাঁড়ায় ঝুলছে। পয়েন্ট তালিকায় নিচ থেকে দুনম্বরে এখন তারা খাবি খাচ্ছে, স্মরণকালে সবচেয়ে জঘন্যতম শুরু তাদের, একথা বোধহয় না বললেও চলে। ফর্মের সাথে যুঝতে থাকা টরেস, জেরার্ডদের মনে হচ্ছে আসল রুপের ছায়া মাত্র, অফেন্স-ডিফেন্স সবখানেই তাদের বেহাল দশা। নয়া কোচ রয় হজসন নবিশ নন, পোড় খাওয়াই বলতে হবে, দলবদলে বাজারসদাই খুব একটা খারাপ করেননি। কিন্তু নতুনরাও একেবারেই হতাশ করছে, আর পুরনো পাপীদের অবস্থাও তথৈবচ। । এরকম আর কিছুদিন চললেই হজসনকে পাততাড়ি গোটাতে হবে ,কিন্তু সেটাই কি সবকিছু বদলে দেবে? মনে হয়না। তারওপর হালে মালিকানা নিয়ে একপশলা নাটকের পর দলটা আসলেই টালমাটাল হয়ে পড়েছে। জাবি আলন্সর বিদায়ের পর থেকে লিভারপুলের পারফরম্যান্সের নিম্নমুখী গ্রাফ এই মৌসুমে মাসকেরানোর দলত্যাগের পর আরো প্রকট হয়েছে। এখন লিভারপুলের খেলা দেখলে চোখ কড়কে নিতে হয়, এই কি সেই লিভারপুল, ইস্তাম্বুলের মাঠে যারা তিন গোলে পিছিয়ে পড়েও জন্ম দিয়েছিল ফুটবলের অবিস্মরণীয় কামব্যাকগুলোর একটি ? ছন্নছাড়া এই দলটির একটা টনিক এখন ভীষণ প্রয়োজন, কিন্তু সেই টনিক কী হতে পারে... লিভারপুল ভক্তদের জন্য এটি একটি কোটি টাকার প্রশ্ন।


৩.

লোকটাকে বলা হয় কখনো ইংল্যান্ড জাতীয় দলের কোচিং না করানোদের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাতজন।পাঁড় ফুটবলানুরাগী না হলে নামটা হয়তো আপনার কাছে খানিকটা আনকোরাই ঠেকবে, তবে এটা হলফ করেই বলা যায়, [url=http://en.wikipedia.org/wiki/Brian_Clough]ব্রায়ান ক্লাফের[/url] মত ক্যারিশম্যাটিক কোচ ফুটবল ইতিহাসে কমই এসেছেন। দ্বিতীয় বিভাগের নিচু সারির দল ডার্বি কাউন্টিকে যিনি প্রথম বিভাগে তোলেন এবং সেখানেই ক্ষান্ত না দিয়ে ৮৮ বছরে প্রথমবারের মত শিরোপা এনে দেন, আবার ফিনিক্স পাখির পুনর্জন্মের মত আরেকটি অখ্যাত ক্লাব নটিংহাম ফরেস্টকে টানা দুবার ইউরোপিয়ান কাপ জেতান ,তাকে ক্যারিশমাটিক ছাড়া আর কীই বা বলা চলে। আর বলাই বাহুল্য, এই রত্নখচিত ক্যারিয়ারে প্রায়ই বিতর্কের আঁচ লেগেছে, মিডিয়ার আঁতশকাচের নিচেও তাকে হরবখত থাকতে হয়েছে।

ব্রায়ান ক্লাফ যেখানেই গিয়েছেন, বিতর্ক বরাবরই তার পিছু নিয়েছে। তবে বীণাপাণি দুহাত ভরে এই একরোখা দুর্বিনীত স্বভাবের ডাকসাইটে কোচটিকে বর দিয়েছেন ,সাফল্যের জন্য মাথা খুঁড়ে মরতে হয়নি তাকে কখনোই। [url=http://www.imdb.com/title/tt1226271/]দ্য ড্যামড ইউনাইটেড[/url] ছবিটি এই বর্ণাঢ্য লোকটিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। মোটাদাগে বললে ছবিটি ফুটবলসংশ্লিষ্ট বলা যায়, কিন্তু ফুটবলকে ছাপিয়ে ক্লাফ সাহেবের ক্যারিশমা বারবারই ছবিতে মূর্ত হয়ে ওঠেছে।সিনেমায় অবশ্য ক্লাফের কীর্তিগাঁথা দেখার আশা করে থাকলে খানিকটা হতাশ হতে হবে, ছবির মূল কাহিনি তার লিডস ইউনাইটেডের কোচ থাকার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কয়েকটা দিন। পিটার টেলরের সাথে তার যুগলবন্দি ছিল ডার্বি কাউন্টির জিয়নকাঠি, কিন্তু উচ্চাকাংখী ক্লাফ ডার্বির মায়া কাটিয়ে লিডস ইউনাইটেডের হাল ধরেন। তবে আরেক দুঁদে কোচ ডন দেভির ছায়ায় মাথা খুঁড়ে মরতে থাকা লিডসে তার সময়টা সুখের কাটেনি মোটেও, নানান সংকটে তিনি জেরবার হয়ে পড়েন।তারপর... বাকিটা না হয় নাই বলি।

ব্রায়ান ক্লাফ আদপেই ছিলেন একজন খ্যাপাটে মানুষ, সহকারী পিটার টেইলর ছিলেন তার সর্বান্তকরনেই তার পরিপূরক, আর মেজাজী ক্লাফের রাশ টেনে ধরার কাজটা প্রায়ই টেলরকেই করতে হত। ক্লাফের মতিভ্রমে মানিকজোড়ে সাময়িক ছাড়াছাড়ি হলেও অচিরেই তাদের ফের মিলন ঘটে, তারপর বাকিটুকু স্রেফ ইতিহাস। জলাফের চরিত্রে মার্টিন শিন ছিলেন অনবদ্য, ফুটবল কোচের ভূমিকায় বেশ ভালি মানিয়েছিলেন তিনি। বাকিরাও যা যার ভূমিকায় উতরে গেছেন। মোদ্দা কথা, ফুটবলভক্তরা ছবিটি দেখলে পস্তাবেননা, এ গ্যারান্টি দেওয়াই যায়।

এতক্ষণ বেশ ইতিহাস কপচালাম ,মনে মনে হয়তো ভাবছেন, আরে ক্লাফের সাথে তো আরেক সাফল্যপ্রসূ কোচ হোসে মরিনহোর ভালই মিল। আমি অবশ্য মরিনহোকে আধুনিক ক্লাফ বলতে নারাজ, সাফল্যের বিচারে কার পাল্লা ভারি সেটাও নির্ণয় করা দুরুহ বটে। তবে মরিনহোর সাথে ক্লাফের যে কিছু মিল আছে ,সেটা অস্বীকার করার জো নেই। আর আজকের খাবি খেতে থাকা লিভারপুলের যে আরেকজন ক্লাফ দরকার , খুব খুব করে দরকার, সে বিষয়েও কোন দ্বিধার অবকাশ নেই। কিন্তু সেই কান্ডারী কে হবেন, এ সওয়ালের জবাব আপাতত আমাদের কাছে নেই।

Friday, October 15, 2010

প্রলাপসমগ্র

কেন লিখি? এ সওয়াল পুছতে কোন ঝঞ্ঝাট নেই বটে, কিন্তু উত্তর দেওয়ার হ্যাপা বিস্তর। লেখালেখি কালেভদ্রে যা করি সেগুলো ধর্তব্যের মাঝে পড়ে বলে মনে হয়না, কিন্তু একথা কুন্ঠাহীন চিত্তে স্বীকার করি, লেখার একটা তাড়না প্রায়ই প্রবলভাবে অনুভব করি। হয়তো ঠিক করলাম, কোন একটা বিষয় নিয়ে লিখব, মনে মনে একটা রাফ আউটলাইনও খাড়া করলাম, কিন্তু কোন এক বিচিত্র কারণে কিবোর্ডে আঙ্গুল স্পর্শ করা মাত্রই গতি অস্বাভাবিক রকমের শ্লথ হয়ে পড়ে, একসময় রণে ভঙ্গে দিয়ে উঠে পড়ি। এভাবে কত কিছুইতো অকালেই ঝরে পড়েছে, ড্রাফট হিসেবে খোলসবন্দি হয়ে পড়ছে, বরাত খুব বেশি ভাল না হলে তাদের কারও সহসা আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনাও নেই। লিখতে আমার রাজ্যের যত আলিস্যি, তারপরও উড়ুক্কু লেখাজোখার ভূত মাথা থেকে চট করে নামতেই চায়না। এদিকে সারাদিন খুচরো খাচরা পড়া ঠিকই হয়ে যায়। এক সচলেই আজকাল বেশ খানিকটা সময় বুঁদ হয়ে থাকতে হয়, তায় পত্রপত্রিকা ইত্যাদি মিলিয়ে বেশ খানিকটা সময় পড়ার পেছনেও ব্যয় হয়ে যায়। তারপরও দেখা গেল , কিছুটা সময় স্রেফ লেখার জন্যই বরাদ্দ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু শেষমেশ সেটা আর হয়ে ওঠেনা। আর তাই হপ্তায় হপ্তায় বিশালবপু রিপোর্টের কথা বাদ দিলে ইদানিং লেখার হার একেবারেই শুন্যের কোটায়।

তারপরও কিছুমিছু যে একেবারেই লেখা হয়না তা নয়। মাঝে মাঝে বেমক্কা একটা জোয়ার আসে, সেই জোয়ারের ঠেলায় তখন আপনিই লেখা হয়। তখন লেখার জন্য খোরাকের অভাব হয়না, আর লেখাও এগোয় তরতরিয়ে, একেবারে দাপুটে বেগে উজিয়ে চলে। কিন্তু এই ধাক্কাটা আসে উটকো, কোন জানান না দিয়েই, আর সেটার জন্য হাপিত্যেশই করে যেতে হয়। তারপর আবার যেইকে সেই। আবার ঝিমিয়ে পড়া এবং মাথা খুঁড়ে মরা ছাড়া কিছু করার থাকেনা।

এখন কেউ যদি আচমকা বলে বসেন, উপসর্গ তো রাইটার্স ব্লকের সাথে বিলক্ষণ মিলে যাচ্ছে, তবে আমাকে হারেরে করে তেড়ে আসতেই অবে। এইবেলা বলে রাখা ভাল, ব্যাধি যতই সংক্রামক হোক, এসব সম্ভ্রান্ত ব্যাধি আমাদের মত উন্মার্গিকদের কস্মিনকালে হবে বলে মালুম হয়না। হবেই বা কেন বলুন, আমি আজকে থেকে একবারের তরে কিবোর্ড না চাপলেও এমন কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হবেনা, যে দুচারজন বন্ধুবান্ধব অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে না পেরে পড়ে ফেলে, আর পড়ার পর বাধ্য হয়েই পিঠ চাপড়ে দেওয়ার ভান করে, তারা হয়তো একদুবার তাগাদা দেবে, কিন্তু স্রেফ এ পর্যন্তই। কদিন বাদে কিবোর্ডে ধুলোর স্তর পুরুও হতে থাকবে, এছাড়া আর কোন ইতরবিশেষ হবে বলে মনে হয়না। হাজার হোক, আজতক লেখালেখি নির্ভেজাল আনন্দের রসদ ছাড়া বৈ আর কিছু তো নয়। পারিবারিক হ্যাপা, শারীরিক-মানসিক অবসাদ ইত্যাদিকে যদি লেখালেখির অন্তরায় ধরে নিই, তবে তা হবে নিছক ছেনালিপনা মাত্র।

এই যেমন ধরুন, এই মুহুর্তে করোটিতে একটা গল্পের প্লট ঘুরপাক খাচ্ছে। কাহিনির একটা সরলরৈখিক রুপও খাড়া করে ফেলেছি এর মাঝে, শুরুটাও বোধ হয় মন্দ হয়নি, কিন্তু এরপরই গিয়ে ঠোক্কর খেতে হল, হঠাৎই খেই হারিয়ে ফেললাম। একবার মনে হল, এভাবে লিখি। খানিক লিখেই আবার সেটা মুছে ফেলি। এভাবে কিবোর্ডের ওপর দিয়ে রীতিমত ঝড় বয়ে গেছে, কিন্তু আদপে লাভের খাতায় লবডঙ্কা, যে তিমিরে ছিলাম এখনো সে তিমিরেই আছি। শেষমেশ যেটা হল, এখন গল্পটার ওপরই বেশ একটা অনীহা জন্মে গেছে, যে কাঠামো খাড়া করেছিলাম সেটাকেও জোলো ঠেকছে। কাহিনির চরিত্রগুলোও বেখাপ্পা হয়ে উঠছে, তাদের বাগ মানানো হয়ে পড়ছে নিতান্তই কঠিন। ফলে এই গল্পটাও বোধহয় আঁতুরঘরেই মারা যেতে বসেছে, যদিনা বিলকুল অবাক করা কিছু ঘটে না থাকে।

তবে এর মাঝে সৈয়দ হকের মার্জিনে মন্তব্য পড়ে হালে কিছুটা হলেও পানি পেলাম। সৈয়দ হক যেখানে কুন্ঠাহীন রায় দিয়ে গেছেন- কোটি কোটি গল্প লেখা হয়ে গেছে, সম্পূর্ণ নতুন গল্প নির্মাণ করা আর সম্ভব নয়, সব সম্ভাবনাই শোষিত নির্মমভাবে, তখন মনে হয়, এভাবে গল্পটিকে অকালেই গলা টিপে না মারলেই পারতাম। হাজার হোক, সব নতুন গল্পই যদি হয় নতুন বোতলে পুরাতন মদিরা, তখন সেখানে কোন গল্পের অকালপ্রয়াণ আমায় ব্যথাতুর করে বৈকি।


মাঝে মাঝেই ভাবি ,গল্পের সুলুক সন্ধান লেখকেরা করেন কীভাবে? কী উপায়ে এমন জম্পেশ সব কাহিনির প্রসব হয়? উত্তরটা অনেক সময় আমিই আপনমনে দিতাম , লেখকদের দেখার চোশ আর ভূয়োদর্শনই হয়তো মোক্ষম তফাত গড়ে দেয়। কিন্তু গল্পের শেষের অমন পিলে চমকানো মোচড়, সেটাই বা আসে কী করে? এইখানে বলতেই হবে, স্রেফ টুইস্ট খুঁজতে গিয়ে একসময় বিভ্রান্ত হতাম, মনে করতাম ,এই টুইস্টের ভেতরেই বুঝি গল্পকারের যাবতীয় কেরদানি, তবে সৈয়দ হকের বয়ানে সেই ভ্রান্তির অপনোদন খানিকটা হলেও হয়েছে। শুনুন তবে-

[i]গল্প খোঁজায় যাঁরা বিশ্বাস করেন তারা আসলে দৈবের ওপর নির্ভর করেন, এ কালে যখন অন্নবস্ত্রের জন্যেও দৈবের ওপর মানুষের বিশ্বাস নেই, তখন গল্পের জন্য তার ওপর নির্ভর করাটা নিতান্তই হাস্যকর। [/i]

একথার পর বোধহয় আর কিছু বলা চলেনা। তারপরও নাটকীয়তার প্রতি একটা পলকা মোহ হয়তো অজান্তেই গল্পকারের ভেতর কাজ করে, আর সেই ফাঁদে লেখক বেভুলে পা দিয়ে বসলেই হয় সাড়ে সর্বনাশ।সে যাকগে, এসব কথা ফেঁদে নিজের অক্ষমতা আর আড়াল করতে চাইনা। এখন কেবল অপেক্ষার পালা, আবার হয়তো একটা জোয়ার আসবে, তখনই এই রাহু থেকে ঘটবে আমার নির্বাণলাভ।

Wednesday, September 15, 2010

নো ইঞ্জিনিয়ারিং ওনলি ফুটবল"

১.

খোমাখাতায় নটঘট করতে করতে হঠাত একটা বিটকেলে গ্রুপ চোখে পরল, "নো ইঞ্জিনিয়ারিং ওনলি ফুটবল" , ভাবলাম, এ আবার কেমনতরো গ্রুপ রে বাবা। বলতেই হবে, ঢুঁ মারতেই মনটা আনচান করে উঠল, আরে এ যে আমাদের মত পথ ভুলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে আসা ফুটবল ফ্যানাটিকদের জন্যই। দেরি না করে চটজলদি জয়েন করে ফেললাম। আর সবকিছু একপাশে থাক, কিন্তু ফুটবল না হলে আমাদের যে একেবারেই চলেনা!
২.

টানা তিন তিনটি ক্লাস শেষ করে আমরা তখন হেদিয়ে পড়েছি, কেউ কেউ কড়া করে একদফা ঘুম দিয়ে দিয়েছে অলরেডি। কে যেন এর মাঝে বেমক্কা বলে উঠল, ওই পোলাপান, বাইরে তো বৃষ্টি পড়তাসে, চল মামা মাঠে। কেউ কেউ দোনোমোনার ভাব দেখাচ্ছিল, কিন্তু পাগলকে সাঁকো নাড়াতে নিষেধ করলে আখেরে কী হয় সেটা তো জানেনই। আর যায় কোথা, সবাই এক ছুট মাঠে। এর মাঝে কেউ আবার শর্টস আনতে হলে ছোটাছোটি করে, কেউ আবার শর্টসের তো বটেই, এক্সট্যাসির বাহারি শার্টেরও নিকুচি করে মাঠে নেমে পড়ে। কাদাভরা মাঠে শেষমেশ হাস্যকর একটা খেলা হয় বটে, কিন্তু তার পরোয়া করে কে? কেউ কেউ আবার বেনসন-গোল্ডলিফের বদৌলতে নিজের ফুসফুসের বারোটা বাজিয়ে সারমেয়র মত জিভ বের করে হাঁপাতে থাকে, আবার কেউ গোলের সামনে বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকার দূরত্বে থেকেও লুকা টনির দক্ষতায় নির্বিবাদে বলটা বাইরে পাঠিয়ে দেয় আর কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, মামা, এই মৌসুমে ফর্ম নাইক্কা; দেখিস ! পরের বার ঠিকই গোল দিমু। আমরা মুচকি হাসি, আর কিছু বলার ফুরসত পাইনা, একটু পরেই সেশনাল , এখনো টপ শীট লেখা হয়নি, দৌড়, দৌড়...

৩.

"ওই ফারুক ভাই, একটা বেনসন আর ডিউ"- হাঁক মেরে বলে তমালভাই আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, মিয়া কীসব বালছাল টিম সাপোর্ট কর- একটা প্লেয়ারও কিনতে পারলানা এই সিজনে। ওই বুইড়া স্কোলস আর গিগসরে দিয়া আর কয়দিন। তোমগো ফার্গুসনের খেল খতম, এক পাও দিয়া রাখসে কবরে- অর টাইম শেষ।

আমিও পাল্টা জবাব দিতে ছাড়িনা- ধুর মিয়া। ওইসব চেলসি-টেলসির বেইল নাই। এত টাগ অফ ওয়ারের পরও নেইমারকে কিনতেও পারলেননা, আবার কথা বলেন । কার্ভালহোর রিপ্লেসমেন্ট কে হবে দেখা যাবে নে, আর টেরি তো ভাই ওয়ার্ল্ডকাপে যা দেখাইলো, এখন অর উচিত আগে ওয়েইন ব্রিজের হাত পা ধরে মাফ চাওয়া। অন্যের বউ পটিয়ে আর কইদিন।

স্পর্শকাতর স্থানে খোঁচা দেওয়ায় এবার তমাল ভাই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন- ওই, টেরির পার্সোনাল অ্যাফেয়ার্স নিয়া কথা কইবানা, তোমাদের এককালের পেয়ারের রোনালদো কি নিজে কম লুইচ্চা নাকি? হালায় পোলা জন্ম দিসে, এখন কইতাসে ওইটার মা নাই।

ওদিকে মারুফ সশব্দে হেসে উঠলে তমাল ভাই আরো খেঁকিয়ে ওঠে- ওই মিয়া, তুমি হাসো ক্যান। এইটা হল, ক্ল্যাশ অব দ্য টাইটান্স। তোমগো ফকিরেরপুল সাপোর্টাররা এখানে আউট অফ সিলেবাস।জো কোল নাকি ওদের নয়া মেসি, শুইনা হাসমু না কানমু।

মারুফের মুখ আমসি হয়ে যায়, তবে জবাব দিতে সে কিছুমাত্র কসুর করেনা- হ, প্রিমিয়ার লিগের সবচে সাকসেসফুল দল কিন্তু আমরা। দুদিনের বৈরাগী, ভাতরে কয় অন্ন।

এভাবেই একের পর এক বেনসন ধোঁয়া হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, আর একটু পর পর ডাক পড়ে- কালীদা, এদিকে এক কাপ চা। আর ফুটবলাড্ডা আরো জম্পেশ হতে থাকে, নিমিষের মধ্যে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে আলোচনা চলতে থাকে। ওদিকে একটু পর আবির হাঁক পাড়ে- বস, দ্রগবা গোল দিসে।

তমাল ভাই তার জন্ডিসাক্রান্ত হলদে দাঁতের পাটি বিকশিত করে বলে- ল মিয়া, যাই, খেলা শুরু হইয়া গেসে। আমার মুখ তেতো হয়ে যায়, মনে মনে চেলসির সাপোর্টারদের পিন্ডি চটকাতে চটকাতে আমি কমনরুমের দিকে এগোতে থাকি।

৪.

ঈদ মৌসুমে আড্ডাটা বেশ ভাল জমে। সব পুরনো বন্ধুদের সাথে মোলাকাত,কথাবার্তা এদিক ওদিক গড়িয়ে শেষ পর্যন্ত আড্ডার টপিক ওই একটাই, ফুটবল। স্পেনের সাথে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচে জয়ের পর একদফা ম্যারাডোনাকে কষে গালাগাল করা হয়, সবাইকে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত দেয়, নাহ! বাতিস্তা কোচ হিসেবে বোধহয় টিকেই গেল। জানেত্তি- ক্যাম্বিয়াসোকে না নেওয়াটা কত বড় ট্যাকটিকাল ভুল ছিল সেই পুরনো লেবুও এইফাঁকে দস্তুরমত চটকানো হয়ে যায়। কেউ মরিনহোকে জাদুকর বলে সাব্যস্ত করে, আর বাকিরা (পড়তে হবে বার্সার সাপোর্টাররা ) রিয়ালের সংশ্রবে মরিনহোর খেল খতম- এমন ঘোষণাও দিয়ে বসে। সব মিলিয়ে ঈদ পরবর্তী আড্ডাটা অবধারিতভাবে একটি ফুটবলাড্ডায় পর্যবসিত হয়,
খড়গ হাতে সমানে রাজা উজির নিধন করে চলি আমরা।

৫.

খোমাখাতা থেকে গ্রুপের শেষ লাইনকটি কিঞ্চিত পরিমার্জন করে বলা যায়- আসলেই, হলে এখন পেল্লায় প্লাজমা টিভি এসে পড়েছে, গোল বিন্দু কম , লাইভস্কোরে আমরা এখন বুঁদ হয়ে থাকি, ম্যাচের পর খোমাখাতায় একেকজন কাগুজে বাঘের হুংকার ছাড়ি, কিন্তু একসাথে খেলা দেখা, ক্যান্টিনে ফুটবল নিয়ে তক্কো থেমে থাকেনা। শেষ পর্যন্ত আমরা কিন্তু একই পথেরই পথিক, এই চর্মগোলকের সাথেই আমাদের নিত্য বসবাস, সে মাঠেই হোক, খোমাখাতায় হোক, বা কমনরুমে।

Wednesday, September 8, 2010

একছটাক কায়েস আহমেদ-২

প্রথম গল্পগ্রন্থ "অন্ধ তীরন্দাজে" আমরা যে কায়েস আহমেদকে দেখতে পাই, তার সাথে গল্পগ্রন্থ -লাশকাটা ঘরের কায়েস আহমেদের মেলাতে গেলে আমূল চমকে যেতে হবে। আগের সেই অবিন্যস্ততা, খ্যাপাটেপনা ঝেড়ে ফেলে এখানে তিনি অনেকটাই থিতু, বিষয়প্রকরণেও সমান মনোযোগী। গল্প বলার সহজাত ঢংকে তিনি খাপছাড়া তলোয়ারের মত ঝলকে ঊঠতে দেননি, তাকে শাণিত করেছেন যতনভরে, দেখিয়েছেন অসামান্য পরিমিতিবোধ। ইলিয়াস তার এই দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ সম্পর্কে নিজের উচ্ছ্বাস চাপা দিতে পারেননি, প্রগলভ সুরেই বলেছেন-

[i]মানুষের নানা রকম বেদনাকে তিনি দেখতে পান সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের অজস্র বিস্ফোরণ বলে। এখানে মানুষের কেবলই মার খাওয়ার অসহায় বেদনাবোধ নেই, রোগের চিকিৎসা করতে সংকল্পবদ্ধ মানুষকেও এখানে পাওয়া যায়।"[/i]

কায়েস আহমেদের সততাকে ইলিয়াস মূল্যায়ন করেছেন বিরল হিসেবে। এখানে পাঠক সওয়াল পুছতে পারেন এই সততার সংজ্ঞা কী? সে উত্তরও ইলিয়াস বাতলে দিয়েছেন- কাহিনির নামে কেচ্ছা ফাঁদার লোভকে বিসর্জন দিতে পারাটাই কায়েস আহমেদের সততা। বারোয়ারি প্লটের ক্লিশে বয়ানের প্রতি লেখকের যে গাত্রদাহ, গড্ডলিকা প্রবাহের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার বিমুখীতা, সেটাও কিন্তু ঝলক দিয়ে উঠেছে তার এই গল্পগ্রন্থটিতেই।

লাশকাটা ঘর-বেশ কিছু কারণেই একটি স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের এমন জাজ্বল্যমান চিত্র আমার স্বল্প এলেমে সমসাময়িক অন্য কোন বাংলাদেশি লেখকের এলাকায় এমনভাবে উঠে এসেছে কিনা জানা নেই। এই ব্যাপারে কায়েস আহমেদ রীতিমত বিশিষ্টতার স্বাক্ষর রাখেন । বিশেষ করে মহাকালের খাঁড়া, নিয়ামত আলীর জাগরণ, দুই গায়কের গল্প আর লাশকাটা ঘর গল্পগুলো ক্ষয়িষ্ণু নকশাল আন্দোলনের অসঙ্গতিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। শ্রেণিশত্রু কতলের নামের মারণঘাতী হুজুগ আখেরে তাই একটি আদর্শের অন্তসারশুন্যতাকেই ফুটিয়ে তোলে।

মহাকালের খাঁড়া গল্পে ভরত তার বৈধ ব্যবসার তলে কালোবাজারি করে বেশ দুপয়সা কামিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তার মনে জুজু বাসা বেঁধেছে, চরমপন্থীরা তার মত মালদারদের আকছার মৃত্যুর সবক পাঠাচ্ছে। এসব নিয়ে সে ভয়ানক উদ্বিগ্ন, ছেলে সুরেনকেও আজকাল ভরত পারলে অহর্নিশ চোখে রাখে। সুরেন সেদিনের মরদ, সে যখন বলে এসব ফরমান তো কেবল পার্টির সাথে জড়িতদেরই পাঠাচ্ছে, তখন পোড় খাওয়া ভরত খেঁকিয়ে ওঠে-

[i]এই তোর বুদ্ধি। পার্টি করিস আর না করিস, তুই ভরত কোলের ছেলে, ভরত কোলে ওদের চোখে শ্রেণী শত্রু,‌ এখন বুঝলি রে গাড়োল। রাস্তায় চলিস কি চোখ বন্ধ করে?[/i]

বোঝা যায়, নকশালপন্থীদের খড়্গ আজকাল আমজতাকেও রেহাই দেয়না, মালদার হলেই ওদের রক্তচক্ষুতে পরিণত হতে হবে।শেষমেশ ভরতকে নিজের একমাত্র ছেলেকে খুইয়ে চরম মূল্যটা দিতেই হয়,এই ঘটনার বর্ণনা যেন অনেক বেশি জান্তব-

[i]সুরেনের লাশকে ঘিরে ভিড়, ঠেলাধাক্কা এবং হৈ চৈ রত কয়েকটা মানুষ ঘরে দাঁড়িয়ে যায়। জায়গাটায় হঠাৎ করে নিঃশ্বাসরুদ্ধ নীরবতা নেমে আসে। মধ্যরাত্রির উন্মুক্ত আকাশতলে সেই স্তব্ধতার মধ্যে শোকোন্মত্ত পিতার "বা বা সু রে ন রে" এই ত্রিভুবন ভাসানো সর্বভেদ্য হাহাকার, ও তার বিপুল বেগে ধেয়ে আসা - খালি গায়ের ছোটখাট গোলগাল মানুষটিকে অবর্ণনীয় বিশালত্ব এনে দেয়।[/i]

দুই গায়কের গল্পে অবশ্য এই সুরটা এত প্রকটভাবে আসেনি।ভাগ্যের ফেরে জগন্নাথ চোখ হারিয়ে ঠুঁটো, সাগরেদ হরিদাসকে নিয়ে দিনমান সে গান গেয়ে বেড়ায়, আর সেটাই তাদের জীবিকা। তবে হরিদাস আবার একেবারে সুস্থ-সবল মরদ, কিন্তু তার জগন্নাথের শিষ্যত্ব নেওয়ার কারণ এক দুর্জ্ঞেয় রহস্য। হরিদাসের সংসার আছে, কিন্তু সংসারে থেকেও যেন সে সন্ন্যাসী।জগন্নাথ ওরফে জগার আবার এসবের বালাই নেই, মাঝে মাঝে "লীলা" করার বদখেয়াল ছাড়া সে সংসারে জড়ানোর তাগিদ খুব একটা অনুভব করেনা। একসময় দৈব দুর্বিপাকে মানিকজোড়ের বাঁধন ছিড়ে যায়, কারো সাতে পাঁচে না থাকা হরিদাস নকশালিস্ট-পুলিশের গোলাগুলিতে বেঘোরে প্রাণ হারায়। আর আপাত নির্লিপ্ত জগার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠে, কিন্তু্ তাতে কি লাভ হয় আদৌ ?-

[i]এই অন্ধকার ফাটানো চিৎকার দিয়ে সে মাটি থেকে উপরে উঠে যায়। দু'হাতে উত্তোলিত হারমোনিয়াম ছুটে যায় সামনে। জগন্নাথের শরীর শুন্যে একটি মোচড় খায়। ধনুকের মত ব্যাঁকে; তারপর; যেনো ধনুক থেকে তীর ছুটে গেলো, জগন্নাথ সমস্ত শরীর দিয়ে পৃথিবী বিদ্ধ করে।[/i]

নিয়ামত আলীর জাগরণও একই ছাঁচে ঢালা গল্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধফেরতা নিয়ামত নিজেকে একজন সৈনিক হিসেবে দাবি করে, খাকি কোত্তা গায়ে দিয়ে বেশ একটা ভড়ং ধরে। মানুষজন তার এসব স্তোকে অবশ্য বিভ্রান্ত হয়না, নিয়ামতকে তারা বিবেচনা করে স্রেফ একজন অকর্মণ্য জড়ভরতের সাথে। নিয়ামতও এসবের থোড়াই কেয়ার করে। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে সেও ভুল সময়ে ভুল স্থানে থাকার খেসারত দেয়, নকশালপন্থি হিসেবে তাকে পাকড়াও করা হয়। নিজের খেয়ালে মগ্ন নিয়ামতও এই নকশাল জুজু থেকে রেহাই পায়না।

এই গল্পগ্রন্থের সবচেয়ে অভিনব গল্প সম্ভবত -মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে গল্পটি। দুজন অনুসন্ধিৎসু মালপদিয়া গ্রামে যায়-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠিকুজির খোঁজে।মানিকের পূর্বপুরুষ এই গ্রামেই আস্তানা গেড়েছিলেন, সেই আস্তানার সুলুক সন্ধানে আসা যুবকদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে শুরুতে ভ্রুকুটি তোলে গ্রামের মানুষ। একসময় সেই ভ্রান্তি অপনোদিত হয়, মানিকের পৈতৃক বাড়ির সন্ধানও তারা পেয়ে যায়। কিন্তু নিজেদের অজান্তেই আগন্তুকেরা এরচাইতে বড় আবিষ্কার করে ফেলে, সংখ্যালঘু মানুষের নিরাপত্তাহীনতা- সংকট সবকিছুই তাদের সামনে আচমকা বিমূর্ত হয়ে ওঠে। প্রথম দর্শনে এই গল্পটিকে একটি আটপৌরে প্রতিবেদন হিসেবে ভ্রম হতে পারে, কিন্তু লেখক গল্পটিতে প্রায়ই নিজের প্রাজ্ঞ রাজনীতি ও সমাজ মনস্কতা জানান দিতে ভোলেননি। দেশভাগের ছোবল থেকে যে কেউই রেহাই পায়নি, এ সত্য ও ভসে ওঠে তাদের সামনে। পলায়নপর মধ্যবিত্ত বা পোড়খাওয়া কৃষিজীবি সকলেই আদতে একই নৌকারই যাত্রী-

[i]অর্থাৎ ভিন্ন একটি সম্প্রদায় যখন শাসন নিয়ন্ত্রণের নিয়ন্তা হয় , তখন শ্রেণীর পার্থক্য ,বর্ণের পার্থক্য ছাপিয়ে সংখ্যালঘুর সামনে প্রবল হয়ে দাঁড়ায় সেই ভিন্ন সম্প্রাদায়ের সাথে নিজেদের সম্প্রদায়গত পার্থক্য, সেখানে "মুখুজ্জেদের" সাথে "মণ্ডলদের" কোন ভেদ নেই।এই বিভাজিত চেতনার ভিত্তিতেই এই উপমহাদেশের রাজনীতি পরিচালিত হয়ে এসেছে। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও এই সাম্প্রাদায়িক ভেদবুদ্ধির প্রবল মূঢ অন্ধকারের প্রতপক্ষ হিসাবে সুস্থ সবল দৃঢ-ভিত্তিক কোন মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কেন হয়নি ? সে অনেক কথা। সে কথা থাক।[/i]

মোদ্দা কথাটা লেখক অকপটে এভাবেই বলে দিয়েছেন ,কোন ছলচাতুরীর আশ্রয় না নিয়েই। ফলে মানিকের ভিটেমাটি পাওয়ার চেয়েও এই ব্যাপারটি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।

লাশকাটা ঘর গল্পে লেখক মানুষের থিতিয়ে পড়া সম্পর্কগুলোকে আতশ কাঁচের নিচে ফেলেছেন, বারবার নিরীক্ষা করেছেন। কালীনাথ-নিশিকান্ত-মনোতোষ মাস্টার বা বাসুদেবরা তো আসলে একই পথেরই পথিক, তাদের সকলেরই হাড় মাংসে পচন ধরেছে, অভাবের সাথে যুঝতে থাকা মানুষগুলো প্রত্যেকেই এখন শবঘরের একেকজন বাসিন্দা, আর খানিক পরেই হয়ত তাদের মনুষ্যত্বের ব্যবচ্ছেদ করা হবে। তারা এ থেকে উত্তরনের পথের হদিস করে, কিন্তু সে পথ আর মেলেনা।

গল্পগ্রন্থের অন্যান্য গল্পগুলো অবশ্য কী ভারে, কী ধারে এগুলোর মত কাটেনা। তার মধ্যেও কিছু কিছু গল্পের হকিকত আলাদাভাবে দিতেই হয়। "গগনের চিকিৎসা তৎপরতা" গল্পে গগন চাঁদের কলংক দূর করার দাওয়াই খোঁজে, দাওয়াইয়ের সন্ধান না পেলেও আমরা জানতে পারি, চাঁদেরও কলংক এতদিন হয়ত ঘুঁচে যাবে ,কিন্তু মানুষের কলংক, সে দিল্লি দূর অস্ত।

অন্যদিকে "গোপাল কামারের তলোয়ার" গল্পে লেখক বেশ কায়দামতো তারিয়ে তারিয়ে একটা জম্পেশ গল্প ফাঁদার চেষ্টা করেন, গোপাল কামারের নিস্পৃহতাকে ফুটিয়ে তোলেন, কিন্তু অন্য গল্পগুলোর তুলনায় এই গল্পের ভঙ্গিটি অনেক জোলো হয়ে যায়।সে তুলনায় "নচিকেতাগণ" গল্পে লেখক অনেক সাবলীল, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা একমাত্র গল্প এটি। হানাদারদের হাতে অন্তরীণ একদল লোক, যারা জানে হয়তো খানিক পরেই তাদের খতম করে দেওয়া হবে, তারপরও তাদের কেউ মিথ্যে ফানুসের বুদুবুদ রচনা করে, ভাবে- হয়তো তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।এই ভাবনাটা ধরা পড়ে এভাবে-

[i]রাত শেষ হয়ে আসছে, একটু পরেই ভোরের আলো এসে পড়বে ভেন্টিলেটরের ফাঁকে, সেই সঙ্গে আসবে চড়ুইটা, কদিন থেকেই লক্ষ্য করছি আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ছোট পাখিটা এসে ডাকাডাকি করে ভেন্টিলেটরে বসে; দেখে এই অপরিসর এই বাথরুমটায় তালগোল পাকিয়ে কজন মানুষ পড়ে আছে। কি বোঝে কে জানে খানিকক্ষণ লাফালাফি ডাকাডাকি করে আবার উড়ে যায় বাইরে। আমি তার অবাধ উড়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি, ভেন্টিলেটরের ওপারের ফাঁকা আলোকিত শুন্যতা বিশাল পৃথিবীটার আভাস দেয়।

[/i]


প্রতারক জোছনা বা পারাপার গল্পে লেখক আবার অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক, মানুষের একাকিত্বই গল্পগুলোর উপজীব্য। তবে মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশিত এই গল্পগ্রন্থের একটাই খুঁত, একই গল্প আলাদা নামে দুবার থাকা। "ফজর আলীর গল্প" ও "নিরাশ্রিত অগ্নি" আদতে একই গল্পই, তবে ছাপা হয়েছে দুবার। এই গল্পটিতে লেখক ডিটেইলে অসাধারণ স্বচ্ছন্দ-

[i]একথা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে একটা সবুজ গাছ ঘুরতে ঘুরতে দূর থেকে কাছে আসতে থাকে, ধীরে ধীরে তার নীচে সাদা, নীল, কতগুলো রঙ জেগে ওঠে, রংগুলো আরো স্পষ্ট হয়ে একসময় জামাকাপড় কি খালি গায়ের কতগুলো মানুষ হয়ে যায়... [/i]

এভাবেই কায়েস আহমেদ আমাদের নিয়ে যান গল্পের এক কুহকময় জগতে, মোহমুগ্ধ পাঠককে গাছে তুলে তিনি আলগোছে মই কেড়ে নেন, আর পাঠক এক অনিঃশেষ বারুদে ঠাসা এক গল্পজগতে খাবি খেতে থেকে।

নিরীক্ষা-১

লোকটা অনেকক্ষণ থেকে কী যেন খুঁজছে।

জায়গাটায় বেশ একটা সুনসান নীরবতা, লোকজনের বেমক্কা হল্লার উটকো আওয়াজ এখানে চট করে কানে লাগেনা। কেমন যেন থম মেরে আসা নীরবতায় চারিদিক আচ্ছন্ন হয়ে আছে। হিজল গাছটা বুড়িয়ে গিয়েছে, তাকে এখন চেনা দায়, মাছারাঙ্গাটিও আর এখানে অলস ঝিমোয়না। কোন জ্বিন-ভূত আসর করেছে কীনা তাই বা কে বলতে পারে? খানিকটা তফাতে একটা খোলামতন জায়গা, সেখানে বেলা গড়ালে ছেলেপেলের দলের মচ্ছব বসে। এদিকে নিচু হয়ে দাঁড়ালে পানিতে ছায়া দেখা যায় বটে, কিন্তু সেটা বড়ই আবছা। পানিটা টলটলে নয় মোটেও, কিনার ঘেঁষে নেমে পড়লে গোড়ালি অবধি পা ভেজে কীনা সন্দেহ। তবে পাড় ঘেঁষে সন্তর্পণে হেঁটে গেলেও দুচারটা বনবিছুটির দঙ্গল না মাড়িয়ে পারা যায়না। তার মধ্যে আবার নাম না জানা পিঙ্গল ফুলের ঝোপ। এখন ভরা মৌসুম, কদিন থেকেই বৃষ্টিবাদলার ধুম পড়েছে। পাড়টা বেশ কাদাটে হয়ে আছে, ঠাহর করে না চললে একেবারে ধরাশায়ী হওয়ার আশঙ্কা থাকে । লোকটা অবশ্য এসবের থোড়াই কেয়ার করে। কিন্তু তার বারবার মনে হতে লাগল, হিসেবে কোথাও বিলকুল গরমিল হয়ে গেছে, কিছু একটা কিছুতেই মিলছেনা। সবকিছু ঠিকঠাক আছে, আবার কোন কিছুই যেন ঠিকঠাক নেই। লোকটা খানিক নি পানির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে, দলা পাকিয়ে ওঠা বিভ্রান্তিগুলোকে ঠিকঠাক করার চেষ্টা করে। তারপর একসময় হাল ছেড়ে দেয়, কিছু একটা খুঁজতে থাকা লোকটা ফের হাঁটতে শুরু করে। পেছনে পড়ে থাকা কিছু না চুকানো হিসেব -নিকেশ।

Saturday, September 4, 2010

একছটাক কায়েস আহমেদ-১

তাঁর সাথে আমার পরিচয় কোন এক ঘোরতর দাবদাহের দিনে। আজিজের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, ঢুঁ মারার লোভটা বরাবরের মত সংবরণ করতে পারলামনা। দোকানে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বইগুলোকে আলগোছে চেখে নিচ্ছিলাম। পকেটের অবস্থা তখন গড়ের মাঠপ্রায়, তাই চাখতেও হচ্ছিল রয়েসয়ে, পৃথুল বইগুলোর লোলুপ প্রলোভন এড়িয়ে ক্ষীণবপুগুলোর দিকে। হঠাৎ করেই হলুদ মলাটের একটি বইয়ের ওপর নজর আটকে গেল। বলে রাখা ভাল, খানিকটা অবাকই হলাম ফ্ল্যাপ উলটে, মোটে ২৮৬ পৃষ্ঠার বইয়েই কীনা এই লেখক তার সব কথা বলে গেছেন। আরো কদ্দুর গিয়ে দেখি রচনাসমগ্রের ভূমিকা লিখেছেন খোদ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। নাহ! অবশিষ্ট দ্বিধাটুকুকে ঝেড়ে ফেলে চটজলদি বইটা বগলদাবা করে নিলাম। কায়েস আহমেদের সাথে আমার অযাচিত পরিচয়টা এভাবেই।

একজন লেখকের বলার খুব বেশি কিছু থাকতে পারেনা, একথা আমি কায়মনোবাক্যে মানি। তারপরেও বলতেই হবে, কায়েস আহমেদ একটু বেশিই স্বল্পপ্রসূ লেখক। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের তিনি মোটেই কোনো দিকপাল নন, প্রচারের শীর্ষে থাকা দৈনিকের রগরগে সাহিত্য পাতায় তাঁকে নিয়ে আদিখ্যেতাও করা হয়না মোটেই, বইমেলার চটকদার সব বইয়ের মাঝে তাঁর দুই মলাটে আবদ্ধ সাহিত্যকীর্তিকে খুঁজে পাওয়াও ভার হবে। এতকিছুর পরেও কায়েস আহমেদকে অস্বীকার করা যায়না, তাঁকে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র একটি ঠাঁই দিতেই হয়। কেন? এ সওয়ালের হদিস পেতে হলে আমাদের একটু সামনে যেতে হবে।

একটা কথা হলফ করে বলা যায়, বাজারি সাহিত্যের পলকা রোশনাই কায়েস আহমেদকে কখনো টলাতে পারেনি। তিনি লিখেছেন কম, কিন্তু যে চেতনাকে তিনি ধারণ করেছেন , যে বিশ্বাস তাকে রসদ যুগিয়েছে, তার দ্যুতি তাঁর রচনা থেকে হামেশাই ঠিকরে পড়েছে। ইলিয়াস “ মরিবার হ’লো তার সাধ” প্রবন্ধে তাঁকে নিয়ে বলতে পেরেছেন,

প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশিরভাগ লেখকের কাছে লেখাটা হল অভ্যাসমাত্র-চাকরিবাকরি আর ব্যবসাবাণিজ্য আর দেশপ্রেমের ঠেলা সামলাতে এনজিও বানিয়ে মালপানি কামাবার সঙ্গে তখন এর কোনো ফারাক থাকে না। তখন লেখায় নিজের সুখ আর বেদনা জানান দেওয়াটা হয়ে দাঁড়ায় তেল মারা আর পরচর্চার শামিল। লেখক হিসেবে সেই সামাজিক দাপট কায়েসের শেষ পর্যন্ত জোটেনি। তাই, কেবল মানুষের খুঁত ধরে আর দুর্বলতা চটকে সাহিত্যসৃষ্টির নামে পরচর্চা করার কাজটি তাঁর স্বভাবের বাইরেই রয়ে গেল। আবার “এই দুনিয়ায় সকল ভালো/ আসল ভালো নকল ভালো...” এই ভেজাল সুখে গদগদ হয়ে ঘরবাড়ি, পাড়া ,গ্রাম, সমাজ ,দেশ, পৃথিবী, ইহকাল ও পরকাল সবকিছুতেই তৃপ্তির উদ্গার শুনিয়ে মধ্যবিত্ত পাঠকদের তেল মারার কাজেও তিনি নিয়োজিত হননি।


ষাটের দশকের ছোটগল্পের ভরা জোয়ারের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন কায়েস আহমেদ। তবে বাঁধাগতের জোয়ারে তিনি গা ভাসিয়ে দেননি, নিজের বিশিষ্টতাকে তিনি সযত্নে লালন করেছেন, লকলকিয়ে একে বেমক্কা বেড়ে উঠতে দেননি। তাঁর প্রথম ছোটগল্পগ্রন্থ “অন্ধ তীরন্দাজ” এই সাধনারই ইঙ্গিতবাহী। তবে লেখক হিসেবে তিনি এই গ্রন্থে যথেষ্ট পরিমিতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন, এমন বলাটা ভুল হবে। তিনি প্রায়শই নিরীক্ষা করেছেন, কারণে বা অকারণে, কিন্তু মাঝে মাঝেই তিনি খেই হারিয়েছেন, গল্পগুলো যেন দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়েছে, কদাচিত কোন কানা গলিতে গিয়ে গোত্তা খেয়েছে। কাহিনির প্রতি, ডিটেলসের প্রতি তার মোহগ্রস্ততার কারণে চরিত্রগুলোর সহজাত পরিবৃদ্ধি তাই অনেক ক্ষেত্রেই ঠোকর খেয়েছে। তার দুর্দান্ত কিছু প্লটও ঠিক একই কারণে হয়ে উঠেছে বক্তব্যপ্রধান। তবে ডিটেলসে তাঁর অত্যাগ্রহ যে অমূলক নয়, সেটা কিন্তু মাঝেমাঝেই বিমূর্ত হয়ে উঠেছে, ঝিলিক দিয়ে উঠেছে-



গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে, জন্ডিস রোগীর মতো ফ্যাকাশে, ক্রমাগত নিঃশোষিত হয়ে আসতে থাকা বনতুলসী, চিচ্চিড়ে, আশ শ্যাওড়া বন আর পিঙ্গল ঘাসের গায়ে লেপ্টে থাকা প্রায় ফুরিয়ে আসা দুপুর যেন থমকে আছে, গাছের পাতা নড়ে না, তামাটে রং এর উপুড় হয়ে থাকা বিশাল সরার মতো আকাশের নীচে শেষ অক্টোবরের পৃথিবী যেন চুপ করে আছে।


কিছু কিছু গল্পে পরাবাস্তবতার ছাঁচে ঢেলে তিনি নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন, “যাত্রী” গল্পের মত। নিঃসঙ্গতার বীভৎস রুপ এই গল্পে প্রকট হয়ে উঠেছে, আর কেন জানি মনে হয়েছে, এই নিঃসঙ্গতাটুকু লেখক বোধকরি প্রশ্রয়ই দেন, একে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন, এর নির্যাসটুকু আহরণ করেন যতনভরে। বন্দী দুঃসময় ঠিক এই ধাঁচের আরেকটি গল্প, ক্লিশে প্রাত্যহিকতায় খাবি খেতে থাকা একজন মানুষ চেনা গন্ডিতে ঘুরপাক খেতে থাকে অবিরত, সে পালাতে চায় কিন্তু সে পথের দিশা তার মেলেনা। এদিক দিয়ে বরং অন্ধ তীরন্দাজ ও সম্পর্ক গল্পে এসে লেখক অনেকটাই থিতু হয়েছেন, ডানা মেলা ভাবনাগুলোর রাশ সময়মাফিক টেনে ধরেছেন। চরিত্রগুলো এই দুটি গল্পে ন্যায্য বিকাশ পেয়েছে, অনাবশ্যক ডিটেইলে গল্প ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েনি।"অন্ধ তীরন্দাজ" গল্পে একদল বেদিশা যুবকের ছাইচাপা হতাশা, বা "সম্পর্ক" গল্পে দুই বন্ধুর পুনর্মিলনীর পরবর্তী ধেয়ে আসা বাস্তবতা নির্মাণে লেখক অনেকটাই সংযত, বরং বলা ভাল অনেকটাই সফল। অথচ দৃশ্যকল্পের প্রতি স্বভাবজাত মুগ্ধতার আঁচ এখানেও পাওয়া যায়, কিন্তু কখনোই তা বেসুরো হয়ে উঠেনা, বরং কায়েস আহমেদকে ঘিরে মনোযোগী পাঠকের প্রত্যাশার পারদ ক্রমেই চড়তে থাকে।



তথ্যসূত্রঃ

কায়েস আহমেদ সমগ্র,প্রকাশক-মাওলা ব্রাদার্স,ঢাকা।
রচনাসমগ্র ৩-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।

Thursday, September 2, 2010

প্রতিভা অন্বেষণ ও কিছু গিনিপিগ বানানোর কেচ্ছা

খানিকটা সরলীকরণ হয়ে গেলেও একটি কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়,বলতে গেলে ডেভ হোয়াটমোর নামক ওই পাকানো গোঁফের ভদ্রলোকটিই বাংলাদেশের ক্রিকেটের খোলনলচে অনেকটুকু বদলে দিয়েছিলেন।তবে পাঁড় ক্রিকেটভক্তরা আশা করি বিস্মৃত হননি,হোয়াটমোরের মস্তিষ্কপ্রসূত কিছু থিওরি কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতাতে পর্যবসিত হয়।হ্যাঁ,আমি তার সুবিখ্যাত "মিডিওকার থিওরির" কথাই বলছিলাম।ব্যাটে বলের লড়াইয়ে সবকিছু মোটামুটি করতে পারে,এমন ক্রিকেটারদের দলে নেওয়ার তার খাপছাড়া নীতি শেষ পর্যন্ত যে কতটুকু সফল হয়েছিল,সেটাও নতুন করে বলবার প্রয়োজন নেই বৈকি।

ভাবছেন, কেন এতদিন পর এসব পুরোনো গপ্পো নতুন করে ফাঁদা।না না ,বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের ব্যবচ্ছেদ করা আমার উদ্দেশ্য নয়(সে গুরুদায়িত্ব উৎপলদার হাতেই ছেড়ে দেওয়া ভাল) আর আমি ধান ভানতে শিবের গীতও গাইছিনা।সত্যি বলতে কি,দূরদর্শন বস্তুটার দিকে আজকাল ঘেষা প্রায় হয়না বললেই চলে।কিন্তু কোন কুক্ষনে যে সেদিন টিভি দেখতে বসেছিলাম কে জানে ! এনটিভিতে দেখলাম মার্ক্স অলরাউন্ডার নামে একটি প্রতিভা অন্বেষণমূলক অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে।বলে রাখা ভাল,এমনিতেই এসব তথাকথিত "তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ" টাইপ অনুষ্ঠানের প্রতি আমার মারাত্মক অ্যালার্জি আছে।প্রতিভা খোঁজার নামে এসব অনুষ্ঠান অনেকটাই ঠক বাছতে গাঁ উজাড় করার মত ব্যাপার বলে মনে হয়।শুরুর দিকের কিছু প্রোগ্রামকে তাও খানিকটা জাতের বলা যায়।কিন্তু পরের দিকের রীতিমত দৃষ্টিকটুভাবে একের পর এক যে হারে তথাকথিত প্রতিভাদের খুঁজে আনা হচ্ছে,তাতে কয়েকদিন বাদে দেশে প্রতিভার মচ্ছব লেগে যাবে আর এসব প্রতিভা রপ্তানি করে বেশ দুপয়সা কামানোও যাবে।সবচেয়ে হাস্যকর লাগে যখন কোমলমতি শিশুদের মর্মান্তিকভাবে এসব নাটুকেপনার শিকার হতে হয়।অনেকটা এরকমই একটি নির্লজ্জ্ প্রদর্শনীই দেখলাম সেদিন।

প্রথমত অলরাউন্ডার কথাটাতেই আমার ঘোরতর আপত্তি।ক্রিকেটীয় পরিভাষায় যে ব্যাটিং বোলিং দুটিই টুকটাক করতে পারে তাকেও কিন্তু অলরাউন্ডার বলা হয়।মজার ব্যাপার হল,মার্কস অলরাউন্ডার নামের অনুষ্ঠানটি মোটামুটি সেই ক্যাটাগরিতেই পড়ে। কোন একটা বিষয়ে স্পেশালাইজড না হয়ে সব কিছুই একটু একটু পারে এমন শিশুদেরই দেখলাম বেমালুম অলরাউন্ডার বলা হচ্ছে।তবে আমার চক্ষু চড়কগাছ হল বিচারকদের জ্ঞানগম্যির বহর দেখে।বিশেষ করে আট বছরের একটি শিশু যখন চমৎকার আবৃত্তি করে,তখন গান বা নাচ জানেনা বলে তাকে এককথায় ছেঁটে ফেলাটা কেমন বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানসিকতার পরিচয় দেয়, তা আশা করি বলার প্রয়োজন নেই।বিশেষ করে আব্দুন নুর তুষারের মত একজন লোক এধরনের অবিবেচক কাজ কিভাবে করেন ,সেটাই আমি ভেবে পাইনা।আর অন্যদের কথা(বিপাশা হায়াত,শম্পা রেজা ,শিবলী মোহাম্মদ)নাইবা বললাম।কোন প্রতিযোগী যদি কোন বিভাগে অপেক্ষাকৃত দুর্বল পারফর্ম করে,তাহলে তাকে এমনভাবে তাগাদা দেওয়া হয়,যেন ভাল না করাটা অপরাধ বৈ আর কিছু নয়।সবচেয়ে বড় কথা হল,সবজান্তা যে কোনকিছুতেই ওস্তাদ হয়না সে সত্য তারা কি জাননেনা,নাকি জেনেও না জানার ভান করেন ।তবে আমার মূল আশঙ্কার জায়গা এটা নয়।আরোপিত কোন কিছু কখনোই শুভ ফল বয়ে আনেনা,তা সে যতই উপাদেয় হোক না কেন। আর যে জিনিসে আনন্দ নেই,সে জিনিস যে আখেরে লাভ না করে ফ্যাকড়াই বাঁধায় তা নিয়েও বোধহয় দ্বিমতের অবকাশ নেই।আগে তো তাও এসব প্রতিভা অনুসন্ধান কেবল একটি নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতেই সীমাবদ্ধ ছিল।কিন্তু অলরাউন্ডার খোঁজার নামের যে প্রহসন চলছে,তার চেয়ে আত্মঘাতী আর কিছুই হতে পারেনা।
আর বিচারকেরাও কি একটিবার ভেবে দেখেননি, নিজেদের সন্তানদের গিনিপিগ বানিয়ে তাদের ওপর এহেন বল্গাহীন পরীক্ষা নিরীক্ষা কি আদৌ তাদের জন্য কল্যাণকর হবে ?


আর বলিহারি এইসব অভিভাবকদের,সব কাজের কাজী বানানোর পাঁয়তারায় যারা খুবই যত্নের সাথে নিজ সন্তানদের নিজের অজান্তেই উদ্যমহীন,অন্তঃসারশূন্য করার মত হঠকারী কাজ করতে যাচ্ছেন,সন্তানের পছন্দ অপছন্দের কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে "এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ " নামের একের পর এক জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দিচ্ছেন। "আরও প্র্যাকটিস,আরও প্র্যাকটিস" বলে যে মন্ত্র তাদের কানে জপে দেওয়া হচ্ছে,ভয় হয়,শেষে না এই মন্ত্রের রিভার্স অ্যাফেক্টে এসব ইঁদুর কপালে শিশুরা একসময় প্রাণশক্তিহীন যান্ত্রিক মানবে পরিণত হয় !

Sunday, August 29, 2010

মৃত কবিদের জন্য এলিজি

মাঝে মাঝে একটা কথা খুব মনে হয় ,কোথায় যেন পড়েছিলাম ,অর্থনাশ ,জরা -ব্যাধি ,প্রিয়জন হারানোর মর্মন্তুদ শোক সবকিছুই একসময় ফিকে হয়ে আসে ,কিন্তু স্বপ্নের টুঁটি চেপে ধরলে সেই দগদগে ক্ষত আজন্ম বয়ে বেড়াতে হয় ,স্বপ্নহননের স্মৃতি আমাদের ফেরারি হয়ে তাড়া করে বেড়ায় অবিরত ।আর বরাত যাদের একেবারেই মন্দ ,সেই অপূর্ণ স্বপ্ন তখন নিতান্তই দুঃস্বপ্ন হয়ে তাদের ওপর সিন্দাবাদের ভূতের মত আছর করে বসে ।হয়তো বলবেন ,এতো একেবারেই ছেঁদো কথা ,সবারই তো এরকম কিছু স্বপ্ন থাকেই ,আর সবগুলো যে পূরণ হবে সে দিব্যিও কেউ হলফ করে দিতে পারবেনা ।তবে যে স্বপ্নের সাথে আবেগ গলাগলি করে বেড়ে ওঠে ,যে স্বপ্ন নেশার মত আচ্ছন্ন করে ফেলে ,সেটার অপূর্ণতায় কোথাও না কোথাও সুর কেটে যায় বৈকি ।

পিটার ওয়েইরের "ডেড পয়েটস সোসাইটি" দেখতে গিয়ে এসব কথাই মাথায় বৃত্তাকারভাবে পাক খেতে লাগল ।নামজাদা এক স্কুলের একদল তরুণের নিস্তরঙ্গ জীবনে আচমকাই একটা পরিবর্তন আসে ।প্রথাগত স্রোতে গা না ভাসিয়ে নতুন সাহিত্যের শিক্ষক তাদের স্বপ্নের গতি-প্রকৃতি আমূল পালটে দেন ,তাদের কোমল মনে বুনে দেন নান্দনিকতার বীজ ,কবিতার প্রতি তাদের ভালবাসাকে দেন উস্কে ।স্বপ্নবাজ তরুণের দল যেন সৃষ্টিসুখের নেশায় পাগলপারা হয়ে ওঠে ,অন্তঃপুরবন্দী হয়েও শিক্ষকের প্রেরণায় মায় নিষিদ্ধ কবিসঙ্ঘ অব্দি গড়ে তোলে ।কিন্তু বড়ই পাষাণভাবে তাদের এই নিখাদ রোমান্টিকতায় জল ঢেলে দেওয়া হয় ,তাদের কাব্যচর্চা মুখ থুবড়ে পড়ে বড় অসময়ে ।আর স্বপ্ন আর বাস্তবের নির্মম সংঘর্ষের বলি হয়ে উঠতি কবিদের পরিণাম হয় মর্মান্তিক।

সিনেমাটি এমন কোন কালজয়ী কিছু নয় ,তবে স্রেফ একটি বাঁধাগতের হলিউডি ছবিও অবশ্যই নয় ,খানিকটা হলেও আপনার মনে তা রেখাপাত করতে বাধ্য ।সবচেয়ে বড় কথা ,কবিতার সনাতনী ধারণাকে আস্কাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে রবিন উইলিয়ামস যখন গমগম করে বলে ওঠেন ,"আমরা স্রেফ শখের খাতিরে কবিতা পড়িনা ,আমরা কবিতা পড়ি কারণ আমরা মানুষ ,আর কবিতা মানুষের বেঁচে থাকার খোরাক", তখন টের পাই ,আমার শিরদাঁড়া দিয়ে আবেগের এক ঠান্ডা চোরাস্রোত বয়ে চলছে ,এই যান্ত্রিক আমিও তখন ভীষণভাবে রোমান্টিক হয়ে ওঠি ,চিত্ত হয়ে ওঠে উতরোল।কারণ এই ভাবনাগুলোই আমি ভাবতাম ঠিক ঐ স্বপ্নদর্শী বয়সে ,আমার মধ্যেও হয়ত তখন সবকিছু দুমড়ে মুচড়ে দেওয়ার দুর্মর ইচ্ছে খেলা করত ,এবং বলাই বাহুল্য ,একসময় এই ক্লিশে নৈমিত্তিকতার চাপে সেই ভাবনাগুলোও আস্তে আস্তে মিইয়ে যায় ,একেবারে ঘুঁচে যায়না বটে, কিন্তু ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে ।

তাই ছাত্রদের কানে যখন রবিন উইলিয়ামসের এই কথা অনুরণিত হতে থাকে ,"সিজ দ্য ডে ,মেক ইওর লাইভস এক্সট্রা-অর্ডিনারি"(অনুবাদ করলাম না ,পাছে রসভংগ হয় ),কেন জানি আমার কানেও কথাটি বারবার ঘুরপাক খেতে থাকে ,স্বপ্নধংসের শোকে আমি ফের আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।

Friday, August 27, 2010

কালো বরফ ও আমার শৈশবচরিত

আমার জগতে তখন সাদাকালোর কোন ঠাঁই ছিলনা, পুরোটাই ছিল ভীষণ রকম রংদার। স্কুলের ঘন্টা বাজত ঢংঢং, একছুটে চলে যেতাম লালচে ইটের স্কুলমাঠে, বিকেলের ফিকে আলোয় দেখতে পেতাম যেন রংধনুর সাত রঙ। বাড়ি ফেরার সময় চারপাশটা আগাপাশতলা চেখে ফেলত আমার নবিশ চোখ; টুংটুং করে বেল বাজানো রিকশাওয়ালা, স্টেশনারি দোকানের ক্লিশে সাইনবোর্ড, অদূরের প্যারেড ময়দান কাঁপিয়ে বেড়ানো ছোকরার দল, সবকিছুই দেদারসে আনন্দ বিলিয়ে যেত, আমার মনে তখন অবারিত আনন্দের ফল্গুধারা। বিকেলটা যেন টুপ করে কেটে যেত, আমার কেবলই মনে হত হতচ্ছাড়াকে যদি আচ্ছাসে পাকড়াও করে ধরে রাখা যেত ,তবে বেশ হত। আমাদের কলোনির সামনে ছিল পুরনো ইটের স্তুপ, সেই ইটের স্তুপে চলত লুকোচুরি খেলা। একসময় হলুদরঙ আলোটা মিইয়ে আসত, মুয়াজ্জিনের জলদগম্ভীর আযান শোনা যেত একটু পরেই, আমরা দমে যেতাম ভীষণভাবে, খেলা এই সাঙ্গ হয়ে এল বলে। সেই থুত্থুড়ে পুরনো কলোনির বাতাসটাকে আমার বেকায়দা রকম গুমোট মনে হত, আঁধার জেঁকে বসার সাথে সাথে সেই ভাবটাও আরো প্রকট হত।


কালো বরফ পড়তে পড়তে এইসব কথাই ঘুরেফিরে আমার করোটিতে পাক খেতে লাগল। আমার বয়সও তখন পোকার মতই, তবে পোকার মত আঙ্গুল চোষার বাতিক বোধহয় ছিলনা। তবে পোকাকে আমি হিংসে করি, একটু বেশি রকমই। পোকার মত আমার কল্পনার পালের হাওয়া কি এত ফুলেফেঁপে উঠত। কী জানি? তবে যে অদ্ভূত ইন্দ্রজাল মাহমুদুল হক সৃষ্টি করেছেন উপন্যাসের শুরুতেই, সে ঘোর থেকে চট করে বের হওয়া খুবই মুশকিল।শুরুতেই তার নিরাসক্ত কথন-

তখন আমার অভ্যেস ছিল বুড়ো আঙ্গুল চোষার। কখনো পুকুর-ঘাটে, কখনো বারান্দার সিঁড়িতে, কখনো- বা জানালায় একা একা বসে কেবল আঙ্গুল চুষতাম। আঙ্গুলের নোনতা স্বাদ যে খুব ভাল লাগতো, ঠিক সে রকম কোন ব্যাপার নয়। তখন ভাললাগা বা মন্দলাগা এসবের কোন ঝক্কি ছিল না, যতোটুকু মনে পড়ে; পৃথিবী যে গোল, একথা শুনে কানমাথা রীতিমতো ঝাঁ ঝাঁ করতো। সে একটা গোলমেলে বিষম ব্যাপার। ভাবতাম আমরা তাহলে কোথায় আছি, কমলালেবুর তলার দিকে না ওপরের দিকে; তলার দিকের মানুষজনের তো টুপটাপ ঝরে পড়ার কথা।

এইভাবে মাহমুদুল হক ভোজবাজির যে রমরমা পসরা সাজিয়ে বসেন, আমার সাধ্য কী এই কুহকের জাল ভেদ করা? আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ে যেতে থাকি। মাঝে মাঝে আবছা আবছা মনে পড়ে, এরকম বিটকেলে ভাবনায় আমিও সময় সময় বুঁদ হয়ে থাকতাম। মা বলতেন, আমি নাকি প্রায়ই নানা প্রশ্নবাণে সবাইকে জেরবার করে ফেলতাম, জবাব না দেওয়া অবধি এসব উটকো সওয়াল থেকে রেহাই পাওয়ার সাধ্য নাকি কারও ছিলনা। কালো বরফ মন্থনকালে কত কথাই যে মনে আসে!এমন ভয়ঙ্কর সুন্দরভাবে কেউ কি লিখতে পারে-

হু হু বাতাসের গায়ে নকশা-তোলা ফুলের মতো অবিরল আকুলতা,পোকার বুকের ভেতরের ফাঁকা দালানকোঠা গুম গুম করে বাজে, পোকা তুই মর, পোকা তুই মর!

যা কিছু নিঃশব্দ, যা কিছু শব্দময়, যা কিছু দৃশ্যগোচর, দৃশ্যাতীত, সবকিছুই একজোট হয়ে হাত ধরাধরি করে ঘিরে ধরে; অদ্ভুত এক আব্জনার তালে তালে আস্ত একটি রাত মোমের মত গলে পড়ে, জিনজার-হিনজার জিঞ্জার-গিনজার, জিনজার-হিনজার পোকা শুনে, শুনতে পায়। পোকা পোকা হয়ে যায়।

তবে অচিরেই ভাবালুতায় চুর হয়ে আমাকে এক লহমায় মাটিতে নামিয়ে আনেন লেখক, আবদুল খালেককে সাক্ষী রেখে দাঁড় করিয়ে দেন বাস্তবতার কর্কশ জমিনে। বৈষয়িকতার সাথে ক্রমাগত যুঝতে থাকা খালেককে আশেপাশের মানুষগুলোর সাথে মেলাতে যায়, শৈশবে ফিরে যেতে খাবি খেতে হয়না আমাকে। এদিকে উপন্যাস এগোতে থাকে তরতর করে, আর আবদুল খালেক ওরফে পোকার দ্বৈত বয়ান আমাকে ধন্দে ফেলে দেয়। দুজনকে মেলাতে পারি তখন, যখন শৈশবের গিরিবালার ঝুপ করে নেমে আসে আবদুল খালেকের ভাষ্যে-

"বাইরে আকাশ বলে একটা কিছু আছে, তা জান তো ! সেখানে একটা চাঁদ আছে, গোল চাঁদ। ঐ চাঁদের ভেতর হাঁটুমুড়ে কতোকাল বসে আছে। চরকায় সুতো কাটছে বসে বসে। "

পোকা ও আবদুল খালেকের এই আজব যুগলবন্দি চলতে থাকে মেলাক্ষণ। বাবা ,মা ,মনি ভাইজান, টিপু ভাইজান, রানিবুবু,পুঁটি, কেনারাম কাকা, ছবিদিরা পোকাকে অহর্নিশ সুখস্বপ্ন দেখিয়ে যায়, তার ছোট্ট জগতে তারা একেকজন অধীশ্বর হয়ে ওঠে, নিজেদের অজান্তেই। ওদিকে আবদুল খালেকও কী প[আরে নিজের ভাবালুতাকে বেনোজলে ভাসিয়ে দিতে? স্ত্রী, শিশুসন্তান নিয়ে তার ছোট্ট সংসার, তারপরও নগ্ন বৈষয়িকতার রক্তচক্ষুর সামনে সন্ত্রস্ত থাকতে হয়। এতকিছুর পরেও তার ভেতরের পোকা মাঝেসাঝেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। স্ত্রীকে সে ভালোবাসে, কিন্তু সেই ভালবাসায় আটপৌরে সমস্যা সূঁচ হয়ে ঢোকে, আর ফাল হয়ে বেরুবার প্রাণপাত চেষ্টা করে। এই টানাপোড়েনে সে বিচলিত হয়, তার ভেতরটা পুড়ে খাক হতে থাকে, কিন্তু আর দশটা মানুষের মত সবদিক সামলে সুমলে চলার ব্যাপারে সে আনাড়িই থেকে যায়। রেখা ও আবদুল খালেকের এইসব ছোটখাট মান- অভিমানের ভেতর দিয়ে আবদুল খালেকের কল্পনাবিলাসী মন পাঠকের কাছে আরও গভীরভাবে ধরা দিতে থাকে এইভাবে-

রেখা আর টুকু, এই দুজনের জন্যে তার ভাবনা। নিজেকে সে বাদ দেয়; নিজেকে নিয়ে তার কোন সমস্যা নেই, কোনো না কোনোভাবে তার চলে যাবে।

এটাও একটা বাতুল চিন্তা, ফালতু ধারণা। আবদুল খালেক শুধরে নেয় নিজেকে, তার ভাবনা -চিন্তায় ওদের ভূমিকা যেন নিছক বোঝার। এর ভেতরে আচ্ছন্নভাবে তার একটা অহমিকা আছে, সে চালাচ্ছে ওদের। কে কাদের চালায়, আসলে তো যে যার নিজের জীবনকে নিজেই চালায়। চালানো মানে জিবনটাকে কোনমতে টেনে বেড়ানো। চেয়ে-চিন্তে, মেরে-কেটে, যেভাবেই হোক।


উপন্যাসের দ্বিতীয়াংশ শুরু হয় অনেকটা আচমকা, "আলো ছায়ায় যুগলবন্দি" শিরোনামে। রেখা ও খালেকের টানাপোড়েন এখানে অনেকটা থিতিয়ে পড়ে, তারা সহসা আবিষ্কার করে, তাদের সম্পর্কের গাঁথুনি পলকা নয় মোটেই। কিন্তু চমকে উঠতে হয়, যখন হঠাৎ পাঠক আবিষ্কার করে, দেশভাগের সময় পোকার ঘরছাড়ার সেই স্মৃতি আবদুল খালেককে আজতক ফেরারি হয়ে তাড়া করে, আর কোন এক আলটপকা মুহুর্তে ছাইচাপা আগুনের মত বেমক্কা জ্বলে ওঠে। পাঠক ধাক্কা খায়, যখন মনিভাইজান ছবিদির কাছ থেকে বিদায় নেয়। আর সেই যে সুর কেটে যায়, আর আবদুল খালেকের সারাটা জীবন বেসুরো হয়ে যায়; পোকা হয়ে সেই হারানো সুরের হদিস ঝুঁজে ফেরে সে,জনমভর।

Thursday, August 19, 2010

অপেক্ষা

আয়তাকার ঘরটি আকৃতিতে নেহাত ছোটখাট নয়,কিন্তু দিনমান একধরনের থম মেরে থাকা সুনসান নীরবতা সেখানে বিরাজ করে। বয়সের সাথে যুঝতে থাকা একজন লোক,শীর্ণপ্রায়, জীর্ণ হয়ে যাওয়া ফুটোঅলা সফেদ পাঞ্জাবি পড়ে ঘরটাকে পাহারা দেন ,বা বলা ভাল আগলে রাখেন। সময় সময় তিনি ক্লায়কেশে পুরনো হয়ে যাওয়া তালা খোলেন;তাকে জেরবার হতে হয়, এই বুড়ো বয়সে রদ্দিকালের তালা খোলার ক্লিশে কাজ করতে হয় তাকে নিয়মিতভাবে-একটা নির্দিষ্ট সময়ে। সেই ঘরে তিনি বসে থাকেন মিটমিট করতে থাকা ফ্লুরোসেন্ট বাতিতে, তার মাথার ওপর খাপছাড়াভাবে ঘুরতে থাকে তার চেয়েও বুড়িয়ে যাওয়া কালচে পাখা।


তিনি একা ঘরে বসে থাকেন অতিপ্রাকৃত নৈঃশব্দের মাঝে, মাঝে মাঝে ছারপোকারা তাকে জানান দিয়ে যায় এই ঘরে তিনি আসলে একা নন, দেয়ালে ওত পেঁতে থাকা হলুদ গৃহগোধিকাও পৌনঃপুনিক টিকটিক শব্দ করে-বলে,"বাছা, রোসো, তোমার প্রতীক্ষার পালা খুব শীঘ্রই সাঙ্গ হবে"। কিন্তু আদপে তা ঘটেনা, বা ঘটার কোন নিকট সম্ভাবনাকেও সুদূরপরাহত মনে হয়। তারপরও তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন, কখনো সখনো ঝিমুতে থাকেন ,তারপর জের কেটে গেলে দেয়ালঘড়ির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন, তারপর আবার ঝিমান, কিন্তু প্রতীক্ষার পালা আর ফুরোয়না।মাঝে মাঝে বিমল মিত্রের তোবড়ানো সাহেব বিবি গোলামের ওপর লেপটে থাকা ধুলোর বহর সরানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালান, আবার আলগোছে পড়ে থাকা ক্যাবকো প্রকাশনীর গুটি গুটি হরফের সঞ্চয়িতা ঠিকঠাক সাজিয়ে রাখেন। এভাবে তিনি বসে থাকেন ক্লান্তিকর সব মূহুর্তের পসরা সাজিয়ে; বেমক্কা তিনি শরতবাবুত ঢাউস সাইজের উপন্যাসসমগ্রের ওপর অপত্য স্নেহে হাত বুলিয়ে দেন, অনুমান করা যায়- তখন তার তার পোড় খাওয়া ফুসফুস থেকে নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। পাশের দোকানে তখন জম্পেশ আড্ডা জমে, ছাই হয়ে যাওয়া অগুণিত বেনসন অ্যান্ড হেজেসের কোন কোনটির ধোঁয়ার কটু গন্ধ ব্যাপন প্রক্রিয়ায় তার নাকে এসে লাগে, হল্লামাস্তি করতে থাকা তরুণদের ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বিষয়ক বচসা তিনি প্রায়ই শুনতে পান, শুনতে পান মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের কোন এক ডানাকাটা পরীর রসালো ফিরিস্তি। এমনকি পড়ুয়াদের অ্যাসাইনমেন্ট- ল্যাবরিপোর্ট বিষয়ক দীর্ঘ আলাপচারিতাও তার কানে আসে, তিনি শুনতে চান বা না চান সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। অনেককিছুরই মর্ম তিনি ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারেননা ,তার লেখাজোখা না থাকা অভিজ্ঞতা ফেল মেরে যায় নির্বিবাদে এসব হালজমানার তরুণদের কাছে। তারপরও তিনি বসে থাকেন, আশা করেন, কোন এক ভুল সময়ে কেউ সেই ক্যাচকেচে দরজা ঠেলে প্রবেশ করবে, বলবে- রহমান ভাই, একটা বই নেওয়া যাবে?

আহসানউল্লাহ হলের তিনতলার বর্ষীয়ান লাইব্রেরিয়ান এভাবে কোন এক শুভ মুহুর্তের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন,অনন্ত কাল ধরে...

Monday, August 16, 2010

অপোগণ্ডের হাস্যপরিহাস

কেন হাসি, এককথায় এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া মুশকিল। হাসি জিনিসটা মানুষের মজ্জাগত, এ নিয়ে যেমন সংশয় নেই ,ঠিক তেমনি এটা ভয়ানক রকম সংক্রামকও বটে। বেমক্কা কারো হাসি চলে আসলে সেই হাসি চেপে রাখতে যে হ্যাপাটা পোহাতে হয় সেটা আশা করি অনেকেরই জানা আছে। উচ মাধ্যমিক পরীক্ষার একদিন আমাদের হলে টহল দিচ্ছিলেন একজন বুড়োমত শিক্ষক। যে কোন কারণেই হোক, তিনি আমাদের রেজিস্ট্রেশন কার্ডটি বারবার খতিয়ে দেখছিলেন। তাই স্বাক্ষর করতেও বেশ বিলম্ব হচ্ছিল তার। একসময় আমাদের এক ফচকে বন্ধুর কার্ডটি চেক করার সময় তিনি একবার ছবির দিকে, ফের বন্ধুটির দিকে চাইছিলেন। বোধকরি, ছবির সাথে বাস্তবের খোমার গরমিল দেখে তিনি বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ বলা নেই,কওয়া নেই ,বন্ধুপ্রবর বিকট স্বরে হল কাঁপিয়ে হেসে উঠল। আমরা তখন লেখাটেখা ছেড়ে কান্ড দেখছি। এদিকে, শিক্ষক মশাই পুরোপুরি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। পরে বন্ধুটি বলেছিল,হঠাৎ করেই নাকি তার এমন বেমক্কা হাসি পেয়ে যায়।


মজার ব্যাপারটা হল, এই হাসিটা কিন্তু বলে কয়ে আসেনা।এটা একটা খুবই প্রচলিত ধারণা, খুব মজার কিছু হলেই মানুষ হাসে। কিন্তু আদপে আমরা [ ঘটনাগুলো থেকেই হাসির রসদ খুঁজে নিই। খুব সাধারণ কথাবার্তাতেই মানুষ হেসে থাকে সবচেয়ে বেশি। মানুষ কথা বলার আগে থেকেই তার মুখে হাসি ফুটেছিল, সেটা গবেষণাতেই বের হয়ে এসেছে। তাই হাসি একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত একটা ব্যাপার, একারণে এর রসায়ন নিয়ে খানাতল্লাশি করতেও জেরবার হতে হয়(বাংলা ছিনেমার মুহাহা মার্কা হাসি বাদ দিলে, একমাত্র ডিপজল এ হাসি স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিতে পারে)। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, ব্যাপারটা আমাদের মেজাজের ওপর হাসির রকমসকম বেশ কিছুটা নির্ভর করে। একারণে দম ফাটানো কোন কৌতুকও বরাত মন্দ থাকলে অবস্থাভেদে মাঠে মারা যায়। আপনি হয়তো একটি জোকস বলে আসর মাত করে ফেলেন, অথচ অন্যদিকে অন্য জায়গায় আপনার জোকসটি হয়ে গেল বিলকুল ফ্লপ। আমাদের এক বন্ধু ছিল, প্রায়ই আমাদের বিভিন্ন কৌতুক বলে হাসানোর কোশেশ করত। আদি রসাত্মক থেকে শুরু করে সবধরনের কৌতুকই তার স্টকে দেদার ছিল। কিন্তু কদিন পরেই ব্যাপারটা বিষম রুপ নিল। একই বাঁধাগতের কৌতুক বলে আর কত লোক হাসানো যায় ? শেষমেষ যেই সে এসে বলত, দোস্ত ,আজকে একটা ব্যাপক জোক্স আছে। কথাটা নিষ্ঠুর শুনাবে, তবে আমরা তখন তাকে বেরসিকের মত থামিয়ে দিয়ে বললাম, আগে বল,কোন জায়গায় হাসতে হবে। কদিন পরেই বন্ধুটি লোক হাসানোর প্রজেক্টে ইস্তফা দিল।

তবে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, উইটি ব্যক্তিরা তাদের উইট নিয়ে খুবই সজাগ থাকেন। যেখানে সেখানে তো নয়ই, বরং বেশ বাছবিচার করে তারা এই উইটের ভাঁড়ার থেকে রয়েসয়েই খরচ করেন। এক্ষেত্রে পরিমিতিবোধের ব্যাপারটাও খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে। কখন থামতে হবে সেটা না জানলে ,শেষমেষ হিউমারের বারোটা বেজে যেতে বাধ্য। সরল বাংলায় আমরা এটাকে বলে থাকি ছ্যাবলামি। তবে সোনায় সোহাগা হয়ে উইটের সাথে যদি আরেক ডব্লিউ,উইসডম যোগ হয়। পাণ্ডিত্যরস তখন সেই রসবোধকে দান করে স্নিগ্ধ আমেজ। সৈয়দ মুজতবা আলী,তপন রায় চৌধুরী নাম এক্ষণে না নিলে তাই গোস্তাকি হবে। তবে কথাটা একটু মোটা দাগের হয়ে যাবে, তারপরও বলি, সব বড় লেখকই কমবেশি রসবোধ নিয়ে জন্মান। কারো লেখায় সেটা প্রকটভাবে ফুটে ওঠে,কারো লেখায় সেটার প্রচ্ছন্ন আভাস পাওয়া যায়, আর কেউ হয়তো সচেতনভাবেই সেটাকে আড়াল করে রাখেন।

তবে কেলোটা বাধে ভীষণভাবে যখন কেউ জোকার খেতাব পেয়ে বসে। সে বেচারা তখন যাই বলে, বা যাই করে,মানুষ অবলীলায় হেসে গড়িয়ে পড়ে। কোন বিশেষ কসরত ব্যতিরেকেই সে হাসিয়ে আসর মাত করে দিতে পারে। এই ক্ষমতাটা যে স্রষ্টাপ্রদত্ত,সে কথাও অস্বীকার করার জো নেই। তার দু;খেও মানুষ তখন হাসে,সুখে তো বটেই। মুশকিল হল, এই তকমা একবার গায়ে এঁটে গেলে সেটাকে খসানোতেও কম বেগ পেতে হয়না। একেবারে আনকোরা লোকজনও যদি নির্বিবাদে তার সাথে ঠাট্টা তামাশা করে, তবে কারই বা ভাল লাগে বলুন?

শুনেছি,রবিবাবু বলে গিয়েছেন, হাস্যরসের পূর্বশর্ত কাউকে না কাউকে একটু ছোট হওয়া। হাসি ঠাট্টার ক্ষেত্রে তাই ভিকটিম থাকতেই হবে।আমাদের বন্ধুমহলে প্রায়ই টিটকারী,ব্যাঙ্গ,বিদ্রুপ আকছার চলে,কিন্তু বেশির ক্ষেত্রে এর শিকার হয় আমাদের সবচেয়ে গোবেচারা বন্ধুটি। সমস্যাটা হল ,মাঝে মাঝেই সম্মিলিত তোপের মুখে পড়ে তাকে একটু বেশি রকম নাকাল হতে হয়। আদতে, কারো আছাড় খাওয়ার ঘ্টনা কিন্তু খুব একটা সুখপ্রদ ব্যাপার নয়। কিন্তু এরকম উটকো আছাড় খেতে দেখলে আমরা প্রায়শই হেসে ফেলি, সেটাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চস্বরে। আবার আছাড়ের থেকে ব্যাপারটা যদি গুরুতর পর্যায়ে চলে যায়, তবে সেখানে ঠাট্টা তামাশা আর চলেনা, তখন কেউ হাসলে তাকে আমরা বিকারগ্রস্তই গণ্য করি। তাই হাসানোর ব্যাপারে যেমন সংযম আবশ্যক, ঠিক তেমনি কখন হাসি থামাতে হবে সেটা বুঝার মত মুরোদও থাকতে হবে বৈকি।

Saturday, August 14, 2010

৩৫ বছর আগের একদিন

১.

এই শুক্রবারটা গড়পড়তা অন্য দিনের মত ছিলনা,সেদিন ঢাকার এক নিভৃত কানাগলিতে কোন অনাহুত আগন্তুককে দেখে নেড়িকুত্তারা সশব্দে ঘেউ ঘেউ করে ওঠেনি, হকারের উচ্চকিত কোরাসে ঐ গলি প্রকম্পিত হয়ে ওঠেনি, সামনের রাজপথের রিকশাগুলো বেপথু হয়ে একটা দুটো কানাগলির সামনে এসে গোত্তা খায়নি, তবে মির্জা আসলাম ঠিকই গোসল সেরে ফুরফুরে মেজাজে বেরিয়েছিলেন। সুপুরুষ এই তরুণের প্রিয় পোশাক পাঞ্জাবি,বনেদী কাঠের আলমারি খুলে তার সদ্য খলিফাপাড়া থেকে সেলাই করা সফেদ পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে দেন। স্বভাববিপরীত ব্রীড়া ঝেড়ে ফেলে আয়নায় নিজেকে দেখার লোভটাও সামলাতে পারলেননা, গর্বোদ্ধত ভঙ্গিমায় নিজেকে দেখলেন,নাহ! পাঞ্জাবিতে আসলেই তাকে দারুণ মানায়। মাথাটা আঁচড়িয়ে যেই টুপিটা হাতে নিলেন, আচমকা একটি অযাচিত খবর তাকে বাকরুদ্ধ করে দিল। শোকস্তব্ধ আসলাম ধীরে ধীরে পাঞ্জাবিটা খুলে ফেলেন, তারপর যন্ত্রচালিতের মত আলগোছে রেখে দেন বিছানার পাশে। সেই নতুন বানানো পাঞ্জাবি তিনি আর ভুলেও ধরে দেখেননি।

২.

গড়পড়তা মানুষের তুলনায় আসলাম সাহেবের উচ্চতা কিছুটা বেশিই । এই প্রৌঢ বয়সেও এই গৌরবর্ণের মানুষটিকে ব্যক্তিত্ত্বের ছটার জন্যে আলাদাভাবে ঠিকই নজর কেড়ে নেন তিনি। সরকারি চাকুরির প্রলম্বিত জীবন শেষে এই কিছুদিন হল তিনি অবসরে গিয়েছেন। চাকুরীর পাট চুকানো হয়ে গিয়েছে, ছেলেমেয়েরাও এখন বেশ লায়েক, পড়াশওনা শেষে তারা টাকাও কামাচ্ছে মন্দ না। ছোট ছেলেটাতো মাত্র কিছুদিন আগেই নতুন চাকুরীতে যোগ দিল। এর মধ্যে পয়লা মাইনের অর্থে সে সবার জন্য উপহারও কিনে ফেলেছে এন্তার। এমনিতে আসলাম সাহেব মানুষটা একটু সৌখিন গোছের। কর্মজীবনেও তিনি ধোপদুরস্ত থাকতে পছন্দ করতেন। চেহারার জৌলুসের কারণে তাকে সব পোশাকেই কমবেশি মানিয়ে যেত। এখন তার বয়স গড়িয়েছে, তবে এটুকু শখ আহ্লাদ এখনো পুরোপুরি বিসর্জন দেননি তিনি। ছেলেদের কাছ থেকে মর্জিমত উপহার পেলে এখনো তিনি বেজায় খুশি হন। এদিকে তার গিন্নি আবার বুড়ো বয়সে সাজপোশাকের এই খোকাটে বাইয়ের জন্য ঠাট্টা করতে ছাড়েননা। তিনি অবশ্য এসবের থোড়াই কেয়ার করেন,কাপর চোপড়ে টিপটপ থাকার চেষ্টা করেন, মায় তাঁর আটপৌরে লুঙ্গি দেখলেও সদ্য পাটভাঙ্গা বলে ভ্রম হতে পারে। আশেপাশের মানুষজনও তাঁর এই বাতিকগ্রস্ততা সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানে।

শুক্রবার। আসলাম সাহেব সময় থাকতে গোসলটা সেরে নিলেন, খানিক বাদেই জুমার নামাজের জন্য মসজিদে যেতে হবে। এসব কাজে তিনি তাড়াহুড়ো একদমই পছন্দ করেননা। তাছাড়া এই বয়সে আগের মত চটপটে হয়ে থাকাটাও হ্যাপার ব্যাপার। তাই সবকিছুর জন্য একটু আলাদা সময় এখন বরাদ্দ রাখতেই হয়। ড্র্রয়ার থেকে সদ্য ধোয়া লুঙ্গি আর ইস্ত্রি করা সাদা হাফশার্টটা গায়ে জড়িয়ে নিলেন।

এমন সময় তাঁর ছোট মেয়ে অনুযোগের সুরে জানতে চাইল,"বাবা, আবার এই সাদা শার্ট কেন? ভাইয়া কালকে যে পাঞ্জাবিটা এনেছে সেটা একদিন পড়লে কীইবা এমন হয় ? "

আসলাম সাহেব মৃদু হাসলেন,"মা,তুই কী জানিস না, আমি শুক্রবার দিন কখনো পাঞ্জাবি পরিনা।"

সত্যিই তো, একে একে পয়ত্রিশটি বছর কেটে গেল,এর মধ্যে তিনি একবারের জন্যও কোন শুক্রবারেই পাঞ্জাবি গায়ে চড়াননি। ৩৫ বছর আগের মধ্যআগস্টের সেই শুক্রবারের ফেরারী স্মৃতি তাঁকে এখনো তাড়া করে ফেরে, চোখ মুদলেই সেদিনকার সেই সফেদ পাঞ্জাবিতে তিনি লাল লাল ছোপ দেখতে পান...তার আর পাঞ্জাবি পরা হয়না....।

Tuesday, August 10, 2010

সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি

সেদিন ক্যাফেতে বসে বেশ ভাবের সাথে রাজা উজির পেটাচ্ছি,বাইরে তখন বৃষ্টিটাও বেশ জেঁকে ধরেছে,তার সাথে অবধারিতভাবে উড়ে যাচ্ছে কাপের পর কাপ চা,আর সিগ্রেট তো দেখতে না দেখতে ভস্ম হয়ে যাচ্ছিলই।মন মেজাজ বড়ই শরিফ ছিল আমাদের।এমন সময় বলা নেই কওয়া নেই কোত্থেকে দুম করে মফিজ এসে পড়ল।মুহুর্তেই আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় আমাদের মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেল।

জানতে চাইলাম,"কিরে,এমন ঝড়ো কাক হয়ে এলি যে?"

বেচারা তখন ভিজে জবজবে হয়ে পড়েছে।ভেজা কাপড় নিংড়াতে নিংড়াতে সে জবাব দিল," আর,বলিসনা,দৌড়োতে দৌড়োতে পেরেশান হয়ে গেলাম।"

মনে মনে ভাবলাম,এই সেরেছে,এখন শুরু হয়ে যাবে এফএম রেডিওর আরজেদের মত ননস্টপ বকবকানি। সবাই দেখলাম একেবারে ম্যাদা মেরে আছে,মফিজের কাহিনী শোনার ইচ্ছে কারো বিন্দুমাত্রও নেই।

কিন্তু মফিজ এসব ভ্রুক্ষেপ করার মত আদমীই নয়,সে ওদিকে বিশাল এক কাহিনী ফেঁদে বসার জন্য রীতিমত প্রস্তুতি নিচ্ছে।আমরা তখন ফাঁকেতালে
তাস পেটানো মুলতবি রেখেই সটকে পড়ার ফিকির
করছিলাম।কিন্তু,বিধিবাম,মফিজ অমনি আমাদের ক্যাঁক করে চেপে ধরল।
"আরে,কোথায় যাস,দাঁড়া ,একটু শুনে যা?" হতচ্ছাড়াটা এমন চিনেজোঁকের মত সেঁটে রয়েছে যে,শেষে পলায়ন পর্বে ইস্তফা দিতেই হল।
"আরে শোন,একটা ভালো খবর আছে।"উৎসাহে তার চোখ চিকচিক করছিল।

সবার মাথায় তখন একই চিন্তা,তোর আর ভাল খবর,গত তিনমাস এই "ভাল খবর " শুনতে শুনতেই তো কেটে গেল।তিন মাস আগে কিন্তু এই হ্যাপা আমাদের পোহাতে হয়নি।কিন্তু কোন কুক্ষণে যে মফিজের মাথায় কোবতে লেখার ভূত চেপে বসেছিল কে জানে।একদিন নাকি শীতের সকালে ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশিরবিন্দু দেখে হঠাৎ তার মনে হল,সে একজন কবি।এসব কেচ্ছা সে যখন আমাদের সবিস্তারে শোনাচ্ছিল তখন আমরা দস্তুরমত ঘাবড়ে গেলাম।এমনিতেই সে একটু ক্ষ্যাপাটে কিসিমের বান্দা,এত বড় নাম সবার ডাকতে অসুবিধে,এই অজুহাতে সে নিজের পিতৃপ্রদত্ত নাম মোস্তাফিজকে অবলীলায় ছেঁটে মফিজ বানাতেও কিচুমাত্র কসুর করেনি।আমাকে তখন বাধ্য হয়েই বলতে হল,"দেখ,তুই কারো কাছ থেকে ছ্যাঁকাও খাসনি,পরীক্ষায়ও গোল্লা মারিসনি,বা অন্য কিছুও হয়নি যে তোকে কবিতা লিখতে হবে।সবচেয়ে বড় কথা হল সবাইকে দিয়ে তো আর সবকিছু হয়না,আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নিয়ে লাভ কি?।"

এবার মফিজের উৎসাহে খানিকটা ভাটা পড়ল বোধহয়।ক্ষুণ্ণচিত্তে সে বলল,"তোরা আমার কবিতা না শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি ?প্রতিভা তো কেবল বের হওয়ার জন্য আকুলি বিকুলি করে,কেবল সুযোগের অভাবে পারেনা।বলতে পারিস,ঐ মুহুর্তে সেই দৃশ্য না দেখলে হয়ত আমি বুঝতেই পারতাম না আমার মাঝে এই প্রতিভা আছে।"

এহেন আবেগমথিত দার্শনিক কথন শুনে আমাদের মন খানিকটা দ্রবীভূত হল বৈকি।বললাম,"আচ্ছা,শোনা দেখি তোর কবিতা?"মানুষ না জেনে খাল কেটে কুমীর আনে,আর আমরা একেবারে হাঙ্গর নিয়ে আসলাম।


ওদিকে মফিজ তখন গলা খাকারি দিয়ে কবিতা শুরু করে দিয়েছে,

সেদিন দুজনে
গিয়েছিলাম বনের ধারে ,
কিন্তু সেখানে কোন বন ছিলনা,
সেখানে ছিল কেবল একখন্ড মরুভুমি,
সেই মরুভূমির শেষ প্রান্তে,
আমরা দিগন্ত দেখতে গিয়েছিলাম ,
কিন্তু আমরা দেখতে পাইনি কোন দিগন্ত,
কারণ আমরা দুজনেই ছিলাম অন্ধ।

এটুকু বলে মফিজ একটু দম ফেলল।আর আমরা ! কি আর বলব,আমরা যাকে বলে একেবারে বাকরুদ্ধ !।বলাই বাহুল্য,আনন্দে অবশ্যই নয়।খুব একটা উপাদেয় কিছু আমরা তার কাছ থেকে আশা করিনি অবশ্যই,তাই বলে এতটা ! ওদিকে মফিজ তখন রীতিমত আশা নিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে আছে।আমরা তখন একজন আরেকজনের দিকে বোবা চাউনি মেলে তাকিয়ে আছি।ভাবখানা এমন,কিরে কি বুঝলি ? ওদিকে মফিজ বল,"এবার বল,কবিতা কেমন হয়েছে?"।আমি সাবধানে বললাম,"দোস্ত,কিছুই তো বুঝলাম না।"ও দেখি ততোধিক উৎসাহে বলে চলেছে,"আসলে ব্যাপার হল,আমি ব্যাপারটার মধ্যে খানিকটা পরাবাস্তব গন্ধ আনতে চেয়েছি।আর শেষের অসাধারণ চমকটা বলতে পারিস,অনেকটা নাটকীয়ভাবে আমার মাথায় চলে এসেছে।ব্যাপারটা তাহলে একটু খুলেই বলি............"

আমি তাড়াতাড়ি বললাম," ও আচ্ছা,আচ্ছা।এবার বুঝলাম।তা তুই এবার কি করবি?"।মফিজ তখন আনন্দে সপ্তম স্বর্গে,"ভাল কথা মনে করেছিস,এই কবিতাটা যে কোন সাহিত্য পত্রিকা লুফে নেবে,কি বলিস?"
আমরা আর কিছু বললামনা।কে আর পাগলকে সাঁকো নাড়তে নিষেধ করবে?

পরের তিন মাস এমনি অসংখ্য কবিতার অত্যাচারে আমরা একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়লাম।তার সর্বশেষ "ভাল"খবর হল,সে নাকি এখন লিটল ম্যাগাজিন বের করবে।আমরাও রীতিমত ভয়ে ভয়ে আছি,কবিতার
ভূত ব্যাটার মাথা থেকে কবে নামবে কে জানে। ততদিন পর্যন্ত গা ঢাকা দিয়ে থাকাই সই।

একটি সচিত্র ফুটবল কাহিনী

সেশনাল,ক্লাস টেস্ট,অ্যাসাইনমেন্টের খপ্পরে প্রাণটা একেবারে ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছিল।নানান ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি পেতে যখন আমরা ফিকির করছিলাম তখনই একদিন ঘোষণা এল,মেকানিক্যাল ডে উপলক্ষে ইন্টার ব্যাচ ডিপার্টমেন্টাল ফুটবলের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের মত পাঁড় ফুটবলভক্ত ও ফুটবলারদের জন্য এ যে ছিল মেঘ না চাইতেই জল ।তারপর কয়েকদিন মাঠে গিয়ে হাড়ভাংগা প্র্যাকটিস এবং ম্যাদামারা শরীরগুলোকে সচল করার দুরুহ অপপ্রয়াস।অবশেষে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শুরু হল টুর্নামেন্ট।প্রথম ম্যাচই ০৫ ব্যাচের সাথে।একেবারে যাকে বলে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই হওয়ার পর আমরা (০৬ ব্যাচ) ২-১ গোলে জিতে ফাইনালে উঠে গেলাম।

অবশেষে এল ধীরে ধীরে ফাইনালের মাহেন্দ্রক্ষণ এগিয়ে এল।খেলা শুরুর আগ থেকেই উত্তেজনায় আমাদের বুক ঢিপঢিপ করছিল।শিরোপা জিততে পারবতো?প্রতিপক্ষ (০৭ ব্যাচ)কে হেলাফেলা করার কোনো সুযোগ ছিলনা।কিন্তু কাগজে কলমে আমরাই ছিলাম এগিয়ে।যাই হোক,রেফারির হুইসেলে খেলা শুরু হল।



ওরা ১৫ জন :)



আমরা দ্রুত যে যার পজিশন নিয়ে ফেললাম।প্রথম দিকে অবশ্য খানিকটা এলোমেলো খেলাই হচ্ছিল।সময় গড়ানোর সাথে ধীরে ধীরে দুই দলই আক্রমন পালটা আক্রমণ চালাতে থাকে ।তবে আমাদের উইঙ্গার সৌরভ আর প্লেমেকার শাহীনের দুর্দান্ত বোঝাপড়ায় ওরা জেরবার হয়ে পড়ছিল ।এরই ফাঁকে আমিও বারকয়েক রাইট ব্যাক থেকে ওভারল্যাপ করে এগিয়ে যাই।কিন্তু মুহুর্মুহু আক্রমণ সত্ত্বেও প্রথমার্ধ গোলশুন্যভাবে শেষ হয়।



বিরতিতে আমাদের দুর্ধর্ষ টিম মিটিং :P



আমাদের আদি ও অকৃত্রিম সাপোর্টারেরা
B-)


দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ওদের আমরা একেবারে জেঁকে ধরি।এমন সময় সৌরভ হঠাৎ বল নিয়ে দু জনকে কাটিয়ে ঢুকে পড়ে ডিবক্সে।কিন্তু তৃতীয়জনকে কাটানোর সময় হঠাৎই সে পপাৎধরণীতল।





তারপর রেফারিকে ঘিরে আমাদের আবেদন




এবং পেনাল্টি স্পটের দিকে রেফারিরি অঙ্গুলিহেলন ,অতঃপর গোওওওওওওওওওওওওওল :):)




এরপর বাকি ম্যাচ রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার মাঝে কোনোমতে পার করে দেওয়া।অবশেষে সেই কাংখিত জয় :D:D




ইতো-অঁরির স্টাইলে আমাদের বিজয়োল্লাস B-)




পাদটিকাঃ দুর্দান্ত স্ন্যাপশটের জন্য বন্ধু নিলয় ও আশিককে ধন্যবাদ।

ঢাকার প্রেম

  ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি , অসিত আর হিতাংশু ; ঢাকায় পুরানা পল্টনে , উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা , সেই পুরানা পল্টন , সেই ...